[মাসিক আলকাউসারের কুরআনুল কারীম সংখ্যায় পাঠক হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেবের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘কুরআনের পরিচয় কুরআনের ভাষায়’ পড়েছেন। বিষয়টি মূলত অনেক দীর্ঘ। তিনি এ বিষয়ের অন্যান্য দিকগুলো নিয়েও লিখছেন। তারই একটি অংশ এ সংখ্যায় পেশ করা হল। কুরআনের পরিচয় যত বিস্তৃতভাবে এবং যত গভীরভাবে অর্জন করা যায় তত ঈমান বাড়ে, কুরআনের মুহাব্বত বাড়ে এবং আমলের আগ্রহ পয়দা হয়। আল্লাহ আমাদের তা দান করেন। – মাওলানা আবদুল মালেক।]
এতে কোনও সন্দেহ নেই
কুরআনের দাবি সে আল্লাহরই পক্ষ হতে অবতীর্ণ এবং এতে কোনও সন্দেহ নেই। কুরআন তাঁর এ দাবির সত্যতা নানাভাবে প্রমাণ করেছে। কুরআন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে,
اَمْ یَقُوْلُوْنَ افْتَرٰىهُ قُلْ فَاْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِهٖ مُفْتَرَیٰتٍ وَّ ادْعُوْا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ.
তবে কি তারা বলে, সে (নবী) নিজের পক্ষ থেকে এই ওহী রচনা করেছে? (হে নবী! তাদেরকে) বলে দাও, তাহলে তোমরাও এর মত দশটি স্বরচিত সূরা এনে উপস্থিত কর এবং (এ কাজে সাহায্যের জন্য) আল্লাহ ছাড়া যাকে ডাকতে পার ডেকে নাও; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। সূরা হূদ (১১) : ১৩
অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন উম্মী নবী। তিনি নিরক্ষর ছিলেন। তোমরা তো অনেক লেখাপড়া জান। আরবী সাহিত্যে তোমাদের প্রচুর দখল ও দক্ষতা। তা এ কিতাব যদি তার মত একজন নিরক্ষর লোক রচনা করতে পারেন, তবে তোমাদের মত উঁচু মানের কবি-সাহিত্যিকগণ কেন পারবে না! সুতরাং তোমরা এর মত পূর্ণাঙ্গ কিতাব নয়; বরং এর মত দশটা সূরাই তৈরি করে দেখাও না! পরবর্তী সময়ে এ চ্যালেঞ্জ আরও সহজ করে দেওয়া হয়। সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে,
وَ اِنْ كُنْتُمْ فِیْ رَیْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰی عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِهٖ وَ ادْعُوْا شُهَدَآءَكُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَ لَنْ تَفْعَلُوْا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیْ وَ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ اُعِدَّتْ لِلْكٰفِرِیْنَ.
তোমরা যদি এই (কুরআন) সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহে থাক, যা আমি আমার বান্দা (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল করেছি, তবে তোমরা এর মত কোনও একটি সূরা বানিয়ে আন। আর সত্যবাদী হলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া নিজেদের সাহায্যকারীদের ডেকে নাও। তারপরও যদি তোমরা এ কাজ করতে না পার আর এটা তো নিশ্চিত যে, তোমরা তা কখনও করতে পারবে না, তবে ভয় কর সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। তা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সূরা বাকারা (২) : ২৩-২৪
সূরা ইউনুসে ইরশাদ,
وَ مَا كَانَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ اَنْ یُّفْتَرٰی مِنْ دُوْنِ اللهِ وَ لٰكِنْ تَصْدِیْقَ الَّذِیْ بَیْنَ یَدَیْهِ وَ تَفْصِیْلَ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ، اَمْ یَقُوْلُوْنَ افْتَرٰىهُ قُلْ فَاْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّثْلِهٖ وَ ادْعُوْا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ.
এ কুরআন এমন নয় যে, এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ হতে রচনা করা হবে, বরং এটা (ওহীর) সেইসব বিষয়ের সমর্থন করে, যা এর পূর্বে নাযিল হয়েছে এবং আল্লাহ (লওহে মাহফূজে) যেসব বিষয় লিখে রেখেছেন এটা তার ব্যাখ্যা করে। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে। তারপরও কি তারা বলে, রাসূল নিজের পক্ষ হতে এটা রচনা করেছে? বল, তবে তোমরা এর মত একটি সূরাই (রচনা করে) নিয়ে এসো এবং (এ কাজে সাহায্য গ্রহণের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডেকে নাওÑ যদি তোমরা সত্যবাদী হও। সূরা ইউনুস (১০) : ৩৭-৩৮
এর ব্যাখ্যায় হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমাদ ‘উছমানী রাহ. বলেন, “অর্থাৎ আমি নিজেই যদি এ কিতাব রচনা করে থাকি, তবে তোমরাও তো আমারই মত মানুষ। তোমরা সকলে মিলে এর একটি সূরার মত সূরা রচনা করে দেখাও। এ কাজের জন্য তোমরা তাবৎ সৃষ্টিকে ডাক। মানব-দানব সকলকে একত্র কর। জগতে যত কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও জ্ঞানী-গুণী আছে, সকলে একত্র হয়ে কুরআন মাজীদের ছোট একটি সূরার মত সূরা বানিয়ে দেখাও। তা যদি পার, প্রমাণ হয়ে যাবে এ কুরআন মানুষের রচনা, যার অনুরূপ অন্য লোকেও তৈরি করতে পারে। কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত কোনও সৃষ্টির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কুরআন তো এক অলৌকিক-অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। এর ভেতর নীতি-নৈতিকতা, সমাজ ও সভ্যতা, রাষ্ট্র রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, আত্মশুদ্ধি, আত্মোৎকর্ষ, মোটকথা আল্লাহপ্রাপ্তি এবং জাগতিক উন্নয়ন ও শান্তি-শৃংখলা সম্পর্কিত যাবতীয় বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। এটা এমনই এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, যা দ্বারা জগত-সৃষ্টির লক্ষ-উদ্দেশ্য সুচারুরূপে পূর্ণ হওয়া সম্ভব। এমন এক নজীরবিহীন গ্রন্থের রচনা-বিন্যাস এক নিরক্ষর জাতির নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব হওয়ার কথা নয়। উপরিউক্ত যাবতীয় জ্ঞান-তত্ত্বের সমাহারই তো কেবল নয়! এর যে আলোড়নসঞ্চারী ভাষা ও সাহিত্যালংকার, পূর্ণাঙ্গ, মনোরম ও হৃদয়গ্রাহী ভাষাশৈলী, সমুদ্রপ্রতিম তরঙ্গময়তা, সাবলীল গতিচ্ছন্দ, বাকভঙ্গীর বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য, এর যে আস্বাদ ও মাধুর্য এবং রাজসিক শান-শওকত, তার তুলনা কবে কোন্ গ্রন্থে, কার রচনায় পাওয়া গেছে, না পাওয়া সম্ভব? এর প্রতিটি বিষয়ই সোচ্চার কণ্ঠে সারা জাহানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কুরআনের জগতপ্লাবী রূপ-মাধুর্য প্রথম যখন আত্মপ্রকাশ করে এবং বনী আদমের সামনে নিজ পরিচয় তুলে ধরে, তখনই তার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিলÑ আমি বিশ্ব স্রষ্টার কালাম। আল্লাহর সৃষ্ট এ পৃথিবীর মত পৃথিবী, তাঁর আসমানের মত আসমান ও তাঁর সূর্যের মত সূর্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা যেমন কারও নেই, তেমনি তাঁর এ পাক কালামের মত কালাম রচনা করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টি এ ব্যাপারে কেবল অক্ষমই হয়ে থাকবে। কুরআনকে মেটানোর জন্য মানুষ ষড়যন্ত্র করবে, প্রাণপণ সংকল্পে এর মুকাবিলায় নেমে পড়বে এবং সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বিশ্বে বড়-বড় শক্তিকে আহ্বান জানাবে, কিন্তু সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তারা কোনও তদবির, কোনও কৌশল ও কোনও অস্ত্রই ব্যবহার না করে ছাড়বে না এবং তা করতে গিয়ে নিজেকে বিপাকে ফেলবে, অন্যদের জন্য মসিবত ডেকে আনবে। মোটকথা যে-কোনও রকম ঝুঁকিগ্রহণ ও যে-কোনও বিপত্তির ভারবহন তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, কিন্তু কস্মিনকালেও এ পবিত্র গ্রন্থের ছোট্ট একটি সূরার মত সূরা রচনা করে দেখানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ لَّىِٕنِ اجْتَمَعَتِ الْاِنْسُ وَ الْجِنُّ عَلٰۤی اَنْ یَّاْتُوْا بِمِثْلِ هٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا یَاْتُوْنَ بِمِثْلِهٖ وَ لَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِیْرًا.
বলে দাও, এই কুরআনের মত বাণী তৈরি করে আনার জন্য যদি সমস্ত মানুষ ও জিন একত্র হয়ে যায়, তবুও তারা এরকম কিছু আনতে পারবে না, তাতে তারা একে অন্যের যতই সাহায্য করুক Ñসূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮৮; তাফসীরে উছমানী, সূরা ইউনুস (১০) : ৩৭-৩৮
মোটকথা কুরআন মাজীদের অনুরূপ কিছু রচনায় মানুষের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে এ কালাম মানব-রচিত নয়; আল্লাহ রাব্বুল-‘আলামীনের নিকট থেকে আগত। কুরআন অন্যভাবেও বিষয়টা প্রমাণ করেছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ وَ لَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَیْرِ اللهِ لَوَجَدُوْا فِیْهِ اخْتِلَافًا كَثِیْرًا.
তারা কি কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ হতে হত, তবে এর মধ্যে বহু অসংগতি পেত। Ñসূরা নিসা (৪) : ৮২
সারা কুরআনের কোথাও কোনও গরমিল ও অসংগতি নেই। মানব-রচিত হলে তা অবশ্যই থাকত। কেননা মানুষ যত বড় প্রতিভাবানই হোক, কোনও না কোনও দুর্বলতা তার মধ্যে থেকেই যায়। স্বাস্থ্য ও মেযাজের উত্থান-পতন, পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভেদ ও যুগ-কালের তারতম্যের কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনায় পার্থক্য ঘটেই যায় এবং কথাবার্তা ও লেখাজোখায়ও তা প্রকাশ পেয়ে থাকে। এ কারণেই মানুষের রচনা-ভাষণে নানারকম অসংগতি ধরা পড়ে। কুরআন মাজীদে কোনওরকম অসংগতি ও সাংঘর্ষিক কথা না থাকাই প্রমাণ করে এটা আদৌ মানুষের রচনা নয়; বরং এমন এক সত্তার বাণী যিনি স্থান-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মেযাজ-মর্জিগত যাবতীয় আপতনের উর্ধ্বে এবং কোনওরকমের পারিপাশির্^কতার প্রভাব যাকে স্পর্শ করে না। অর্থাৎ হিদায়াতের এ মহাগ্রন্থ আল্লাহ তাআলারই বাণী। তিনিই এ বাণী মানুষকে পথনির্দেশ করার জন্য তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নাযিল করেছেন। সুতরাং হে মানুষ তোমরা নিশ্চিত আস্থার সাথে এ হিদায়াত-গ্রন্থ অবলম্বন করতে পার। এ কিতাব কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছার পথ তোমাকে দেখাবে।
সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত
কুরআন মাজীদের আগে আর যত কিতাব নাযিল হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ কোনও জাতিকে পথ দেখানো। যেমন তাওরাত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
وَ اٰتَیْنَا مُوْسَی الْكِتٰبَ وَ جَعَلْنٰهُ هُدًی لِّبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ .
আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং তাকে করেছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য পথনির্দেশ। সূরা ইসরা (১৭) : ২
হযরত ‘ঈসা আ.-কেও কেবল বনী ইসরাঈলের জন্যই নবী করে পাঠানো হয়েছিল। সূরা সফ্ (৬১) : ৬
কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে সারা বিশে^র সমস্ত মানুষের জন্য। এটা কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের তাবৎ মানুষের পথনির্দেশ। কুরআন মাজীদ শুরুতেই নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ঘোষণা করেছে,
هُدًی لِّلْمُتَّقِیْنَ
এ কিতাব মুত্তাকীদের জন্য পথনির্দেশ। সূরা বাকারা (২) : ২
অর্থাৎ যে-কেউ আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, ফলে তাঁর খুশি-অখুশি জানতে চায়, তাঁর পথে চলতে প্রয়াসী হয়, এমন প্রত্যেককেই এ কিতাব পথ দেখায়, সে আরব হোক বা অনারব, প্রাচ্যের হোক বা পাশ্চাত্যের এবং খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর লোক হোক বা তার পরের কিয়ামত পর্যন্ত যে-কোনও কালের হোক। ভাষা-বর্ণ ও স্থান-কাল নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য এ গ্রন্থ দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণপথের হিদায়াত। কিন্তু এ হিদায়াতে কর্ণপাত করে কেবল তারাই, যারা আল্লাহকে ভয় করে। তারাই এ পথনির্দেশ অনুসরণ করে এবং সে অনুযায়ী জীবন গড়ে। ফলে আল্লাহ তাআলাকে পেয়ে যায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্যম-িত হয়। আর যারা আল্লাহকে ভয় করে না, তারা এ মহামূল্যবান হিদায়াতের কদর করে না। ফলে এর কল্যাণলাভ থেকে বঞ্চিত থাকে। অথচ এর উপদেশ ও পথনির্দেশ সকলের জন্যই সমান অবারিত। ইরশাদ হয়েছে,
اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ۠.
এটা তো আর কিছুই নয়; সারা জাহানের জন্য উপদেশবাণী।’ সূরা ইউসুফ (১২) : ১০৪
অন্যত্র ইরশাদ,
هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی.
এটা মানুষের জন্য হিদায়াত ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। সূরা বাকারা (২) : ১৮৫
মানুষের জন্য বলতে বিশেষ কোনও যুগ ও বিশেষ কোনও অঞ্চলের মানুষ নয়; বরং সারা জাহানের সর্বকালের মানুষ। ইরশাদ হয়েছেÑ
وَ اُوْحِیَ اِلَیَّ هٰذَا الْقُرْاٰنُ لِاُنْذِرَكُمْ بِهٖ وَ مَنْۢ بَلَغَ.
আমার প্রতি ওহীরূপে এই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যাতে এর মাধ্যমে আমি সতর্ক করি তোমাদেরকেও এবং এমন সমস্ত মানুষকেও, যাদের কাছে এ কুরআন পৌঁছবে।’ সূরা আনআম (৬) : ১৯
এ পৌঁছানোর জন্য কোনও স্থান-কালের সীমারেখা নেই। এ উম্মতের প্রতি কঠোর নির্দেশ, তারা যেন কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের কাছে কুরআনের বাণী প্রচার করে। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত সারা বিশে^র যেখানেই যে-কেউ আল্লাহর অবাধ্যতা করবে, এ কুরআন তাকেই অবাধ্যতার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে এবং তা থেকে বাঁচার পথ দেখায়। ইরশাদ হয়েছে,
تَبٰرَكَ الَّذِیْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰی عَبْدِهٖ لِیَكُوْنَ لِلْعٰلَمِیْنَ نَذِیْرَا.
মহিমময় সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দার প্রতি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে মীমাংসাকারী এই কিতাব নাযিল করেছেন, যাতে তা বিশ^বাসীর জন্য হয় সতর্ককারী। সূরা ফুরকান (২৫) : ১
সুতরাং সারা জাহানের সমস্ত মানুষের মুক্তি ও সফলতা এই সার্বজনীন হিদায়াতের অনুসরণেই নিহিত। ইরশাদ হয়েছে,
فَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِهٖ وَ عَزَّرُوْهُ وَ نَصَرُوْهُ وَ اتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ۠.
যে সকল লোক তাঁর (অর্থাৎ শেষ নবীর) প্রতি ঈমান আনবে, তাঁকে সম্মান করবে, তাঁর সহযোগিতা করবে এবং যেই নূর ও জ্যোতি তাঁর সাথে নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করবে, কেবল তারাই সফলকাম। সূরা আরাফ (৭) : ১৫৭
কারণ তাঁর আনীত সে নূর কোনও গোষ্ঠীবিশেষের জন্য নয়; সারা জাহানের সকলের জন্য। ইরশাদ হয়েছ্
قُلْ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیْ رَسُوْلُ اللهِ اِلَیْكُمْ جَمِیْعًا.
বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল। সূরা আরাফ (৭) : ১৫৮
আরও ইরশাদ,
وَ مَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا كَآفَّةً لِّلنَّاسِ بَشِیْرًا وَّ نَذِیْرًا.
আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। সূরা সাবা (৩৪) : ২৮
কুরআন কোনও অভিনব কিতাব নয়
দুনিয়ায় মানব প্রেরণের প্রাক্কালেই আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি মানুষের জন্য পথনির্দেশ পাঠাবেন, সেই অনুযায়ী যে চলবে তার পথ হারানোর ভয় থাকবে না, আর যে তা পাশ কাটিয়ে চলবে সে বিপথগামী হবে ও তার মানবজন্ম ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা যুগে-যুগে যে হিদায়াত-গ্রন্থ নাযিল করেছেন, কুরআন মাজীদ সেই ধারারই সর্বশেষ কিতাব। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেÑ
اِنَّاۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْكَ كَمَاۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلٰی نُوْحٍ وَّ النَّبِیّٖنَ مِنْۢ بَعْدِهٖ وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلٰۤی اِبْرٰهِیْمَ وَ اِسْمٰعِیْلَ وَ اِسْحٰقَ وَ یَعْقُوْبَ وَ الْاَسْبَاطِ وَ عِیْسٰی وَ اَیُّوْبَ وَ یُوْنُسَ وَ هٰرُوْنَ وَ سُلَیْمٰنَ وَ اٰتَیْنَا دَاوٗدَ زَبُوْرًا.
হে নবী! আমি তোমার প্রতি ওহী নাযিল করেছি, যেভাবে ওহী নাযিল করেছি নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের প্রতি এবং আমি ওহী নাযিল করেছিলাম ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, (তাদের) বংশধরগণ, ‘ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারুন ও সুলায়মানের প্রতি। আর দাউদকে দান করেছিলাম যাবূর। সূরা নিসা (৪) : ১৬৩
অর্থাৎ তোমার প্রতি ওহীর মাধ্যমে যে কিতাব নাযিল করেছি তা অভিনব ও বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যাপার নয়। মানুষকে সুপথ দেখানো, সৎকর্মের পরিচয় দান, সৎকর্মের উত্তম পুরস্কার সম্পর্কে সুসংবাদদান ও অসৎপথে চলার পরিণতি ও অসৎকর্মের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য নবী প্রেরণ ও কিতাব নাযিলের ধারা আগে থেকেই চলে এসেছে। কুরআন মাজীদ সেই ধারারই এক হিদায়াত-গ্রন্থ ও সর্বশেষ কিতাব।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
نَزَّلَ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ وَ اَنْزَلَ التَّوْرٰىةَ وَ الْاِنْجِیْلَ مِنْ قَبْلُ هُدًی لِّلنَّاسِ.
তিনি তোমার প্রতি সত্যসম্বলিত কিতাব নাযিল করেছেন, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থন করে এবং তিনিই তাওরাত-ইন্জীল নাযিল করেছিলেন এর আগে মানুষের জন্য পথনির্দেশস্বরূপ।’ সূরা আলে-ইমরান (৩) : ৩-৪
সূরা আনআমে আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণের দীর্ঘ ফিরিস্তি দেওয়ার পর বলেন,
اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ.
ওই সকল নবীগণকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম। সূরা আনআম (৬) : ৮৯
অতপর যারা কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মানতে রাজি নয় এবং মানুষের প্রতি কিতাব নাযিল হওয়াকে অসম্ভব মনে করে, তাদের দাবি খ-নে ইরশাদ করেন,
قُلْ مَنْ اَنْزَلَ الْكِتٰبَ الَّذِیْ جَآءَ بِهٖ مُوْسٰی.
বল, মূসা যে কিতাব নিয়ে এসেছিল, তা কে নাযিল করেছিলেন? সূরা আনআম (৬) : ৯১
তারপর কুরআন সম্পর্কে বলেন,
وَ هٰذَا كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ مُبٰرَكٌ.
আর এটা এক বরকতময় কিতাব, যা আমি (তোমার প্রতি) নাযিল করেছি। সূরা আনআম (৬) : ৯২
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজ নবুওতের ঘোষণা দেন এবং কুরআন প্রচার করেন, তখন অনেকেই ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক মনে করেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন,
قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَ مَاۤ اَدْرِیْ مَا یُفْعَلُ بِیْ وَ لَا بِكُمْ اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوْحٰۤی اِلَیَّ وَ مَاۤ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ مُّبِیْنٌ. قُلْ اَرَءَیْتُمْ اِنْ كَانَ مِنْ عِنْدِ اللهِ وَ كَفَرْتُمْ بِهٖ وَ شَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْۢ بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ عَلٰی مِثْلِهٖ فَاٰمَنَ وَ اسْتَكْبَرْتُمْ، اِنَّ اللهَ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الظّٰلِمِیْنَ۠. وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَوْ كَانَ خَیْرًا مَّا سَبَقُوْنَاۤ اِلَیْهِ، وَ اِذْ لَمْ یَهْتَدُوْا بِهٖ فَسَیَقُوْلُوْنَ هٰذَاۤ اِفْكٌ قَدِیْمٌ وَ مِنْ قَبْلِهٖ كِتٰبُ مُوْسٰۤی اِمَامًا وَّ رَحْمَةً، وَ هٰذَا كِتٰبٌ مُّصَدِّقٌ لِّسَانًا عَرَبِیًّا لِّیُنْذِرَ الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا وَ بُشْرٰی لِلْمُحْسِنِیْنَ.
বল, আমি রাসূলগণের মধ্যে অভিনব নই। (বরং আমি যুগ-যুগ ধরে চলে আসা নবী-রাসূলগণের ধারারই এক রাসূল। আমি গায়বের জ্ঞাতা নই। ফলে) আমি জানি না আমার সংগে কী আচরণ করা হবে এবং এটাও জানি না যে, তোমাদের সংগে কী আচরণ করা হবে। আমি তো কেবল আমার প্রতি যে ওহী নাযিল করা হয় তারই অনুসরণ করি। আর আমি তো কেবল একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি এটা (অর্থাৎ এই কুরআন) আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় (যেমন তাঁর পক্ষ থেকে পূর্বে আরও অনেক কিতাব নাযিল হয়েছিল) আর তোমরা একে অস্বীকার কর, অন্যদিকে বনী ইসরাঈলের কোনও সাক্ষী এ রকম বিষয়ের প্রতি সাক্ষ্য দেয় (আর বলে এরকমই কিতাব হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি নাযিল হয়েছিল এবং মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের দিক থেকে কুরআন মাজীদ তারই মত কিতাব) এবং সে এর প্রতি ঈমানও আনে আর তোমরা নিজেদের অহমিকায় লিপ্ত থাক, তবে এটা মারাত্মক অবিচার হবে না? নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে হিদায়াতপ্রাপ্ত করেন না। যারা কুফ্র অবলম্বন করেছে, তারা মুমিনদের সম্পর্কে বলে, এটা (ঈমান আনয়ন) যদি ভালো কিছু হত, তবে তারা এর প্রতি আমাদের চেয়ে অগ্রগামী হতে পারত না এবং কাফেরগণ যখন এর দ্বারা নিজেরা হিদায়াত লাভ করল না, তখন তো এটাই বলবে যে, এটা সেই পুরানো দিনের মিথ্যা। এর আগে মূসার কিতাব এসেছে পথপ্রদর্শক ও রহমত হয়ে। আর এটা (অর্থাৎ কুরআন) আরবী ভাষায় অবতীর্ণ কিতাব, যা তাকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়, যাতে এটা জালেমদেরকে সতর্ক করে এবং সৎকর্মশীলদের জন্য হয় সুসংবাদ। সূরা আহকাফ (৪৬) : ৯-১২
এ মর্মে আরও বহু আয়াত আছে, যা সুস্পষ্টভাবে জানান দেয় যে, কুরআন মাজীদ অভিনব ও বিচ্ছিন্ন কোনও কিতাব নয়; বরং পথ দেখানোর লক্ষে অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহেরই অন্তর্ভুক্ত এক কিতাব। সেসব কিতাবের মূল শিক্ষা ও আল-কুরআনের মূল শিক্ষা একই। আর এজন্য সেসব কিতাবের অনুসারীদের লক্ষ করে ডাক দেওয়া হয়েছে যে,
قُلْ یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا اِلٰی كَلِمَةٍ سَوَآءٍۭ بَیْنَنَا وَ بَیْنَكُمْ اَلَّا نَعْبُدَ اِلَّا اللهَ وَ لَا نُشْرِكَ بِهٖ شَیْـًٔا وَّ لَا یَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ، فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوْا بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ.
বল, হে আহ্লে কিতাব (ইহূদী ও নাসারা সম্প্রদায়)! তোমরা এমন এক কথার দিকে এসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই রকম। (আর তা এই যে,) আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না। তাঁর সাথে কোনও কিছুকে শরীক করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে আমরা একে অন্যকে রব বানাব না। তথাপি তারা মুখ ফিরিয়ে নিলে বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম। সূরা আলে ইমরান (৩) : ৬৪
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থক
কুরআন মাজীদ তার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে তার একটি হল, ‘সে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থক’। তার এ সমর্থনের বিভিন্ন দিক আছে, যথা সেসব কিতাবে যে মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও সাধারণ সৎকর্মসমূহের বর্ণনা আছে, কুরআন মাজীদেও তা বর্ণিত হয়েছে, যথা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ, রাসূলের রিসালাত, আখিরাত, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, ফিরিশতা ও তাকদীরের সত্যতা; দয়া, সত্যকথন, আমানতদারি, ওয়াদারক্ষা, বদান্যতা প্রভৃতি সদগুণের প্রশংসা; জুলুম, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি মন্দ চরিত্রের নিন্দা। সব কিতাবেরই প্রাণবস্তু ছিল এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর দাওয়াত ও তাঁর সংগে কাউকে শরীক করার নিষেধাজ্ঞা। কুরআন মাজীদেরও কেন্দ্রীয় বিষয় সেটাই। সেসব কিতাবের প্রত্যেকটি বিশেষ কোনও নবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, যেমন তাওরাত হযরত মূসা আ.-এর প্রতি, ইন্জীল হযরত ঈসা আ.-এর প্রতি, যাবূর হযরত দাউদ আ.-এর প্রতি এবং হযরত ইবরাহীম আ.-এর প্রতিও কোনও এক কিতাব নাযিল হয়েছিল, কুরআন মাজীদও এ কথার সাক্ষ্য দান করে এবং কুরআন মাজীদের সে সাক্ষ্য অনুযায়ী ওই সকল কিতাব ও তার নবীগণের প্রতি ঈমান আনা আমাদের জন্যও জরুরি।
ওই সকল কিতাবের আরও একটা বিষয় ছিল সর্বশেষ নবী ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। সেই ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রত্যেক কিতাবের অনুসারীগণ শেষ নবীকে চিনত ও তাঁর প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার কথা সেই কুরআন সম্পর্কেও জানত। তো ওইসকল কিতাবে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য, কুরআন মাজীদ তার সপক্ষে সাক্ষ্য দান করে। অর্থাৎ কুরআন জানাচ্ছে ওইসকল কিতাবে যে শেষ নবীর আগমনী সংবাদ জানানো হয়েছে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সেই নবী এবং তাঁর প্রতি যে কিতাব নাযিল হওয়ার কথা কুরআন মাজীদই সেই কিতাব।
এই যাবতীয় সমর্থনের প্রতি ইঙ্গিত করেই কুরআন মাজীদ ঘোষণা করছে-
وَ مَا كَانَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ اَنْ یُّفْتَرٰی مِنْ دُوْنِ اللهِ وَ لٰكِنْ تَصْدِیْقَ الَّذِیْ بَیْنَ یَدَیْهِ وَ تَفْصِیْلَ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
এ কুরআন এমন নয় যে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ হতে রচনা করা হবে; বরং এটা এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থন করে এবং তোমাদেরকে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে। এতে কোনও সন্দেহ নেই। এটা জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে। -সূরা ইউনুস (১২) : ৩৭
অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহও যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ এবং তাতে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা সত্য, এ কিতাব তা প্রত্যয়ন করে। কুরআন যেহেতু পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে সমর্থন করে, তাই সে বিশেষভাবে সেইসব কিতাবের অনুসারীদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اٰمِنُوْا بِمَاۤ اَنْزَلْتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ وَ لَا تَكُوْنُوْۤا اَوَّلَ كَافِرٍۭ بِهٖ وَ لَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا .
আর আমি যে বাণী নাযিল করেছি তাতে ঈমান আন, যখন তা তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থকও বটে। তোমরা এর প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর আমার আয়াতসমূহ তুচ্ছমূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করো না। -সূরা বাকারা (২) : ৪১
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ اٰمِنُوْا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ.
হে কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে যে কিতাব (পূর্ব থেকে) আছে, তার সমর্থকরূপে (এবার) আমি যা (অর্থাৎ কুরআন) নাযিল করেছি, তোমরা তাতে ঈমান আন। -সূরা নিসা (৪) : ৪৭
অর্থাৎ কুরআন ও কুরআনের নবী সম্পর্কে যেহেতু আগে থেকেই তোমাদের জানা আছে, তাই সে জানার দাবি হল, আর সকলের আগে তোমরাই ঈমান আনবে। কিন্তু আহলে কিতাব, বিশেষত ইহূদী জাতি তাদের সে জ্ঞানের দাবি অনুযায়ী কাজ করেনি; উল্টো তারা আরবজাতির প্রতি ঈর্ষাকাতর হল এবং সেই ঈর্ষাবশে কুরআন ও কুরআনের নবীকে অস্বীকার করল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَ لَمَّا جَآءَهُمْ كِتٰبٌ مِّنْ عِنْدِ اللهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ یَسْتَفْتِحُوْنَ عَلَی الَّذِیْنَ كَفَرُوْا فَلَمَّا جَآءَهُمْ مَّا عَرَفُوْا كَفَرُوْا بِهٖ ؗ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَی الْكٰفِرِیْنَ بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهٖۤ اَنْفُسَهُمْ اَنْ یَّكْفُرُوْا بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ بَغْیًا اَنْ یُّنَزِّلَ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ عَلٰی مَنْ یَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ فَبَآءُوْ بِغَضَبٍ عَلٰی غَضَبٍ وَ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمْ اٰمِنُوْا بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا نُؤْمِنُ بِمَاۤ اُنْزِلَ عَلَیْنَا وَ یَكْفُرُوْنَ بِمَا وَرَآءَهٗ وَ هُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمْ.
যখন তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে এমন এক কিতাব আসল, যা তাদের কাছে (পূর্ব থেকে) যা আছে তার (অর্থাৎ তাওরাতের) সমর্থন করে (তখন তাদের আচরণ লক্ষ করে দেখ), যদিও পূর্বে তারা কাফেরদের (অর্থাৎ আরব পৌত্তলিকদের) বিরুদ্ধে (এ কিতাবের মাধ্যমে) আল্লাহর কাছে বিজয় প্রার্থনা করত, কিন্তু যখন সেই জিনিস আসল, যাকে তারা চিনত তখন তাকে অস্বীকার করে বসল। সুতরাং এমন কাফেরদের প্রতি আল্লাহ তাআলার লানত। কতই না নিকৃষ্ট সেই মূল্য, যার বিনিময়ে তারা নিজেদের আত্মাকে বিক্রি করেছে। তা এই যে, তারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে কেবল এই অন্তর্জালার কারণে অস্বীকার করছে যে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহের কোনও অংশ (অর্থাৎ ওহী ও কিতাব) নিজ বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা (অর্থাৎ আরবীয় নবীর প্রতি) কেন নাযিল করবেন? সুতরাং তারা (তাদের অন্তর্দাহের কারণে) গযবের উপর গযব নিয়ে ফিরল। বস্তুত কাফেরগণ লাঞ্ছনাকর শাস্তিরই উপযুক্ত। যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যে কালাম নাযিল করেছেন তার প্রতি (অর্থাৎ কুরআনের প্রতি) ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরা তো কেবল সেই কালামের উপরই ঈমান আনব, যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ তাওরাত)। আর এছাড়া সবকিছু তারা অস্বীকার করে। অথচ তাও সত্য এবং তা তাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থনও করে। -সূরা বাকারা (২) : ৮৯-৯১
কুরআন মাজীদে এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা প্রমাণ করে এ কিতাব পূর্বের আসমানী কিতাবসমূহের মৌল শিক্ষার সমর্থক। এ দ্বারা একদিকে যেমন সেইসব কিতাবের সত্যতা প্রমাণিত হয়, সেই সংগে কুরআন মাজীদ যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে প্রেরিত কিতাব তাও প্রমাণ হয়ে যায়। কেননা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন উম্মী ও নিরক্ষর ব্যক্তি ছিলেন। পূর্বেকার আসমানী কিতাবসমূহে কী কী বিষয় আলোচিত হয়েছে তা তার জানার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তিনি যখন কুরআনের আয়াতে সেইসব কিতাবের শিক্ষা তুলে ধরেছেন, তখন স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তা আল্লাহর নিকট থেকে ওহী মারফতই জানতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি একজন নবী এবং তিনি যা আবৃত্তি করে শোনান তা আল্লাহর কিতাব। তো ইহূদী ও খ্রিস্টান জাতি যখন দেখতে পাচ্ছে কুরআন তাদের কিতাবের সমর্থন করে আর তা দ্বারা এ কিতাবের সত্যতা এবং এর নবীর নবুওত প্রমাণ হয়ে যায়, তখন তাদের কর্তব্য হয়ে যায় শেষনবী ও তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান আনা। কুরআন মাজীদও এই যুক্তিসম্মত ডাকই তাদেরকে দিয়েছে। কিন্তু তারা আরবজাতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। কিতাবধারী হওয়ার কারণে তারা নিজেদেরকে দুনিয়ার অন্যসব জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করত। তারা জ্ঞানের অহমিকায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব তাদের বাইরে নিরক্ষর আরবদের কাছে আসবে আর ঈমান এনে তারা সেই নিরক্ষরদের সাথে এক কাতারভুক্ত হয়ে যাবে, এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না। এই অহমিকাজনিত বিদ্বেষই তাদের ধ্বংস করে। ফলে তাদের অল্পকিছু সংখ্যক ছাড়া অধিকাংশই ঈমানের বাইরে থেকে যায়। না কুরআনকে আসমানী কিতাব বলে স্বীকার করে আর না হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত মেনে যায়। বস্তুত এটাই হয় অহংকারীর অনিবার্য পরিণাম। তার পক্ষে কখনও সত্য মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। অহংকার তার সামনে এক দুর্লংঘ্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সংরক্ষক
কুরআন মাজীদের গুণ-বৈশিষ্ট্য-
وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مُهَیْمِنًا عَلَیْهِ.
এবং (হে রাসূল!) আমি তোমার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি তার পূর্বের কিতাবসমূহের সমর্থক ও তার সংরক্ষকরূপে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৮
অর্থাৎ কুরআন মাজীদ যেমন সাক্ষ্য দেয় তাওরাত, ইন্জীল প্রভৃতি কিতাব আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত, মানুষকে পথ দেখানোর জন্য সেগুলো বিশেষ-বিশেষ নবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, তেমনি এ কিতাব সেগুলোর শিক্ষা-সংরক্ষকও বটে। সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়েছে এ কারণে যে, ওইসব কিতাবকে বারবার মতলববাজদের উঞ্ছবৃত্তির শিকার হতে হয়েছে। তার অনুসারীরা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য তাতে অনেক রদবদল ঘটিয়েছে। এমনসব কথা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা আদৌ আসমানী তালিমের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। দ্বীনের সাম্য ও সম্প্রীতির বাণীকে তারা ক্ষুণ্ন তো করেছেই, তদুপরি যেই তাওহীদের শিক্ষা নিয়ে নবী-রাসূলগণ দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন, তাকেও পর্যন্ত তারা বিকৃত করে ফেলেছে। কুরআন মাজীদ তাদের সেই দুষ্কর্মের প্রতি অংগুলীনির্দেশ করত সেগুলোর মৌলিক শিক্ষা ও প্রকৃত হিদায়াত কী ছিল তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। ফলে কুরআন মাজীদের আপন হেফাজতের ভেতর দিয়ে সেসব কিতাবের হিদায়াত ও শিক্ষাও কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়ে গেছে। উদাহরণত হযরত ঈসা আ.-এর ঈশ্বরত্ব, পুত্রত্ব ও উপাস্য হওয়ার বিষয়টাকেই দেখা যেতে পারে। খ্রিস্টজাতি এটাকে তাদের ধর্মের মূল আকীদা বানিয়ে তাদের ধর্মগ্রন্থ ইন্জীলের ভেতরও একে প্রক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। ফলে প্রচলিত ইন্জীলের পাঠক যখন ইন্জীলের পৃষ্ঠা ওল্টায়, তার ভেতর সে এরকম শিক্ষাই পায় যে, হযরত ঈসা আ. ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন। (পিতা-পুত্র ও পাক কালাম) ঈশ্বরের (এই) তিন সত্তার এক সত্তা হিসেবে স্বয়ং ঈশ্বরও ছিলেন এবং ঈশ্বর হওয়ার কারণে তার পূজা-অর্চনা করা মানুষের কর্তব্য। এসব ধারণা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মানুষের মনগড়া সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন যে-কেউ তা এমনিতেই বুঝতে পারে। তা সত্ত্বেও আসমানী কিতাবের পবিত্রতা রক্ষার্থে সর্বশেষ কিতাব কুরআন মাজীদের মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, ওসব কথা মানুষের মনগড়া। এর বিপরীতে ইন্জীলের শিক্ষা কী ছিল কুরআন তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। হযরত মাসীহ আ.-এর যবানীতে কুরআন বলছে-
وَ قَالَ الْمَسِیْحُ یٰبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّیْ وَ رَبَّكُمْ اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ.
মাসীহ বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল, আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সংগে (কাউকে) শরীক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। -সূরা মায়িদা (৫) : ৭২
অর্থাৎ আমিও তোমাদেরই মত আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমার ও তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিকেরই ইবাদত কর। এভাবে তিনি নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলতেন এবং মানুষকে আল্লাহরই ইবাদতের দিকে ডাকতেন, নিজেকে ঈশ্বর বলতেন না এবং মানুষকে নিজেদের ইবাদত-উপাসনার দিকে ডাকতেন না, যেমনটা প্রচলিত ইন্জীল দ্বারা বোঝা যায়।
হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলা যখন বলবেন, ‘হে ঈসা ইবন মারয়াম! তুমি কি মানুষকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার মা’কেও মাবূদরূপে গ্রহণ কর?’ -সূরা মায়িদা (৫) : ১১৬
তখন ঈসা আ. বলবেন-
سُبْحٰنَكَ مَا یَكُوْنُ لِیْۤ اَنْ اَقُوْلَ مَا لَیْسَ لِیْ بِحَقٍّ اِنْ كُنْتُ قُلْتُهٗ فَقَدْ عَلِمْتَهٗ تَعْلَمُ مَا فِیْ نَفْسِیْ وَ لَاۤ اَعْلَمُ مَا فِیْ نَفْسِكَ اِنَّكَ اَنْتَ عَلَّامُ الْغُیُوْبِ مَا قُلْتُ لَهُمْ اِلَّا مَاۤ اَمَرْتَنِیْ بِهٖۤ اَنِ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّیْ وَ رَبَّكُمْ وَ كُنْتُ عَلَیْهِمْ شَهِیْدًا مَّا دُمْتُ فِیْهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّیْتَنِیْ كُنْتَ اَنْتَ الرَّقِیْبَ عَلَیْهِمْ وَ اَنْتَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ شَهِیْدٌ.
আমি তো আপনার সত্তাকে (শিরক থেকে) পবিত্র মনে করি। যে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, সে কথা বলার সাধ্য আমার ছিল না। আমি এরূপ বলে থাকলে আপনি অবশ্যই তা জানতেন। আমার অন্তরে যা গোপন আছে আপনি তা জানেন, কিন্তু আপনার গুপ্ত বিষয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে আপনি সম্যক জ্ঞাত। আপনি আমাকে যে বিষয়ের আদেশ করেছিলেন তা ছাড়া অন্য কিছু আমি তাদেরকে বলিনি। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তারপর আপনি যখন আমাকে তুলে নিয়েছেন তখন আপনি স্বয়ং তাদের তত্ত্বাবধায়ক থেকেছেন। বস্তুত আপনি সবকিছুর সাক্ষী। -সূরা মায়িদা (৫) : ১১৬-১১৭
এমনিভাবে খ্রিস্ট সম্প্রদায় আরও যত ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসমূলক কথা ইন্জীলে প্রক্ষেপণ করেছে, কুরআন মাজীদ তার ভ্রান্তি তুলে ধরে সেসব বিষয় থেকে আসমানী ইন্জীলের পবিত্রতা সংরক্ষণ করেছে। ইহূদী জাতি তাওরাত-গ্রন্থের মারাত্মক বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং তাতে এমনসব কথা জুড়ে দিয়েছে, যা আদৌ তাওরাতের অংশ নয়। কুরআন বলছে-
وَ قَدْ كَانَ فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَسْمَعُوْنَ كَلٰمَ اللهِ ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَهٗ مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.
তাদের একটি দল এমন ছিল, যারা আল্লাহর কালাম শুনত। তারপর তা ভালোভাবে বোঝার পরও জেনেশুনে তাতে বিকৃতি ঘটাত। -সূরা বাকারা (২) : ৭৫
তারা যে কেবল মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কিতাবের বিকৃতি ঘটাত তাই নয়; বরং নিজেদের পক্ষ থেকে কথা বানিয়ে তা কিতাবের ভেতর জুড়ে দিত। কুরআন বলছে-
فَوَیْلٌ لِّلَّذِیْنَ یَكْتُبُوْنَ الْكِتٰبَ بِاَیْدِیْهِمْ ثُمَّ یَقُوْلُوْنَ هٰذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِیَشْتَرُوْا بِهٖ ثَمَنًا قَلِیْلًا فَوَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا كَتَبَتْ اَیْدِیْهِمْ وَ وَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا یَكْسِبُوْنَ.
সুতরাং ধ্বংস সেই সকল লোকের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে, তারপর (মানুষকে) বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, যাতে তার মাধ্যমে কিঞ্চিৎ আয়-রোজগার করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা রচনা করেছে সে কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস এবং এবং তারা যা উপার্জন করেছে, সে কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস। -সূরা বাকারা (২) : ৭৯
এসব ইচ্ছাকৃত রদবদলের পাশাপাশি তাদের অবহেলাও ছিল চরম। তাওরাতের শিক্ষা অনুযায়ী আমল তো করতই না, উপরন্তু শিক্ষার চর্চা ও হেফাজতের ব্যাপারেও ছিল গাফিল। ফলে তাওরাতের বহু শিক্ষা তারা ভুলে গিয়েছিল এবং তাদের কাছ থেকে তা হারিয়ে গিয়েছিল। কুরআন বলছে-
یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ وَ نَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ .
তারা কথাসমূহ তার আপনস্থান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তার একটা বড় অংশ ভুলে যায়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৩
একইরকম উদাসীনতা প্রদর্শন করেছিল খ্রিস্টজাতিও। কুরআন বলছে-
وَ مِنَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّا نَصٰرٰۤی اَخَذْنَا مِیْثَاقَهُمْ فَنَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ .
যারা বলেছিল, আমরা নাসারা, তাদের থেকেও প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম। অতপর তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তার একটা বড় অংশ তারাও ভুলে যায়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৪
মোটকথা তাদের উদাসীনতা, মনগড়া ব্যাখ্যা ও শাব্দিক প্রক্ষেপণ- এ সকল প্রকারেই তাওরাত, ইন্জীল প্রভৃতি আসমানী কিতাবে প্রচুর রদবদল ও বিকৃতি ঘটে গেছে। সবশেষে কুরআন মাজীদ এসে তার নিশানদিহি করে দেয় এবং তার প্রকৃত শিক্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরে। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ قَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلُنَا یُبَیِّنُ لَكُمْ كَثِیْرًا مِّمَّا كُنْتُمْ تُخْفُوْنَ مِنَ الْكِتٰبِ وَ یَعْفُوْا عَنْ كَثِیْرٍ قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌ.
হে কিতাবীগণ! তোমাদের নিকট আমার (এই) রাসূল এসে পড়েছে, যে (তাওরাত ও ইন্জীল) গ্রন্থের এমন বহু কথা তোমাদের কাছে প্রকাশ করে, যা তোমরা গোপন কর এবং অনেক বিষয় এড়িয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের কাছে এক জ্যোতি এবং এমন এক কিতাব এসেছে, যা (সত্যকে) সুস্পষ্ট করে। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৫
অর্থাৎ তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও অবহেলার কারণে আসমানী কিতাবের যা-কিছু শিক্ষা পর্দার অন্তরালে চলে গিয়েছিল, তার মধ্যে যা দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করা জরুরি ছিল, প্রকাশ না করলে কর্ম ও বিশ^াসগত দিক থেকে দ্বীনী ক্ষতি অবধারিত ছিল, সেগুলো শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ করে দিয়েছেন, আর যেগুলো প্রকাশ না করলে কোনও ক্ষতির আশংকা ছিল না, তা তিনি এড়িয়ে গেছেন।
সারকথা কুরআন না হলে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে মানুষ চিরকাল অজ্ঞ থেকে যেত। এ কারণেই কুরআনকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সংরক্ষক বলা হয়েছে।
যিলহজ্ব ১৪৩৭ – সেপ্টেম্বর ২০১৬
মুহাররম ১৪৩৮ – অক্টোবর ২০১৬
মাসিক আলকাউসার