মার্চ স্বাধীনতার মাস। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ২৫ মার্চের কালোরাতের পরের দিন। ১৯৭১-এর এই দিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়। হয় পাকিস্তান থেকে আলাদা। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। ইতিহাসের এই নিকট-অধ্যায়ই সামনে নিয়ে আসে স্বাধীনতার দীর্ঘ শতাব্দীকালের ইতিহাস খুঁজে দেখার উপলক্ষ। সে-সূত্রেই আমাদের লক্ষ্য হয়- চেরাগ আলী গাজীর সন্ধান। তাঁর ইতিহাস ও ইতিহাসের পিঠস্থান ঘুরে দেখার প্রেরণা অর্জন। এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তিনি এক অমূল্য সম্পদ। অথচ উপেক্ষিত ও অজানা।
১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা। মাগরিবের কিছু পর। টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস। লক্ষ্য গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা। যানজটের ধাক্কায় আড়াইঘণ্টার মাথায় মাওয়া-পদ্মা। এরপর ফেরি। রাতের পদ্মা। চাঁদ ও শীতের কোমল ছোঁয়া। রাত দেড়টায় গওহরডাঙ্গা মাদরাসার সামনে। সঙ্গে রাহবার ও সহযোগী স্নেহভাজন মাওলানা মাসীহুল্লাহ। কড়া নাড়তেই ঘরের দরজা খুলে দিলেন একজন। মাসীহুল্লাহর মেঝোমামা। হাফেয মোস্তফা। হযরত আবদুল মান্নান কাশিয়ানী হুযুর রাহ.-এর মেঝো ছেলে। তার বাসায় রাতযাপন। তার বাসাতেই আপ্যায়ন। ফজরের কিছু পর হৃদয়-প্রশান্তির যিয়ারত। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার পশ্চিম প্রান্তে ছোট্ট কবরস্থান। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুজনের মাঝে তিনি শুয়ে আছেন। মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী- ছদর ছাহেব হুযুর রাহ.। দরদী ও ত্যাগী অভিভাবক। এ জাতির, এ উম্মাহর। বিলিয়ে বিলিয়েই ফুরিয়ে গেলেন। বিলিয়ে বিলিয়েই অনন্য হলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে প্রাণ ভিজে যায়। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। চেরাগ আলী গাজীর সন্ধানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ও জায়গার ব্যাপারে খোঁজ নিলাম। হাতে সময় থাকায় ঘুরে দেখার মতো দু-একটি জায়গা দেখেই কাজে নেমে পড়লাম।
সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন গওহরডাঙ্গার শিক্ষক মাওলানা মাকসুদুল হক, নবীন লেখক-আলেম মঈনুল ইসলাম। প্রথমেই দেখা করলাম শতবর্ষী মুহাম্মাদ আবদুস সোবহান খানের সঙ্গে। তার বাড়ির উঠানে। উদ্দিপ্ত অনর্গল তার কথাবলা। উপভোগ করলাম। এরপর মাসীহুল্লাহর সঙ্গে হেঁটে গেলাম মাদরাসার উত্তরদিকে। হযরত ছদর ছাহেব রাহ.-এর বড় ছেলে মরহুম হাফেয মাওলানা ওমর আহমদ ছাহেবের বাসায় একপাক গেলাম। কাছ থেকে দেখলাম মুফতি রূহুল আমীন সাহেবের বাসা। আর তাঁদের বাড়ির আরেকটু উত্তরদিকে আরো দু-তিনজন সূত্রের সঙ্গে দেখা করলাম। কথা বললাম। ঘুরে দেখলাম কিছু জায়গা জমি-মসজিদঘর। ঝোপঝাড়-প্রাচীন গোরস্থান। ব্রিটিশবিরোধী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, বালাকোট-মুজাহিদ চেরাগ আলী গাজীর অস্পষ্ট মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো। লিখিত ও নির্দিষ্ট অনেক তথ্যই এখন নেই। কিন্তু সূত্র ও শ্রুত বহু তথ্যই এখনো আছে। আছে আলামত ও পদচিহ্ন। দ্বীন ও স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত একটি খান্দানের সন্ধানই যেন পরিষ্কার হয়ে আসতে লাগল।
। দুই।
চেরাগ আলী গাজী রাহ.। তিনি কে ছিলেন? আরব তথা পশ্চিমের কোনো মুসলিম দেশ থেকে তার পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গের যশোরে এসে বসতি করেন। কোনো কোনো সূত্রে বলা হয় বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর সঙ্গের ১৭ জন সৈনিকের একজন ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। সেই পরিবারের এক উত্তরপুরুষ চাঁদ গাজী অষ্টাদশ শতাব্দীতে চলে আসেন বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা এলাকায়। দাওয়াতী ও দ্বীনী মেহনতের সূত্রে। এরপর ওই অঞ্চলে বিয়ে করেন এবং শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়দের সহযোগিতার সুবাদে সেখানেই বসতি গড়ে তোলেন। হিন্দু ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটিতে দ্বীনী দাওয়াতের কাজ করেন। পরবর্তীতে তাঁর ঘরে জন্ম নেয় চেরাগ আলী। সেই চেরাগ আলী গাজীরও প্রধান কাজ ছিল দ্বীনের পথে দাওয়াত ও দ্বীন কেন্দ্রিক বিভিন্ন মেহনত। পাশাপাশি ব্রিটিশবিরোধী জিহাদেও তিনি জড়িয়ে পড়েন। লোকজনকে সংগঠিত করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ব্রিটিশবিরোধী এক অমর মুজাহিদ ছিলেন তিনি। বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী চেরাগ আলী গাজী রাহ.। তাঁরই দ্বিতীয় স্তরের উত্তরপুরুষ (পৌত্র) ছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী-ছদর ছাহেব রাহ.। বিংশশতাব্দীর এক জগত-আলোকরা মনীষী।
বিভিন্ন কোষ (বাংলাপিডিয়া- উইকিপিডিয়া) ও তথ্যমূলক নিবন্ধে লেখা হয়- চেরাগ আলী সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রাহ.-এর শিখ-ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। জীবনীকার মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক রাহ. লিখেছেন- বালাকোটের শহীদ সাইয়েদ আহমদ বেরলভী রাহ.-এর জিহাদী কাফেলার দাওয়াত যখন বাংলাদেশে পৌঁছল তখন চেরাগ আলী গাজী সাহেব তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য-শাগরেদসহ ওই কাফেলায় যোগদান করে সাইয়েদ সাহেবের সাক্ষাতে হাজির হলেন এবং ইংরেজ বিরোধী জিহাদী স্পৃহা আরো শতগুণ বেড়ে যাওয়ায় কঠোর ট্রেনিং-এ যোগদান করে সাইয়েদ সাহেবের সাথে জিহাদী কাফেলায় সময় অতিবাহিত করতে লাগলেন। সাইয়েদ সাহেব বালাকোটে শাহাদাত বরণ করার পর চেরাগ আলী গাজী সাহেব জীবিত কয়েকজন সাথীদের সাথে কিছুদিন বিভিন্ন স্থানে অবস্থানের দীর্ঘদিন পর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মুরব্বিগণের নির্দেশে দেশে দাওয়াতের কাজে লেগে যান।’
। তিন।
তথ্য বিন্যাসের প্রয়োজনে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চেরাগ আলী গাজীর পৌত্র হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (ছদর ছাহেব) রাহ.-এর জন্ম ১৮৯৬ সালে। আর তাঁর ইন্তেকাল হয় ১৯৬৯ সালে। তাঁর পিতার নাম ছিল মুনশি আব্দুল্লাহ। তিনি ছিলেন মুনশি আব্দুল্লাহর ছোট ছেলে। তাঁর আপন বড় ভাইয়ের নাম ফযলুল হক। তাঁর একজন সৎ ভাইও ছিলেন। নাম হারেস। মরহুম ফযলুল হক সাহেবের শতায়ু ছেলে জনাব মঈনুদ্দিন এবং মরহুম হারেস সাহেবের নাতি সত্তরোর্ধ্ব হাবিবুর রহমানের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর পৈতৃক মূলবাড়ির ভিটায় (গওহরডাঙ্গা মাদরাসার উত্তরদিকে সামান্য ভেতরে) তারা বসবাস করছেন।
আনুমানিক হিসাবে যদি ধরে নেওয়া যায়, হযরত ছদর ছাহেবের জন্ম যখন হয়েছে তখন তার পিতার বয়স ৩৫/৪০ বছর, তাহলে তার পিতার জন্ম হয় ১৮৫৬/৬১ সালে। এটি একটি সম্ভাব্য আনুমানিক জন্ম তারিখ। হযরত ছদর ছাহেব হুযুরের পিতার জন্ম যদি উনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে হয় তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাঁর দাদা চেরাগ আলী গাজীর জন্ম কবে হতে পারে? কিংবা চেরাগ আলীর যুগ কোনটি? এ বিষয়ে সামান্য খোঁজখবর করে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়- সেটি হচ্ছে, চেরাগ আলী গাজীর ছিল দুই ছেলে। ছোট ছেলের নাম মুনশি আব্দুল্লাহ। যিনি ছদর ছাহেবের আব্বা। কিন্তু বড় ছেলের নাম স্থানীয়ভাবে বলা হয়, এদুন মুনশি। ওই ছেলে ছিলেন বড়। গওহরডাঙ্গার শতায়ু ও ছদর ছাহেব রাহ.-এর নিকট- সান্নিধ্যধন্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীবুর রহমানের তৃতীয় শ্রেণিতে থাকাকালীন সহপাঠী জনাব আব্দুস সোবহান খানের সঙ্গে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয়েছে। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন স্মৃতির অধিকারী ও শক্ত সমর্থ বর্ষীয়ান আব্দুস সোবহান খান বিভিন্নভাবে শ্রুত কিছু তথ্য আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদ গাজীর ছেলে চেরাগ আলী ছিলেন কাশিয়ানীর ধলইতলা গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে থাকাকালেই তাঁর প্রথম ছেলে এদুন মুনশির জন্ম হয়। সেখানে থাকাকালেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী জিহাদে জড়িয়ে পড়েন। আট-দশ বছর এভাবেই পার হয়ে যায়। পরবর্তীতে (বালাকোট বিপর্যয়ের পর) তিনি বাড়িতে (ধলইতলা) ফিরে এসে বিভিন্নভাবে জিহাদের কাজ করতে থাকেন। কিন্তু যখন আইনের লোকেরা তাঁর খোঁজে সেই ধলইতলার বাড়িতে বারবার হানা দিতে থাকে তখন এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে হিজরত করে কাশিয়ানী থেকে তিনি বর্তমান গওহরডাঙ্গায় চলে আসেন। এক অর্থে গওহরডাঙ্গায় এসে তিনি আত্মগোপন করেন। সে হিসেবে যদি তার দ্বিতীয় ছেলের জন্মের সময়টি ধরা হয় তার ৫০ বছর বয়সের কাল, তাহলে বালাকোটের অন্তত ২৪/২৫ বছর আগে তার জন্ম হওয়ার কথা। ওই হিসাব ধরে বালাকোট পূর্ববর্তী ৫/৭ বছরের সময়কালটি তাঁর জন্য ছিল একদম টগবগে যৌবনের সময়। বিপ্লব ও জিহাদের উপযোগী বয়স। বয়স ও পর্যায়ের এই হিসাবে কিছু গরমিল হলেও অবশ্য বিশেষ সমস্যা নেই।
শতবর্ষী আবদুস সোবহান খান বলেন, এই গওহরডাঙ্গা এলাকাটি ছিল পুরোপুরি গহীন একটি চরাঞ্চল। এখানে জনবসতি ছিল খুব কম। মানুষ সহজে এ তল্লাটে ভিড়তো না। বাঘ-ভাল্লুকের থাকতো যত্রতত্র আনাগোনা। সেজন্যে চেরাগ আলী গাজী ব্রিটিশ প্রশাসনের চোখের আড়াল বেছে নিতে এই এলাকায় চলে আসেন। এখানে এসেও তিনি দ্বীনী দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি জিহাদী ট্রেনিংয়ে বাছাইকরা লোকজনকে নিয়োজিত করেন। স্থানীয় নিবেদিত দ্বীনদার লোকেরা সংগ্রামী ও দাওয়াতী কাজে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা দান করে। আবদুস সোবহান খান বলেন, তার পরদাদা আবদুর রহিম খান ছিলেন চেরাগ আলী গাজীর একজন বিশিষ্ট সঙ্গী-সহচর। তিনি এ এলাকায় চেরাগ আলী গাজীকে বাড়িঘর করতে সহযোগিতা করাসহ জিহাদী কাজেও নানাভাবে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের সুযোগ হয়েছে চেরাগ আলী গাজীর প্রথম সন্তান এদুন মুনশির একজন চতুর্থ উত্তরপুরুষের সঙ্গে কথা বলার। তার নাম মোহাম্মদ জমিরুল ইসলাম। যুবক বয়সী। তার পিতার নাম নূর ঈমান মুনশি। নূর ঈমান মুনশির পিতা লোকমান মুনশি। আর লোকমান মুনশির পিতা এদুন মুনশি। অর্থাৎ চেরাগ আলী গাজী সাহেবের বড় ছেলে। অবশ্য জীবনীকার মরহুম মাওলানা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনা অনুযায়ী -গওহরডাঙ্গা অঞ্চলে প্রথমে এসে ঘরবসতি গড়ে তুলেন চেরাগ আলী রাহ.-এর পিতা মরহুম চাঁদ গাজী। তিনিই এখানে এসে বিয়ে করেন। চেরাগ আলী গাজীর জন্ম এই গওহরডাঙ্গাতেই হয়। পিতার দেখানো পথ অনুযায়ী চেরাগ আলী দ্বীনী দাওয়াতী কাজে নিমগ্ন থাকেন। এভাবেই একসময় জিহাদী কাজে (বালাকোট সংগ্রামে) জড়িত হয়ে পড়েন। পরে জিহাদী কাজে বিপর্যয়ের (বালাকোট বিপর্যয়) পর বিভিন্ন জায়গায় শিষ্যদের নিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে দেশে ফিরে আসেন। এবং পুনরায় বিভিন্নমুখি দাওয়াতী কাজে যুক্ত হয়ে যান।
এখানে কে প্রথমে এসেছেন? চাঁদ গাজী না চেরাগ আলী গাজী- তথ্যের এ অ-মিলটুকু বাস্তব বিষয়টি প্রমাণে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। সমকালীনতা ও পরিবেশ ইতিহাসের সেই বাস্তবতাকে বরং সমর্থনই দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, বালাকোট সংগ্রামে কিংবা বালাকোট কেন্দ্রিক জিহাদ আন্দোলনে চেরাগ আলী গাজীর সম্পৃক্ততা ইতিহাসের সূত্রেও পাওয়া যায়। পাওয়া যায় পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শ্রুত বর্ণনা এবং সমকালীনত্ব থেকেও।
। চার।
ইতিহাসে পরিচিত জিহাদ আন্দোলন নামে। বালাকোট আন্দোলনও বলা হয়। বলা হয়- আজাদি আন্দোলন। আরও কোনো কোনো নামেও ডাকা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারত-উপমহাদেশব্যাপি এক ব্যাপক ও সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উত্তর ভারতের হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.। ১৮৩১-এর ৬ মে বালাকোটে বড় রকম বিপর্যয় ঘটে গিয়ে আন্দোলনটি হোঁচট খায়। কিন্তু ইতিহাস বলে, পরবর্তীকালের সিপাহী বিপ্লবসহ আজাদির ছোট-বড় প্রতিটি সংগ্রামে এ আন্দোলন শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত নানা অবয়বে সক্রিয় ছিল। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা-ভারত থেকে বেনিয়া ব্রিটিশ ও মুসলিম-উৎপীড়ক দুর্বৃত্ত স্থানীয় ভিন্ন ধর্মানুসারী শাসক শক্তির কব্জা থেকে মুসলমানদের মুক্ত করা, স্বাধীন করা। এ অঞ্চলে একটি অখ- ও স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। শিরিকমুক্ত তাওহীদের অনুশীলনকারী মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ধ্বংসাত্মক বিদআত ও বিজাতীয় রুসম দূর করা। উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন গড়ে উঠলেও উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই তৎকালীন পূর্ববঙ্গেও এ আন্দোলন বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বালাকোটের আগে এবং পরে বহু মুজাহিদ এখান থেকে দূরে গিয়ে এবং এখানে অবস্থান করে দেশ-উদ্ধারের জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শাহাদাত-বন্দিত্ব ও আহত হওয়ার বহু ঘটনাও এ অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে। বিশেষত ১৮২২ সালে হজ্বপূর্ব সফরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ. যখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তখন পূর্ববঙ্গের বহু মুজাহিদ তাঁর সঙ্গে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর হাতে বাইআত হয়ে জিহাদে জড়িত হন। মহান মুজাহিদ নোয়াখালীর ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী রাহ.-এর নেতৃত্বে সেসময় অন্তত ৪০জন বাঙ্গালী মুজাহিদ কলকাতায় গিয়ে জিহাদের শপথ নেন- এ তথ্য দালিলিকভাবেই বিদ্যমান। এছাড়াও তাঁর নিজের এবং অন্যান্য মুজাহিদের চেষ্টায় পূর্ববঙ্গের বহু জেলায় এ আন্দোলনের কর্মী সংগ্রহ হয়। গড়ে ওঠে নীরব ঘাঁটি।
এরকম বহু ঘাঁটি ও ব্যক্তির গড়ে উঠার ঘটনা বালাকোটের আগে এবং পরেও অব্যাহত ছিল। উইলিয়াম হান্টারের ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের এ-জাতীয় বিদ্রোহী ব্যক্তি ও ঘাঁটির বিচিত্র বর্ণনা পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, বৃহত্তর ফরিদপুরে একক ব্যক্তি ও ঘাঁটিগুলোর তেমনই একজন ছিলেন হযরত চেরাগ আলী গাজী রাহ.। তাঁর আরো যেসব অনুসারী -অনুচর ছিলেন তাঁদেরও অনেকে এ আন্দোলনে আত্মনিবেদন করেছেন। সে সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে এখন আর কারো পক্ষেই উল্লেখ করার সুযোগ নেই। একইসঙ্গে চেরাগ আলী গাজীর এই জিহাদী তৎপরতা বালাকোটের আগে ছিল নাকি পরে- এটিও হয়তো পুরোপুরি মীমাংসা করে বলা এখন আর সম্ভব নয়। তিনি হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ. সূচিত জিহাদ ও আজাদির লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন- এটা মোটামুটি সাব্যস্ত ও পরম্পরাগতভাবেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁর ছোট ছেলের দিকের ছোট নাতির জন্ম যদি ১৮৯৫/৯৬ সালে হয় তাহলে তার পক্ষে ১৮৩১-এর আগে ও পরের এবং ১৮৫৭-এর আগে ও পরের সংগ্রামে যুক্ত থাকার সময়-সম্ভাবনাটি মোটামুটি প্রশ্নমুক্ত। বাকি তার নামের সঙ্গে ‘গাজী’ শব্দটির সংযোগ ইতিহাসের একটি উপলক্ষের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটি হলো, বালাকোটে যেসব মুজাহিদের শাহাদাত কিংবা প্রাণহানি ঘটেনি, যারা সেখান থেকে জীবিত বেঁচে এসেছেন তাদের নামের সঙ্গে এ শব্দটির সংযোগ স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়। যেমন গাজী আশেকুল্লাহ, গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী প্রমুখ। সে হিসেবে সম্ভাবনা এটিরও প্রবল যে তিনিও বালাকোটের জিহাদে শরিক ছিলেন; কিন্তু বেঁচে এসেছেন। সেজন্য তাকে ‘চেরাগ আলী গাজী’ নামে ডাকা হতো। অবশ্য শতাব্দীব্যাপী এ আন্দোলনে যুক্ত অনেককেই ‘মুজাহিদ’ অর্থেও ‘গাজী’ শব্দে ডাকা হয়েছে। সেরকম কিছুও তাঁর ক্ষেত্রে ঘটে থাকতে পারে। বালাকোটের মূল ঘটনায় কিংবা বালাকোট-আন্দোলনে (বালাকোটের আগে ও পরে) শরিক থাকার যে কোনো বিষয়ই তার ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। কোনো সম্ভাবনাই স্বাধীনতাসংগ্রামে তার অবদান ও অংশগ্রহণের বাস্তবতা ও তাৎপর্যকে ছোট করে না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাওলানা গোলাম রাসূল মেহের রাহ.-এর লেখা ‘জামাআতে মুজাহিদীন’ এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. রচিত ‘কারওয়ানে ঈমান ওয়া আযীমাত’ বইয়ে পূর্ববঙ্গের দু-একজন মহান মুজাহিদের নাম-পরিচিতি থাকলেও সবার নাম যে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি- এটা তাদের গ্রন্থের ভূমিকা এবং ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকেও বোঝা যায়।
আমাদের সাক্ষাৎদাতা বর্ষীয়ান আবদুস সোবহান খান বলেছেন, তিনি শুনেছেন, চেরাগ আলী গাজীর এখানে বছরের কোনো এক সময় বজরা নিয়ে মধুমতি নদী বেয়ে তাশরীফ আনতেন মাওলানা কারামাত আলী জৌনপুরী রাহ। যিনি ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর খলীফা। তিনি বালাকোট-পরবর্তী সময়ে দাওয়াত ও হেদায়েতের কাজেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। অপরদিকে উনবিংশ শতাব্দীর বালাকোট-আন্দোলন কিংবা সর্বভারতীয় জিহাদ আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত বাংলা অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিম) দুটি স্বতন্ত্র ও সমকালীন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনার নারিকেলবাড়িয়ায় হযরত বীর তিতুমির রাহ.-এর আন্দোলন ও বাঁশের কেল্লা নির্মাণের ইতিহাসটি প্রসিদ্ধ। তিতুমিরের নেতৃত্বে সংস্কার এবং অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী একাধিক যুদ্ধে জয় এবং শেষে বিপর্যয়ের বিয়োগান্তুক ঘটনা (১৮৩১- নভেম্বর) সবার জানা। ইতিহাসের সূত্র বলে, ১৮২২ সালে কলকাতা থেকে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর হজ্বের সফরে তিনিও শরিক ছিলেন। জিহাদ আন্দোলনের আদল ও বৈশিষ্ট্যেই তার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে।
একই রকম পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ফরিদপুরের অপরপ্রান্ত পদ্মার পাড়ে মাদারিপুরের শিবচরে (বাহাদুরপুর) হাজী শরীয়াতুল্লাহর নেতৃত্বে র্শিক-বিদআতবিরোধী সংস্কার আন্দোলন এবং মুসলিম কৃষক-প্রজা উৎপীড়ক জমিদার ও অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজশক্তির স্থানীয় আমত্যবর্গের বিরুদ্ধে জিহাদ রচিত হয়। পূর্ণ শক্তিতে এ আন্দোলন চলাকালে ১৮২০ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত বহুবার হাজী শরীয়াতুল্লাহ গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৮৪০-এর পর থেকে আন্দোলন আরো তুঙ্গে নিয়ে যান হাজী শরীয়াতুল্লাহর ছেলে দুদু মিয়া। চলে আরো বহু বছর। ফরায়েযী জামাতের নামে পরিচালিত এ আন্দোলনের সঙ্গে বালাকোটের জিহাদ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কোনো যোগসূত্র পাওয়া না গেলেও দুটিই ছিল সমকালীন ও সমবৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যে সংঘটিত আন্দোলন। এজন্য পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বালাকোট-আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফরায়েযী জামাতের যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনাও একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে জিহাদ আন্দোলন ও ফরায়েযী আন্দোলনের সম-সংগ্রামে অনেক রকম যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনাটি অপ্রাসঙ্গিক নয়। তখন ছিল নৌপথের যুগ। পদ্মা, আড়িয়ালখাঁ আর মধুমতির যোগসূত্রে কাছাকাছি অঞ্চলে একই রকম সংগ্রামে আত্মনিবেদন ও পারস্পরিক সহযোগিতার একটি অপ্রকাশ্য অথচ আলোকোজ্জ্বল দিগন্ত থেকেও যেতে পারে। হয়তো ইতিহাসের সেই দাস্তান আজানার ধুলায় ঢেকে আছে।
। পাঁচ।
প্রথমে একজন মুরব্বি জানালেন, চেরাগ আলী গাজী রাহ. এবং তাঁর ছেলে মুনশি আবদুল্লাহ ও ছেলে-বউয়ের কবর নদীতে ভেঙ্গে গেছে। এখানে কোথাও নেই। কথাটা শুনে কৌতূহল বেড়ে গেল। কোথায় কোনদিকে ছিল সেই গোরস্তান? অথবা কবর? একই সঙ্গে আরো কিছু তথ্য যদি পাওয়া যায়! বাড়িজুড়ে ঘুরছি। এ ঘর- ও ঘর। শতবছর পেরুনো বৃদ্ধ মঈনুদ্দীনের স্মৃতি কিছুটা ধুসর হয়ে এসেছে। তার সঙ্গে কথা বললাম। দেখা হলো, সত্তরোর্ধ্ব হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, এখানে এসে চেরাগ আলী গাজী রাহ. মানুষকে ইসলামী শিক্ষা দিতেন। কুরআন শরীফ পড়াতেন। আবার জীবিকার জন্য চাষবাসও করতেন। হাবিবুর রহমান আরেকটি ঘটনার কথা বললেন, চেরাগ আলী গাজী তখন জীবিত। একবার একটি গ-গোল হলো গওহরডাঙ্গায়। পুলিশ এল। ওই ঘটনায় দায়ী ছিল চেরাগ আলী গাজী সাহেবের কোনো সন্তান। পুলিশ এসেছে, এখন নানানজনের ওপর জুলুম করতে পারে। এটা শুনেই তিনি এগিয়ে গিয়ে জানালেন, দায় আমার ছেলের। শাস্তি দিলে তাকে দিন। অন্য কাউকে কষ্ট দেবেন না। তখন পুলিশ অবাক হয়ে গেল। নিজের ছেলেকে কেউ ধরিয়ে দেয়! সন্দেহ নেই, চেরাগ আলী গাজী রাহ. অনেক উঁচু আখলাক ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
আমরা যখন চেরাগ আলী গাজী রাহ. ও তাঁর সন্তানদের কবরের সন্ধানে ঘুরছি তখনই এলেন জমিরুল ইসলাম। তিনি বাড়ির একদম উত্তরে গাছগাছালির মধ্যে পুরনো মরচেপড়া টিনের একটি মসজিদ দেখালেন। সামনে ঝোপঝাড়ের মতো। ছোট্ট গোরস্থান। বোঝা যায়- যায় না। দুয়েকটি কবরের পিঠ একটু যেন উঁচু হয়ে আছে। এটাই প্রাচীন কবরস্থান। এ পরিবারের দেড়শ বছর আগের মুরব্বিদের অনেকেই এখানে শুয়ে আছেন। দেখেও তাই মনে হলো। ঘুরে ফিরে দেখলাম। শতভাগ নিশ্চয়তা তো সম্ভব নয়। পরিবারের পুরনো কবরস্থান হলে এখানেই গাজী সাহেবের কবর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমরা যিয়ারতের জন্য দাঁড়ালাম। হঠাৎ অদ্ভুৎ অনুভূতি হলো। তাহলে কি এখানেই, এই অজানা সবুজের ঝোঁপেই ইতিহাস শুয়ে আছে? শুয়ে আছে কিংবদন্তি? আমরা কি উদাসীন হয়েই থাকব? ইতিহাসের বীরপুরুষরা, স্বাধীনতা ও দ্বীনের মহান উৎসর্গিত সৈনিকরা কি আমাদের একটু শ্রদ্ধা, একটু ‘সালাম’ পেতে পারেন না!
জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৭ – মার্চ ২০১৬
মাসিক আলকাউসার