হজ্বের পদ্ধতি
হজ্বের ফরয তিনটি :
১। ইহরাম বাঁধা। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ২। উকূফে আরাফা। অর্থাৎ ৯ যিলহজ্ব সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী রাতের সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্বে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিন সকালে ফজর নামায পড়ে মিনা থেকে আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং আরাফায় পৌঁছে নামিরাতে অবস্থান করলেন। নামিরা হল আরাফার ঐ স্থান যেখানে ইমাম অবস্থান করেন। অতঃপর যখন যোহরের সময় হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রূত নামায আদায় করলেন। এখানে তিনি যোহর ও আসর একত্রে পড়লেন এবং খুতবা দিলেন। তারপর আরাফার মাওক্বিফের দিকে রওয়ানা হলেন এবং সেখানে উকূফ (অবস্থান) করলেন।-সুনানে আবু দাউদ ১/২৬৫ সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুবহে সাদিকের পূর্বে আরাফায় অবস্থান করতে সক্ষম হল সে হজ্ব পেল।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৮৬১
৩। তাওয়াফে যিয়ারত। ১০ যিলহজ্ব থেকে ১২ তারিখ সূর্যাসে-র আগে এ তাওয়াফ সম্পন্ন করতে হবে। হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন তাওয়াফে যিয়ারত করেছেন অতঃপর মিনায় এসে যোহর আদায় করেছেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪২২
হজ্বের ওয়াজিবসমূহ এই-
১। উকূফে মুযদালিফা। ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিকের পর হতে সূর্যোদয় পর্যন্ত- সময়ের ভিতর সামান্য সময় মুযদালিফায় অবস’ান করলেও এ ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। হযরত উরওয়াহ ইবনে মুযাররিছ রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুযদালিফায় অবস্থানকালে বলতে শুনেছি, যে আমাদের সঙ্গে এই নামায (ফজরের নামায) আদায় করল অতঃপর এখানে অবস’ান করল এবং ইতিপূর্বে সে আরাফায় অবস্থান করেছে রাতে কিংবা দিনে, তার হজ্ব পূর্ণ হয়েছে।-সুনানে নাসাঈ ২/৩৮
২। সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ী করা। এ সায়ী তাওয়াফে যিয়ারতের পরও করা যায়। আবার ৮ যিলহজ্বের আগেও নফল তওয়াফের পর আদায় করা যায়। ইফরাদ হজ্ব আদায়কারীগণ মক্কা প্রবেশের পর যে ‘তাওয়াফে কুদূম’ করে থাকেন তখনও হজ্বের ওয়াজিব সায়ী করে নিতে পারেন। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন-র্ভুক্ত। সুতরাং যে (কাবা) গৃহের হজ্ব করে কিংবা উমরা করে তার জন্য এ দুয়ের মাঝে সাঈ করাতে কোনো দোষ নেই।-সূরা বাকারা : ১৫৮
৩। নির্দিষ্ট দিনগুলোতে জামরাতে রমী তথা কংকর নিক্ষেপ করা। হযরত জাবির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন কংকর নিক্ষেপ করেছেন চাশতের সময়। আর পরবর্তীগুলো করেছেন সূর্য ঢলে যাওয়ার পর।-সহীহ মুসলিম ১/৪২০
৪। তামাত্তু ও কিরান হজ্ব আদায়কারীর জন্য দমে শোকর তথা হজ্বের কুরবানী। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) তারপর যখন তোমরা নিরাপদে থাক তখন যে ব্যক্তি উমরাকে হজ্বের সঙ্গে একত্র করে লাভবান হয় সে (যবেহ করবে) কুরবানী যে প্রাণী সহজলভ্য হয়।-সূরা বাকারা : ১৯৬
৫। মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামারাতে এসে কংকর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মিনার নির্দিষ্ট স্থানে এসে কুরবানী করলেন। এরপর ক্ষৌরকারকে প্রথমে ডান দিকে তারপর বাম দিকে ইশারা করে মাথা মুণ্ডানোর আদেশ করলেন। অতঃপর চুল মুবারক মানুষের মাঝে বন্টন করে দিলেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪২১
৬। মীকাতের বাহির থেকে আগত লোকদের ‘তাওয়াফে বিদা’ করা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, হাজীগণ বিভিন্ন দিকে প্রত্যাবর্তন করছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেউ যাতে বাইতুল্লাহর নিকট তার সর্বশেষ উপসি’তি ব্যতীত ফিরে না যায়।-সহীহ মুসলিম ১/৪২৭ হজ্বের পাঁচ দিনের আমল
নিম্নে ৮ যিলহজ্ব থেকে ১২ যিলহজ্ব পর্যন- হজ্বের পাঁচ দিনের আমলগুলোর কর্মপদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট মাসায়িল আলোচনা করা হচ্ছে :
প্রথম দিন ৮ যিলহজ্ব
আজ সূর্যোদয়ের পর সকল হাজীকে ইহরাম অবস্থায় মিনা গমন করতে হবে। যোহর থেকে পরবর্তী দিনের ফজর পর্যন- মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামায মিনায় পড়া এবং ৮ তারিখ দিবাগত রাত্রি মিনায় অবস্থান করা সুন্নত।- রদ্দুল মুহতার ২/৫০৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৭ হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ যিলহজ্ব মিনায় গমন করলেন এবং সেখানে যোহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর নামায আদায় করলেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৭৫৫
হজ্বের ইহরাম : ইফরাদ হজ্ব ও কিরান হজ্ব আদায়কারী হজ্বের ইহরাম পূর্ব থেকেই করে থাকে। তামাত্তু হজ্ব আদায়কারী আজ মিনায় যাওয়ার পূর্বে হজ্বের ইহরাম গ্রহণ করবেন।হযরত জাবির রা. বলেন, যখন আমরা ইহরাম থেকে মুক্ত হলাম তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করলেন, আমরা যেন মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় ইহরাম গ্রহণ করি। আমরা আবতাহ নামক স’ানে ইহরাম গ্রহণ করলাম।-সহীহ মুসলিম ১/৩৯২
হজ্বের ইহরাম বাঁধার স্থান
মাসআলা : হজ্বের ইহরাম বাঁধার জন্য পুরুষ-মহিলা কারো জন্যই মসজিদে হারামে যাওয়া জরুরি নয়। ইবরাহীম রাহ. বলেন, মক্কাবাসী (যারা তামাত্তু হজ্বের নিয়তে ওমরা করে মক্কায় অবস্থান করেন তারাও মক্কাবাসীর অন-র্ভুক্ত) ওমরার ইহরামের জন্য হারামের সীমানা থেকে বের হবে আর হজ্বের ইহরাম নিজ স্থানেই গ্রহণ করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৯৯ মাসআলা : মহিলাগণ নিজ নিজ অবস্থান স্থল থেকেই ইহরাম বাঁধবে। পুরুষরাও হোটেল বা আবাস-স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে পারে। তবে পুরুষের জন্য সম্ভব হলে মসজিদে হারামে এসে নিয়ম অনুযায়ী ইহরাম বাঁধা ভালো।
ইসমাইল ইবনে আবদুল মালিক থেকে বর্ণিত, হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রাহ. ৮ যিলহজ্ব স্বস্থান থেকে পায়ে হেঁটে বের হলেন, আমিও তার সঙ্গে বের হলাম। তিনি মসজিদে হারামে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। অতঃপর মসজিদ থেকে বের হয়ে কাবার দিকে ফিরে তালবিয়া পাঠ করলেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৯৩১
মাসআলা : হজ্বের ইহরামের পর থেকে ১০ তারিখ জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন- তালবিয়া পড়তে থাকবে। কংকর নিক্ষেপের পর থেকে তালবিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।-মানাসিক ২২৫; গুনইয়াতুন নাসিক ১৭০ হযরত ফযল ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা পর্যন- তালবিয়া পাঠ করেছেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪১৫
মিনায় অবস্থান না করা
মাসআলা : ৮ তারিখ দিবাগত রাতে যদি কেউ মিনায় অবস্থান না করে কিংবা এ তারিখে মোটেই মিনায় না যায় তাহলেও তার হজ্ব আদায় হয়ে যাবে। তবে মাকরূহ হবে।-মানাসিক ১৮৮-১৮৯; আহকামে হজ্ব ৬২ বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আতা রাহ. থেকে বর্ণিত, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. ৮ তারিখের সন্ধ্যা এবং আরাফার পূর্ণ রাত মক্কায় অবস্থান করেছেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৭৫৮
তাবু মিনার বাইরে হলে
মাসআলা : মিনায় জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণে মিনার এলাকার বাইরে বহু তাবু লাগানো হয়। যেহেতু এটি জায়গার সংকীর্ণতার ওজরে করা হয়ে থাকে তাই আশা করা যায়, এ সকল তাবুতে অবস্থানকারীরাও মিনায় অবস্থানের ফযীলত পেয়ে যাবে। তবে যারা তাবুর বাইরে মিনার এলাকায় গিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে পারেন তাদের জন্য সেখানে অবস্থান করাই ভালো। নির্ধারিত সময়ের আগেই মিনার উদ্দেশে রওয়ানা
মাসআলা : মিনায় রওয়ানা হওয়ার সময় হল ৮ তারিখ সূর্যোদয়ের পর। কিন’ আজকাল ৭ তারিখ দিবাগত রাতেই মুআল্লিমের গাড়ি রওয়ানা হয়ে যায় এবং রাতে রাতেই মিনায় পৌঁছে যায়। যদিও ৮ তারিখ সূর্যোদয়ের পর রওয়ানা হওয়া নিয়ম এবং এটিই ভালো, কিন’ অধিক ভিড়ের কারণে আগে চলে যাওয়া দোষের বিষয় নয়।-মানাসিক ১৮৮; গুনইয়াতুন নাসিক ১৪৬, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৭ হাজ্জাজ রাহ. বলেন, আমি হযরত আতা রাহ.কে ‘ইয়াওমুত তারবিয়া’র একদিন পূর্বে (অর্থাৎ ৭ তারিখে) মিনায় যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি তা দোষের বিষয় মনে করেননি।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৫৩৪
তাকবীরে তাশরীক
মাসআলা : ৯-১৩ যিলহজ্ব প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক পড়া ওয়াজিব। তাই প্রত্যেক হাজীকে এ বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি যিলহজ্বের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন- প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৫৬৭৮