নবীজি একরকম বিপন্নকাল অতিবাহিত করছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠতম দুই জন তখন তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে—যাঁরা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন অনন্য মর্যাদায়;—প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা ও একনিষ্ঠ অভিভাবক চাচা আবু তালিব—এই দুজন নানা ঝঞ্ঝামাতাল সময়ে তাঁকে মানসিক ও সামাজিক স্থিরতা দিয়ে সমর্থন সাহস বন্ধুতা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন; কিন্তু তাঁদের অনুপস্থিতি, তাঁদের একেবারে চলে যাওয়া নবীজিকে মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপন্ন করে তুলছিলো। নবীজির এই মানসিক ও সামাজিক বিপন্নতাকে ষড়যন্ত্রের আরেক মোক্ষম পাঁয়তারা হিসেবে নিলো মক্কার কাফেররা। এক মুহূর্তের জন্যেও তারা নবীজিকে ছাড়লো না—যত রকমভাবে হতে পারে এবং না-হতে পারে, তার সকলভাবেই তারা নবী-জীবনকে বিষিয়ে তুললো। মক্কায় ইসলামের দাওয়াতপ্রদান ও মানুষের ইসলাম-গ্রহণের ব্যাপারে একরকম নৈরাশ্য তৈরি হলো।
তখন নবুওতের দশম বছর। মদিনার পাশে এক ফলফলাদিপ্রজ শহরের নাম তায়েফ। নবীজি শাওয়াল মাসের শেষ দিকে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাকে সাথে নিয়ে তায়েফে গমন করেন, এবং তায়েফবাসীদেরকে তিনি সত্যের বাণীর দিকে আহবান করেন। দীর্ঘ এক মাস কাল যাবৎ ক্রমাগত তাদের মাঝে তাবলিগ ও হোদায়েতের কাজে নিয়োজিত থাকেন; কিন্তু একটি লোকের ভাগ্যেও সত্য গ্রহণের তাওফিক হলো না; জালেমরা বরং শহরের কিছু বখাটে ও লম্পট ছেলেদেরকে নবীজিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য লেলিয়ে দেয়। এই পাষাণ-হৃদয় হতভাগারাও নবীজির পেছনে লেগে পড়ে। নবীজির উপর তারা এমনভাবে পাথর নিক্ষেপ আরম্ভ করে যে, তাঁর পা মোবারক রক্তাক্ত হয়ে গেলো। হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু যেদিক থেকেই পাথর আসতে দেখতেন, সেদিকেই তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন এবং পাথরের আঘাত তাঁর গায়ে এসে লাগতো। একসময় আঘাতে আঘাতে হযতর যায়েদও রক্তাক্ত হয়ে পড়েন। নবীজির এই কষ্টপীড়িত সময়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা পাঠান। ফেরেশতা তায়েফবাসীর উপরে আজাবের পরোয়ানা নিয়ে আসেন; কিন্তু তিনি রহমতুল্লিল আলামিন—তিনি তাতে সায় দেন না; তাঁর মুখে উচ্চারিত হয় দয়ার বাণী; অথচ তাঁর পবিত্র ঠোঁটের ঈষৎ কম্পনেই তায়েফবাসীর সকল উম্মাদনা এবং মত্ততার পরিসমাপ্তি ঘটে যেতে পারতো এবং তায়েফ ও তায়েফবাসীর নাম-নিশানা পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠ হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত পারতো।
অবশেষে দীর্ঘ এক মাস পর রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ হতে এমন অবস্থায় ফিরলেন, যখন তাঁর পা মোবারক ছিলো রক্তে রঞ্জিত; কিন্তু দিল অবুঝ উম্মতের জন্য ব্যথিত ও কম্পমান…