১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ। নদীয়া।
দুপুর। নিজের প্রাসাদে মধ্যাহ্ন-ভোজনে ব্যস্ত রাজা লক্ষণ সেন। আচমকা শোরগোলের শব্দ শোনা গেল বাইরে। শোরগোল ক্রমেই এগিয়ে আসছে। রাজা খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে কী হচ্ছে দেখা দরকার। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো এক ভৃত্য। ‘তুর্কিরা আক্রমণ করেছে।’ কোনোমতে বললো সে। শুনে লক্ষণ সেন আতংকে কাঁপতে থাকেন। পণ্ডিতরা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তুর্কিরা নদীয়া জয় করবে। তাঁরা রাজাকে বলেছিলেন পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদস্থানে চলে যেতে। লক্ষণ সেন তাঁদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে রাজমহলের তেলিয়াগড় দুর্গে সেনা সমাবেশ করেন। কিন্তু পণ্ডিতরা ছিলেন আতংকিত। তাঁরা রাজাকে ছেড়ে একেকজন একেকদিকে চলে যান।
তুর্কিরা রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি চলে এসেছে, এর মানে হলো তারা তেলিয়াগড় দুর্গ জয় করে এসেছে। সুতরাং লক্ষণ সেনের আর কোনো আশা নেই। বৃদ্ধ রাজা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁকে কী করতে হবে। এখুনি পালাতে হবে। তিনি প্রাসাদের পেছনদিকে চলে গেলেন। মৃত্যুভয়ে ভীত রাজা খালি পায়েই প্রাসাদ থেকে বের হলেন। নদীপথে রওনা হলেন রাজধানী বিক্রমপুরের দিকে।
২.
লক্ষণ সেনের ধারণা ভুল ছিল। তুর্কিরা তেলিয়াগড় দুর্গ জয় করে আসেনি। তারা এসেছিল ঝাড়খন্ডের দুর্ভেদ্য জঙ্গল অতিক্রম করে। সেনাপতি বখতিয়ার খলজি, খাটো আকৃতি আর কুৎসিত চেহারার কারণে যিনি মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে পারেননি, তিনি জানতেন লক্ষণ সেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে। তাই তিনি তেলিয়াগড়ের পথ না ধরে ঝাড়খন্ডের জঙ্গল অতিক্রম করে নদীয়ার দিকে অগ্রসর হন। তাঁর বাহিনীর পুরো অংশই পেছনে পড়ে যায়। তিনি ১৮ জন সেনাসহ নদীয়ায় এসে উপস্থিত হন। লোকসংখ্যা কম দেখে প্রথমে স্থানীয়রা তাঁদের ঘোড়া-ব্যবসায়ী মনে করেছিল। কিন্তু দ্রুতই বখতিয়ারের মূলবাহিনী এসে উপস্থিত হয়। রাজা আগেই পালিয়ে গেছেন, বখতিয়ারের বাহিনী কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই নদীয়া জয় করে ফেলে। তিনদিন পর বখতিয়ার নদীয়া থেকে আহরিত ধন-সম্পদ নিয়ে লক্ষণাবতী বা গৌড়ে চলে যান। সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন।(১)
৩.
বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। অবশ্য বখতিয়ারের রাজ্যের সীমানা ছিল পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট থেকে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত। এর বাইরে বাংলার বিস্তৃত এলাকা তখনও মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বখতিয়ার কোনো স্বাধীন শাসক ছিলেন না, তিনি নিজের জন্য সুলতান উপাধিও নেননি। বরং তিনি মুহাম্মদ ঘুরির নামে মুদ্রা চালু করেন। গৌড় জয়ের পর বখতিয়ার খলজি রাজ্যশাসনের দিকে মনোযোগ দেন। এসময় তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন। ঢেলে সাজান প্রশাসনিক কাঠামো।(২)
৪.
বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয়। কিন্তু এটিই বাংলায় মুসলমানদের প্রথম আগমন নয়। বাংলায় মুসলমানদের আগমন শুরু হয়েছে অনেক আগে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে। সম্প্রতি লালমনিরহাটে ৬৯ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হওয়ায় এই দাবি আরও শক্তিশালী হয়েছে। প্রায় সকল ঐতিহাসিক একমত, আরব ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলা অপরিচিত ছিল না। খ্রিষ্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীতে রচিত আরব ভূগোলবিদদের (ইবনে খুরদাদবা, সুলাইমান তাজির, আল ইদ্রিসি) বইপত্রে চট্টগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসময় বাণিজ্যিক কারণে আরব ব্যবসায়ীরা বাংলায় সফর করতেন। প্রথমযুগের মুসলিমরা অন্তরে তীব্র দাওয়াতি স্পৃহা লালন করতেন। এইসকল আরব বণিককে নিছক ব্যবসায়ী ভাবলে ভুল হবে। ব্যবসার পাশাপাশি তাঁরা একইসাথে এককেজন মুবাল্লিগ বা ধর্মপ্রচারক হয়ে উঠতেন। ফলে তাঁদের মাধ্যমে বাংলার অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। ড. এম এ রহিম ও ড. এনামুল হক মনে করেন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরব বণিকরা বসবাসও করেছিলেন। এই দুই অঞ্চলের ভাষা ও রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা এই অনুমান ব্যক্ত করেন।(৩)
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে খলিফা হারুনুর রশিদের আমলের একটি মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে ড. এনামুল হক প্রাচীন বাংলায় মুসলমানদের আগমনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন (৪)। অর্থাৎ বখতিয়ারের আগমনের আগেও বাংলায় মুসলমানরা এসেছিলেন। এবং তাঁদের দ্বারা স্থানীয়রা অবশ্যই কিছু না কিছু প্রভাবিত হয়েছিল।
৫.
বখতিয়ার খলজি মারা যান ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে। এর কিছুদিন আগে তিনি তিব্বতের ব্যর্থ অভিযান থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। বখতিয়ারের পর খলজিরা কিছুকাল বাংলা শাসন করেন। শুরুর দিকে তাঁরা দিল্লির সুলতানদের আনুগত্য করতেন। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে আলি মর্দান খলজি স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুলতান উপাধি নেন। তিনি ছিলেন লখনৌতির প্রথম স্বাধীন সুলতান। ১২১২ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় বসেন ইওজ খলজি। তিনি জনকল্যাণমূলক অনেক কাজ করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলায় নৌবাহিনী গঠন করেন। নিজের নামে মুদ্রা চালু করেন। এসবের পাশাপাশি রাজ্যবিস্তারেও মনোনিবেশ ছিল তাঁর। চারদিকে নিজের রাজত্বের সীমানা খানিক বৃদ্ধি করেন। তিনি তাঁর পূর্বের শাসক আলি মর্দান খলজির মতো স্বাধীন শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেননি। ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুতমিশ লখনৌতি আক্রমণ করেন। যুদ্ধ শেষে দুপক্ষে সন্ধি হয়। ইওজ খলজি ইলতুতমিশের বশ্যতা স্বীকার করলেও ইলতুতমিশ ফিরে গেলে তিনি আবার নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।
১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ নাসিরুদ্দিন মাহমুদ লখনৌতি আক্রমণ করলে ইওজ খলজি পরাজিত ও নিহত হন। আবদুল করিমের মতে, তিনি লখনৌতির মুসলিম রাজ্যকে বাংলার মুসলিম রাজ্যে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দিল্লির সুলতান বৈরীভাব পোষণ না করলে তিনি হয়তো সফল হতেন।(৫)
ইওজ খলজির মৃত্যুর পর নাসিরুদ্দিন মাহমুদ লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন। লখনৌতি আবারও দিল্লির অধিনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লখনৌতি দিল্লির অধীনে শাসিত হতে থাকে। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর বুগরা খান লখনৌতিতে স্বাধীন বলবনি সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। আবারও লখনৌতি দিল্লির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় বসেন বুগরা খানের ছেলে রুকনুদ্দিন কায়কাউস। তিনি রাজত্বের সীমানা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করেন। জয় করেন হুগলি জেলার ত্রিবেনী। পরবর্তী শাসক শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ এই সীমানা আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি সোনারগাঁ জয় করেন। ১৩০৫ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁ টাকশাল থেকে উতকীর্ণ একটি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ময়মনসিংহ ও সিলেট জয় করেন। সিলেট অভিযানকালে তাঁর সাথে বিখ্যাত সুফি ব্যক্তিত্ব শাহ জালাল মিলিত হন। সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহের সময় একদিকে রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি পেয়েছিল অপরদিকে এসময় বাংলায় ইসলাম প্রচারের গতিও বেড়ে যায়। বিশেষ করে হজরত শাহজালালের কারণে সিলেট অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়।
দিল্লিতে তখন চলছিল ক্ষমতার পালাবদল। খলজিদের পতনের পর ক্ষমতায় আসে তুঘলকরা। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিয়াসুদ্দিন তুঘলক। ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লখনৌতি আক্রমণ করেন। তিনি বাংলাকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করেন–লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁ। প্রতিটি প্রদেশে পৃথক গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁর গভর্নর বাহরাম খান মারা গেলে তাঁর বর্মরক্ষক ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ স্বাধীন সোনারগাঁ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের নামে মুদ্রা চালু করেন। চট্টগ্রাম জয় করেন। চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি সড়কও নির্মাণ করেন।
৬.
১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ। সে বছর লখনৌতির শাসক আলাউদ্দিন আলি শাহকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসলেন হাজি ইলিয়াস। সিংহাসনে বসে তাঁর নাম হলো শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তিনি ইলিয়াস শাহি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশ প্রায় ৭০ বছর বাংলা শাসন করেছিল।
শুরুতে ইলিয়াস শাহ শুধু লখনৌতির শাসক ছিলেন। সোনারগাঁ শাসন করতেন স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ। সাতগাঁও শাসন করতেন দিল্লির অনুগত গভর্নর। ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ সাতগাঁও আক্রমণ করে দখলে নেন। সেখানে নিজের নামে মুদ্রা চালু করেন। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সোনারগাঁ আক্রমণ করে ইখতিয়ারুদ্দিন গাজিশাহকে পরাজিত করেন। এর ফলে ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলার শাসক হন। এর আগে আর কেউ পুরো বাংলার সুলতান হতে পারেননি। তাঁরা ছিলেন নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের শাসক। ইলিয়াস শাহের আমল থেকেই এই অঞ্চল বাংগালা নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। দিল্লির ঐতিহাসিকরাও তাঁকে শাহ-ই-বাংগালা, সুলতান-ই-বাংগালা উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নেপাল আক্রমণ করে অনেক ধনসম্পদ অর্জন করেন। পাশাপাশি কামরুপ, উড়িষ্যা ও বাহরাইচ জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলার অভিযানে আসেন। ইলিয়াস শাহের সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু যুদ্ধ হয়। কিন্তু চুড়ান্ত সাফল্য অর্জন ছাড়াই ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লি ফিরে যান। ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার মুসলিম সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সিকান্দার শাহ ক্ষমতায় বসেন। সিকান্দার শাহ অত্যন্ত যোগ্য শাসক ছিলেন। তাঁর সময়ে ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বিতীয় বার বাংলা আক্রমণ করেন এবং ব্যর্থ হন। ৩১ বছরের রাজত্ব শেষে ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এক লড়াইয়ে তিনি নিহত হন।
১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মসনদে আসীন হলেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ। তিনি ছিলেন সিকান্দার শাহের ছেলে এবং ইলিয়াস শাহের নাতি। উদার, চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ একজন সুশাসক হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। যৌবনে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও আবদুল করিমের মতে, তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার। একজন কবি ও বিদ্বান ছিলেন তিনি। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তাঁর পত্র-যোগাযোগ ছিল। ছিলেন বিখ্যাত সুফি-বুজুর্গ নুর কুতবুল আলমের সহপাঠি। মক্কা-মদিনায় লোক পাঠিয়ে মাদরাসা, মসজিদ ও সরাইখানা নির্মাণ করেন তিনি। বাংলার সুলতানদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
৭.
১৪১০ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহকে হত্যা করা হয়। এই হত্যায় গনেশ নামে তাঁর একজন হিন্দু সভাসদের হাত ছিল। গনেশ ক্ষমতায় বসায় নিহত সুলতানের ছেলে হামজাহ শাহকে। দুবছর পর, ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে গনেশ তাঁকেও হত্যা করে। এর সাথে বাংলায় ইলিয়াস শাহি শাসনের অবসান হয়। এই বংশের অবদান হলো তাঁরা বাংলাকে এক রাজদন্ডের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। সীমানাও বিস্তৃত করেছিলেন।
৮.
১৪১২ থেকে ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ–এই তিনবছর একজন ক্রীতদাস বাংলা শাসন করেছিলেন। তাঁর নাম শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ। ১৪২৫ সাতলে তাঁকে হত্যা করে গনেশ সরাসরি ক্ষমতায় বসে। এর ফলে দুশো বছর ধরে চলা মুসলিম শাসনের অবসান হয় এবং হিন্দু শাসনের সূত্রপাত হয়। রিয়াজুস সালাতিন-রচয়িতার বক্তব্য অনুসারে, গনেশ ক্ষমতায় বসেই মুসলমানদের উপর অত্যাচার শুরু করে। অনেককে সে হত্যা করে। বাধ্য হয়ে শায়েখ নুর কুতবুল আলম জৌনপুরের শাসক ইবরাহিম শর্কির কাছে পত্র লিখে গনেশের অত্যাচার সম্পর্কে জানান। সুলতান ইবরাহিম শর্কি বাংলা আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে গনেশ সিংহাসন ছেড়ে দেয়। তার পুত্র যদুকে ক্ষমতায় বসায়। যদু নুর কুতবুল আলমের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জালালুদ্দিন। জালালুদ্দিনকে ক্ষমতায় বসানোর কারণে ইবরাহিম শর্কি বাংলা আক্রমণ না করেই ফিরে যান। তিনি ফিরে যেতেই গনেশ আবার ক্ষমতায় বসে যায়। একটি বর্ণনামতে জালালুদ্দিনকে গনেশ বন্দী করে রাখে।
বাংলায় হিন্দু রাজত্বের সময়কাল আরও বাড়তে পারত, কিন্তু ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে গনেশের মৃত্যুর পর জালালুদ্দিন আবার ক্ষমতায় বসেন। তিনি রাজধানী গৌড়ে সরিয়ে নেন। মিসরের খলিফার কাছ থেকে সনদ নেন। গনেশ কর্তৃক নির্বাসিত শায়েখ জাহেদকে ফিরিয়ে আনেন। এছাড়া জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। তিনি চিন, মিসরে দূত পাঠান। তৈমুর লং-এর ছেলে শাহরুখের সাথেও যোগাযোগ করেন। একজন শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন যথার্থ। ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে শামসুদ্দিন আহমাদ শাহ তিন বছর রাজত্ব পরিচালনা করে। ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ক্ষমতায় আরোহণ করেন। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ছিলেন ইলিয়াস শাহি পরিবারের সদস্য। সুতরাং তাঁদের এই শাসনামলকে দ্বিতীয় ইলিয়াস শাহি শাসনামল বলা যায়। তাঁর শাসনামলে খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় খান জাহান বাগেরহাট জয় করেন। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাঁর মৃত্যর পর ক্ষমতায় বসেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। একজন শাসক ও সেনাপতি হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। তিনি ত্রিহুত ও বরিশাল জয় করেন। ১৪৭৪ খ্রিষ্টা ব্দে তিনি মারা যান। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে পরবর্তি ইলিয়াস শাহদের হটিয়ে হাবশিরা ক্ষমতা দখল করে নেয়। চারজন হাবশি সুলতান ৬ বছর বাংলা শাসন করেন। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাদের হটিয়ে হোসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
৯.
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রজাদরদি শাসক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নসরত শাহ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহের আক্রমণে গৌড়ের পতন হয়। হোসেন শাহি বংশকে সরিয়ে এবার ক্ষমতায় আসে আফগানরা। বাংলায় সূচনা হয় আফগান শাসনের। শেরশাহের বাংলা বিজয়ের সংবাদ শুনে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা আক্রমণ করেন। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহ চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন ভারত থেকে পালাতে বাধ্য হন। শেরশাহ দিল্লির মসনদে বসেন। বাংলাকে পরিণত করেন দিল্লি সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে। খিজির খানকে বাংলার গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়।
শেরশাহের ছেলে ইসলাম শাহের শাসনামলেও বাংলা ছিল দিল্লির নিয়ন্ত্রণাধীন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ বাংলার মসনদে বসেন। তিনি নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা দেন। এরপর তাঁর বংশের কয়েকজন শাসক শাসন করেন। ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানি গৌড় জয় করেন। তিনি কয়েকমাস শাসন করেন। এরপর ক্ষমতায় আসেন তাঁর ভাই সোলাইমান কররানি। দিল্লিতে ততদিনে মুঘলরা নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে। সম্রাট হুমায়ুন ফিরে এসে মারা গেছেন। ক্ষমতায় বসেছেন তরুন সম্রাট আকবর। সোলাইমান কররানি আকবরকে ক্ষেপিয়ে তোলার পরিবর্তে তাঁর সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তাই প্রথমদিকে আকবরও এদিকে আগ্রহ দেখাননি। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা গেলে তাঁর ছেলে দাউদ খান কররানি ক্ষমতায় বসেন। তাঁর সময়ে আকবরের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে বাংলার দিকে।
এদিকে দাউদ খান কররানিও নিজের নামে মুদ্রা ও খুতবা চালু করেন। ফলে আকবরের মেজাজ বিগড়ে যায়। দাউদ খানকে পরাস্ত করতে মুগল বাহিনী এগিয়ে আসে। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে আফগানরা মুঘলদের মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে মুঘলরা জয়ী হয়। দাউদ খান কররানিকে হত্যা করা হয়। সমাপ্ত হয় সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলা সুলতানি আমলের। সূচনা হয় মুঘল শাসনামলের। অবশ্য রাজমহলের যুদ্ধে জয়লাভ করেই মুঘলরা পুরো বাংলায় নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। সেজন্য তাদেরকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল।(৬)
টীকা
১। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), ৮২-৮৩ পৃষ্ঠা। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০১৩, ঢাকা।
২। প্রাগুক্ত, ৮৪ পৃষ্ঠা।
৩। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আকবর আলি খান এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে আরব বণিকেরা ছিল শাফেয়ী মাজহাবের সদস্য। সুতরাং তারা যদি এখানে বসতি স্থাপন করত তাহলে অবশ্যই এখানে শাফেয়ী মাজহাবের প্রাধান্য পাওয়া যেত। (বিস্তারিত জানতে দেখুন- বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য, ৬২-৬৩ পৃষ্ঠা- আকবর আলি খান। প্রথমা, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ, ঢাকা)। আকবর আলি খান যে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এ বক্তব্য দিয়েছেন তা খুব দূর্বল। । আকবর আলি খান শাফেয়ি মাজহাবের কথা বলছেন। ইমাম শাফেয়ির জন্ম ১৫০ হিজরিতে। লালমনিরহাটে আবিষ্কৃত মসজিদের শিলালিপিতে এর প্রতিষ্ঠাকাল লেখা আছে ৬৯ হিজরি। অর্থাত ইমাম শাফেয়ির জন্মের প্রায় একশো বছর পূর্বেই বাংলায় মুসলিমরা এসেছে এমনকি মসজিদও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। ইমাম আবু হানিফার জন্ম ৮০ হিজরিতে। ইমাম মালেকের জন্ম ৯৩ হিজরিতে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের জন্ম ১৬৪ হিজরিতে। অর্থাৎ মাজহাবের ইমামদের জন্মের অনেক আগেই বাংলায় মুসলিমরা এসেছিল। সে সময় যেহেতু মাজহাব চতুষ্টয়ের জন্মই হয়নি তাই তাদের কোনো মাজহাবের অনুসারী হওয়ার কথা নয়। অপরদিকে মসজিদ নির্মান থেকেই বুঝা যায় বাংলায় তখন ক্ষুদ্র হলেও দু একটি মুসলিম বসতি অবশ্যই গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া শুরুর দিকে অনেকগুলো মাজহাব ছিল । ইমাম যাহাবি অন্তত ৪০ জন ইমামের কথা লিখেছেন, যাদের নিজস্ব মাজহাব ছিল, অনুসারীও ছিল (বিস্তারিত জানতে দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮ম খন্ড, ৯১ পৃষ্ঠা- ইমাম যাহাবী। মুআসসাতুর রিওসালাহ, বৈরুত) । দেখা গেল প্রথমদিকে অনেকগুলো মাজহাবের প্রাধান্য ছিল। তাদের অনুসারীও ছিল। সুতরাং আরব বণিকরা বসতি স্থাপন করলে সবাইই শাফেয়ি হবে এটা বেশ কষ্টকল্পনা।
৪। আবদুল করিম অবশ্য তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে এই মুদ্রা অনেক পরে কেউ নিয়ে এসেছিল। দেখুন, বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, ৬২ পৃষ্ঠা।
৫। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭ খ্রি.), ২৯ পৃষ্ঠা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
৬। প্রাগুক্ত, ৫০-১২২ পৃষ্ঠা।
ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24