বড়দের মুখে বড়দের বেড়ে ওঠার কাহিনী – মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান খান (৪র্থ পর্ব)

কয়েকটি স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, একজন বুযুর্গ ব্যক্তি ও অপর একজন শাসক ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন দুটি লিখিত (পরোয়ানা) দিলেন। উভয় কাগজে একই কথা লেখা ছিল যে, ‘আমি তোমাকে সম্মান দান করলাম’। একটি কাগজের চারদিকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পবিত্র নামের সীলমোহর যুক্ত ছিল এবং পরিষ্কার পড়া যাচ্ছিল। কিন্তু অপর কাগজের সীলমোহরের লেখা অস্পষ্ট থাকায় তা পড়া যাচ্ছিল না। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় হযরত থানভী রাহ.-এর সম্মানিত উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ. বললেন, তুমি ইনশাআল্লাহ ধর্মীয় এবং পার্থিব উভয় সম্মানই লাভ করবে।

আরেকবার তিনি স্বপ্নে দেখলেন, একটি পুকুর, তাতে ফোয়ারার পানির মতো রূপা উথলিয়ে উঠছে এবং তা হযরত থানভী রাহ.-এর পিছনে পিছনে চলছে। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় হযরতের প্রিয় উস্তায হযতর মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রাহ. বললেন, ইনশাআল্লাহ দুনিয়া ও দুনিয়ার সম্পদ তোমার পিছনে পিছনে ঘুরবে, কিন্তু তুমি তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। (আশরাফুস সাওয়ানেহ, খন্ড ১ পৃষ্ঠা ২৯)

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমি যেরূপ নির্দোষ অবস্থায় (দারুল উলূম দেওবন্দে, ইলম তলব করার জন্য) গিয়েছিলাম, পাঁচ বছর পর (পড়া-শোনা শেষ করে) সেরূপ নির্দোষ অবস্থায়ই ফিরে এসেছি। পড়া-শোনা শেষ করে ফারেগ হয়ে স্বাধীনভাবে নিজের সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎও করেছি। তাদের বাড়ীতে দাওয়াতও খেয়েছি। ফারেগ হওয়ার আগে কারো সাথে দেখা-সাক্ষাৎও করিনি, সম্পর্ক স্থাপনও করিনি। আত্মীয়-স্বজনের সাথেও নয়। ছাত্র ভাইদের সাথেও নয়। স্থানীয় লোকজনের সাথেও নয়। যদি কেউ আমার সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চাইত, তাহলে আমি তার সাথে উল্টো আচরণ করতাম। ফলে অধিকাংশ লোক (আমাকে) দেমাগী (অহংকারী) মনে করত। আসলে এগুলো কিছুই ছিল না। আসল কথা হল, আমার সময় অহেতুক নষ্ট করতে (মারাত্মক) ঘৃণা বোধ হয়। হযরত থানভী রাহ.-এর এটা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি কোনোভাবেই নিজের সময় নষ্ট করতেন না। এটাই ঐ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা তাঁর জীবনের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত সমুজ্জ্বল ছিল এবং এটাই তাঁর এত দ্রুত ফারেগুত তাহসীল (প্রাতিষ্ঠানিক পড়া-লেখা শেষ করা) হওয়ার অন্যতম কারণ। এর ফলেই হযরত থানভী রাহ. সব ধরনের খারাপ সঙ্গ থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন এবং এত অধিক সংখ্যক কিতাব রচনা করতে পেরেছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের খুব অল্প সংখ্যক লোকের এ সৌভাগ্য হয়েছে। হযরত থানভী রাহ.-এর সময়ানুবর্তিতা বিস্ময়কর ছিল। দেখলে মনে হতো যেন একটি মেশিন, যা সর্বদা চলছে।

হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. ছাত্রাবস্থায় কারো সাথে সাধারণত দেখা-সাক্ষাৎ করতেন না। সব সময় পড়া-শোনায় ব্যস্ত থাকতেন। যদি ফুরসত পেতেন তাহলে স্বীয় উস্তায ও মুরুববী হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ.-এর খেদমতে গিয়ে বসতেন।

একদিনের ঘটনা, হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব ছাহেব রাহ. কোথাও কোনো কাজে গিয়েছিলেন। মাদরাসায় ছিলেন না। হযরত থানভী রাহ. অবসর ছিলেন তাই তিনি এ সময়টা অহেতুক নষ্ট না করে তাঁর অপর উস্তায হযরত মাওলানা সাইয়েদ আহমাদ ছাহেব রাহ.-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন। উস্তাদজী জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে করে কীভাবে আসলে? হযরত থানভী রাহ. বিনয়ের সঙ্গে অকৃত্তিমভাবে উত্তরে আসল কথাই নিবেদন করলেন, ‘আজ যেহেতু হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ. উপস্থিত নেই। তাই আপনার খেদমতেই এসেছি।’ হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর অনেক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনও দেওবন্দে ছিলেন। তাদের সাথেও তিনি তেমন দেখা সাক্ষাৎ করতেন না। প্রথম প্রথম যখন তিনি দেওবন্দ গিয়েছেন, তখন কোনো কোনো আত্মীয়-স্বজন খুব চাপাচাপি করতেন যে, মাদরাসার খাবার না খেয়ে আমাদের বাড়ীতে এসে বাড়ীর খাবার খেও। খামাখা মাদরাসার খাবার খেয়ে কষ্ট করার কী দরকার। হযরত থানভী রাহ. পিতার অনুমতি ব্যতীত নিজ থেকে এমনটি করা পছন্দ করতেন না। তাই তিনি এ সংবাদ চিঠির মাধ্যমে তার পিতাকে লিখে জানালেন। তখন তার পিতা ধমক দিয়ে ক্রোধ প্রকাশ করে চিঠির উত্তর দিলেন যে, তুমি ওখানে পড়তে গিয়েছ? নাকি আত্মীয়তা রক্ষা করতে গিয়েছ?

 

রজব ১৪৩৫ – মে-২০১৪

মাসিক আল কাউসার