রাসূলুল্লাহ আর তাঁকে সত্য ধর্মের প্রচারে সহযোগিতা করার অপরাধে বনু হাশেম ও মুত্তালিবকে সামাজিকভাবে নির্বিশেষ বয়কটের মুখে ফেলা হয়েছিলো। এই অবর্ণনীয় যাতনার বয়কটকাল এক বা দুই দিন কিংবা সপ্তাহ বা মাসে সীমাবদ্ধ ছিলো ন; একে একে সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে অনতিক্রান্ত সে বয়কটকাল বছর দুই-তিনের দুঃসহ জীবনে রূপ নেয়। অসহ্য হয়ে পড়ে মুসলিমগণ এবং বনু হাশেম ও মুত্তালিব।
এরপর নবুওতের ১০ম বর্ষের মুহাররম মাসে লিখিত অঙ্গীকারনামাটি ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং অত্যাচার-উৎপীড়নের পরিসমাপ্তি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কারণ, প্রথম থেকেই কিছু সংখ্যক লোক এর বিপক্ষে ছিলো। যারা এর বিপক্ষে ছিলো, তারা সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকতো একে বাতিল কিংবা বিনষ্ট করার জন্য। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বছর দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর রহমতে সেই একরারনামা বিনষ্ট করার মোক্ষম এক সুযোগ এসে যায় অবলীলাক্রমে।
হাশিম বিন আমর নামে এক রহমদিল মানুষ ছিলো মক্কায়। তিনি মাঝে মাঝে লুকিয়ে বয়কটপীড়িতদের খাদ্যের সংস্থান করতেন। স্বজাতির প্রতি স্বজাতির এ উৎপীড়নের তিনি কোনো মানে খুঁজে পেতেন না। চিন্তা করতেন, কীভাবে এর একটা শেষ করা যায়। একদিন তিনি যুহাইর বিন উমাইয়ার কাছে গেলেন। যুহাইর আবু তালিবের ভাগ্নি। হাশিম যুহাইরকে তিরস্কার করে বললেন, ‘যুহাইর, ভালো খাবার কীভাবে তোমার উদরস্থ হয়? অথচ তোমার মামা-বংশ না খেয়ে মরণাপন্ন!’ শুনে যুহাইরের যেন সুপ্ত দুঃখ জেগে উঠলো; সে বললো, ‘দুঃখ কি আমারও হয় না, হাশিম! কিন্তু একা আমি কী করতে পারি, বলো?’ হাশিম বললেন, ‘তুমি একা নও, আমি তোমার সাথে আছি।’ যুহাইর বললেন, ‘বাহ। তবে চলো, তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করি।’ এভাবে মুতঈম ইবনে আদি, আবুল বুখতারি ইবনে হিশাম এবং যামআ ইবনে আসওয়াদ নামের সমমনা পাঁচজন রহমদিল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলেন; এবং স্থির করলেন, কাল কাবা-চত্বরে গিয়ে ওই অন্যায় অঙ্গীকারনামা তারা ছিঁড়ে ফেলবেন। সে কল্পে তারা সুন্দর একটি বুদ্ধিও করলেন।
পরদিন যুহাইর কাবা তাওয়াফ করে বলতে লাগলেন, ‘এ তো অন্যায়, আমরা খাবো-পরবো আর বনু মুত্তালিব পচে পচে মরবে; আমি তো এ অন্যায় আর সহ্য করতে পারি না।’ অন্যদিকে আরেকজনও এমন বলে ওঠে। এভাবে প্রত্যেকে তাদের মতো করে বয়কটের অন্যায় ও অসাড়তার দিক তুলে ধরে এর শেষ হওয়া উচিত বলে ঘোষণা করে। তাতে কাবা-চত্বরে বসে থাকা অন্য কাফেরকুল ক্ষেপে ওঠে ও তাদের সাথে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়; এবং আবু জাহল বলতে থাকে, ‘এরা চুক্তি করে এসব বলছে; এর সব এদের পরিকল্পনা। তখনই আবু তালিব সেখানে উপস্থিত হয়। আবু তালিবের সেখানে উপস্থিত হওয়ার প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট আরও মজার ও আশ্চর্যের। আবু তালিব বলেন, ‘আমার ভাতিজা আমাকে এক পয়গাম নিয়ে পাঠিয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনাদের ওই অন্যায় চুক্তিনামা পোকা-মাকড়ে খেয়ে ফেলেছে; চুক্তির কোনো দফাই আর সেখানে উল্লেখ নেই। আপনারা খবর নিয়ে দেখুন। যদি আমার ভাজিতার কথা সত্যি হয়, তাহলে এ অন্যায় বয়কটের এখানেই শেষ হবে। আর এর অন্যথা দেখা গেলে আমাদের কোনো কথা নেই। ইত্যবসরে মুতঈম নিজেই সেটি ছিঁড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলো; আবু তালিবের এই কথা শোনার পর সকলেই কাবার দেয়ালের কাছে দৌড়ে গেলো। গিয়ে দেখলো, অঙ্গীকারনামায় শুধু ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এইসব ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে বেদনাবিধুর অসহ্য মানবেতর বয়কট-জীবনের অবসান ঘটলো। রাসূল-জীবন অম্লমধুর অন্য কোনো এক অবাক-আশ্চর্য বৈচিত্রের দিকে বাহিত হওয়ার পথ নিলো…