হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলতেন, ‘আমার মধ্যে দ্বীনের মহববত আমার ইবতেদায়ী উস্তায হযরত মাওলানা ফাতেহ মুহাম্মাদ ছাহেব রাহ.-এর নেক সোহবতের বরকতে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অত্যন্ত মুবারক ও নেক ব্যক্তিত্ব, কামেল ওলী ও উচ্চস্তরের বুযুর্গ ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, এই ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই হযরত রাহ. মাত্র বার/তের বসর বয়স থেকেই শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন এবং ওজীফা আদায় করতেন। হযরতের চাচীআম্মা তাঁর এত ছোট বয়সে শীতকালে শেষ রাতে উঠে ওযু করতে ও নামায পড়তে দেখে খুব বিচলিত হতেন এবং কোনো কোনো সময় বারণও করতেন এবং বলতেন, বাবা! এখন তোমার বয়সই বা কত, বড় হয়ে এ সব আমল করো। কিন্তু হযরত রাহ. আমলে লেগে থাকতেন। অগত্যা চাচীআম্মাও স্নেহ বশত জেগে বসে থেকে হযরতকে পাহারা দিতেন।
শৈশবে হযরতের খেলাধুলার মধ্যেও দ্বীনী বিষয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ প্রকাশ পেতো। যেমন কোনে কোনো সময় সকল সাথীর জুতা একত্র করে সেগুলো দিয়ে কাতার বানাতেন এবং একটি জুতা সকল কাতারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন এবং এ দৃশ্য দেখে নিজেই আনন্দ বোধ করতেন যে, জুতাগুলোও জামাতে নামায পড়ছে।
এছাড়া শৈশব থেকে বয়ান করার ও খুতবা প্রদানের প্রতি আগ্রহ ছিলো। যখন ছোট-খাটো কোন জিনিস কেনার জন্য তাঁকে বাজারে পাঠানো হতো, তখন রাস্তার পাশের কোনো খালী মসজিদ দেখলে তাতে প্রবেশ করে সোজা মেম্বারে গিয়ে তাতে দাঁড়িয়ে খুতবার মতো করে কিছু পড়ে চলে আসতেন। সে সময় নামাযের ওয়াক্ত না হওয়ায় কেউ দেখতেও পেতো না। তিনিও লজ্জা অনুভব করতেন না, বরং নির্ভিকচিত্তে খুব স্বাধীনভাবে খুতবা ও বয়ানের সখ পূর্ণ করতেন। মোটকথা দ্বীনী বিষয়ের প্রতি বাল্যকাল থেকেই হযরতের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল।
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. বলতেন, ‘বাল্যকাল থেকেই আমার মন-মস্তিষ্ক একটি বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়ে গড়ে উঠেছে। যার দরুণ সাধারণ থেকে সাধারণ বিষয়ও যদি সাজিয়ে গুছিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বয়ান করা না হয় তাহলে তা আমার উপলব্ধিতে আসে না। নিজেও কোনো কিছু অগোছালো ও বিশৃঙ্খলভাবে বয়ান করতে পারি না।
আমার প্রথম স্ত্রী এদিকে ইঙ্গিত করেই বলত, ‘আপনি কোনো রাজার ঘরে জন্ম নিলে বেশ হতো।’
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর কাছে আত্মশুদ্ধিপ্রার্থীদের প্রচুর চিঠি-পত্র আসতো। তিনি প্রায় প্রতিদিনের চিঠির উত্তর ঐ দিনই লিখে শেষ করতেন। এজন্য অনেক সময় রাতে দীর্ঘক্ষণ জাগ্রত থেকে উত্তর লিখতে হতো। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলতেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আগত চিঠি-পত্রের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের উত্তর লিখতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ঘুমাতে চাইলেও ঘুমাতে পারি না।’
সফরের দরুণ অনেক সময় কয়েকদিনের চিঠি-পত্র জমা হয়ে যেত, তখন প্রায় দিনই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করতেন। কোনো কোনো দিন ইশার নামাযের পর হতে ফজরের নামাযের আযান পর্যন্তও চিঠির উত্তর লেখায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু একদিনের কাজ পরের দিনের জন্য রেখে দিতেন না।
হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. তাঁর শৈশবে দেখা একটি স্বপ্নের কথা এভাবে বর্ণনা করেন, আমরা মিরাঠ শহরে যে বাড়িতে থাকতাম, স্বপ্নে দেখলাম সেই দুই কামরাবিশিষ্ট বাড়ির বড় কামরায় একটি খাঁচা, তাতে সুন্দর এক জোড়া কবুতর। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল তখন কবুতর দুটি আমাকে বলল, অন্ধকার হয়ে গেল আপনি আমাদের খাঁচা আলোকিত করে দিন। আমি বললাম, তোমরা নিজেরাই আলোর ব্যবস্থা করে নাও। আমার কথা শুনে তারা খাঁচার সাথে নিজেদের ঠোট ঘষলো এবং ঘষা মাত্রই তাতে প্রচুর আলো বের হল এবং পুরো খাঁচা আলোকিত হয়ে গেল।
অনেকদিন পর হযরত রাহ. যখন স্বীয় মামা (বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব) হযরত মরহুম ওয়াজেদ আলী ছাহেবের নিকট নিজ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করলেন তখন তিনি স্বপ্নের এ তা’বীর করলেন যে, কবুতররূপে তোমাকে তোমার রূহ এবং তোমার নফসকে দেখানো হয়েছে। কারণ সূফীয়ায়ে কেরাম তাসাওউফের পরিভাষায় রূহকে নর, আর নফসকে নারী আখ্যায়িত করে থাকেন। মূলত এ স্বপ্নে রূহ ও নফস তোমার নিকট আবেদন করল যে, আপনি মুজাহাদা (সাধনা) করে আমাদেরকে আলোকিত করুন। আর তাদের আবেদনের উত্তরে তুমি বললে, তোমরা নিজেরাই আলো অর্জন করে নাও। অতপর তারা নিজেরা নিজেদের ঠোট ঘষে আলো অর্জন করল। এর ব্যাখ্যা এই যে, তুমি আধ্যাত্মিক সাধনায় রিয়াযত ও মুজাহাদা তেমন করবে না, ইনশাআল্লাহ উল্লেখযোগ্য বিশেষ রিয়াযত ও মুজাহাদা (চেষ্টা ও সাধনা) ব্যতীতই আল্লাহ পাক তোমার রূহ ও নফসকে মারেফাতের নূর দ্বারা নূরানী করে দিবেন।
পরবর্তীতে হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. বলতেন, স্বপ্নের এই তা’বীরের এক অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, অর্থাৎ আমার দ্বারা রিয়াযত মুজাহাদা তেমন কিছুই হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ নূর এখনো সৃষ্টি হয়নি। আল্লাহ পাকের কাছে দু’আ করি তিনি যেন অন্তরে নূর সৃষ্টি করে দ্বিতীয় অংশও বাস্তবায়িত করে দেন।
হযরত মাওলানা শায়েখ মুহাম্মাদ মুহাদ্দিস থানভী রাহ. ছিলেন হযরত মিয়াজী নূর মুহাম্মাদ রাহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ও হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ.-এর পীর ভাই। হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. যখন মাত্র মক্তবে পড়তে আরম্ভ করলেন তখনই তিনি বলতেন, আমার পরে এই ছেলেই হবে আমার স্থলাভিষিক্ত। পরবর্তীকালে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে একথা বাস্তবায়িত হয়েছিল। কেননা তাঁর ওফাতের পর হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-ই ওই শহরে জাহেরী ও বাতেনী উলূমের ধারক-বাহক হয়েছিলেন। হযরতের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিলো। এমনকি একবার থানবী রাহ. স্বপ্নে দেখলেন, তিনি বলছেন, তোমার প্রতি আমার সুদৃষ্টি এখনো তেমনই আছে যেমনটি আমার জীবদ্দশায় ছিল।
হযরত মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী রাহ. একবার নিজের এক ঘনিষ্ঠ খাদেমের নিকট বলেছিলেন, ‘তার (হযরত থানভী রাহ.-এর) সঙ্গে আমার ঐ সময় থেকেই মহববত রয়েছে যখন তিনি আমাকে চিনতেনও না।’’
মোটকথা, হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. শৈশব থেকেই বুযুর্গানে দ্বীনের নেক-নজর ও মহববত লাভ করেছিলেন।ষ
(সূত্র: আশরাফ চরিত ৫০-৫২ পৃষ্ঠা)
জুমাদাল উখরা ১৪৩৫ – এপ্রিল ২০১৪
মাসিক আল কাউসার