ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়
১। পুরুষের জন্য শরীর বা শরীরের কোনো অঙ্গের আকার অনুযায়ী তৈরিকৃত বা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা নিষিদ্ধ। যেমন : পাঞ্জাবি, জুব্বা, শার্ট, সেলোয়ার, প্যান্ট, গেঞ্জি, কোট, সোয়েটার, জাঙ্গিয়া ইত্যাদি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, মুহরিম কী কী কাপড় পরতে পারবে? তখন তিনি ইরশাদ করলেন, জামা, পাগড়ি, পাজামা, টুপি ও মোজা পরবে না। তবে চপ্পল না থাকলে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন- কেটে পরতে পারবে। তোমরা এমন কোনো কাপড় পরিধান করো না যাতে ‘জাফরান’ বা ‘ওয়ারছ’ লেগেছে।-সহীহ মুসলিম ১/৩৭২ মাসআলা : ইহরামের কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করে কিংবা জোড়া দিয়ে পরিধান করা যাবে। তবে ইহরামের কাপড় এ ধরনের সেলাইমুক্ত হওয়াই ভালো। -রদ্দুল মুহতার ২/৪৮১, শরহু লুবাবিল মানাসিক ৯৮
মাসআলা : ইহরাম অবস’ায় সেলাইযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করা ও বেল্ট বাঁধা নিষিদ্ধ নয়। তাবেয়ী উরওয়া রাহ. মুহরিমের জন্য টাকা-পয়সা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হেফাযতের উদ্দেশ্যে ব্যাগ ব্যবহার করা বৈধ মনে করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৬৯৯
তাউস রাহ. বলেন, মুহরিম কোমরবন্দ (বেল্ট) ব্যবহার করতে পারবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৬৮৯ ২। পুরুষের জন্য মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা নিষেধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, মুখমণ্ডল ও তার উপরের অংশ মাথার অন-র্ভুক্ত। অতএব ইহরাম গ্রহণকারী থুতনী থেকে উপরের দিকে আবৃত করবে না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৪৫২
এ প্রসঙ্গে মহিলাদের বিধান ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। তাদের জন্য মুখমণ্ডল আবৃত করা নিষেধ নয়। তবে মুখমণ্ডলে কাপড় লাগানো নিষেধ। তাই তারা পর পুরুষের সামনে এমনভাবে মুখমণ্ডল আবৃত করবেন যেন তাতে কাপড়ের স্পর্শ না লাগে।
৩। পুরুষের জন্য পায়ের পাতার উপরের উঁচু হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান করা নিষেধ। তাই এমন জুতা বা স্যান্ডেল পরতে হবে যা পরলে ওই উচু অংশ খোলা থাকে।-রদ্দুল মুহতার ২/৪৯০ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাদর, লুঙ্গি ও চপ্পল পরে ইহরাম বাঁধবে। যদি চপ্পল না থাকে তবে চামড়ার মোজা গীরার নিচ পর্যন- কেটে পরিধান করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৪৮৮১
৪। ইহরামের কাপড়ে বা শরীরে ইহরাম গ্রহণের পর আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। হযরত ইয়া’লা ইবনে উমাইয়্যা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জিঈররানা নামক স্থানে অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে এলেন, যার পরনে ছিল জাফরান মিশ্রিত এক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত জুব্বা। … রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, সুগন্ধির চিহ্ন দূর কর এবং জুব্বা খুলে ফেল।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৭৩
মাসআলা : সুগন্ধিযুক্ত তেল, যয়তূন ও তিলের তেলও লাগানো যাবে না। সুগন্ধি সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আতা রাহ. বলেন, ‘ইহরাম গ্রহণকারী তার শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধিযুক্ত তেল লাগালে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৮৩৩
মাসআলা : পৃথকভাবে সুগন্ধি জর্দা খাওয়াও নিষেধ। আর পানের সাথে খাওয়া মাকরূহ।-মানাসিক ১২১; আহকামে হজ্ব ৩৪ বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত কাসেম রাহ. মুহরিমের জন্য খাবারের সাথে সুগন্ধি জাফরান খাওয়া অপছন্দ করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩২৭৮
মাসআলা : ইচ্ছাকৃতভাবে ফল-ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া মাকরূহ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. মুহরিমের জন্য ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া অপছন্দ করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৮২৭ আবুয যুবাইর রাহ. বলেন, আমি জাবির রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইহরাম গ্রহণকারী কি ফুল বা সুগন্ধি শুঁকতে পারে? তিনি বললেন, না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৮২৮
৫। নখ কাটা কিংবা শরীরের কোনো স্থানের চুল, পশম কাটা বা উপড়ানো নিষেধ। হযরত আতা, তাউস ও মুজাহিদ রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়ীগণ বলেন, ‘মুহরিম তার বগলের নিচের পশম উপড়ালে বা নখ কাটলে তার উপর ফিদয়া দেওয়া ওয়াজিব হবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬০৪
৬। ইহরাম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা বা স্ত্রীর সামনে এ সংক্রান- কোনো কথা বা কাজ করা নিষেধ। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হজ্বের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ্ব করা সি’র করে অতঃপর হজ্বে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ।’-সূরা বাকারা : ১৯৭এক ব্যক্তি তাওয়াফে যিয়ারতের পূর্বে স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়ে গেল। তাদের সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি একটি উট জবাই করার নির্দেশ দিলেন।-মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ২৩৮
হযরত ইবনে আব্বাস রা.কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল যে, আমি ইহরামের হালতে কামভাবের সাথে নিজ স্ত্রীকে চুম্বন করেছি। এখন আমার করণীয় কী? তিনি উত্তরে বললেন, তুমি একটি কুরবানী কর।-কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ৫৩
৭। কোনো বন্য পশু শিকার করা বা শিকারীকে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের উপর স’লের প্রাণী শিকার করা হারাম করা হয়েছে যে পর্যন- ইহরাম অবস্থায় থাক।-সূরা মায়িদাহ : ৯৬
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইহরাম অবস্থায় স্থলভাগের শিকারকৃত প্রাণী তোমাদের জন্য হালাল যদি তা তোমরা নিজেরা শিকার না কর কিংবা তোমাদের উদ্দেশ্যে শিকার করা না হয়।-জামে তিরমিযী ১/১৭৩ হযরত আবু কাতাদাহ রা. বিদায় হজ্বে হজ্ব কাফেলার সাথে হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। কাফেলার সবাই ইহরাম অবস’ায় ছিলেন, কিন’ তিনি তখনো ইহরাম গ্রহণ করেননি। এ অবস্থায় একটি শিকারী প্রাণী দেখে তিনি তা শিকার করে ফেললেন। অতঃপর তা নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপসি’ত হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কেউ কি আবু কাতাদাহকে এই প্রাণীটি ইঙ্গিত করে দেখিয়েছ বা অন্য কোনোভাবে শিকার করতে সহযোগিতা করেছ? সবাই বলল, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তখন তিনি বললেন, তাহলে তোমরা তা খেতে পার।-সহীহ মুসলিম ১/৩৮১
৮। ঝগড়া-বিবাদ সাধারণ সময়েও নিষিদ্ধ। ইহরাম অবস্থায় তা আরো ভয়াবহ। কুরআন মজীদে আছে, ‘হজ্বের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ্ব করা সি’র করে অতঃপর হজ্বে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ।’-সূরা বাকারা : ১৯৭
হযরত জাবির ইবনে যায়েদ রাহ. আল্লাহ তাআলার বাণী ‘এবং না ঝগড়া-বিবাদ’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তোমার জন্য এই অবকাশ নেই যে, সঙ্গীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং তাকে রাগান্বিত করবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৩৯৪
৯। কাপড় বা শরীরের উকূন মারা নিষিদ্ধ।-আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৮৬-৪৯০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৪; মানাসিক ১১৭-১২০; গুনইয়াতুন নাসিক ৮৫ বিখ্যাত তাবেয়ী ইকরামা রাহ. কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইহরাম গ্রহণকারী তার কাপড়ে উকূন দেখতে পেলে কী করবে? উত্তরে তিনি বললেন, আলতোভাবে ধরে যমীনে রেখে দিবে, মেরে ফেলবে না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩২৯৭ মাসআলা : ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ তাতে লিপ্ত হওয়া গুনাহ। এর কারণে হজ্ব অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। উপরন’ কিছু বিষয় এমন রয়েছে যাতে লিপ্ত হলে ‘দম’ ওয়াজিব হয়। ইবরাহীম নাখাঈ রাহ. বলেন, বলা হত যে, যে ব্যক্তি হজ্বে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করল সে এর জন্য একটি পশু জবাই করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫১৯১
মাসআলা : আরাফায় অবস্থানের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলে হজ্ব নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গরু বা উট যবেহ করা ছাড়াও পরবর্তী বছর তা কাযা করা জরুরি।-আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৫৮-৫৫৯, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৪৪, মানাসিক ১১৭ এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এসে বলল, আমি ইহরাম অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছি। এখন আমার কী করণীয়? তিনি বললেন, তোমরা উভয়ে হজ্বের অবশিষ্ট আমলগুলো সম্পন্ন করবে। অতঃপর আগামী বছর এ হজ্ব কাযা করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩২৪৫
হযরত আলী রা. বলেন, স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের উপর একটি করে ‘বাদানা’ তথা গরু বা উট জবাই করা ওয়াজিব।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩২৫৯
এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, আমি ও আমার স্ত্রী মুহরিম ছিলাম। এ অবস’ায় আমি স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি (এখন আমাদের করণীয় কী?) ইবনে উমর রা. বললেন, তুমি হজ্ব নষ্ট করে ফেলেছ। তুমি ও তোমার স্ত্রী অন্যান্যদের সঙ্গে থাকবে এবং তাদের মতো হজ্বের (অবশিষ্ট) কাজ করতে থাকবে এবং তারা যখন ইহরাম থেকে মুক্ত হয় তখন তোমরাও মুক্ত হবে। অতঃপর আগামী বছর তুমি ও তোমার স্ত্রী হজ্ব করবে এবং ‘হাদি’ (জবাই করার পশু) নিয়ে আসবে। যদি তোমাদের হাদির সামর্থ্য না থাকে তাহলে হজ্বের মধ্যে তিনটি রোযা রাখবে এবং প্রত্যাবর্তনের পর সাতটি।-সুনানে কুবরা বায়হাকী ৫/১৬৭
মাসআলা : ইহরাম অবস্থায় মাথা ও মুখ ব্যতীত পূর্ণ শরীর চাদর ইত্যাদি দিয়ে আবৃত করা যাবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এক ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় সওয়ারীর পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু বরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তাকে বড়ই পাতা মেশানো পানি দিয়ে গোসল দাও এবং তার পরনের কাপড় দু’টি দ্বারা কাফন পরাও। তার চেহারা ও মাথা আবৃত করো না। কেননা সে কিয়ামতের দিন উত্থিত হবে তালবিয়া পড়তে পড়তে।-সহীহ মুসলিম ১/৩৮৪ মাসআলা : কান, ঘাড়, পা ঢাকা যাবে। মাথা ও গাল বালিশে রেখে শোয়া যাবে। তবে পুরো মুখ বালিশের উপর রেখে ঢেকে শোয়া যাবে না। -মানাসিক ১২৩-১২৪, গুনইয়াতুন নাসিক ৯৩
মাসআলা : ইহরাম অবস্থায় পান খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। তবে পানে সুগন্ধিযুক্ত মসলা বা জর্দা খাওয়া নিষিদ্ধ। বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত কাসেম রাহ. ‘মুহরিম’ ব্যক্তির জন্য খাবারের সঙ্গে সুগন্ধি জাফরানের মিশ্রণকে অপছন্দ করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩২৭৮
মাসআলা : ইহরাম অবস্থায় পানিতে ডুব দেওয়া যাবে।-গুনইয়াতুন নাসিক ৯১হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ‘জুহফা’ নামক স্থানে উপসাগরের পাশে ছিলাম। তাতে আমরা ডুব দিয়েছি। হযরত উমর তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন’ তিনি আমাদেরকে এজন্য দোষারোপ করেননি। আমরা ছিলাম ইহরাম অবস্থায়।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩০১৩