জানলে আমিই উপস্থিত হতাম
হাকীম আব্দুল মাজীদ খান ছাহেবের ঘটনা, তিনি এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও হযরত থানভী রাহ.-এর সাথে তার এমন গভীর সম্পর্ক হয়েছিল যে, হযরত থানভী রাহ. যখন স্বীয় পীর ও মুর্শিদ হযরত হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ ছাহেব মুহাজিরে মক্কী রাহ.-এর নির্দেশে স্থায়ীভাবে থানাভবন এসে বসবাস ও আগত লোকদের আত্মশুদ্ধির কাজ শুরু করলেন, তখন হাকীম ছাহেব থানাভবন এসে সাক্ষাতের ইচছা করলেন। দিল্লীতে বসবাসকারী থানাভবনের এক লোককে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, থানাভবনে হাজির হওয়ার জন্য কী কী নিয়ম পালন করতে হয়?
থানাভবনের সে লোকটি উত্তরে বলল, আপনার জন্য আর কী নিয়ম, আপনি তো তাঁর (হযরত থানভী রাহ.-এর) উস্তায! হাকীম ছাহেব বললেন, না ভাই! এটা উস্তায-শাগরিদের কথা নয়। উস্তায-শাগরিদের সস্পর্ক ভিন্ন। আর এই (আত্মশুদ্ধির) পথ ভিন্ন। আমি তো সেখানে (থানাভবন) ঐভাবেই যাব যেভাবে একজন ইসলাহপ্রত্যাশী যায়। কিন্তু হাকীম ছাহেব আর আসার সুযোগই পাননি। কারণ এর কিছুদিন পরই তার ইন্তিকাল হয়ে যায়।
হযরত থানভী রাহ. যখন হাকীম ছাহেবের ইন্তিকালের পর এ কথা শুনলেন, তখন খুব আফসোস করলেন এবং বললেন, ‘যদি আমি হাকীম ছাহেবের এ ঘটনা তাঁর ইন্তিকালের আগে জানতে পারতাম, তাহলে আমি নিজেই তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে নিবেদন করতাম যে, হযরত আপনার জন্য আমার কাছে আসার একটাই নিয়ম। আর তা এই যে, আমি নিজেই আপনার (খেদমতে) উপস্থিত হই।
কথাও শুনেন না, যেতেও দেন না
কানপুরে একজন অতি বৃদ্ধ একরোখা পাঠান ছিল। একসময় সে নিজেও অনেক সম্পদের মালিক ছিল। পরবর্তীতে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির অনুগত ও সহকারী হয়েছিল। কিন্তু ঠাট-বাট আগের মতোই ছিল। যখন তখন সবাইকে ধমকাতে থাকত। একবার সে আশুরার সময় এসে বলতে লাগল, এখানে (কানপুরে) শাহ সালামাতুল্লাহ ছাহেবের নিয়ম ছিল, আশুরার সময় ‘শাহাদাতনামা’ পাঠ করার। কাজেই আপনিও শাহাদাতনামা পাঠ করবেন। আপনি যদি না পড়েন তাহলে লোকেরা খারাপ মনে করবে। হযরত থানভী রাহ. বললেন, আশুরায় শাহাদাতনামা পাঠ করাটা শিয়াদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার কারণে নাজায়েয। একথা শুনে সে রাগ হয়ে বলল, আফসোস! আমরা তো কল্যাণ ও উপকারের কথা বলি, সেটাও মানতে অস্বীকৃতি! হযরত থানভী রাহ. এ কথা শুনে বললেন, আফসোস! বে-ইলম লোকেরাও আজকাল আলেমদেরকে পরামর্শ দেওয়ার দুঃসাহস দেখায় যে, আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে করে দ্বীনের কাজ কর। একথা শুনে (সেই পাঠান) খুবই রাগ হয়ে চলে গেল। যেতে যেতে বলল, ঠিক আছে! আমার কথা মানা হল না। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে সে আবার ফিরে এসে বলল, আমার কথাও মানেন না, আবার আমি যেতে চাইলে আমাকে যেতেও দেন না। আমার পা-ই চলে না। পা আটকে যাচ্ছে। জানি না কী করেছে! এরপর সে হযরত থানভী রাহ.-এর নিকট ক্ষমা চাইল। হযরত রাহ. থেকে মাফ করিয়ে নেয়ার পর সে আশ্বস্ত হল। (আশরাফুস সাওয়ানেহ, প্রথম খন্ড, ৪৬ পৃষ্ঠা)
চাঁদা সংগ্রহে ‘না’
কানপুরের ‘‘ফয়যে আম’’ মাদরাসায় কয়েকমাস পড়ানোর পর সে মাদরাসা-কমিটির একটি আচরণে সে মাদরাসা থেকে হযরতের মন উঠে যায়। ঘটনা হল, হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. অন্যদের মতো ওয়াযের মধ্যে চাঁদা সংগ্রহ করতেন না এবং এটাকে আলেমদের মর্যাদা পরিপন্থী মনে করতেন। হযরত থানভী রাহ.-এর এ মানসিকতা পূর্বাপর সবসময়ই ছিল।
মাদরাসা কমিটির কোনো কোনো অপরিণামদর্শী সদস্য এজন্য হযরতের সমালোচনা করল। তিনি জানতে পেরে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন এবং এ সমালোচনার উত্তরে বললেন, চাঁদা সংগ্রহের জন্যই যদি ওয়াজ করি তাহলে নিজের জন্য সংগ্রহ করব না কেন? এ কাজ আমার নয়। চাঁদা সংগ্রহের দায়িত্ব তো মাদরাসা কমিটির। আমার কাজ হল, ছাত্রদের পাড়ানো।
যদিও হযরত থানভী রাহ.-এর একথা একেবারে যুক্তিসঙ্গত ছিল, কিন্তু কমিটির সদস্যরা বিরূপ মমত্মব্য ও চর্চা করতে লাগল। এতে হযরত থানভী রাহ. অসন্তুষ্ট হয়ে মাদরাসার শিক্ষকতার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন।
পরে অবশ্য কমিটির লোকেরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল। কিন্তু হযরত বুঝতে পেরেছিলেন যে, এরা মানুষের মর্যাদা দিতে জানে না। এদের সাথে বনিবনা হবে না। তাই তিনি সেখানে থাকতে রাযি হলেন না।
আমি দায়িত্ব নিচ্ছি
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তালিবুল ইলমদেরকে বলেন, ‘‘তোমরা তিনটি কাজ নিজেদের উপর আবশ্যকীয় করে নাও। তাহলে আমি তোমাদের ব্যাপারে দায়িত্ব নিচ্ছি যে, তোমরা ইলমী যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হবে।’’
১. দরসের আগে মোতালাআ করে আসবে। অর্থাৎ, নতুন পড়া দেখে আসবে। এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। এর উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, معلومات اور مجهولات مميز هو جائين (জানা আর অজানা চিহ্নিত হয়ে যায়।) এটুকু হলেই চলবে।
২. উস্তায থেকে পড়া ভালোভাবে বুঝে পড়বে। না বুঝে অগ্রসর হবে না। দরসের সময় উস্তাযকে বার বার জিজ্ঞাসা করার ফলে যদি তিনি বিরক্ত হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে অন্য কেনো সময়ে উস্তায থেকে বুঝে নিবে।
৩. উপরোক্ত দু‘টি কাজের পর নিজে নিজেই পুরো সবকের সারকথা পুনরাবৃত্তি করবে। এই তিনটি কাজ গুরুত্বের সাথে নিয়মিত করার পর একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। চাই পঠিত বিষয় স্মরণ থাকুক বা না থাকুক। এতেই ইনশাআল্লাহ যোগ্যতা সৃষ্টি হবে। এই তিনটি কাজ (ছাত্রদের জন্য) ওয়াজিব পর্যায়ের। আরেকটি কাজ আছে মুস্তাহাব পর্যায়ের। আর তা হল, প্রতিদিন কিছু কিছু ‘আমুখতা’ অর্থাৎ পূর্বের পঠিত বিষয় পড়বে। (আশরাফুস সাওয়ানেহ ১ম খন্ড, ৫১ পৃষ্ঠা)
কঠোরতা করিনি
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, আমি কানপুরের পটকাপুর মহলস্নায় সর্বদা থেকেছি। কারণ আমাদের মাদরাসা ঐ মহল্লাতেই ছিল। যদিও ঐ এলাকার লোকেরা খুবই স্বাধীনচেতা ও দুঃসাহসী বলে বিখ্যাত ছিল। আমি কানপুরে অবস্থানকালের পুরো সময়ই তাদের সাথে কাটিয়েছি। তারা সর্বদাই আমার সাথে মুহাববতের আচরণ করেছে। এর কারণ হল, আমি কোনো ব্যাপারেই তাদের সাথে কঠোরতা করিনি। তাদের কাছ থেকে (দুনিয়াবী) কোনো কিছু পাওয়ার আশাও কখনো করিনি; বরং আমি নিজেই প্রয়োজনের মুহূর্তে সেখানের দরিদ্র লোকদেরকে সাহায্য করেছি। সেখানে দুর্ভিক্ষ চলাকালে প্রতিবেশীর হক আদায়ের নিয়তে কয়েকবার চাঁদা সংগ্রহ করে সে এলাকার দরিদ্র লোকদের মধ্যে খাদ্য-শস্য ও কাপড়-চোপড় বণ্টন করেছি। (আশরাফুস সাওয়ানেহ ১ম খন্ড, ৪৮ পৃষ্ঠা)
রবিউস সানি ১৪৩৬ – ফেব্রুয়ারি ২০১৫
মাসিক আল কাউসার