হজ্ব ইসলামের একটি স্তম্ভ। বিত্তবানদের উপরে জীবনে একবার ফরয; দেরি না করা ওয়াজিব। আর স্বাস্থ্য ও অর্থ থাকলে প্রতি চার বছরে এক বার বাইতুল্লাহ শরীফে নফল হজ্ব বা উমরার মাধ্যমে হাযির হওয়া বাইতুল্লাহ শরীফের হক।
১.‘হজ্বে বদল’-এ যারা যায়, পাঠানেওয়ালা যদি তামাত্তু বা যে কোনো হজ্বের অনুমতি দেয় বা সে অনুমতি নিয়ে নেয় তাহলে ফাতওয়া হলোদ যদিও ইফরাদ করা উত্তম, তবে তামাত্তু করা জায়িয। হাকীমুল উম্মত থানবী রহ., মুফতী শফী রহ. ও মাওলানা যাফর আহমদ উসমানী রহ. এই মত প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বর্তমান যুগের কোনো আলিমের এ ব্যাপারে কোনো মতানৈক্য নেই। সূত্র: জাওয়াহিরুল ফিকহ (পৃ. ৫০৮-৫১৬) ইমদাদুল আহকাম (২য় খণ্ড, পৃ.১৮৬)
২.সাধারণত মাসআলার কিতাবগুলোতে লেখা আছে যে, মক্কা ভিন্ন শহর আর মিনা ভিন্ন শহর। অতএব দুই শহর মিলিয়ে যদি কেউ পনেরো দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত করে তাহলে সে মুকীম হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুকীম বা মুসাফির হওয়ার মাসআলা পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত। পরিস্থিতি পাল্টে গেলে মাসআলা পাল্টে যাবে। আর বর্তমান পরিস্থিতি হলো মক্কা ও মিনা এখন দুই শহর নেই, আবাদী মিলে এখন এক হয়ে গেছে। এমনকি মুযদালিফা-আরাফা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, মিনার সমস্ত ইন্তেজামী কাজ মক্কার সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং আবাদী মিলে যাওয়া ও সরকার কর্তৃক ইন্তেজামী বিষয় এক করে নেওয়ায় মিনা মক্কা শহরের মধ্যে দাখিল হয়ে যাবে, বা কমপক্ষে মিনাকে মক্কা শহরের উপকন্ঠ/শহরতলী বলা হবে।
অতএব কিতাবের উল্লিখিত মাসআলা পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কারণে কার্যকর থকবে না। সুতরাং এখন যদি মক্কা-মিনা মিলিয়ে কেউ পনেরো দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত করে তাহলে সে মুকীম গণ্য হবে। মাসআলাটি ভালো করে বুঝে রাখা দরকার। কারণ অনেক আলিমও পরিস্থিতি না জানার কারণে পুরনো কিতাবের মাসআলা বলে থাকেন।
এটার একটা নমুনা আমদের ঢাকাতেই আছে। যেমন, একটা সময় ছিল সফরের উদ্দেশ্যে কেউ ঢাকা ত্যাগ করে বিমানবন্দরে গেলে তাকে মুসাফির বলা হতো। কারণ, তখন ঢাকা আর বিমানবন্দরের মাঝে বেশ ফাঁকা ছিল; কোনো আবাদী ছিল না। আর সরকারও তখন এয়ারপোর্ট-উত্তরা এলাকাকে শহরের মধ্যে শামিল করে নাই। তখন উলামাদের ফাতওয়া ছিল এয়ারপোর্ট গেলে সে মুসাফির গণ্য হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই ফাঁকাটা বসতিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় এবং সরকার টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত শহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করায় এখন ফাতওয়া হচ্ছে কেউ বিদেশ ভ্রমনের জন্য এয়ারপোর্ট গেলে তিনি মুসাফির হবেন না; বরং মুকীম থাকবেন যতক্ষণ না বিমান উপরে উঠে। এখানে যে মাসআলা, মক্কা-মিনায়ও সেই মাসআলা।
কাজেই যেহেতু তারা মুকীম হলো তাই তাদের জন্য আরো কয়েকটা মাসআলা মানতে হবে।
(ক) তাদের এখন মক্কা-মিনা-মুযদালিফা-আরাফায় চার রাক‘আত বিশিষ্ট নামায চার রাকা‘আতই পড়তে হবে। (মুসলিম ৩য় খণ্ড হাদীস নং ৬৮৭)
(খ) মিনায় ১২ বা ১৩ তারিখ পর্যন্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে যদি কোনো দিন শুক্রবার হয় তাহলে মিনাতে জুমু‘আ পড়তে হবে। কারণ, এটা শহর বা শহরতলী। (তাতারখানিয়া ২য় খণ্ড পৃ.৫৫৩, মাসআলা নং-৩২৭৬)
অথচ আমি এবার (২০১২ ইং) হজ্বে গেলাম। খবর নিলাম; কেউ যুহর পুরা পড়েছে, কেউ দুই রাকা‘আত পড়েছে। অথচ তাদের অবস্থান মিনা-মক্কা মিলে পনেরো দিনের বেশি থাকা হচ্ছে এবং শহরতলীতে অবস্থান করছে। তারপরেও তারা জুমু‘আ তো পড়েই নাই, আবার যুহরের মধ্যে কসর করেছে। সঠিক মাসআলা না জানার কারণে তারা এ সমস্ত ভুল করেছে এবং এখনো অনেকে করছে।
(গ) নিসাবের মালিক হওয়ার কারণে দেশে যে প্রত্যেক বছর একটা কুরবানী করতো, মুকীম হয়ে যাওয়ায় ঐ কুরবানিটা বহাল থাকবে। চাইলে দেশেও করতে পারে, চাইলে সেখানেও করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, হজ্বের কুরবানী ভিন্ন। যা তামাত্তু বা কিরান করার কারণে হারামের সীমানায় ১২ই জিলহজ্বের মধ্যে করতে হয়। (ফাতাওয়ায়ে শামী, ২য় খণ্ড পৃ.৫১৫)
মহিলাদের কিছু ভুলঃ
(ক) চেহারা খোলা রাখা। মাসআলা হলো চেহারা দেখা যাবে না; তবে বোরকার নেকাব চেহারার সাথে লেগে থাকবে না। এর জন্য এমন কিছু ব্যবহার করতে হবে যাতে করে নেকাব চেহারার সাথে না লেগে না থাকে। (ফাতাওয়ায়ে শামী ২য় খণ্ড পৃ.৫২৭)
(খ) মহিলাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত হারামের জামা‘আতে ও জুমু‘আয় যাওয়া মাকরুহে তাহরীমী। অথচ দেখা যায় যে, মহিলারা পাঁচ ওয়াক্ত জামা‘আতে যাচ্ছে! যার কারণে ভিড় বেশি হচ্ছে। তারাও গুনাহগার হচ্ছে, পুরুষরাও গুনাহগার হচ্ছে। আর হাজারো পুরুষের ধাক্কা খাচ্ছে, ধাক্কা দিচ্ছে। আর পুরুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে পুরুষের নামাযও নষ্ট হচ্ছে। তারা যাচ্ছে ফযিলতের জন্য; অথচ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো মহিলা হজ্ব বা উমরার জন্য মক্কায় এসে ঘরে নামায পড়লে এক লাখের চেয়ে বেশি সওয়াব পাবে (মুসনাদে আহমদ ৬ষ্ঠ খন্ডঃ পৃ.২৯৭, ৩০১। হাদীস নং-২৬৫৯৮, ২৬৬২৬) । তেমনিভাবে মদীনার মসজিদে নববী থেকে তার ঘরের নামাযের ফযিলত বেশী । অতএব মহিলারা জুমু‘আয়ও যাবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেও যাবে না। তবে তাওয়াফ করতে গিয়েছে এমন সময় কোনো নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল সে সময় মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে নামায পড়ে নিতে পারবে। চাই তাওয়াফ হজ্বের হোক বা উমরার হোক, বা অন্য কোনো তাওয়াফ হোক।
কয়েকটি মারাত্মক ভুল:
(ক) এক শ্রেণীর হাজী সাহেব আছে, তারা সারাদিন মোবাইল বা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে থাকে। অথচ জানদারের ছবি তোলা হারাম কাজ (বুখারী শরীফ ৪র্থ খণ্ড পৃ.৭১, হাদীস নং ৫৯৫০) । তারা হজ্বে গিয়েও হারাম শরীফের মধ্যে এই হারাম কাজ করছে। হজ্বের সফরে হারাম কাজ করলে হজ্বে মাবরূর নসীব হয় না।
(খ) অনেক পুরুষ ইহরাম খোলার সময় যেখানে শরীয়ত বলেছে মাথা মুণ্ডানোর কথা সেখানে তারা দাড়িও মুণ্ডায়। আমাদের শায়খ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. বলতেন,“দেশে অন্যায় কাজ করলে, আল্লাহর ঘরে গিয়েও তা করলে; এভাবে তোমার কয়েক লাখ টাকার হজ্ব ঐ জায়গায়ই দাফন করে রেখে আসলে”।
হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, যখন কেউ দাঁড়ি-কাটা অবস্থায় ‘আস্-সালাতু ওয়াস্-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ বলে তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দেন না। কারণ সে প্রতিদিন রাসূলের কলিজায় খুর চালায়। তাই এমন কেউ সালাম দিলে তিনি চেহারা মোবারক আরেক দিকে ফিরিয়ে নেন। এমন অবস্থায় একশত বার হজ্ব করলেও তার হজ্বে মাবরূর নসীব হবে না।
(গ) ‘তালবিয়া’ ইনফিরাদী আমল। সবাই যার যার তালবিয়া পড়বে। দেখা যায়, অনেকে লিডারের সাথে তাল মিলিয়ে তালবিয়া পড়তে থাকে। অথচ এর কোনো প্রমাণ নাই।
(ঘ) আরাফা ও মুযদালিফার মধ্যখানে ৫ কিলোমিটার প্রশস্থ একটি ময়দান আছে, যেখানে অনেক টয়লেট ও গাছপালা আছে এ সব থেকে অনেকেই এটাকে মুযদালিফা মনে করে এখানে অবস্থান করে, অথচ এটা আরাফার মধ্যে দাখিল নয় এবং মুযদালিফার মধ্যে ও দাখিল নয়, এটা ভিন্ন একটা ময়দান, এখানে হজ্বের কোন কাজ নাই। এখানে মাগরিব ও ইশা একত্রে পড়া জায়িয নাই, এবং রাত্রে অবস্থান করাও জায়িয নাই। এবং বা’দ ফজর এখানে উকূফে করলে উকূফে মুযদালিফাও আদায় হবে না। অথচ যারা পায়দল আরাফা থেকে মুযদালিফায় যায় তাদের অনেকে এ ভুলটা করে। তাদের উপর ‘দম’ ওয়াজিব হয়ে যায় তাও তারা না জানার কারণে আদায় করে না।
(ঙ) ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী না করানো উচিত। কারণ এতে কখনো ১০ তারিখে বড় শয়তানকে কংকর মারার আগে কুরবানী হয়ে যায়। আবার কখনো কুরবানী সম্পন্ন হওয়ার আগে মাথা মুণ্ডানো হয়ে যায়। আর এ উভয় ভুলের দরুন তামাত্তু ও কিরানকারীর উপর দম ওয়াজিব হয়ে যায়। কারণ তাদের জন্য ১০ তারিখে এই তিনটি কাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী।
(১) বড় শয়তানকে কংকর মারা, (২) কুরবানী করা ও (৩) মাথা মুণ্ডানো।
এজন্য নিজেরা বা বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে কুরবানীর ব্যবস্থা করা জরুরী। কংকর মারার পর কুরবানী করবে, তারপর কুরবানী সম্পন্ন হওয়ার পর মাথা মুণ্ডাবে। মাথা মুন্ডানোর দ্বারা বা চুল ছোট করার দ্বারা হালাল হয়ে যাবে, তখন ইহরাম অবস্থায় যে সব কাজ নিষিদ্ধ ছিল তা এখন জায়িয হয়ে যাবে। উল্লেখ্য ইহরামের চাদর খুললে ইহরাম খোলা হয় না বা হালাল হওয়া যায় না।