দুগ্ধপোষ্য শিশুদের লালন-পালনের ব্যাপারে তৎকালীন নগরবাসী আরবগণের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা প্রচলিত ছিল : শহর-নগরের জনাকীর্ণ পরিবেশজনিত আধি-ব্যাধির কুপ্রভাব থেকে দূরে উন্মুক্ত গ্রামীণ পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করানো, যাতে শিশুরা বলিষ্ঠ দেহ এবং মজবুত মাংসপেশির অধিকারী হয় এবং বিশুদ্ধ আরবিভাষা শিখতে সক্ষম হয়; আর এ উদ্দেশ্যে দুগ্ধপান ও সযত্ন পরিপালনের জন্য বেদুঈন-পরিবারের নারীদের হাতে আরবরা তাদের শিশুদের ন্যস্ত করতো।
এ প্রথানুযায়ী আব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে দুগ্ধ পান করানোর উদ্দেশ্যে ধাত্রী অনুসন্ধান করেন এবং শেষ পর্যন্ত হালিমা বিনতে আবু যুয়ায়বের নিকট তাঁকে ন্যস্ত করেন। তিনি বনু সাদ বিন বকর গোত্রের একজন খাতুন ছিলেন। তাঁর স্বামীর নাম ছিলো হারিস বিন আব্দুল উযযা এবং উপনাম ছিল আবু কাবশাহ।
হযরত হালিমা সাদিয়ার নিজের বর্ণনা, ‘আমি তায়েফ হতে বনু সাদ গোত্রের মহিলাদের সাথে দুগ্ধপোষ্য বাচ্চার অনুসন্ধানে মক্কায় দিকে রওয়ানা হই। সে বছর দুর্ভিক্ষ ছিলো। আমার কোলে একটি সন্তান ছিলো। কিন্তু (অভাব-অনাটনের কারণে) আমার স্তনে এতটুকু দুধ ছিলো না, যা ওই বাচ্চার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। রাতভর বাচ্চাটি ছটফট করতো আর আমরা ওর জন্য বসে বসে রাত কাটাতাম। আমাদের কাছে একটি উষ্ট্রীও ছিলো, কিন্তু সেটারও দুধ ছিলো না।
যে বড়-কানবিশিষ্ট উষ্ট্রীর ওপর চড়ে আমরা মক্কায় রওয়ানা হলাম, সেটিও এত দুর্বল ছিলো যে, অন্যদের সাথে সমান তালে চলতে পারছিলো না। এতে আমার সফরসঙ্গীরাও বিরক্তবোধ করছিলো। অবশেষে বেশ কষ্টে সফর শেষ করে আমরা মক্কায় এসে পৌঁছুলাম।
আমরা লক্ষ্য করলাম, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে দেখে যখন কোনো মহিলা শুনছিলো, তিনি এতিম, তখন কেউ তাঁকে গ্রহণ করছিলো না।’
এদিকে হালিমার ভাগ্যের তারকা চমকাচ্ছি্লো। তাঁর দুধের স্বল্পতা তাঁর জন্য রহমতে পরিণত হয়ে গেলো। কারণ, দুধের স্বল্পতা দেখে কেউ তাকে নিজেদের বাচ্চা দিতে সম্মত হলো না।
হালিমা বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে বললাম, শূন্য হাতে ফেরত যাবো, এটা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। তাই শূন্য হাতে যাওয়ার চেয়ে এটাই উত্তম হবে যে, আমরা এই এতিম শিশুটিকেই নিয়ে যাই। স্বামী সম্মত হলেন।’
তাঁরা এতিম রত্নটিকে নিয়ে এলেন, যার দ্বারা কেবল হালিমা ও আমেনার গৃহ নয়, বরং গোটা বিশ্ব আলোকিত হবার অপেক্ষা করছিলো।
শিশু মুহাম্মাদকে তাঁবুতে নিয়ে এসে দুধ পান করাতে বসতেই নানা বরকত প্রকাশ পেতে শুরু করলো। হালিমার স্তনে এত পরিমাণ দুধ নেমে এলো যে, নবীজি নিজে এবং তাঁর দুধভাই উভয়ে মিলে অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সাথে দুধ পান করলেন এবং আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন।
এদিকে তাঁরা উষ্ট্রীর দিকে তাকিয়ে দেখেলেন, সেটারও স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। হালিমার স্বামী দুধ দোহন করে আনলেন। সে দুধ সবাই তৃপ্তি সহকারে পান করলো। দীর্ঘ দিন পর সেটা ছিল প্রথম রাত, যাতে পুরো রাত তাঁরা আরামে কাটালো।
হালিমার স্বামী বলতে লাগলেন, ‘হালিমা, তুমি তো বড়ই বরকতময় শিশু নিয়েছো।’ হালিমা বললেন, ‘আমারও তা-ই ধারণা, এ অত্যন্ত মোবারক শিশু।’
হালিমা বলেন, ‘এরপর আমরা মক্কা হতে রওনা হলাম। আমি মুহাম্মদকে কোলে নিয়ে ওই বড় কানবিশিষ্ট উষ্ট্রীর ওপর আরোহণ করলাম, আর তখনই মহান আল্লাহর কুদরতের এই লীলা দেখতে শুরু করলাম। দেখলাম, আমার দুর্বল উষ্ট্রীটি এতই দ্রুতবেগে চলতে শুরু করলো যে, অন্য কারো সওয়ারি এর কাছে পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছিলো না। আমার সহযাত্রী মহিলারা বিস্মিত হয়ে বলতে লাগলো, ‘এটা কি সেই উষ্ট্রী, যেটাতে চড়ে তুমি এসেছিলে!’
ফলকথা, পথ শেষ হলো। আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম। সেখানে তখন চরম দুভিক্ষ বিরাজ করছিলো। দুধের সবগুলো পশু ছিলো দুধশূন্য। কিন্তু আমি ঘরে প্রবেশ করতেই আমার বকরিগুলোর স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।
এরপর থেকে প্রতিদিন আমার বকরিগুলোর স্তন দুধে টইটম্বুর হয়ে থাকতো, আর অন্যরা তাদের পশুগুলো হতে এক ফোঁটা দুধও সংগ্রহ করতে পারছিলো না। আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের রাখালদের বলে দিলো, ‘তোমরাও নিজেদের পশুগুলোকে ওই চারণভূমিতে নিয়ে যাবে, হালিমার বকরিগুলো যেখানে ঘাস খায়।’
কিন্তু বাস্তবে তো সেখানে চারণভূমি ও ঘাস-পাতার কোন বিশেষত্ব ছিলো না, বরং কোনো এক অমূল্য রত্নের খাতিরেই এসব হচ্ছি্লো। তাই একই স্থানে চরানোর পরেও তাদের পশুগুলো দুগ্ধশূন্যই থাকতো। আর আমার বকরিগুলো দুধে টইটম্বুর হয়ে ফিরতো। এভাবে আমরা অনবরত মুহাম্মদের বরকতসমূহ প্রতক্ষ্য করতে থাকলাম। এমন করে দুই বছর কেটে গেলো আর আমি মুহাম্মদের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলাম।’