সুলতানি আমলে বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রচার-প্রসার ছিল। শিক্ষা ছিল সামাজিক সম্মান অর্জনের মাধ্যম। বাংলার সুলতানরা তাই শুরু থেকেই শিক্ষার প্রসারে মনোযোগ দিয়েছেন। এমনকি ধনাঢ্যরাও পিছিয়ে থাকেননি।
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতো মক্তবে। প্রায় প্রতিটি মসজিদে এবং ধনী ব্যক্তিদের বাড়ির সামনে থাকত মক্তব। বাংলায় এসব মক্তবকে পাঠশালাও বলা হতো। সাধারণত চার বা পাঁচ বছর বয়সে শিশুদেরকে মক্তবে পাঠানো হতো।
ভারতবর্ষে সাধারণত বছর ও মাসের মিল রাখা হতো, যেমন চার বছর চার মাস বয়সে কিংবা পাঁচ বছর পাঁচ মাস বয়সে শিশুদেরকে মক্তবে পাঠানো হতো। শিক্ষক কোরআনের একটি আয়াত পাঠ করতেন, শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত। এভাবেই শুরু হতো শিশুর শিক্ষাজীবন। ধনীরা এই উপলক্ষে খাবারের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এই অনুষ্ঠানকে বলা হতো বিসমিল্লাহ-খানি। সেসময় ফার্সি ছিল রাজভাষা। ফলে সালতানাতের চাকরি পেতে হলে ফার্সি ভাষা জানা লাগত। মক্তবে আরবি ও ফার্সি পড়ানো হতো। হিন্দু শিশুরাও তাই মক্তবে পড়ত। সুলতানি আমলে অনেক হিন্দু কর্মকর্তা সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সাইয়েদ সোলাইমান নদভি তাঁর ‘হিন্দুয়ো কি তালিমি তরক্কি মে মুসলমান হুকুমরানো কি কোশিশে’ গ্রন্থে এমন অনেক হিন্দু কর্মকর্তার পরিচয় দিয়েছেন যাঁরা বাল্যকালে মক্তবে মুসলিম শিশুদের সাথে পড়াশোনা করেছেন।
সেকালে প্রতিটি মসজিদের জন্য লা খেরাজ ভূমির ব্যবস্থা ছিল। এই জমির আয় থেকে মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। সাধারণত মসজিদের ইমামই মক্তবে পড়াতেন। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষাদানই ছিল মূল পাঠ্যক্রম। কবি বিপ্রদাস লিখেছেন, মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে মক্তবে ওজু করা ও নামাজ পড়ার পদ্ধতি শেখানো হতো। এসময় হস্তলিপিও শেখানো হত।
প্রাথমিক শিক্ষার পরের ধাপটি ছিল মাধ্যমিক শিক্ষার। মাদরাসাসমূহে এই স্তরের পাঠ দেয়া হতো। সুলতানি আমলের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে প্রচুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ লিখেছেন, বখতিয়ার খলজি লখনৌতি জয়ের পর সেখানে মসজিদ মাদরাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন।
সুলতানি আমলের অন্য সুলতানরাও এই ধারা অব্যাহত রাখেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য লা খেরাজ জমি বরাদ্দ দেয়া হত। শিক্ষকদের জন্যও ভাতা নির্ধারণ করা হত। সুলতানি আমলে শিক্ষকদের এই ধরনের ভাতাকে বলা হতো মদদ-ই-মাআশ। সদরুস সুদুর ও শায়খুল ইসলাম নামে দুটি পদ ছিল। এই দুই পদে আসীন কর্মকর্তারা এসব মাদরাসা ও শিক্ষকদের দেখভাল করতেন। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রচুর লা খেরাজ জমি ওয়াকফ করে দেয়া হতো। নওগাঁর মহিসন্তোষে তকিউদ্দিন আরাবি প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার জন্য বরাদ্দ জমির পরিমাণ ছিল ২৭০০ একর। রাজশাহীর বাঘাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার জন্য ৪২টি গ্রাম দান করা হয়েছিল। এসব মাদরাসায় ছাত্ররা বিনা খরচে আহার, পোষাক, তেল, প্রসাধনী, পান্ডুলিপি নকল করার জন্য কাগজ-কলম–সবই পেত।
সেসময় ধনাঢ্যরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিতেন। এলাকার দরিদ্র ছাত্ররাও এই শিক্ষকের কাছে পড়ার সুযোগ পেত। সুলতানি আমলে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। তবে এখনো দুয়েকটি মাদরাসার নিদর্শন টিকে আছে। এর মধ্যে নওগাঁর মহিসুনে তকিউদ্দিন আরাবির মাদরাসার কথা বলা যায়। এই মাদরাসায় পড়েছিলেন বিহারের বিখ্যাত সুফি শারফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরির পিতা ইয়াহইয়া মানেরি। এই মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যামিতি, ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয় পাঠ্য ছিল। সেসময় মহিসুন ছিল সোহরাওয়ার্দি তরিকার সুফিদের আবাসভূমি।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে শায়খ শারফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক তথ্যমতে বাংলায় সর্বপ্রথম এখানেই হাদিসের দরস দেয়া হয়। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ দরসবাড়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। চাপাইনবাবগঞ্জে এখনো এই মাদরাসার অবকাঠামো টিকে আছে।
আবদুল করিম লিখেছেন, সুলতানি আমলে যেখানেই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হত সেখানেই একটা religious complex গড়ে উঠতো। মাদরাসার সাথে মসজিদ, খানকা, মাজার ও সরাইখানাও নির্মাণ করা হতো। কখনো কখনো শুধু মসজিদ ও মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করা হতো। সুফিরা মাদরাসা নির্মাণ করলে সাথে তাঁরা খানকাহও নির্মাণ করতেন।
এই মাদরাসাগুলো ছিল আবাসিক। ছাত্র-শিক্ষক সবাই-ই মাদরাসায় অবস্থান করতেন। জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের শিলালিপিতে তালিবুল ইলমদের জন্য ব্যয় করার কথা আছে। বিভিন্ন শিলালিপিতে মাদরাসাকে দারুল খাইরাত বা বিনাউল খাইরাত বলা হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায়, সুলতান ও আমিরদের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও মাদরাসা ও ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য ব্যয় করতেন। জাফর খানের মাদরাসার শিলালিপিতে দেখা যায় কাজি নাসির তাঁর ব্যক্তিগত অর্থ থেকে এই মাদরাসায় দান করেছিলেন।
এইসব মাদরাসায় সাধারণত কোরআন, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, তাসাউফ, নাহু-সরফ, ফিকহ, আদব ও অন্যান্য ইসলামী বিষয় পাঠ্য ছিল। এর পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, জ্যামিতি ও অন্যান্য বিষয়ও পড়ানো হতো। এই অঞ্চলে গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যয়ন করানো হতো। শরফনামা গ্রন্থে আমির সাহাবুদ্দিন হাকিম কিরমানি নামে চতুর্দশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি চিকিৎসকের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুলতান জামালউদ্দিন ফতেহ শাহ চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মুহাম্মদ বুদাই লিখিত হিদায়াতুর রমি বা তীর চালনার নির্দেশিকা বইটি অনেক মাদরাসায় পাঠ্য ছিল। এ থেকে বুঝা যায় কোথাও কোথাও প্রাথমিক পর্যায়ের যুদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হতো। অনেক মাদরাসায় ক্যালিগ্রাফি বা লিপিকলা শেখানো হতো।
সুলতানি আমলে মেয়েদের পর্দার কারণে সাধারণত তাদের পড়াশোনা প্রাথমিক স্তর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। বালিকাদেরও বিসমিল্লাহখানি অনুষ্ঠান করা হতো। তারা বালকদের সাথে একত্রে মক্তবে পড়াশোনা শুরু করত। অভিজাত পরিবারের মেয়েরা তাদের ঘরেই কোনো শিক্ষকের কাছে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করতেন। আলেমগণ অবসরে তাদের কন্যাদেরকে শিক্ষা দিতেন।
সেকালে শিক্ষকরা সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিক্ষকের হাতে সন্তানকে তুলে দিয়ে পিতামাতা নিশ্চিন্ত হতেন। ছাত্ররাও শিক্ষকের প্রতি প্রচণ্ড ভক্তি ও শ্রদ্ধা অনুভব করত।
রাজদরবারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের লা খেরাজ জমি ও ভাতা দেয়া হতো। ছাত্ররা শিক্ষকদের সাংসারিক কাজকর্মেও সাহায্য করত। মাদরাসার শিক্ষকরা সামাজিক বিভিন্ন বিষয়েও জড়িয়ে যেতেন। যেমন বিয়েশাদি ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিচালনা।
ছাত্রদের অনুপস্থিতি, পাঠে অমনোযোগ, বেয়াদবি ইত্যাদিকে দোষ হিসেবে গণ্য করা হতো। এজন্য তাদেরকে শাস্তি দেয়া হত। কখনো বেত্রাঘাত করা হত, কখনো অন্য শারিরিক শাস্তি দেয়া হতো।
প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মেঝেতে খড়িমাটি দিয়ে লিখত। এরপর তারা কলাপাতা, তালপাতা এসবে লিখত। কলম হিসেবে ব্যবহার করত বাঁশের কঞ্চি, পাখির পালক বা নলখাগড়ার টুকরো। ছাত্ররা বসত মেঝেতে বা ঘর থেকে নিয়ে আসা মাদুরে। ছাত্ররা নিজেরাই লেখার কালি তৈরি করত। হরিতকি ও প্রদীপের নির্বাপিত ফুলকা দ্বারা তারা যে কালি তৈরী করত তা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকত।
তথ্যসূত্র
১. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস- ডক্টর এম এ রহিম। বাংলা একাডেমী।
২. মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য- আবদুল করিম। কাকলী প্রকাশনী।
৩. মহিসন্তোষ-সুলতানী আমলে হারিয়ে যাওয়া একটি নগরী- মো আবদুল করিম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24