হিজরী দ্বিতীয় শতকের একজন বিশিষ্ট মনীষী আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ.। তিনি ইমাম মালিক রাহ., ইমাম আবু ইউসুফ রাহ., ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. প্রমুখ মুজতাহিদ ইমামের সাহচর্য লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ ইলমের দুই বিখ্যাত কেন্দ্র মদীনা ও কুফার উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেছিলেন। ইমাম মালিক রাহ.-এর দরবারে সময় ভাগ করা ছিল। দিনের শুরুতে মদীনাবাসী শায়খগণ তাঁর দরসে বসতেন, এরপর মিসরের শায়খরা , এরপর অন্যদের সুযোগ আসত। আসাদ ইবনুল ফুরাত তৃতীয় দলের সঙ্গে প্রবেশের অনুমতি পেলেন। কিন্তু অল্প দিনেই ইমাম মালিক রাহ.-এর সুদৃষ্টি লাভ করেন এবং দ্বিতীয় দলের সঙ্গে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে যান।
ইমাম মালিক রাহ.-এর দরস অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ হত। তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদরাও বেশি প্রশ্ন করার সাহস পেতেন না। তাদের অনুরোধে আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ. ইমাম মালিক রাহ. কে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। আসাদ বলেন, ‘আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম ও অন্যশায়খরা আমাকে প্রশ্ন করতে বলতেন।’ আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম রাহ. ছিলেন ইমাম মালিক রাহ.-এর শীর্ষস্থানীয় মনীষীশাগরিদদের অন্যতম। পরবর্তীতে এঁর মাধ্যমে ইমাম মালেক রাহ.-এর ফিকহ সংকলিত হয়েছে।
আসাদ ইবনুল ফুরাতের মধ্যে ফিকহ ও ইজতিহাদের প্রতিভা লক্ষ করে ইমাম মালিক রাহ. তাকে ইরাকে যাবার পরামর্শ দিলেন। সে সময় কুফায় ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বিদ্যমান ছিলেন। আসাদ ইবনুল ফুরাত এই দুই ইমামের শীষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। তবে তাঁর প্রতিভা বিকাশে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর অবদান ছিল বেশি।
আসাদ বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর কাছে আবেদন বললাম, আমি একজন পরদেশী, আর আপনার বেশি আলোচনা শোনার সুযোগ আমার হয়নি। ইমাম মুহাম্মাদ বললেন, ‘তুমি দিনে সবার সঙ্গে আমার মজলিসে বসবে এবং রাতে তোমাকে বিশেষভাবে সময় দিব।’ আসাদ বলেন, রাতে যখন আমার চোখ ঘুমে ভেঙ্গে আসত এবং আমি ঝিমুতে থাকতাম তখন তিনি আমার চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতেন!
একদিন ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. তাকে পথের পার্শ্বে রাখা পথিকদের পানি পান করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখান থেকে পান করছে যে? আসাদ বললেন, ‘আমিও তো পথিক, পথেই আমার অবস্থান!’ এটা শুনে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. তাকে আশিটি দীনার দিলেন এবং বললেন, আমি এইমাত্র জানতে পারলাম যে, তুমি এইভাবে জীবন ধারণ করছ!
এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর ঘটনা আছে। আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ. যখন নিজ দেশে ফিরছিলেন তখন তার কাছে রাহা খরচও ছিল না। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কে আলোচনা করলেন এবং পরদিন তাকে যেতে বললেন। তবে যাওয়ার সময় যে উপদেশটি দিলেন তা মনে রাখার মতো। তিনি বললেন, ‘অমুক দিন তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাত করবে। তবে মনে রেখো, নিজেকে তুমি যে অবস্থানে রাখবে ঠিক তেমন আচরণই তোমার সঙ্গে করা হবে।’
যথাসময়ে তিনি সেখানে গেলেন। তাকে সম্মানের সঙ্গে বসানো হল এবং খাদিম একটি আবৃত রেকাবিতে কিছু খাবার এনে তার সামনে রাখল। তিনি ভাবতে লাগলেন এবং মেজবানের অনুপস্থিতিতে খাবার গ্রহণ করা অপমানজনক মনে করলেন। তবে অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে খাদিমকে বললেন, তুমি কষ্ট করে খাবারগুলো বহন করে এনেছ এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ, কিন্তু আমি একা খেলে কি তোমার মনিব খুশি হবেন? আসাদ বলেন, আমার কাছে চল্লিশ দিরহাম ছিল। পুরোটাই ওই খাদিমকে হাদিয়া দিয়ে দিলাম এবং খাবারগুলো নিয়ে যেতে বললাম।
সে নিয়ে গেল। পরে জেনেছি যে, ওই ব্যক্তি এই বৃত্তান্ত শুনে বললেন, ‘খোদার কসম, ইনি তো অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ।’
পরে তিনি দশ হাজার দিরহাম মঞ্জুর করেন এবং পুনরায় তার সঙ্গে সাক্ষাত করার অনুরোধ জানান। সবশুনে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বললেন, ‘তুমি যদি পুনরায় সাক্ষাত করতে তাহলে তোমাকে তাদের খাদিম হয়ে যেতে হত। যা তোমার জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে এতেই তোমার চলবে এবং দেশে ফিরে তুমি মানুষের খিদমতে আত্ম নিয়োগ করবে।’
ইতিমধ্যে ইমাম মালিক রাহ.-এর ইন্তেকাল হল। তাঁর ইন্তেকালে গোটা কুফা যেন মুষড়ে পড়ল। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. ছিলেন কুফার সর্বজনপ্রিয় ইমাম। আসাদ বলেন, আমি তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য বললাম, কুফার আলিমদের মধ্যেও ইমাম মালিক রাহ. এত শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র কেন? তিনি তো বহু বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন?
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘খামুশ! তিনি হাদীসশাস্ত্রে আমীরুল মুমিনীন ছিলেন।’
এরপর আসাদ রাহ. মিসরে গেলেন। ইমাম মালিক রাহ.-এর বিশিষ্ট ছাত্র আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াহব রাহ.-এর কাছে আরজ করলেন, এই দেখুন, ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর কিতাবসমূহ, আপনি কি এই বিষয়গুলোতে ইমাম মালিক রাহ.-এর মত আমাকে জানাবেন? ইবনে ওয়াহব সম্মত হলেন না। এরপর তিনি আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম রাহ.-এর নিকটে এসে একই আবেদন করলেন। ইবনুল কাসিম রাহ. রাজি হলেন এবং ফিকহে মালিকীর সুবিস্তৃত সংকলন প্রস্ত্তত হল। এই কিতাবগুলো ‘আলমাসাইলুল আসাদিয়্যাহ’ নামে প্রসিদ্ধ।
ইমাম আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম রাহ. দিনে ও রাতে দুই খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ. যখন তাকে অনুরোধ করলেন তখন তিনি বললেন, তোমার জন্য এক খতম কুরআন তেলাওয়াত কমিয়ে দিচ্ছি যাতে ইলমের এই সংকলন প্রস্ত্তত হয়।
রচনা ও সংকলনে তাঁর নিপুণতা এমন ছিল যে, যে গ্রন্থের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত হত তার মূল্য অনেক গুণ বৃদ্ধি পেত। অতি উচ্চমূল্যেও পাঠক ওই গ্রন্থ সংগ্রহ করত।
ইমাম আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ. যখন নিজ দেশে ফিরে এলেন তো দেশ-বিদেশের অসংখ্য শায়খে তার মজলিস গমগম করত। তাদের মধ্যে ইরাকের শায়খরা যেমন থাকতেন তেমনি থাকতেন মদীনার শায়খরাও। তিনি যখন ইরাকী ইমামদের মতামত আলোচনা করতে থাকতেন তখন মদীনার শায়খরা আবেদন করতেন, ‘আবু আবদুল্লাহ! এবার দ্বিতীয় বাতিটাও প্রজ্জ্বলিত করুন।’ ইবনুল ফুরাত রাহ. তখন মাদানী ইমামদের মতামতও সবিস্তারে আলোচনা করতেন।
তাঁর মাদানী শীষ্যদের মধ্যে সুহনূন রাহ.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘আলমাসাইলুল আসাদিয়্যাহ’ নামক গ্রন্থগুলো সংগ্রহ করেন এবং পুনরায় ইমাম আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম রাহ.-এর সঙ্গে সেগুলো আলোচনা করেন। এরপর সংযোজন-বিয়োজনের পর মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা’ প্রস্ত্তত করেন।
আমীর যিয়াদাতুল্লাহর আমলে ইমাম আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ. কাইরাওয়ানের কাযী নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রায় দশ বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর তাকে ‘ছিকিল্লয়াহ’ অভিযানে সেনাপতি রূপে প্রেরণ করা হয়। ইলম ও ফিকহের গভীর পান্ডিত্যের পাশাপাশি তিনি একজন বীর মোজাহিদও ছিলেন। মাত্র দশ হাজার সঙ্গী নিয়ে দেড় লক্ষ খৃষ্টান সৈন্যের মোকাবিলা করেন এবং আল্লাহ আআলার মদদ ও নুসরতে জয় লাভ করেন।
একজন বর্ণনাকারী বলেছেন, আমি দেখেছি, আসাদ ইবনুল ফুরাত রাহ.-এর হাতে জিহাদের পতাকা উড়ছে। আর তিনি সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করছেন। এই অভিযানে তিনি মারাত্মভাবে আহত হন এবং ২১৩ হিজরীতে কলম ও তরবারীর এই মুজাহিদ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
ছিকিল্লিয়া অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার আগে গোটা শহর যেন ভেঙ্গে পড়েছিল তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য। চারদিকে অশ্বের হেস্রাধ্বনি, অভিযানে প্রস্ত্তত সুসজ্জিত বাহিনী এবং উপস্থিত জনসমুদ্র প্রত্যক্ষ করে তিনি তাকবীর ও তাহলীল পাঠ করলেন এবং বললেন, জনমন্ডলি, আমার পিতা বা দাদা কেউ ক্ষমতাশালী ছিলেন না এবং এমন দৃশ্যও আমার পূর্বপুরুষদের কেউ অবলোকন করেননি। আজ আমি যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি এতে আমাকে সহায়তা করেছে আমার লেখনী। আপনারাও এর পিছনে আপনাদের শক্তি ও প্রতিভাকে মগ্ন করুন এবং ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে দ্বীন সংকলনে মনোযোগী হোন। আল্লাহ আপনাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা দান করবেন।’
তথ্য সূত্র : তারতীবুল মাদারিক ৩/২৯১-৩০৯; আদদীবাজুল মুযহাব পৃ. ১৬১; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৯/১৪-১৬; আল আ’লাম
সফর ১৪৩০ – ফেব্রুয়ারী ২০০৯
মাসিক আলকাউসার