নবম শতাব্দী থেকে পনেরো শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় ভূমিদাস প্রথা চালু ছিল। এই ব্যবস্থা মধ্যযুগের পুরো সময়কালটায় ইউরোপবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন এবং তাঁদের আচার-আচরণ ও ভাবধারার উপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
ভূমিদাস প্রথা বিকশিত হয়েছিল তখন, যখন সম্পদ ও ক্ষমতার উৎস ছিল একমাত্র জমি। জার্মান অভিবাসনের সময় শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং এ সময় মূলত জমি-কেন্দ্রিক উৎপাদন গুরত্ব লাভ করায় জমির মালিকের নিকট ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হয়েছিল। সামন্ত প্রথার উৎপাদনের কাজে সামন্ত প্রভুদের কোনো ভূমিকা থাকত না। উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকত কৃষক ও ভূমিদাসগণ অথচ উৎপাদিত ফসলের এক বিরাট অংশ পেত সামন্ত প্রভুরা।
সর্বোপরি ভূমিদাস প্রথা বলতে আমরা বুঝি এমন কতগুলো প্রথা, বিধি ও ব্যবস্থার সমষ্টি যেখানে শক্তিশালী মানুষ দুর্বল মানুষকে সাহায্য করবে এবং এর বিনিময়ে দুর্বল মানুষ শক্তিশালী মানুষের সেবা করবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অধিকার-সচেতনতার ফলে ইউরোপে এই প্রথা লোপ পায়। তবে ভারত উপমহাদেশে এসে এই প্রথা কার্যকর করে তোলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি৷
ইংরেজরা প্রথমে বনিকের ছদ্মবেশে উপমহাদেশে আগমন করে রাজশক্তি নিজের হাতে কুক্ষিগত করে ৷ তারপর তারা মীর জাফরের বংশধরদের নামমাত্র নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসালেও প্রকৃত রাজক্ষমতা তথা দেশপরিচালনা করার ক্ষমতা নিজেদের অধীনে রাখত ৷
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পর ইংরেজরা নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের নীতি গ্রহণ করে ৷ এই সময় ইংরেজরা ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য বিশেষভাবে মনোযোগী হয় ৷ ভূমি কর আদায়ের জন্য তৈরি করা হয় সূর্যাস্ত আইন ৷ এর প্রথম ধাপে কোম্পানি-প্রশাসন একসনা (এক বছরীয় প্রদেয়) বন্দোবস্ত চালু করে ৷ দ্বিতীয় ধাপে তারা পাঁচসনা বন্দোবস্ত চালু করে ৷ তৃতীয় ধাপে দশসনা বন্দোবস্ত চালু করে ৷ সব শেষ ধাপে ১৭৯৩ সালের ২৩ শে মার্চ দশসনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রুপান্তরিত করা হয় ৷ ইংরেজরা সহজেই বুঝে ফেলে, দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আন্দোলনে তাদের কিছু এসে যাবে না৷ এবং এরা সাহসও করবে না৷ তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত রাখতে হলে বিত্তশীলদের খুশি রাখতে হবে৷ তারা ভোগ-বিলাসে মেতে থাকলে রাজকার্যে নাক গলাবে না।
তৎকালীন লোভী অসচেতন জমিদারদের সহায়তার ফলেই ইংরেজ-রাজ দুইশো বছর দীর্ঘায়িত হতে পেরেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎপাদিত এই ভূমিলোভী জমিদাররা তাদের ইংরেজ প্রভুদের কি রুপ সেবা করেছিল সে সম্পর্কে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বলেন ‘আমি এটা বলতো বাধ্য যে ব্যপক গণবিক্ষোভ অথবা গণবিপ্লব থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে ৷ অন্যান্য অনেক দিক দিয়ে এমনকি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যর্থ হলেও এর ফলে এমন এক বিপুল সংখ্যক ধনী ভূস্বামী সৃষ্টি হয়েছে যারা বৃটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে আগ্রহশীল এবং জনগণের ওপর যাদের অখণ্ড প্রভুত্ব বজায় আছে।’
জমিদাররা কেবল এর ফল ভোগই করেনি। বরং তা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। ১৮৭০ সালে তৎকালীন বৃহত্তর পাবনাতে কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর বিদ্রোহ সংগঠিত করে ৷ এটি দমন করতে জমিদার ও ইংরেজ সরকারকে চরম বেগ পেতে হয়েছিল ৷ এই সময় জমিদার বাবুরা একে অপরের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ৷ এর প্রেক্ষিতে জমিদার-সংঘের সৃষ্টি করে ৷
ইংরেজ কৌশল, চাপপ্রয়োগ এবং ইংরেজসৃষ্ট জমিদারদের অগাধ বিলাসিতার ফলে সাধারণ প্রজাশ্রেণির ওপর সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে আসে৷ দেশীয় শিল্প নষ্ট হয়। দুর্ভিক্ষ হয়। ইউরোপের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সঙ্গে যেমন ভূমিদাস প্রথা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ভারত স্বাধীনতার ইতিহাসেও তা সমানভাবে স্মরণীয়।
কাজী মাহবুবুর রহমান
মূলঃ fateh24