মুহতারাম উপস্থিতি,
আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য চারটি জগত সৃস্টি করেছেন-
১. আলমে আরওয়াহ তথা রূহের জগত। যেখানে কিয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সমস্ত রূহকে এক করা হয়েছিলো। সেখানে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন নিজের রবুবিয়াত আর বড়ত্ব বয়ান করেছিলেন। নিজের বড়ত্ব বয়ান করার পর সমস্ত রূহকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? সেখানে একজনও এমন ছিলো না যে স্বীকার করে নি, বরং সবাই স্বীকার করেছে জ্বী, আপনি আমাদের রব। কুরআনে কারীমের সূরা আরাফের আল্লাহ তা‘আলা এ স্বীকারোক্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন-
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُووا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ
এবং (হে রাসূল! মানুষকে সেই সময়ের কথা স্বরণ করিয়ে দাও) যখন তোমার প্রতিপালক আদম সান্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বাক্ষী বানিয়েছিলেন (আর জিজ্ঞেস করেছিলেন যে,) আমি কি তোমাদের রব নই? সকলে উত্তর দিয়েছিল, কেন নয়? আমার সকলে (এ বিষয়ে) সাক্ষ্য দিচ্ছি (এবং এ স্বীকারোক্তি আমি এজন্য নিয়েছিলাম) যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, আমরা তো এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। [সূরা আরাফ; আয়াত ১৭২]
মুসনাদে আহমাদের ২৪৫৫ ও ২১২৩২ নং হাদীসেও এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
তো এই যে আমরা স্বীকার করে এসেছি তা আমাদের মনে নেই। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আসমান থেকে কিতাব নাযিল করেছেন, নবীদের (আ.) পাঠিয়েছেন। আল্লাহর বড়ত্বের আর রবুবিয়াতের ঐ কথাগুলোই আম্বিয়া আ. শুনিয়েছিলেন। এবং এখন আম্বিয়া আ. এর সিলসিলা শেষ। এখন আল্লাহর বড়ত্বের আর রবুবিয়াতের ঐ কথাগুলোই নায়েবে আম্বিয়া অর্থাৎ উলামায়েকেরাম আমাদেরকে শুনাচ্ছেন। উলামারা নায়েবে রাসূল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মেহরাবে নামায পড়াতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মিম্বরে বসে হেদায়াতের কথা বলতেন। কিভাবে জান্নাত পাওয়া যাবে, কিভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচা যাবে, এই কথাগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন। এখন তিনি নেই। এই কথাগুলো এখন উনার নায়েবরা বলছেন। যাই হোক, আলমে আরওয়াহ হলো একটা জগত।
২. দুনিয়া। রূহের জগত থেকে আমরা মায়ের পেট হয়ে আরেকটা জগতে এসেছি সেটা হলো, দুনিয়ার জগত। পরীক্ষার জগত। এখন আমরা যেখানে আছি। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন আমরা একজনও এখানে থাকবো না। এক হাদীসে এসেছে, একদিন রাতের বেলা নবীজী সাহাবায়ে কেরামকে বিশেষভাবে তাকীদ দিয়ে বললেন-
فإن رأس مائة سنة منها، لا يبقى ممن هو على ظهر الأرض أحد
তোমরা যারা আজকে এখানে আছো, একশত বছর পর তোমরা কেউ দুনিয়াতে থাকবে না। {সহীহ বুখারী; হাদীস নং-১১৬ মুসনাদে আহমাদ; হাদীস নং-৫৬১৭}
দশম হিজরীতে তিনি এই কথাটি বলেছিলেন। ঠিক তাই হয়েছে। একশত দশ হিজরীর পর কোন সাহাবী দুনিয়াতে ছিলো না। আমের ইবনে তোফায়েল রা. একশত দশ হিজরীতে সর্বশেষ সাহাবী হিসেবে ইন্তেকাল করেছেন। [আল ইস্তিআব লি ইবনে আব্দিল বার আলকুরতুবী ২/৭৯৮]
৩. বরযখ। দুনিয়ার জগতের পরে আরেকটি জগত আসবে। সেটা হলো বারযাখ। বারযাখের জগত। দুনিয়া এবং আখিরাতের মধ্যবর্তী জগত। অনেক উলামায়েকেরাম এই জগতকে বলেছেন, ওয়েটিং রুম। আপনি যদি ট্রেনের ফাস্ট ক্লাসের টিকেট কিনে থাকেন তাহলে আপনার ওয়েটিং রুমটিও ফাস্ট ক্লাস হবে। আর যদি সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট কিনে থাকেন তাহলে আপনার ওয়েটিং রুমটিও সেকেন্ড ক্লাস হবে। বুঝানোর জন্য তুলনা করা হয়েছে। ঐ জগত দুনিয়ার সাথে মিলানো। এই জগতের একটি মাথা দুনিয়ার সাথে লাগানো এবং আরেকটি মাথা আখিরাতের সাথে লাগানো। দুনিয়ার সাথে যে লাগানো এর প্রমাণ হলো, আমার সাথে কোন ভাইয়ের যদি পরিচিতি থাকে যিনি ঐ জগতে চলে গেছেন তাহলে আমি তার কবরে গিয়ে সালাম করলে সে শুনবে। আমি তার জন্য তিনবার সূরা ইখলাস পড়লে আল্লাহ পাক তার কাছে পৌছে দিবেন। সে পাবে। সে আমাকে চিনবে।
৪. আখেরাত। বারযাখের জগত শেষ হলে আরেকটি জগত আসবে। সেই জগতের নাম আখিরাত। আখিরাতের জগত ফল ভোগ করার জগত। দুনিয়া পরীক্ষার জগত, কবর হলো ওয়েটিং রুম আর আখিরাত হলো ফল ভোগ করার জগত। যে পরীক্ষা দুনিয়াতে দিয়েছি ঐ পরীক্ষার ফল দেয়া হবে। কিয়ামতের ময়দানে এই ফল ঘোষনা করা হবে। কুরআনে কারীমে সূরা শুরা ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَتُنْذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَييْبَ فِيهِ فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ
এভাবেই আমি তোমার উপর নাযিল করেছি আরবী কুরআন, যাতে তুমি সতর্ক কর কেন্দ্রীয় জনপদ (মক্কা) ও তার আশপাশের মানুষকে এবং সতর্ক কর সেই দিন সম্পর্কে, যে দিন সকলকে একত্র করা হবে, যে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল প্রজ্বলিত আগুনে। [সূরা শুরা; আয়াত ৭]
যাই হোক, উলামায়ে কেরামের জবানে, হায়াতের যে চারটা স্তর এই কথা আমরা বার বার শুনেছি। এটা বিশ্বাস করা জরুরী। এটা ঈমানের একটা অংশ। এর কোন একটা জগতকে অবিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না। মোমিন হওয়ার জন্য ঈমানের সবগুলো কথা মানা এবং বিশ্বাস করা জরুরী। কিন্তু বেঈমান হওয়ার জন্য সবগুলো কথা অবিশ্বাস করা জরুরী না। কোন একটি কথা বা বিষয় অবিশ্বাস করলে বা সন্দেহ করলে বেঈমান হয়ে যাবে। সে কাফেরের কাতারে চলে যাবে। ইসলামে তার কোন অংশ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা রূহের জগত থেকে সরাসরি মানুষকে জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাতে পারতেন কিন্তু তা করেন নি কারণ আল্লাহ তা‘আলা চান আমাদেরকে দিয়ে সরেজমিনে করিয়ে তারপর যার যার কাজ অনুযায়ী জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাবেন। এর কারণ হলো -যদি আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সরাসরি জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাতেন তাহলে কাফেরদের আপত্তি করার সুযোগ ছিল। তারা হয়তো বলতে পারতো, হে আল্লাহ! আপনি যদি আমাদেরকে একবার দুনিয়াতে পাঠাতেন তাহলে আমরা ঈমান এনে অনেক বেশী দীনের কাজ করতাম। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে রূহের জগত থেকে সরাসরি জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাদের কোন সুযোগ দেন নাই। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কাফের-মুশরিকদের এমন কোন কথা বলার সুযোগ দেন নাই। আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এখন যদি ঈমান এনে, ঈমান আমলের মেহনত না করে যেউ জাহান্নামি হয় তাহলে কোন আপত্তি করতে পারবে না। বরং কুরআনে কারীমে সূরা বানী ইসরাইল; আয়াত ১৪-এ আল্লাহ তা‘আলা বলেন- اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
(বলা হবে) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। [সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ১৪]
অনত্র আছে, আল্লাহ বিচার করার আগে বান্দাকে বলা হবে, বান্দা তুমি নিজেই তোমার নিজের বিচার করো আর দেখ তুমি কিসের উপযুক্ত। জান্নাত বা জাহান্নামের (?) প্রত্যেক বান্দা নিজেই বুঝতে পারবে সে কিসের উপযুক্ত।
তাই খেয়াল রাখতে হবে, দুনিয়াতে আল্লাহ পাঠিয়েছেন পরিক্ষা নেয়ার জন্য। এই পরিক্ষা নেয়ার জন্য আল্লাহ দুটি রাস্তা রেখেছেন। একটা হলো শুকোর গুজারীর রাস্তা অর্থাৎ জান্নাতের রাস্তা। আরেকটা হলো, না শুকরির রাস্তা অর্থাৎ জাহান্নামের রাস্তা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন- إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا
আমি তাকে (মানুষকে) পথ দেখিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে অথবা হবে অকৃতজ্ঞ। [সূরা দাহর; আয়াত ৩]
মানুষ জন্মের পর থেকে অনেক কিছু দেখে। এই দেখার কারণে তার ক্বলবের মধ্যে এক্বিন পয়দা হয়। ক্বলব হলো অঙ্গ-প্রতঙ্গের রাজা। আর বাকী অঙ্গ-প্রতঙ্গ হলো প্রজা। ক্বলবের মধ্যে যে কথার একিন পয়দা হয় ঐ কথার উপর আমল করার জন্য ক্বলব (রাজা) বাকী অঙ্গ-প্রতঙ্গকে (প্রজাদেরকে) হুকুম করে তা করার জন্য। যেমনঃ মানুষ দেখে, জমিন থেকে ফসল হয়। যার বড় পোষ্টের চাকরি আছে ২/৩ লাখ টাকা বেতন পায়, যার মিল ফেক্টরি আছে সে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ায়। মাল ওয়ালাদের সম্মান অনেক বেশী ইত্যাদি। আর এই দেখার উপর বিশ্বাস করেই লোকেরা কাজ কর্ম করছে। কুরআনে কারীমে সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৯৬-এ আল্লাহ মোমিন বান্দাকে এই দেখা জিনিসের উপর এক্বীন করা থেকে সাবধান করেছেন যে, কাফেররা যে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে তা দেখে ধোঁকা খেও না। এর মধ্যে কোন কামিয়াবী নাই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي الْبِلَادِ
যারা কুফর অবলম্বন করেছে, দেশে দেশে তাদের (সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ) বিচরণ যেন তোমাকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে। [সূরা আলে ইমরান; আয়াত১৯৬]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মানুষের ক্বলবেন এক্বীনকে ঠিক করার জন্য লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন । মানুষের ক্বলবের মধ্যে যে দেখা জিনিসের এক্বীন আছে তা বের করে আল্লাহ থেকে হওয়ার এক্বীন ক্বলবে পয়দা করা। সকল নবীর মেহনত এক ছিল। ক্বলব থেকে যা হয় তা ঈমান আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ থেকে যা হয় তা আমল। অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্বলবের অনুগত। রাজা ঠিক হয়ে গেলে প্রজা ঠিক।
এই জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَلَا إِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلُحَتْ صَلُحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ , وَإنْ فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّههُ أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ
অর্থাৎ তোমার শরীরে একটা গোসতের টুকরা আছে ক্বলব। এই ক্বলব যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে তোমার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ ঠিক হয়ে যাবে। [আসসুনানুল কুবরা লিন বাইহাকী; হা.নং ১০৪০০]
কাজেই ক্বলব ঠিক করার জন্য মেহনত করতে হবে। ইসলামেও মদ নিষেধ করা হয়েছে ২/৩ ধাপে। ক্বলব ঠিক হয়ে গেছে তো নিষেধ বলার সাথে সাথে সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। মুআত্তায়ে ইমাম মালেক; হা.নং ৭১৫, মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৩৩৭৬
সুতরাং আমাদেরকে ক্বলবের পেছনে মেহনত করে এ বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে যে, আমরা যা দেখি তা গলদ, ধোঁকা। এই সব কিছুর পেছনে একটা শক্তি কাজ করছে। সেই শক্তির নাম হলো, খলীক, মালিক, রব্ব, আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বিভিন্ন আসবাবের মাধ্যমে নিচের শক্তিকে প্রকাশ করছেন মাত্র। আসল শক্তি একমাত্র আল্লাহর। আমরা দেখি পিয়ন টাকা নিয়ে এসে আমাকে দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না কি আমার ছেলে যে বিদেশ থাকে সে পিয়নের মাধ্যমে আমার কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। ঠিক তেমনি চাকরী, ব্যবসা, জমি এগুলো আল্লাহর পিয়ন। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত এই পিয়নের মাধ্যমে আমাদের রিযিক পৌছাচ্ছেন। আমাদের কারো চাকরী চলে গেছে যাক, ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে যাক কোন সমস্যা নাই। এক পিয়ন চলে গেছে তাতে কি, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নিকট লাখ লাখ পিয়ন রয়ে গেছে। আল্লাহ অন্য পিয়নের মাধ্যমে আমাদের রিযিক পৌছাবেন, ইনশাআল্লাহ। কেননা, হাদীসে এসেছে, আমাদের মৃত্যু আমাদেরকে যে পরিমাণ তালাশ করে, আমাদের রিযিক আমাদেরকে তার চেয়ে ও বেশী পরিমাণ তালাশ করে। [শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকী; হা.নং ১১৪৭]
কিন্তু এখন জানার বিষয় হলো যে, ক্বলবের একীন সহীহ করার নেযাম বা পদ্ধতি কী?
আল্লাহ পাক প্রতিটা জিনিসের একটা নেযাম রেখেছেন। কেউ যদি চায় তার সন্তান নেককার হোক তাহলে তাকে নেককার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, নিজেকে নেককার হতে হবে। কিন্তু কেউ যদি নেককার না হয়ে, নেককার মেয়ে বিয়ে না করে, নেক সন্তান আশা করে তাহলে এটা হবে তার মিথ্যে আশা। প্রতিটা জিনিসের একটা নেযাম রাখা আছে। এক নেযাম দিয়ে আরেক কাজ নেয়া যায় না। ভাত বানানোর নেযাম দিয়ে মুড়ি বানানো যায় না। ঠিক তেমনি আল্লাহ থেকে হওয়ার এক্বীন ঠিক করার জন্য আল্লাহ নেযাম রেখেছেন। সেটা হলো ক্বলবের উপর মেহনত। আমরা মেহনত করবো আরেকজনের উপর কিন্তু নিয়ত থাকবে প্রথমে যেন নিজের ক্বলব ঠিক হয়ে যায়, নিজের ঈমান মজবুত হয়ে যায়, দ্বিতীয় নিয়ত হলো যে ভাইয়ের পেছনে মেহনত করা হচ্ছে তার ক্বলব যেন ঠিক হয়ে।
আমার সকল ভাইয়ের হেদায়াতের জন্য মেহনত করতে হবে। তারাও হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত। হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছেন যেন উনার সকল উম্মত বেহেস্তে যায়। মুনাফেকের ব্যপারে আয়াত নাযিল হয়েছে, আপনি যদি ৭০ বার তাদের জন্য মাগফিরাত চান আমি (আল্লাহ) তাদের মাফ করবো না। হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এই আয়াতে ৭০ এর অর্থ যদি ৭০- ই হয়ে থাকতো, ৭১ বার মাফ চাইলে যদি আল্লাহ মুনাফেকদের মাফ করে দিতো, তাহলে আমি ৭১ বার আল্লাহর কাছে তাদের জন্য মাফ চাইতাম। কিন্তু এই ৭০ এর অর্থ তা না। বরং ৭০ বারের অর্থ হলো যতবেশী মাফ চাওয়া হোক, মাফ করা হবে না। {মুসনাদে আহমাদ; হাদীস নং- ৯৫, সহীহ বুখারী ; হাদীস নং- ১৩৬৬,}
যদিও মুনাফেকের সর্দার কিন্তু সে তো আমারই উম্মত। সে জান্নাতে গেলে আমার কী ক্ষতি। কাফের হোক, মুনাফেক বা মুশরিক সবাই রসূলের উম্মত। সকলের ব্যাপারে আমাদের ফিকির করতে হবে। কিভাবে তারা জান্নাতে যেতে পারে। তাদের ব্যাপারে ফিকির করা ২য় স্তর। প্রথম ফিকির করতে হবে নিজের ব্যাপারে। আমার ঈমান কিভাবে শিরিক মুক্ত হয়, আমার ক্বলবের এক্বীন কিভাবে ঠিক হয়ে যায় সেটা। এই নিয়তে অন্যের পেছনে মেহনত করতে হবে। বল দেয়ালে মারলে যেমন নিজের কাছে ফিরে আসে ঠিক তেমনি আমরা অন্য ভাইয়ের ক্বলবের পেছনে মেহনত করবো, কিন্তু আমার ক্বলব ঠিক হয়ে যাবে। ঐ ভাই হেদায়াত পাক, না পাক আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দান করবেন ইনশাআল্লাহ। হেদায়াত একমাত্র আল্লাহর হাতে। কোন নবী রাসূলের হাতে হেদায়াত না। যদি হতো তাহলে নূহ আ. এর ছেলে, লূত আ. এর পরিবার, ইবরাহীম আ. এর পিতা, আমাদের নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চাচা গোমরাহ হতেন না।
এই দাওয়াতের লাইনে মেহনত করলে ঈমান মজবুত হয়। এমন মজবুত হয় যে বিভিন্ন বালা-মুসিবতে তার ঈমান নষ্ট হয় না। কারো কারো ঈমান কচুর পাতার পানির মতো। একটু সামান্য ব্যতিক্রম পরিস্থিতিতে তার ঈমান নড়বড়ে হয়ে যায়। এক শ্রেনীর শয়তান আছে যার কাজ হলো মুসলমানের ঈমান নষ্ট করা। তাই খুব সাবধান থাকতে হবে।
আল্লাহ আমাদের ঈমানের পরিক্ষা নিবেন। আমরা বাজারে গেলে সামান্য একটা মাটির হাড়ি কেনার জন্য ১০ বার পরিক্ষা করে নেই। একটা কাপড় কিনতে গেলে কত যাচাই বাছাই করে নিয়ে আসি। আর আল্লাহ আমাদের আপন করার আগে একটু দেখে নিবেন না? অবশ্যই তা করবেন। এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ দেখবেন আমরা কোন বিপদের কারণে আল্লাহর পথে থাকি নাকি অন্য পথে চলে যাই। দুনিয়াদাররা বিপদে পরলে মন্ত্রির কাছে দৌড়ে যায় বা ডাক্তারের কাছে দৌড়ে যায়। আর মোমিন কোন বিপদে পরলে আল্লাহর কাছে দৌড়ায়। পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
অথচ তাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদেরকেও আমি পরীক্ষা করেছি। সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন করা সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে এবং তিনি অবশ্যই জেনে নেবেন কারা মিথ্যাবাদী। [সূরা আনকাবূত; আয়াত ৩]
আল্লাহ আমাদের ঈমানের পরিক্ষা নিবেন। এই ঈমানের পরিক্ষায় পাশ করতে হলে দাওয়াতের লাইনে মেহনত করতে হবে। ঈমান বাড়ানোর যে মেহনত তা হলো দাওয়াতের লাইনে মেহনত। এটাই নেযাম। যত বড় আলেম হোক তাকেও ঈমানের মেহনত করতে হবে, আবার গরীব মজদুরকেও ঈমানের মেহনত করতে হবে। শাইখুল হাদীস সাহেবও যদি ঈমানী মেহনত না করে তাহলে তার ঈমান নিয়ে মৃত্যু হওয়ার গেরান্টি নাই। আবার মূর্খ গরীব মজদূর যদি ঈমানী লাইনে মেহনত করে, তার ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যাওয়ার গেরান্টি আছে। নিজের গণ্ডির মধ্যে এই মেহনতকে ফরযে আইন করা হয়েছে। আর সারা দুনিয়াবাসী যেন এই দাওয়াতটা পায় তা ফরযে কিফায়া করে দেয়া হয়েছে।
সাহাবা রা. এই মেহনতকে সারা দুনিয়ার প্রত্যেকের কাছে পৌছানোর জন্য অনেক কুরবানী করেছেন। এই মেহনতের একটা চাওয়া হলো কুরবানী। আমাদেরকেও এই মেহনতকে সামনে রেখে কুরবানী পেশ করতে হবে। সাহাবীদের তুলনায় আমাদের কুরবানীতো কিছুই না। উনারা বিবি-বাচ্চা, ঘর-বাড়ি সব কিছুর কুরবানী করেছেন। আমাদেরতো সব ঠিক রেখে তাবলীগে চল্লিশ দিন ৩ চিল্লা লাগাতে বলা হচ্ছে। আমাদের ব্যবসা-বানিজ্য সবই ঠিক রেখে এই মেহনত করতে বলা হচ্ছে। এর জন্য আমরা সবাই তৈরী থাকি, আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করেন, আমীন।
(বয়ান: ১৫.০৩.২০১৮, স্থান: মুহাম্মাদপুর কবরস্থান মসজিদ)