হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলতেন, কোনো লোক যত বড় ধনী আর জমিদারই হোক না কেন, কেবলমাত্র তার ধনাঢ্যতা, জমিদারী ও বাহ্যিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় আমার উপর তার কোন আছর হয় না। কারণ, আমি মনে করি সে হয়তো অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক! আমিও তো আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে নিজের ঘরেরটাই খাই পরি, আমিও তো কোনো গরীব ঘরের সন্তান নই। আল্লাহপাকের শোকর যে তিনি সর্বদা আমাকে খুবই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছেন। সুতরাং ধন-সম্পদ সম্পর্কে এমন কোনো আফসোস নেই যে, কোন সম্পদশালী লোকের মুখাপেক্ষী হব। কারণ মানুষের অভ্যাসই হল কোনো জিনিষ ব্যবহার করে মন ভরে গেলে আর সে জিনিষের লোভ থাকে না। হযরত থানভী রাহ. যে অতুলনীয় আত্মমর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন তার এটাও একটি কারণ। অবশ্য আল্লাহপাকের সাথে গভীর সম্পর্কই এর মূল কারণ। তাছাড়া অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ যদি সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবারের হন, তাহলে উচ্চ শ্রেণীর লোকদের জন্যও তার অনুসরণ করা দ্বিধা ও লজ্জার কারণ হয় না। তদুপরি এমন ব্যক্তির উপর অন্য কোনো দুনিয়াদার ব্যক্তির বাহ্যিক প্রভাব-প্রতিপত্তির অযথা ক্রিয়াও হয় না। মোটকথা যেহেতু আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল, হযরত থানভী রাহ.-এর দ্বারা উম্মতের ইসলাহ ও হেদায়েতের মহা মর্যাদাপূর্ণ কাজ নেওয়া, তাই তাঁকে আকল-বুদ্ধির প্রাচুর্য, ইশকের মাধুর্য, বংশীয় আভিজাত্য ও খান্দানী স্বচ্ছলতা ইত্যাদি নেআমত ও বৈশিষ্ট্য দ্বারা সৌভাগ্যশালী করেছিলেন। (আশরাফুস সাওয়ানেহ, ১/১২-১৩)
তর্কশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যায় আগ্রহ ও ঘৃণা
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্! আমি কখনো স্বভাবকে বিবেকের উপর এবং বিবেককে শরী‘আতের উপর প্রবল হতে দেইনি।
তর্কশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শিতা সম্পর্কে হযরত থানভী রাহ. নিজে বলতেন, আমি এ সত্য কথা কেন বলবো না যে, আমার ইলমে মানতেকে পরদর্শিতা আছে। আমি যেহেতু (অতি) বিনয়ীও নই এবং অহংকারীও নই, তাই খোদা প্রদত্ব জিনিষকে আমি কেন অস্বীকার করবো।
উল্লেখ্য যে, হযরত থানভী রাহ. ছাত্রাবস্থায়ই উপস্থিত বুদ্ধি, বাকপটুতা, বাকচাতুর্য ও বিতর্কে অনন্য ছিলেন। ফলে যে কোনো ধর্মের যে কোনো লোক বিতর্কের উদ্দেশ্যে দেওবন্দ আসলে হযরত উপস্থিত হয়ে অল্পেই তাকে কুপোকাত করে দিতেন।
একবার এক ইংরেজ পাদ্রীর সাথেও বিতর্কের উদ্দেশ্যে পৌঁছে গেলেন। একথা যখন শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান রাহ. শুনলেন, তখন তিনি হযরত থানভী রাহ. সম্পর্কে চিন্তা করলেন, যে বাচ্চা মানুষ আবার ঘাবরে না যায়। তাই তিনি নিজেই হযরত থানভী রাহ.-এর সহযোগিতার জন্য পৌঁছে গেলেন। থানভী রাহ. মাত্র দু’মিনিটের মধ্যেই পাদ্রীর মুখ বন্ধ করে দিলেন। পাদ্রীর এ শোচনীয় অবস্থা দেখে তার মেম সাহেবা তাকে বাঁচানোর জন্য স্লীপ লিখে পাঠালো যে, তুমি শীঘ্র চলে আসো! (সে এটাকে সুযোগ মনে করে) মেম সাহেবা ডাকছেন বলে তখনই ওখান থেকে চলে আসলো এবং (সামান্য সময়ের মধ্যেই) দেওবন্দ ছেড়ে চলে গেল।
পরবর্তী জীবনে হযরত থানভী রাহ. বলতেন, পূর্বে তর্ক-বিতর্কের প্রতি আমার যতটা আগ্রহ ছিল, এখন এর বিভিন্ন অনিষ্টতা প্রত্যক্ষ করে ততটাই ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে।
-আশরাফুস সাওয়ানেহ, ১ম খন্ড ৩২-৩৩ পৃষ্ঠা
তোমাদের সামনে অন্যদের অস্তিত্বই থাকবে না
১৩০০ হিজরীতে যখন হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হন, সে সময় জানতে পারলেন যে, খুবই শান শওকতের সাথে আড়ম্বরপূর্ণ দস্তারবন্দি জলসার আয়োজন করা হচ্ছে। তখন তিনি স্বীয় সহপাঠীদেরকে সঙ্গে নিয়ে প্রিয় উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ.-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন, ‘হযরত! আমরা শুনেছি, আমাদের দস্তারবন্দি করা হবে এবং সনদ (সার্টিফিকেট) প্রদান করা হবে। অথচ আমরা এর একেবারেই উপযুক্ত নই। সুতরাং এ ব্যাপারটি স্থগিত রাখা হোক। তা না হলে মাদরাসার খুবই দুর্নাম হবে যে, এ ধরনের অযোগ্যদের সনদ প্রদান করা হয়েছে।’
এ কথা শুনে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ. আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, ‘তোমাদের এ ধারণা একেবারেই ভুল। এখানে (দেওবন্দে) যেহেতু তোমাদের উস্তাযগণ আছেন, তাই তাদের উপস্থিতিতে তোমাদের ব্যক্তিস্বত্বার মর্যাদা দৃষ্টিগোচর হয় না এবং এমনই হওয়া উচিত। তোমরা যখন এখান থেকে বাহিরে অন্যত্র যাবে, তখন তোমরা নিজেদের মর্যাদা অনুধাবন করতে পারবে। তোমরা (পৃথিবীর) যেখানেই যাবে, সেখানে শুধু নিজেদেরই দেখতে পাবে। অন্যদের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো।’
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রাহ.-এর উপরোক্ত মন্তব্য উল্লেখ করে হযরত থানভী রাহ. বলতেন, বাস্তবিকই হযরত উস্তাযের এ ভবিষ্যদ্বাণীর এত বরকত হয়েছে যে, আলহামদুলিল্লাহ! আমি যেখানেই থেকেছি, সেখানেই বড় বড় আলেমগণও আমাকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছেন। সাধারণ বিশেষ নির্বিশেষে সকলেই আমাকে অন্যদের তুলনায় প্রাধান্য দিয়েছেন।
-আশরাফুস সাওয়ানেহ, ১ম খন্ড ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা
শাবান-রমযান ১৪৩৫ – জুন-জুলাই ২০১৪
মাসিক আল কাউসার