মানুষের প্রকৃতি হল মুখাপেক্ষিতা। তাই সে নিজ কাজ-কর্ম সম্পাদন করতে এবং প্রয়োজন পুরা করতে অন্যের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। তন্মধ্যে মুমিন বান্দা তার সকল কাজ সম্পাদনে নিজের সকল প্রয়োজনে কেবল আল্লাহর তা‘আলার দরবারেই প্রার্থনা করে। এতে অন্য কারো মধ্যস্থতা সে গ্রহণ করে না। কেননা মানুষের সকল প্রয়োজন আল্লাহ তা‘আলার কাছে রোনাজারি ও দু‘আর মাধ্যমেই পুরা হয় এতে কারো মধ্যস্থতার দরকার হয় না। এছাড়া হাদীসে এসেছে দু‘আ হল একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। অন্য হাদীসে এসেছে, দু‘আ ইবাদতের মগজ। তাই দু‘আর মাধ্যমে মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়ার সাথে সাথে এতে রয়েছে আরো বিশেষ ফায়দা। প্রত্যেক দু‘আর বিনিময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা সওয়াব লাভ হয়।
দু‘আর এই ফযিলত ও ফায়দা লাভ করতে হলে কিছু শর্ত ও আদাব রক্ষা করা জরুরী। সে সব শর্ত ও আদাবের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দু‘আ করলে দু‘আ কবুল হয় এবং দু‘আর দ্বারা পূর্ণ সুফল লাভ হয়। তন্মধ্য থেকে কিছু শর্ত ও আদাব এবং দু‘আ কবুল হওয়ার বিশেষ সময়ের কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
দু‘আ কবুল হওয়ার কিছু শর্তঃ
১. দু‘আকারীর পানাহার পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান হালাল হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে এলোমেলো চুল ও ধূসর দেহ নিয়ে আসমানের দিকে দু’ হাত তুলে বলতে থাকেঃ হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই হারাম অতএব তার দু‘আ কিরূপে কবুল হবে?” (সহীহ মুসলিম: ১০১৫)
২. বাহ্যিকভাবে কবুল হতে বিলম্ব হচ্ছে মনে হলে অধৈর্য্য না হওয়া। এবং এ কথা না বলা যে, আমি দু‘আ করেছিলাম কিন্তু তা কবুল হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের দু‘আ কবুল হবে যদি না তোমরা তাড়াহুড়া করো। এবং এ কথা না বলো যে, আমি দু‘আ করলাম কিন্তু তা কবুল হল না।” (মুসলিম: ২৭৩৫)
৩. প্রার্থিত বিষয় নাজায়েয কিছু না হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোনো মুসলমান যখন কোনো দু‘আ করে তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে হয়ত তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি দান করেন অথবা তার থেকে অনুরূপ অনিষ্টতা দূর করে দেন, যদি না সে কোনো গুনাহের জন্য অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দু‘আ করে।” (তিরমিযী: ৩৪৬৮, মুসনাদে আহমদ: ১১১৩৩)
৪. দু‘আ কবুল হওয়ার জন্য এও শর্ত যে, মুসলিম উম্মাহর মাঝে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে নিষেধ বিদ্যমান থাকা। কেননা ব্যাপকভাবে এ আমল বন্ধ হয়ে গেলে দু‘আ কবুল হওয়ার প্রতিশ্রুতি বলবৎ থাকে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে লোক সকল! আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে বলেছেন, তোমরা সৎকাজের আদেশ করো এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো এমন সময় আসার পূর্বে যখন তোমরা আমাকে ডাকবে কিন্তু আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো না। তোমরা আমার নিকট কিছু চাইবে কিন্তু আমি তা পূর্ণ করবো না। তোমরা শত্রুর বিরুদ্ধে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে কিন্তু আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো না।” (সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯০)
দু‘আর আদব সমূহঃ
১. উযুর সাথে মুনাজাত করা। (সহীহ মুসলিম: ২৪৯৮)
২. কিবলামুখী হয়ে মুনাজাত করা। (সহীহ বুখারী: ৩৯৬০, সহীহ মুসলিম: ৮৯৪)
৩. মুনাজাতের সময় সিনা বরাবর হাত তোলা এবং মুনাজাত শেষে চেহারায় হাত মোছা। (মুসনাদে আহমাদ: ১১০৯৩, আবু দাউদ: ১৪৮৫)
৪. দু‘আর পূর্বে কোনো নেক আমল করা। (সহীহ মুসলিম: ২৭৪৩)
৫. আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও খুব কাকতি-মিনতি করে এভাবে দু‘আ করা যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে দিয়েই দাও, আমার তো আর কোনো রব নেই, তুমি কবুল না করলে আমার কোনো উপায় নেই। এভাবে বিনয়ের সাথে বারবার বলতে থাকা। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৮৭১)
৬. দু‘আর শুরুতে ও শেষে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা এবং ‘আমীন’ দ্বারা দু‘আ শেষ করা। (আবু দাউদ: ১৪৮১, তিরমিযী: ৩৪৭৬)
৭. এই ইয়াকীন ও বিশ্বাসের সাথে মুনাজাত করা যে, আমি যা চাইলাম আমার মাওলা নিশ্চিত আমাকে তা দিবেন। (বুখারী: ৬৩৩৯, মুসলিম: ২৬৭৮)
৮. নিম্নস্বরে কায়মনোবাক্যে মুনাজাত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা তোমাদের প্রভুকে কায়মনোবাক্যে ও অনুচ্চস্বরে ডাকো, নিশ্চয় তিনি সীমা-লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (আল আ’রাফ: ৫৫)
৯. মুনাজাতে কান্নাকাটি করা। কান্না না আসলে কান্নার ভান করা। (মুসলিম: ২০২, ইবনে মাজাহ: ৪১৯৬)
১০. সকল মুমিনের জন্য দু‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আপনি আপনার নিজের ভুলের জন্য ইস্তিগফার করুন এবং সকল মুমিন নর-নারীদের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” (সূরা মুহাম্মদ: ১৯)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “যে ব্যক্তি মুমিন নর-নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রত্যেক নর-নারীর বদলায় তার আমলনামায় একটি করে নেকী লেখা হয়। (ত্ববারানী; মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ২১৫৫, মাজমাউয যাওয়াইদ: ১০/২১০)
১১. প্রথমে নিজেকে দিয়ে দু‘আ শুরু করা। হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কারো আলোচনা করে তার জন্য দু‘আ করতে চাইতেন তখন প্রথমে নিজের জন্য দু‘আ করতেন, এরপর আলোচিত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করতেন।
১২. কোনো গুনাহের কাজ সম্পন্ন হওয়ার দু‘আ না করা। নাজায়েয কোনো কিছুর জন্য দু‘আ না করা। এসব দু‘আ তো কবুল হয়ই না বরং ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
দু‘আ কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু সময়
১. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর।
বি.দ্র. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। তবে এই মুনাজাত নামাযের অংশ নয় এবং এখানে ইমামের ইত্তিবা’ বা অনুসরণ নেই। সুতরাং যারা বলে, ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা আবশ্যক তাদের কথা যেমন সহীহ নয় তেমনি যারা দাবি করেন যে, ফরয নামাযের পর কোনো মুনাজাতই নেই তাদের কথাও সহীহ নয়। বিস্তারিত জানতে এ বিষয়ে আমার লেখা ‘ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের শর‘ঈ বিধান’ কিতাবটি পড়ে নিতে পারেন।
২. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে। (আবু দাউদ: ৫২১, তিরমিযী: ২১২)
৩. রাতের শেষভাগে। (তিরমিযী: ৩৪৯৯)
৪. জুমআর দিন খুতবার মাঝে কিংবা আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ে। (বুখারী: ৯৩৫, মুসলিম: ৮৫২)
৫. যমযমের পানি পান করার সময়। (মুসনাদে আহমদ: ১৪৮৪৯, ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)
৬. শরী‘আত সম্মত যিকিরের মজলিসে থাকা অবস্থায়। (বুখারী: ৬৪০৮, মুসলিম: ২৭২৯)
৭. সিজদা অবস্থায়। মুমিন বান্দা এ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার অতি নিকটে চলে যায়। (সহীহ মুসলিম: ৪৮২)
৮. অসুস্থ ব্যক্তির নিকট দু‘আ করার সময়। কারণ তার নিকটে গিয়ে যা বলা হয় এর উপর ফেরেশতারা ‘আমীন’ বলতে থাকে। (সহীহ মুসলিম: ৯১৯)
৯. বৃষ্টির সময়। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ২/১১৪)
১০. জিহাদের ময়দানে যুদ্ধরত অবস্থায়। (আবু দাউদ: ২৫৪০, সুনানে দারেমী: ১২০০)
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আর শর্ত ও আদাবের প্রতি লক্ষ্য রেখে দু‘আ কবুলের বিশেষ মুহূর্তগুলো সহ সব সময় বেশি বেশি দু‘আ করার তাউফীক দান করুন। আমীন।