তিনি বসবাস করতেন সেই ইয়েমেন দেশে। বিখ্যাত দাউস গোত্রের একজন সদস্য ছিলেন তিনি। ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি সব ফেলে হিজরত করে চলে এসেছেন মদীনা মুনাওয়ারায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে। সপরিবারে। মদীনায় এসে নবীজীর সাথে সাথেই থাকতেন তিনি। সবসময়।
বল তো কার কথা বলছি? বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথাই আলোচনা করছি। পরিবার বলতে মা-ই ছিলেন একমাত্র তাঁর আপনজন। আর মায়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও টান ছিল ভিন্ন রকম।
সে সময় তাঁর খুব অভাব ছিল। যেহেতু তিনি সবসময় নবীজীর দরবারেই পড়ে থাকতেন, নবীজী যখন যা-ই বলতেন মুখস্থ করে নিতেন, ফলে আয়-উপার্জনের কোনো সুযোগ ছিল না তাঁর। ক্ষুৎ-পিপাসাকে সঙ্গী করেই চলতে হত তাঁকে। তাই বলে অভাবে তো আর মহব্বতে ছেদ পড়ে না।
একবার তিনি মসজিদের দিকে রওয়ানা হলেন। মসজিদে নববীর সামনে দেখলেন- কিছু লোক জটলা বেঁধে আছে। এগিয়ে গেলেন তিনি। তারা দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন-
-আবু হুরায়রা! কী জন্য এলে এখানে?
-ক্ষুধায় আর টিকতে পারছি না। বের হলাম- দেখি কী হয়!
-ও আল্লাহ! আমরাও তো ক্ষুধার কারণেই এখানে সমবেত হয়েছি।
দয়ার নবীর দুয়ার বলে কথা! সবাই মিলে হাজির হল নবীজীর দুয়ারে। রহমতের নবী ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-এ মুহূর্তে তোমরা এখানে?!
-ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ… আমাদের হালত!
-আচ্ছা! এ-ই খেজুরের থালাটা নিয়ে আস তো।
নবীজী থালা থেকে সবার হাতে দু’টি করে খেজুর তুলে দিচ্ছেন।
-খেজুর দুটো খেয়ে পানি পান করে নিও তোমরা। আজ আর সারাদিন ক্ষুধা লাগবে না তোমাদের।
নবীজী দিচ্ছেন আর একথা বলছেন।
হযরত আবু হুরায়রাও হাত পেতে দু’টো খেজুর নিলেন বটে। কিন্তু খেলেন মাত্র একটি। অপরটি রেখে দিলেন। নবীজী এমনিতেই তো আবু হুরায়রাকে অনেক মহব্বত করতেন। দেখে ফেললেন- আবু হুরায়রা করছেটা কী!
আওয়াজ এল-
-আবু হুরায়রা, আরেকটা তুলে রাখছ কী জন্যে?
-ইয়া রাসূলাল্লাহ! বাড়িতে মা আছেন। এটি তাকে দিব।
-না না। দু’টোই তুমি খাও। তোমাকে আমি আরো দু’টো দিচ্ছি। মা’কে নিয়ে দিবে। ঠিক আছে!
(তবাকাতে ইবনে সা‘দ ৪/৩২৮; তারীখে ইবনে আসাকির ৫৮/৪৪০)
প্রচন্ড ক্ষুধায় কাতর। মুখে-পেটে কিছু দিবেন, এমন মুহূর্তেও তিনি মায়ের কথা ভুলতেন না।
যিনি মায়ের ক্ষুধার সামান্য কষ্ট বরদাশত করতে প্রস্তুত নন, বল, তিনি কি সেই মমতাময়ী মা ঈমান ছাড়া দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন, চিরকালের জন্য জাহান্নামে জ্বলবেন- এটা মেনে নিতে পারেন?!
সেই ইয়েমেন থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন। মুসলমান হয়েছেন। ভিটে-বাড়ি ফেলে রেখে হিজরত করেছেন মদীনা মুনাওয়ারায়। দুুনিয়াবী কায়-কারবারের ঝামেলা বাদ দিয়ে পড়ে রয়েছেন নবীজীর দরবারে। নবীজীর সান্নিধ্য গ্রহণ করেছেন। সাহাবী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মমতাময়ী মা জননী এখনও মুসলমান হননি। এ অবস্থায় যদি তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন তাহলে চিরদিনের জন্য তাকে জ্বলতে হবে জাহান্নামের দাউ দাউ আগুনে। বল, আবু হুরায়রা রা.-এর মতো মা-ভক্ত এমন সুপুত্র কীভাবে তা সহ্য করতে পারে!
হযরত আবু হুরায়রা রা. যে কতভাবে মা’কে বোঝাতেন! ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন! কিন্তু না, মা কবুল না করে ছাফ অস্বীকার করে বসতেন। তখন তাঁর আফসোসের আর সীমা থাকত না। তবুও তিনি হতাশ হতেন না। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আবার বোঝাতেন। হেকমতে-কৌশলে বোঝাতেই থাকতেন।
একদিন মা’কে খুব ভালোভাবে বুঝালেন। মা বুঝবেন তো দূরের কথা, উল্টো নবীজীর শানে এমনসব বললেন যে, আবু হুরায়রা রা.-এর মনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। হায়! আজ মা’কে দাওয়াত দিতে গিয়ে প্রিয় নবীর শানে এসব কী শুনতে হল! তাহলে কি আম্মাজানের নসীবে হেদায়েত নেই!!
চলে আসলেন নবীজীর দরবারে। আশা ও সান্তনার ঠিকানায়! হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর চোখ দু’টো লাল। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কেঁদে কেঁদে নবীজীর নিকট আরজ করলেন-
ইয়া রাসূলাল্লাহ! মা’কে তো সবসময়ই বুঝিয়ে আসছি। তিনি বুঝছেন না। কিন্তু ঘটনা হল- আজকে যখন বুঝাচ্ছিলাম, তিনি বুঝবেন তো দূরের কথা, উল্টো তিনি আপনার শানে এমনকিছু বলে বসলেন যে,… ।
ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার খেদমতে দরখাস্ত, আম্মাজানের হেদায়েতের জন্য একটু দুআ করে দিন!
নবীজী দরখাস্ত কবুল করলেন। দুআ করলেন- ‘আল্লাহুম্মাহদি উম্মা আবী হুরাইরাহ।’
‘আয় আল্লাহ! আপনি আবু হুরায়রার মা’কে হেদায়েত দিয়ে দিন।’
আবু হুরায়রা রা.-এর বিশ্বাস- যেহেতু নবীজী দুআ করে দিয়েছেন, অবশ্যই আল্লাহ তা কবুল করবেন।
ছুটলেন বাড়ির দিকে। বাড়ির দরজা ভেড়ানো। মা ভেতর থেকেই ছেলের পায়ের আওয়াজ পেয়ে বললেন,
-আবু হুরায়রা! বাবা, একটু বাইরে দাঁড়াও!
আবু হুরায়রা রা. বাইরে দাঁড়িয়েই শুনতে পাচ্ছেন পানির ঝপঝপ শব্দ। মা তড়িৎ গোসল সেরে পাক-পবিত্র কাপড় পরে দরজা খুলে বললেন- ‘আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহূ ওয়া রাসূলুহ।’ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।)
আরে এ কী হল! আবু হুরায়রা রা. থ হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। এরপর আবার ছুটে গেলেন রহমতের নবীর খেদমতে। এখনও গাল বেয়ে তাঁর অশ্রু ঝরছে। কিন্তু এ অশ্রু বেদনার নয়; আনন্দের অশ্রু।
-ইয়া রাসূলাল্লাহ, বড় খোশখবরী! বড় খোশকিসমতী!! আল্লাহ তাআলা আপনার দুআ কবুল করেছেন। আবু হুরায়রার মা’কে হেদায়েত দিয়েছেন।
-আলহামদুু লিল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। সকল কৃতজ্ঞতা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য।
নবীজীর দুআর বরকতে উম্মে আবু হুরায়রা চির শান্তির ঠিকানা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। অর্জন করলেন সাহাবী হওয়ার মর্যাদা। এখন আমরা তাঁর নাম নিলেই বলি- রাযিআল্লাহু আনহা (আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন)।
এটা ছিল নবীজীর মুজেযা। নবীজীর এসকল মুজেযা দেখে দেখে হযরত ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকত। আর পরবর্তীতে সেগুলো শুনে শুনে মুমিন বান্দাদের ঈমানও তাজা হতে থাকে। নবীজীর দুআর তাৎক্ষণিক এ প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন দেখে হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর ঈমান আরো বেড়ে গেল। তিনি নবীজীর কাছে আবার (দুআর) আবদার করে বসলেন-
-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি দুআ করুন, আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে ও আমার মা’কে সকল মুমিনের নিকট প্রিয় বানিয়ে দেন। আর সকল মুুমিনকে আমাদের নিকট প্রিয় করে দেন।
নবীজী দুআ করলেন- ‘আয় আল্লাহ! আপনার এ বান্দাকে ও তার মা’কে আপনার মুমিন বান্দাদের কাছে প্রিয় বানিয়ে দিন। আর এদের নিকট আপনার মুমিন বান্দাদেরকে প্রিয় করে দিন।’
আবু হুরায়রা রা. বলেন, এর পর থেকে সকলেই আমাকে মহব্বত করতে থাকে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৯১)
আচ্ছা বল তো, আমি তুমি কি কখনও হযরত আবু হুরায়রা রা.-কে দেখেছি? কোনোদিনই দেখিনি। অথচ নবীজীর এ প্রিয় সাহাবীর জন্য আমাদের দিলে কত মহব্বত! এজন্যই তো আবু হুরায়রা রা.-এর নামের সাথেও আমাদের অন্যরকম এক হৃদ্যতা। এটা হল নবীজীর সেই দুআর বরকত।
মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর
রবিউল আউয়াল ১৪৪০ – ডিসেম্বর ২০১৮
মাসিক আলকাউসার