গায়েবী সাহায্য
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. ফারেগ হওয়ার পর পরই কানপুরের ‘‘ফয়যে ‘আম’’ মাদরাসায় শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। শুরু হতেই তাঁকে উপরের জামাতের বড় বড় কিতাব পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম প্রথম তিনি এই ভেবে খুব ঘাবড়ে যেতেন যে, এ সকল উচ্চসত্মরের কিতাব কী করে পড়াবেন? তারপর তিনি আল্লাহ পাকের কাছে খুব দুআ করে পড়াতে বসতেন। আলহামদুলিল্লাহ! এ পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং কোনো কোনো সময় তিনি গায়েব থেকে এ ব্যাপারে সান্তনা ও উৎসাহ লাভ করতেন।
হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. নিজেই বলেন, ‘‘অধম হাদীসের দরস শুরু করলে একদা স্বপ্নে মুহতারাম উসত্মায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব ছাহেব রাহ.-কে দেখলাম। তখন আমি লক্ষ্য করলাম আমার কাছে ‘বুখারী শরীফ’ আর পড়ার জন্য ছাত্রদের একটি জামাত বসে আছে। আমার সামনে ‘বুখারী শরীফে’র একটি কপি রাখা আছে। আমি যা পড়াচ্ছি আমার উসত্মায তা ব্যাখ্যা করছেন।’’
আরেকবার স্বপ্নে দেখলাম যে, ‘‘কানপুর জামেউল উলূম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা জনাব আব্দুর রহমান খান ছাহেবের ছোট প্রেসের মতো একটি জায়গা। সেখানে একটি কূপের পাড়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁর একেবারে কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। এ স্বপ্ন দেখার পর হতেই আল্লাহপাক আমার অন্তরে কুরআনুল কারীমের তাফসীরের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন।’’
অবশ্য হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর শায়েখ হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ. পবিত্র মক্কায় অবস্থান কালেই হযরতের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাফসীর ও তাসাউফের সাথে আল্লাহ পাক তোমাকে মুনাসাবাত দান করবেন।
কানপুরের ভালবাসা
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বলতেন, ‘‘কানপুর যাওয়ার সময় যদিও আমার বয়স কম ছিল, আলহামদুলিল্লাহ! সেখানের লোকেরা প্রথম থেকেই আমাকে ভালবাসতো এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা করত। পরে বয়স বৃদ্ধিতে আর বেশী কিছু হয়নি। আমাদের পক্ষের-বিপক্ষের সকলের অন্তরেই আল্লাহপাক মহববত সৃষ্টি করে দেন। যারা অন্য মাযহাবের তারা ভক্তি না করলেও মহববত করতেন। আমার দৃষ্টিতে মহববতই বেশী মূল্যবান। কারণ মহববতের ক্ষেত্রে সম্পর্ক হয় স্বাভাবিক এবং সমতাপূর্ণ। পক্ষান্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে মনের উপর এক ধরনের বোঝা চেপে থাকে। অহেতুকই পেরেশান হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে লৌকিকতা করতে হয়। সব সময় ভয় থাকে কখন কোন কাজে যেন ভক্তি শেষ হয়ে যাবে। অথচ মহববতের ব্যাপার ভিন্ন। ভক্তি না থাকলেও মহববত থাকতে পারে।
হযরত থানভী রাহ. বলেন, কানপুরের লোকেরা আমার সঙ্গে এমনই ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধার আচরণ করত যে, তাদের ভালবাসায় আমি আমার বাড়ী-ঘর পর্যন্ত ভুলে যাচ্ছিলাম। ওখানে আমার মন যেভাবে বসত, বাড়ীতে সেভাবে বসত না।
কানপুরের ভালবাসার আধিক্যে আমি আমার আসবাব-পত্রে (থালা-বাটিতে) নিজের নামের পরিবর্তে ‘‘কানপুর’’ শব্দ খোদাই করিয়ে লিখিয়েছিলাম।
হযরত হাজ্বী ছাহেব রাহ.-এর ইশারা না পেলে আমি কোনো দিনই কানপুর ছেড়ে আসতাম না। সত্যি বলতে আমার প্রসিদ্ধি কানপুরবাসীর মাধ্যমেই হয়েছে। তা না হলে আমি এ মর্যাদার অধিকারী ছিলাম না এবং এখনো নই। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। (আশরাফ চরিত ৬৫, ৬৬ ও ৬৭ পৃষ্ঠা)
অদ্ভুত সাহসিকতা
কানপুর থাকাকালীন একবার কোনো কারণে মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। মিলাদে সবাই যখন কিয়াম করল (দাঁড়িয়ে গেল) তখনও হযরত হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বসেই থাকলেন। কারণ স্বীয় মুরুববীদেরকিয়াম করতে দেখেনি। পুরো মজলিসে কেবল হযরত থানভী রাহ.-ই বসে ছিলেন, অন্য সকলে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কিয়ামপন্থীই ছিলেন। ঐ মজলিসে হযরত থানভী রাহ.-এর একজন ছাত্রও ছিল। সে এ অবস্থা দেখে আরবীতে বলল, ‘এ সময় বসে থাকা সমীচীন নয়’। হযরত থানভী রহ. তার এ কথা মানলেন না, বরং বললেন, আল্লাহপাকের হুকুম অমান্য করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য বৈধ নয়।
এ কথা শোনার পর হযরত রাহ.-এর ঐ ছাত্রও বসে পড়ল। পরে জানা গেল যে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যারা কিয়াম করে না, তাদেরকে ঐ এলাকার লোকজন মারধরও করেছে। কারণ তারা এ ব্যাপারে মারাত্মক বাড়াবাড়ির শিকার ছিল। কিন্তু হযরত থানভী রাহ.-কে কারো কিছু বলারই সাহস হলো না। বরং সে এলাকার প্রভাবশালী লোকদের কেউ কেউ কিয়ামপন্থী হওয়া সত্ত্বেও বলেছেন, আমরা যদি জানতে পারতাম হযরত থানভী রাহ. কিয়াম করেননি, তাহলে আমরাও কিয়াম করতাম না।
(আশরাফুস সাওয়ানেহ, প্রথম খ-৪৪ পৃষ্ঠা)
মুহাররম ১৪৩৬ – নভেম্বর ২০১৪
মাসিক আল কাউসার