খাইরুদ্দিন পাশা : উছমানি খেলাফতের মহান সংস্কারক

উছমানি খেলাফতের পতনোন্মুখ সময়ে সাম্রাজ্যের কাঠামো, নীতি এবং জনগণের জীবনমানের সংস্কারে যে কজন মহান ব্যক্তিত্ব আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদের অন্যতম খাইরুদ্দিন পাশা আত-তিউনিসি। একদিকে যেমন ছিলেন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একান্ত অনুরাগী, অন্যদিকে ছিলেন ইসলামি আইন শাস্ত্র ও ইলমে শরিয়াহ’র ওপর অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন জীবনমানের উন্নয়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করছিল, উছমানি সাম্রাজ্য তখন আভ্যন্তরীণ সংঘাত, স্বার্থবাদিতা আর নানা রকম দুর্নীতিতে জর্জরিত। খাইরুদ্দিন পাশা এই সময়টায় খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে থেকে শাসনব্যবস্থা থেকে নিয়ে জনগণের জীবনমানের উৎকর্ষ সাধন ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি সাম্রাজ্যের প্রজাসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নিজের সাধ্যানুযায়ী বৈষয়িক নানা কাজে এনেছেন সংস্কার।

ভাগ্য বিড়ম্বনা : যোদ্ধার সন্তান থেকে ক্রিতদাস

ককেশাস পর্বতমালার একটি গ্রামে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম খাইরুদ্দিন পাশা আত-তিউনিসির। অতি অল্পবয়সে মর্মান্তিকভাবে পিতাকে হারান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসমানিদের একটি যুদ্ধে পিতা নিহত হন। পিতার মৃত্যুর পর ঘটনাচক্রে শিশু খাইরুদ্দিনকে অপহরণ করা হয় এবং ইস্তাম্বুলের ক্রীতদাস বেচাকেনার বাজারে গোলাম হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

তাহসেন বেগ আল কাবরিসি নামক এক ব্যক্তি তাঁকে কিনে নিয়ে যান। তাহসেন বেগ শিশু খাইরুদ্দিনের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে সন্তানের মতো তাঁকে লালন-পালন করেন। ইস্তাম্বুলের অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি, তুর্কি ও ফ্রেঞ্চ ভাষার ওপর পড়াশোনা করেন খাইরুদ্দিন।

ক্রিতদাস থেকে রাজপ্রাসাদে

তারপর ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যখন ১৭ বছরের টগবগে তরুণ, তাহসেন বেগ তাঁকে উছমানি খেলাফতের অধীন তিউনিসিয়া অঞ্চলের শাসনকর্তার প্রাসাদে প্রেরণ করেন। তিউনিসিয়া শাসনকর্তা তখন আহমদ পাশা। তিনিও খাইরুদ্দিনের মেধা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে নিজের ছেলের মতো তাঁকে গ্রহণ করেন এবং নিজের তত্ত্বাবধানে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ করে দেন।

তিউনিসিয়ার তৎকালীন উচ্চতর শিক্ষাগার মা’হাদুয যাইতুনায় ভর্তি হন খাইরুদ্দিন এবং ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্বের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্যারিস গমন করেন এবং সেখানে তিনবছর অবস্থান করে প্রশাসনিক জ্ঞান ও আধুনিক আইন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন।

প্যারিসে থাকাকালে ইউরোপের জীবনমানের উৎকর্ষতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের ক্রমশ উন্নতির কৌশল পর্যবেক্ষণ করেন। তিন বছর পর তিউনিসিয়ায় ফিরে এসে বহুল সমস্যায় জর্জরিত উছমানি সাম্রাজ্যকে কীভাবে আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই চিন্তা থেকে নিজের সাধ্যমাফিক বেশ কিছু সংস্কার কাজে হাত দেন খাইরুদ্দিন।

প্রশাসনে : রাষ্ট্রক্ষমতায়

১৮৫৭ সালে তিনি তিউনিসিয়ার যুদ্ধমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে তিউনিসিয়ার নৌ বন্দরকে আধুনিকায়ন করেন। ঢেলে সাজান সামরিক বাহিনীকেও।

কয়েক বছর পর তাঁকে তিউনিসিয়ার কৃষি ও শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময় তিনি তিউনিসিয়ার কৃষিখাতকে আধুনিকরূপে দাঁড় করান। জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেন খেজুর ও জলপাই চাষে। শিক্ষাখাতেও আনেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ইসলামি শিক্ষাদীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সমান গুরুত্বের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্লাসও চালু করেন।

প্রশাসনিক কাঠামোকেও ঢেলো সাজাবার চেষ্টা চালান এ সময়ে। কিন্তু খেলাফতের স্তরে স্তরে দুর্নীতি আর স্বার্থবাদিতা এতটাই প্রকট হয়ে ছিল যে, খাইরুদ্দিন পাশার পক্ষে এখানে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভবপর ছিল না।

এই রাগ থেকে ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রশাসনিক সব রকমের দায়িত্ব থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। কয়েক বছর রাজনীতি ও দর্শন নিয়ে একাগ্রচিত্তে পড়াশোনা করেন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিউনিসিয়ার বায়তুল মালের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। তার দুবছর পর দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। এইসব দায়িত্বে থাকাকালে তিউনিসিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোকে আধুনিকরূপে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন তিনি। কৃষিখাতের অসম্পূর্ণ কাজও সম্পূর্ণ করেন। পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদেন উৎকর্ষ সাধনে প্রতিষ্ঠা করেন উচ্চতর বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসা আস সাদিকিয়্যাহ। এটা পরিচালিত হতো তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। যেখানে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমান পারদর্শিতা অর্জন করত শিক্ষার্থীরা।

মাদরাসাপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তৈরি করেছিলেন বিশালায়তেনের লাইব্রেরি। মাকতাবায়ে আবদালিয়া নামের এ লাইব্রেরিতে ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের দুর্লভ ও বিপুল সংগ্রহ ছিল।

খেলাফতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দায়িত্বে

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে খেলাফতের পক্ষ থেকে তুরস্কে ডেকে নেওয়া হয় এবং খেলাফতের প্রধান নির্বাহী বা সদরে আজম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ উছমানি খেলাফতের মসনদে তখন ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সদরে আজম পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

একই বছর খাইরুদ্দিন পাশা খেলাফতের উচ্চতর বিশেষ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু অবধি এ দায়িত্বে বহাল থাকেন।

খাইরুদ্দিন পাশা উসমানি খেলাফতের কেবল প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী একজন অনন্য ব্যক্তিত্বও৷ উলুমে শরিয়াহর ওপর তাঁর যেমন দখল ছিল, তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কেও ছিলেন পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।

উছমানি খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও তিনি প্রশাসনিক সংস্কার ও জনগণের অধিকারের পক্ষে কাজ করে গেছেন অকপটে। তবে খেলাফত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন।

অবদান

তাঁর সংস্কারবাদিতার মূল লক্ষ্য ছিল, শরিয়াহর গণ্ডির ভেতরে থেকে সাম্রাজ্যের প্রজাসাধারণকে আধুনিকরূপে গড়ে তোলা এবং শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়াহর পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদেরকে সমানভাবে পারদর্শী করে তোলা। তাছাড়া তুর্কি জনগণ এবং অতুর্কি জনগণের মধ্যে একটা বৈষম্য গড়ে উঠেছিল উছমানি সাম্রাজ্যে, খাইরুদ্দিন চাইতেন তুর্কি-অতুর্কির মধ্যকার এ বৈষম্য দূর করে সবাইকে ইসলামের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতে।

আধুনিক সভ্যতার পর্যালোচনা বিষয়ে তিনি আকওয়ামুল মাসালিক ফী মারিফাতি আহওয়ালিল মামালিক নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। এর পাশাপাশি ইলা আওলাদী : মুজাক্কারাতু হায়াতীল খাসসাহ ওয়াস সিয়াসিয়াহ নামে আত্মজীবনীও লেখেন।

ইন্তেকাল

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে উছমানি খেলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলে মহান এ সংস্কারক ইন্তেকাল করেন। ইস্তাম্বুলের জামে আইয়ুব মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মরদেহকে তিউনিসিয়ায় স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানকার বিখ্যাত কবরস্তান মাকবারাতুল জালাযে পুনরায় দাফন করা হয়।


হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24