অনিদ্রারোগকে (Insomnia) বলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় ইনসমনিয়ার নানা রকমফের আছে। মোটাদাগে তিনপ্রকার:
১. ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে শুয়েছেন, কিন্তু আসি আসি বলে ঘুম ফাঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। দীর্ঘ সময় এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েন।
২. একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া হালকা ঘুম হয়। স্নায়বিক উত্তেজনার কারণেই এমনটা ঘটে থাকে।
৩. রাতের শেষ ভাগে ঘুম ভেঙে যায়। একবার কোনও কারণে ঘুম ভেঙে গেলে আর আসতে চায় না। বিশেষ করে বৃদ্ধদের এমনটা হয়।
অনিদ্রারোগ নিয়ে সংবাদপত্রে, মিডিয়ার নানা ভার্শনে প্রতিনিয়ত আলোচনা হয়। প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় বাতলানো হয়। কিন্তু চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় আরেকটি ‘ইনসমনিয়া’ কখনোই ধরা পড়ে না। এটা বিশেষ ধরনের ইনসমনিয়া। কী সেই ‘অজ্ঞাত ইনসমনিয়া’? হাঁ, সে অজ্ঞাত ইনসমনিয়াকে আমরা ‘ঈমানী ইনসমনিয়া’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। কুরআন কারীমই এই ইনসমনিয়ার কথা আমাদের জানিয়েছে। কুরআনি ইনসমনিয়াও বলা যেতে পারে।
১. সূরা যারিয়াত। যারিয়াত মানে? এমন দমকা বাতাস, যা ধুলোবালি উড়িয়ে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। সূরার শুরুতে বাতাসের চারটি কর্মপ্রক্রিয়া উল্লেখ করে চারবার কসম করেছেন আল্লাহ তা‘আলা।
২. এভাবে কসম দিয়ে শুরু করা প্রথম সূরা হল ‘আস-সাফফাত’। তেইশ পারায়। সূরা ইয়াসীনের পরের সূরা। ফিরিশতাদের তিনটি বৈশিষ্ট্যমূলক কর্মকে প্রকাশ করে কসম করা হয়েছে।
৩. কোনও বস্তুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে, কথাকে বলিষ্ঠ, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও অলঙ্কারপূর্ণ করার জন্যে, আল্লাহ তা‘আলা কসম করেন। পাশাপাশি এই আকীদাও পোষণ করতে হবে, কোনও কথা বিশ্বাস করানোর জন্যে, আল্লাহ তা‘আলা কসমের মুখাপেক্ষী নন। তিনি সব কিছু থেকে বেনিয়ায। অমুখাপেক্ষী।
৪. কসমের পর সাধারণত কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কুরআন কারীমের যেখানেই কসম আছে, তারপর রাব্বে কারীম কী বলেছেন, সেটা গভীর মনোযোগের সাথে খেয়াল করা উচিত। সাধারণত কসমের পর, তাওহীদের আলোচনা থাকে। কখনো কেয়ামতের আলোচনা থাকে। কখনো ভীতি প্রদর্শন থাকে।
৫. সূরা সাফফাতে কসমের পরপরই চতুর্থ আয়াতে তাওহীদের কথা বিবৃত হয়েছে,
إِنَّ إِلَٰهَكُمْ لَوَاحِدٌ
নিশ্চয়ই তোমাদের মাবুদ একই।
৬. সূরা যারিয়াতে, চারটি কসমের পর, দুই আয়াতে কেয়ামতের ভয়াবহতার রূপ চিত্রায়ন করা হয়েছে। সপ্তম আয়াতে বহু পথবিশিষ্ট আকাশের কসম করে পরবর্তী সাতটি আয়াতে আবার কেয়ামতের ভীতিপ্রদ আলোচনা করা হয়েছে।
এটুকু পড়ার পর একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। সামনে কি আলোচনা আসছে, সেটা গ্রহণ করার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার উদ্দেশ্যে।
৭. কসম, কেয়ামতের পর শুরু হয়েছে একদল মহসৌভাগ্যবান মানুষের কথা। আশার কথা। চিরন্তন সুখের কথা। স্বাচ্ছন্দ্যের কথা। পুরস্কারের কথা। প্রতিদানের কথা। কিভাবে এই সুখের দেশে পৌঁছা যাবে, তার উপায়ের কথাও আছে!
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ ۚ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَٰلِكَ مُحْسِنِينَ كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
(১৫): মুত্তাকীগণ অবশ্যই উদ্যানরাজি ও প্রসবণসমূহের ভেতর থাকবে।
(১৬): তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা-কিছু দেবেন, তারা তা উপভোগ করতে থাকবে। তারা তো এর আগেই সৎকর্মশীল ছিল।
মুত্তাকীগণই হবেন উদ্যানরাজি ও প্রস্রবণসমূহের (جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ) মালিক। তাদের এই মহাসৌভাগ্য লাভের চাবিকাঠি কি? দু’টি কারণ বলা হয়েছে,
১: তারা সৎকর্মশীল ছিল। আরেকটি কারণ?
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
(১৭): তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত।
(১৮): এবং তারা সাহরীর সময় ইস্তিগফার করত।
৮. রাতের ঘুমকে হুজু‘ (هجوع) বলে। রাতে অল্প ঘুমুনোকে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি বলা হয়েছে। জান্নাতে পৌঁছার উপায় বলা হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান কি এটাকে ইনসমনিয়া বলবে? এই স্বল্পনিদ্রা কি রোগ?
৯. কল্পনার চোখে দেখলে, কেমন লাগে না! সবাই ঘুমুচ্ছে, একজন মানুষ ঘুমায়নি। জেগে আছে। তিনি রাতে অল্প কিছু সময় ঘুমিয়েছেন। বাকি সময় কী করেছেন? তিনি বাকি সময় জেগে জেগে আল্লাহর ইবাদত করেছেন। যিকির করেছেন। কাকুতি মিনতি করে মুনাজাত করেছেন। রবের সম্মানে তাসবীহ পাঠ করেছেন। ইস্তেগফার করেছেন। অসীম ক্ষমতাবানের দরবারে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছেন। রুকু করেছেন। সিজদা করেছেন। কিয়াম করেছেন। বিনম্রচিত্তে আত্মসমাহিত হয়ে প্রভুর দরবারে ধর্না দিয়ে পড়ে থেকেছেন। এভাবেই রাতের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন। ঘুমিয়েছেন সামান্য কিছু সময়। অল্প ঘুমিয়ে বাকি সময়টুকু রবের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন। আয়াতটা আবারও পড়ি?
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
একবার কেন বারবার পড়ি! পড়তে পড়তে রাতের চিত্রটা হৃদয়পটে আঁকার চেষ্টা করি। নিজেকেও তার জায়গায় কল্পনা করে দেখি!
ইলমের মানদণ্ড!
১০. এতো গেল সূরা যারিয়াতের কথা। সূরা যুমারের দিকে একটু তাকাই। শুরু থেকে জাগতিক বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে নবম আয়াতে গিয়ে ‘ঈমানি জাগরনের’ অবতারণা করেছেন। ভিন্ন শব্দে। এখানে ‘রাতজাগাকে’ অপূর্ব এক সম্মানে বিভূষিত করেছেন। রাতজাগা ব্যক্তিকে ‘জ্ঞানীর’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন। এই সম্মান অর্জন করা প্রতিটি মুমিনের পক্ষেই সম্ভব। আয়াতটা দেখি,
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ
তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে,কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে? এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, উভয়ে কি সমান? (কিন্তু) উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।
১১. শুনতে কেমন অবাক লাগে না? বিস্ময়ে কারো কারো দুই চোখ বড় বড় হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়াকে জ্ঞানের অন্যতম মানদণ্ড হিশেবে দেখানো হয়েছে! এ কি করে সম্ভব? সাধারণ ধার্মিকের মনেও প্রশ্নটা উঁকি দেয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাহাজ্জুদ পড়া ধার্মিকতা হতে পারে, তাকওয়া হতে পারে, তাই বলে জ্ঞানের মানদণ্ড? পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধ্যান-ধারনা দ্বারা প্রভাবিত চিন্তায় বিষয়টাকে আসলেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে হতে পারে।
১২. রাত জেগে রুকু-সিজদা করা ব্যক্তিকে কানিত (قَانِتٌ) বলে আখ্যায়িত করেছেন আল্লাহ তা‘আলা। বিনয়-নম্রতার সাথে আনুগত্য করে, পরম আন্তরিকতায়, ধারাবাহিক ইবাদত বন্দেগী বা গভীর মনোযোগে সালাতে মশগুল হওয়াকে কুনুত (قُنُوتُ) বলা হয়।
১৩. কুনূতের সাথে রাতজেগে ইবাদত করাকে ‘জ্ঞানীর’ কাজ বলা হয়েছে আয়াতে। প্রকারান্তরে বিপরীত আচরণ (কুনূতের সাথে রাতজাগা ইবাদত না করা)-কে অজ্ঞতা বলা হয়েছে।
১৪. প্রশ্ন হতে পারে, আমরা সমাজের বেশির ভাগ মানুষকেই দেখি, রাতজেগে ইবাদত করেন না। বস্তুবাদি জাগতিক বিচারে তারা বড় বড় ডিগ্রিধারী। তারা কি তবে জাহেল?
(ক): রাতজাগা কানিতকে আলিম বলা হয়েছে। এবং প্রশ্ন করা হয়েছে,
هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ
যারা জানে (মানে রাত জাগা কানিত) আর যারা জানে না (রাত জাগা কানিত নয়), উভয়ে কি সমান?
যারা রাতজাগা কানিত নয়, তারা হয়তো জাগতিক বিচারে জ্ঞানী, কিন্তু কুরআনি বিচারে তারা প্রথম স্তরের জ্ঞানী নয়। তাদেরকে সরাসরি জাহেল বলা না গেলেও, অন্তত এটুকু তো বলা যাবে, তারা প্রকৃত জ্ঞানের দৌড়ে এখনো পিছিয়ে আছে।
(খ): দু’টি বিষয়,
১: একটা ইলম বা জ্ঞান।
২: আরেকটা হল জ্ঞানের ফলাফল বা জ্ঞানের বাস্তবায়ন।
এভাবেও বলতে পারি, একটা হল ইলম আরেকটা হল ইলম অনুযায়ী আমল।
-মূল লক্ষ্য কোনটা? ইলম না আমল?
-অবশ্যই আমল।
ইলম হল ‘পথ ও পন্থা’। আমল হল সিদ্ধি বা লক্ষ্য।
১৫. ইলম বা জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য কি? আল্লাহকে চেনা ও আল্লাহর দাসত্ব (عُبُودِيّة) করা। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলে, নিছক ইলমের মূল্য কি? যে জ্ঞান বা ইলম আমাকে আল্লাহর উবূদিয়্যত বা দাসত্ব পর্যন্ত নিয়ে গেল না, সেটাকে ইলম বলি কি করে? আমি অনেক কিছু জেনেও যদি আল্লাহর দাসত্ব করতে অভ্যস্ত হলাম না, রাত জেগে ইবাদত করলাম না, তাহলে আমি জাহেলই রয়ে গেলাম।
১৬. নিছক রাতাজাগা ইবাদতের কথাই বলেননি, পাশাপাশি ইবাদতের ধরনও বলেছেন। তারা ইবাদত করেন, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে (سَاجِدًا وَقَائِمًا)। তারা মানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে কিয়াম করেন ও সিজদা করেন। এবং খুব কুনূতের সাথেই করেন।
১৭. ইবাদতের বাহ্যিক অবস্থা রুকু ও সিজদার কথাই শুধু বলেননি আল্লাহ তা‘আলা। কানিতের ভেতরকার অবস্থাও তুলে ধরেছেন। রুকু ও সিজদায় কানিতের অবস্থা কেমন থাকে? দু’টি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন,
ক: যে আখেরাতকে ভয় করে (يَحْذَرُ الْآخِرَةَ)।
খ: এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে (وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ)।
আখেরাতের ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে, তাহাজ্জুদগুজার ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। সেদিন কী হবে, কেমন হবে, এনিয়ে শংকিত থাকে। পাশাপাশি ভয় তার মধ্যে কোনও প্রকার নৈরাশ্য সৃষ্টি করেই না, উল্টো রবের রহমতের আশা, তাকে আরও বেশি ইবাদতমুখী করে দেয়। এমন ভয় ও আশা শুধু সামান্য সময়ের জন্যেই নয়, ইবাদতের পুরো সময়কাল জুড়েই ব্যাপ্ত থাকে।
১৮. চারপাশে মানুষজন গভীর ঘুমে বিভোর। তাহাজ্জুদগুজার কানিত প্রশান্তচিত্তে সালাত আদায় করে চলেছেন। কায়মনোবাক্যে মুনাজাতের পরম স্বাদ আস্বাদন করে চলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে তাহাজ্জুদগুজারের এমন অপূর্ব ঈমানি চিত্র কেন এঁকেছেন? গভীর রাতের নির্জন অন্ধকারের এই চিত্র দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন?
-আল্লাহ তা‘আলা কি, আমাদেরকেও এমনটা করতে উৎসাহিত করেননি? আয়াতের ভাষ্য কি এটাই বলছে না, বান্দা! তুমি যদি প্রকৃত জ্ঞানী হতে চাও, তাহলে এভাবে রাতের আঁধারে সাজিদ-কায়িম-কানিত হও?
১৯. আয়াতের শেষে এসেও আমাদের উৎসাহ আগ্রহকে উস্কে দিতে চেয়েছেন। আমাদেরকে জ্ঞানের পথ, জ্ঞানীগনের পথ অবলম্বন করতে বলেছেন। প্রকৃত জ্ঞানীর মতো উপদেশ গ্রহণ করতে বলেছেন। উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে (إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ)।
২০. সূরা সাজদায় এসে দেখি রাতজাগার অন্যরকম চিত্র। কথা শুরুই হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। একেবারে মূলে মূল ধরে টান দেয়া হয়েছে। মুমিন কারা? আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি যারা ঈমান আনে, তারা কেমন হয়? কেমন হয় তাদের আমল?
إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ۩
আমার আয়াতসমূহে তো ঈমান আনে কেবল তারা, যারা এর দ্বারা যখন উপদেশপ্রাপ্ত হয়, তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং নিজ প্রতিপালকের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে। আর তারা অহংকার করে না (১৫)।
এই আয়াত পড়লে সিজদা দিতে হয়।
২১. এতো গেল প্রকৃত মুমিনের সার্বক্ষণিক চিত্র। তাদেরকে যখন উপদেশ দেয়া হয় তারা,
ক: সিজদায় লুটিয়ে পড়ে।
খ: রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করে।
গ: তারা অহংকার করে না। বিনা বাক্যব্যয়ে উপদেশ মেনে নেয়।
কিন্তু রাতের বেলা এই সত্যিকারের মুমিনগণ অভূতপূর্ব এক কাজ করেন। কী সেটা? আয়াতে দেখি,
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
(রাতের বেলা) তাদের পাশ্বদেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশা (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে (১৬)।
২২. ইশার নামায পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন মানুষটা। আশেপাশের লোকজন তখনো জেগে। আস্তে আস্তে রাত গভীর হল। একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। চারদিক সুনসান। কিভাবে যেন মানুষটা জেগে গেলেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর বিছানার সাথে পিঠ লাগিয়ে রাখতে পারলেন না। তড়াক করে উঠে গেলেন। মশগুল হয়ে গেলেন রব্বের ইবাদতে। রবের ভয় আর আশার দোলাচলে দোল খাওয়া হৃদয়ে কিয়াম-রুকু-সিজদা-মুনাজাতে ডুবে গেলেন। আবার পড়ি।
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
রাত গভীর হলেই বিছানা যেন কাঁটাময় হয়ে যায়। এই মানুষগুলো আর শুয়ে থাকতে পারেন না। পিঠে যেন কাঁটা বিঁধতে থাকে। শুয়ে থাকতে একটুও স্বস্তিবোধ হয় না। অদ্ভুতরকমের অস্থির অস্থির লাগতে শুরু করে। মাথাটা বালিশের উপর এপাশ ওপাশ করতে থাকে। বুকের ভেতরটা ভয়ে কেমন ধড়ফড় করতে করতে থাকে। আবার অসম্ভব কিছু পাওয়ার আশা মনের গহীনে কোথাও ঝিকিয়ে উঠতে থাকে। আর শুয়ে থাকা যায় না। দু‘আ পড়তে পড়তে আরামের শয্যা ছেড়ে বসে পড়েন।
২৩. এই আয়াতে যে মুমিনের কথা বলা হয়েছে, জীবনে কখনো কি আমি তার দলে শামিল হতে পেরেছিলাম? রবের ভালোবাসা আমাকে এতটা মাতোয়ারা আর বেচাইন করে তুলতে পেরেছিল? আয়াতে যে চিত্রকল্পটা আঁকা হয়েছে, আমার সামনে কি সেটা যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে? আঁধার রাত! একজন ঘুমন্ত মানুষ! অস্থিরতা! আচানক বিছানা ছেড়ে উঠে পড়া? আসে কল্পনায়? চিন্তায়? অনুভবে? আসে এমন কিছু? স্বচক্ষে এমন কাউকে দেখার সুযোগ হয়েছিল? সৌভাগ্য এসেছিল জীবনে এমন দৃশ্য দুই নয়নে সরাসরি দেখার?
২৪. এই আয়াতটি পড়ার সময়, কখনো নিজেকে আয়াতের দৃশ্যকল্পে কল্পনা করে দেখেছিলাম? আয়াতটি তিলাওয়াত করতে গিয়ে, থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল কখনো? গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, কখনো কি আয়াতটি মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল? বিজন রাতে কখনো এই আয়াত আমাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য করেছিল? এই আয়াত কখনো কি আমার দুগ্ধফেননিভ ফুলশয্যাকে শরশয্যায় পরিণত করেছিল? এই আয়াত কি আমাকে কখনো নিকষ কালো রাতে, ওজুখানায় ছুটে যেতে বাধ্য করেছিল? তারাহীন রাতে এই আয়াত কি কখনো আমার হৃদয়াকাশে জ্বলজ্বলে তারা হয়ে ধরা দিয়েছিল? চাঁদহীন কোনও রাতে, আকাশজুড়ে কি (تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ) আয়াতটি ভেসে উঠেছিল? ক্রমশ নিস্প্রভ হতে থাকা, কোনও জোছনামাখা রাত আমাকে (خَوْفًا وَطَمَعًا) ভয় ও আশায় উদ্বেল করে তুলতে পেরেছিল?
২৫. ঈমানি জাগরণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, এমন বেশ কিছু আয়াত আছে। কিন্তু এই আয়াত? এটার ধরনই আলাদা! এই আয়াতের প্রভাবই আলাদা। এই আয়াতের আবেদনই ভিন্ন। অস্থির করে তোলে। নিজের অতীত পাপের শাস্তির ভয় শংকিত করে তোলে। রাব্বে কারীমের অসীম ক্ষমার প্রতি পরম আশাবাদী করে তোলে। আবারও পড়ি,
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
আসলেই কি এই আয়াত আমার রাতকে এমন সুবর্ণ করে তোলে? নাকি আর দশটা শূন্য দিনের মতো, নিশুতি রাতটাও আঁধারে আঁধারে কেটে যায়?
২৬. আমি কে? আল্লাহর বান্দা। রহমানের বান্দা। আসলেই কি তাই? রহমানের বান্দা হতে হলে, যে যোগ্যতা লাগে, আমার কি সেই যোগ্যতা আছে? কুরআন কারীমে রহমানের বান্দাগনের যে বৈশিষ্টগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তার কোনওটা কি আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে? রহমানের বান্দাগণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল,
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
এবং তারা (রহমানের বান্দারা) রাত অতিবাহিত করে নিজ প্রতিপালকের সামনে (কখনও) সিজদারত অবস্থায় এবং (কখনও) দণ্ডায়মান অবস্থায় (ফুরকান ৬৪)।
২৭. দুনিয়ার সবাই রাত কাটায়। রাত যাপন করে। রাত অতিবাহিত করে। কিন্তু সবার রাত কাটানো আর রহমানের বান্দাগণের রাত কাটানোতে আকাশ পাতাল তফাৎ। কেউ রাত কাটায় বেঘোরে ঘুমিয়ে। কেউ রাত কাটায় অনলাইনে। কেউ রাত কাটায় ইউটিউবে। কেউ রাত কাটায় মোবাইলে। কেউ রাত কাটায় গল্পের বইয়ে। কেউ রাত কাটায় অন্য কোনও গুনাহে! কেউ রাত কাটায় গুনাহপূর্ণ দৃশ্য দেখে। কেউ রাত কাটায় অহেতুক গল্পগুজবে। কেউ কাটায় অনর্থক ঘোরাফেরায়।
এমনকি অনেকে ভালো কাজেও রাত কাটায়। কেউ দ্বীনি বইপত্র পড়ে, কেউ কুরআন তিলাওয়াত করে, কেউ ওয়াজ নসীহত শুনে, কেউ দ্বীন সম্পর্কে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গিয়ে। কিন্তু রহমানের বান্দারা রাত কাটায়, তাদের রবের প্রতি (سُجَّدًا وَقِيَامًا) (কখনও) সিজদারত অবস্থায় এবং (কখনও) দণ্ডায়মান অবস্থায়।
২৮. এই আয়াতে রাতের নির্দিষ্ট কোনও অংশের কথা বলা হয়নি, পুরো রাত জুড়েই একটানা ইবাদত বন্দেগীর কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে তারা রুকুতে পড়ে থাকে! দীর্ঘ সময় জুড়ে তারা সিজদায় লুটিয়ে থাকে। ইলমচর্চা, জ্ঞানচর্চার বাহ্যিক উপকরণ তাদেরকে ইলমচর্চার আসল মাধ্যম থেকে বিমুখ করতে পারে না। তারা জানে, প্রকৃত ইলমচর্চা রাতজেগে রুকু-সিজদা করার মাঝেই নিহিত।
২৯. ঈমানি জাগরণের সবচেয়ে কোমল আর সুন্দর চিত্র ফুটে আছে, সূরা মুযযাম্মিলে। আল্লাহ তা‘আলা একান্ত আপন ভঙ্গিতে নবীকে সম্বোধন করছেন। আয়াতে ফুটে আছে ঘরোয়া অন্তরঙ্গ সুর,
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا نِّصْفَهُ أَوِ انقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
হে চাদরাবৃত! রাতের কিছু অংশ ছাড়া বাকি রাত (ইবাদতের জন্যে) দাঁড়িয়ে যান, রাতের অর্ধাংশ থেকে কিছু কমিয়ে নিন। বা তা থেকে কিছু বাড়িয়ে নিন এবং ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত করুন (১-৪)।
৩০. নবীজি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন বা বসে আছেন। আমাদের মতোই। কেন? তখন কি শীতকাল ছিল? এত গরমের মধ্যে চাদর মুড়ি দেয়া কেন? সে যাক। আল্লাহ তা‘আলা এমন অবস্থাতেই অহী পাঠালেন। ওহীর শব্দমালায় নবীজির তাৎক্ষণিক অবস্থার চিত্র চিরকালের জন্যে, আঁকা হয়ে গেল। আমরা সান্ত¡না পেতে পারি, তিনিও আমাদের মতো চাদর মুড়ি দেন। আমাদের মতো শুয়ে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলার সাথে তাঁর অত্যন্ত আপন-আপন সম্পর্ক। নবীজি নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছেন। পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। এ-সময় ওহী পাঠালেন আল্লাহ। কী বললেন? ঘুম-বিছানা-আরাম-স্ত্রী-কন্যাদের ছেড়ে উঠে যেতে বললেন। সালাতে দাঁড়াতে হুকুম দিলেন।
৩১. ইসলামের অভিযাত্রা সবে শুরু হয়েছে। তখনও দাওয়াতের কাজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরু হয়নি। কাফেরদের প্রবল প্রতিরোধ আসতে শুরু করেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে, রাব্বে কারীম জানেন। প্রবল ঝাপটার মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহাজ্জুদ ছিল সে প্রস্তুতির শক্তিশালী উপাদান। জাহেলী যুগে, চরম অন্ধকার থেকে আলোতে আসা নবমুসলিমদের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যে, তাহাজ্জুদের আমল দিয়েছিলেন। সম্বোধন নবীজিকে করলেও, আরেক আয়াতে বোঝা যায়, আমলে সাহাবায়ে কেরামও সঙ্গী হতেন।
৩২. এমন আমল আসার কথা ছিল দ্বীনের দাওয়াতের শেষ দিকে। লোকজন ইসলামে আসার পর, ইসলামকে বোঝার, কুরআন কারীমের মাহাত্ম্য অনুধাবন করার পর, নবীজিকে ভালো করে জানার পর, গভীর রাতের তাহাজ্জুদের যিম্মাদারি আসার কথা ছিল। কিন্তু একেবারে শুরুতেই এমন উচ্চ পর্যায়ের আমল? উঁচুদরের সাধনা? একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, আল্লাহ তা‘আলা কেন এই আমল শেষে না দিয়ে শুরুতেই দিয়েছিলেন। তাহাজ্জুদের আমলে বান্দার আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। রব্বের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। রাতের ইবাদতে দিনের গ্লানি মুছে যায়। প্রথম দিকে দিনের বেলা, প্রকাশ্যে ইবাদত করা নিরাপদ ছিল না, ইবাদত রাতে করাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত ছিল।
৩৩. দ্বিতীয় আয়াতের অর্থটা খেয়াল করেছি? অল্পকিছু সময় ছাড়া, বাকি রাতের পুরোটাই ইবাদতের জন্যে দাঁড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে নবীজিকে। অল্প (قَلِيلًا) মানে? তিনভাগের একভাগ? নাকি আরও কম? বাকি এত দীর্ঘ সময় নবীজি ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকতেন? সুবহানাল্লাহ!
৩৪. এই হুকুম শুধু নবীজি সা.-এর জন্যেই ছিল না। সাহাবায়ে কেরামও শরীক ছিলেন। প্রথম দিককার সেই কষ্টের দিনগুলোতে, সাহাবায়ে কেরামও নবীজির সাথে তাহাজ্জুদের আমলে শরীক হতেন। প্রায় পুরো রাত, নিঝুম আঁধারে, নবীজির সাথে একদল নবদীক্ষিত মুসলিম, সালাতে দাঁড়িয়েছেন! দৃশ্যটা কল্পনা করতে কেমন লাগে না? আলী আছেন! আবু বকর আছেন! উসমান আছেন। আম্মাজান খাদীজা রা.-ও আছেন! আহ কী সব দিন ছিল! সারাদিনের কষ্ট, নির্যাতন সয়ে রাতে এসে মনিবের কোলে আশ্রয় নিয়ে একদল মানুষ হেঁচকি দিয়ে কেঁদে কেঁদে ইবাদত করছে! আয়াতটা পড়ি,
إِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ أَنَّكَ تَقُومُ أَدْنَىٰ مِن ثُلُثَيِ اللَّيْلِ وَنِصْفَهُ وَثُلُثَهُ وَطَائِفَةٌ مِّنَ الَّذِينَ مَعَكَ ۚ
(হে রাসূল!) আপনার প্রতিপালক জানেন, আপনি রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে, (কখনও) অর্থ রাতে এবং (কখনও) রাতের এক তৃতীয়াংশে (তাহাজ্জুদের নামাযের জন্যে) জাগরণ করেন এবং আপনার সঙ্গীদের মধ্যেও একটি দল (এ রকম করে): ২০।
৩৫. প্রথম দিকের সাহাবীগণের তাহাজ্জুগুজারি, আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই ভালো লেগেছিল। পছন্দ হয়েছিল। তিনি তাদের কথা সরাসরি আয়াতে উল্লেখ করে, অবিস্মরণীয় করে দিয়েছেন। আয়াত নাযিল হওয়ার সময়, যারা নবীজির সাথে রাতের আমলে শরীক হতেন, তারা কত সৌভাগ্যবান? রাতের বেশির ভাগ অংশ ইবাদতে কাটানো চাট্টিখানি কথা নয়। তাদের এই আমলের কারণে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তাদের আলোচনাকে চিরন্তন করে দিয়েছেন। আমরা যদি এমন আমল করি, আমরাও রাব্বে কারীমের আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হব। আমরা দুনিয়াবী কাজে দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে পারলেও, দুই রাকাত তাহাজ্জুদের জন্যে একটুখানি সময় ব্যয় করতে পারি না। আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার কাজে রাতকে রাত জাগতে পারি, আল্লাহর অতি নিকটে এনে দেবে, এমন কাজে পুরো রাত নয়, অর্ধেক রাত নয়, ঘণ্টা নয়, সামান্য কিছু সময় ব্যয় করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে না।
৩৬. এরচেয়েও দুঃখজনক ঘটনা আছে। সারা রাত জাগে। নামাজী ব্যক্তি। তাই রাত জেগে দুনিয়া ঠিক রাখে, আখেরাতও ঠিক রাখে। যা তা কথা নয়! ফজর পড়ে তারপর ঘুমুতে যায়। কিন্তু ফজর নামাজ কিভাবে পড়ে?
وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَىٰ
তারা যখন সালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসতার সাথে দাঁড়ায় (নিসা ১৪২)।
৩৭. উপরোক্ত আয়াতে মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে। তারা সালাত আদায় করে আলস্যের সাথে। শুধু দুনিয়াদার নয়, দ্বীনদারদের মধ্যেও এমন কেউ কেউ আছে, রাত জেগে কুরআন হাদীস পড়েছেন, ইলমচর্চা করেছেন, কিন্তু ফজরের সালাতে হুবহু উক্ত আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাহলে কী লাভ হল এত কুরআন হাদীস চর্চা করে?
৩৮. কুরআন কারীমে রাত জাগা নিয়ে এত গুরুত্ব, এত তাকিদ, আধুনিক যুগে এসে কেন যেন বিষয়টি অনেকের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। একেবারে গৌণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সমকালীন একজন বিখ্যাত ‘দায়ীর’ বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি আবার ‘মোটিভেশনাল’ বক্তা হিশেবেও বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন। কথা বলছিলেন, ‘টাইম ম্যানেজম্যান্ট’ সময়-ব্যবস্থাপনা নিয়ে। সময় নিয়ন্ত্রণের সাথে কিভাবে ব্যক্তিত্বের শক্তিমত্তা প্রকাশ পায়, বেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা দিয়ে বোঝাচ্ছেন। শ্রোতারাও বিমুগ্ধচিত্তে শুনছে। কথা বলতে বলতে ঘুম প্রসঙ্গে এলেন। তিনি দায়ী, তার শ্রোতারাও বেশিরভাগ দাওয়া ঘেঁষা। অবাক লাগল, তিনি ঘুম প্রসঙ্গে কথা বললেন, পুরোপুরি পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ঢঙে। বরং বলা ভালো, তিনি তাদের চেয়েও আগে বেড়ে বললেন, একটি কর্মমুখর দিবসের জন্যে একটি ঘুমশ্রান্ত রাত দরকার। একজন দায়ীর চিন্তার যদি এই হাল হয়, মাদউ বা দাওয়াতপ্রাপ্তদের হালত কেমন হবে? দ্বীন ইসলামের খোলনলচেকে এভাবে ‘পাশ্চাত্যের’ রূপরঙরসে জারিত করে ফেললে চলবে? তিনি কুরআন হাদীসে সুপণ্ডিত, তারপরও তার সামনে থেকে কুরআন কারীমের আয়াতগুলো কিভাবে সরে গেল?
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
আমার চিন্তাচেতনায় কুরআন কারীমের প্রভাব প্রবল না হয়ে পাশ্চাত্যের জং ধরা ধ্যানধারনা কিভাবে প্রবল হয়?
৩৯. হাঁ, তাহাজ্জুদ হল নফল। ঐচ্ছিক। পড়তে পারলে ভালো, না পড়লে ধরপাকড় নেই। কিন্তু তাই বলে এতটা হেলাফেলায় ছেড়ে দেয়ার মতোও তো নয়? সবকিছুতে ছাড় চাই। শরীয়তের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আমলেও কেন ছাড়গ্রহীতা বনে বসে আছি? আল্লাহর কালামে যা আছে, সেটাকে কেন আমরা ছাড়ের তালিকায় শীর্ষস্থান দিয়ে রেখেছি? পাশ্চাত্যের মানদণ্ডের ঘুম যদি মানবজাতির জন্যে অধিক উপকারী হত, তাহলে কুরআন কারীম কেন বারবার রাতজাগার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে? আল্লাহ তা‘আলা কেন তার পাক কালামে বারবার মুমিনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাহাজ্জুদের আমলের প্রতি আগ্রহী করার প্রয়াস পেয়েছেন?
৪০. আমরা যদি তাহাজ্জুদ বিষয় আয়াতগুলো গভীরভাবে তাদাব্বুরের সাথে পড়ি। তারপরও নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি,
-আমি কিভাবে রাতদিন কাটাব?
কুরআনের আদর্শ ধারণ করে যদি উত্তরটা খুঁজতে যাই, তাহলে মুমিনের দিনযাপন পদ্ধতি আর পাশ্চাত্যের আদর্শ জীবনযাপন পদ্ধতি খুবই সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। পাশ্চাত্যের চিন্তাবলয় থেকে কল্পনা করাই মুশকিল, রাতজেগে ইবাদত করার, দীর্ঘ কিয়াম রুকু সিজদা করার মাঝে কী উপকারিতা নিহিত আছে!
৪১. শায়খগনের কাছে মুরীদেরা প্রশ্ন করেন,
-আমি কিয়ামুল লাইলে অভ্যস্ত নই। আগে কখনো তাহাজ্জুদ পড়িনি। প্রথম রাতে জাগতে পারি। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে, আর জেগে উঠতে পারি না। পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায়, আমলটাকে অত্যন্ত কঠিন মনে হয়।
-বৎস! তুমি আগে আল্লাহর কাছে দু‘আ করো। সাহায্য চাও। তাওফীক কামনা করো। তারপর প্রতিজ্ঞা করো আজ রাতেই আমলটা করব। দেখবে সহজেই হয়ে গেছে। আর মনে রাখবে, জীবনের প্রথম দিনের তাহাজ্জুদে অন্যরকমের স্বাদ আছে। ভিন্ন রকমের আনন্দ আছে। আল্লাহর খাস বান্দাগণই শুধু এই আনন্দের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন। তুমি আল্লাহর দিকে আসতে চাইলে আল্লাহ তোমাকে এগুতে সাহায্য করবেনই। শুধু প্রথম দিনই নয়, প্রতিদিনই, তাহাজ্জুদ গুজারগণ তাদের মনে অপূর্ব স্বাদ আর আনন্দ উপভোগ করেন। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠে, ওজু করে, তাহাজ্জুদের দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত সময়টাতে প্রিয় ‘মাহবূবের’ সামনে দাঁড়ানোর যে প্রতীক্ষা চলতে থাকে, সে মিষ্টি প্রতীক্ষার মিষ্টতা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। প্রস্তুতি শেষ করে তুমি যখন ‘মাহবূবের’ সামনে সালাতে দাঁড়াবে, তোমার তনুমন বর্ণনাতীত প্রশান্তিতে ছেড়ে যাবে। মনে হবে তুমি তীব্র গরম থেকে এইমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রবেশ করলে। প্রবল শত্রুর ধাওয়া খেয়ে পরম নিরাপদ আশ্রয়ে এসে প্রবেশ করলে। প্রতিদিন তাহাজ্জুদ শুরুর সুবর্ণ মুহূর্তটার অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করার জন্যে পুরো দিন উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করতেন। জুনায়েদ বাগদাদী রহ.-এর একটা উক্তি সুফি মহলে বেশ বিখ্যাত। ইবনুল কাইয়িম রহ. তার মাদারিজুস সালিকীনেও বাক্যটা উল্লেখ করেছেন,
وَشَوْقَاه إلى أَوْقَاتِ البِدايَةِ
আহা! কী অধীর প্রতীক্ষামাখা উন্মুখ ব্যাকুলতা, (তাহাজ্জুদ) শুরুর (অপূর্ব) ক্ষণগুলোর প্রতি!
৪২. উপরোক্ত আয়াতগুলোতে, কিয়ামুল লাইলের দু’টি স্তর আছে। আয়াতে বর্ণিত কিয়ামুল লাইল থেকে দুটি সম্ভাবনা বের করা হয়,
১: কিয়ামুল ফরয (قِيامُ الفرض)। ফরয কিয়াম। ঈশার সালাতের কিয়াত।
২: কিয়ামুল কামাল (قيام الكَمال)। পূর্ণতার কিয়াম। এটা তাহাজ্জুদ।
একটুখানি তত্ত্বকথা!
৪৩. প্রথমে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেই। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টা মাথায় থাকলে, সালাফ ও খালাফ (পরবর্তী)-এর তাফসীরের মধ্যে আপাত বিরোধগুলোর সুন্দর সমাধান জানা হয়ে যাবে। কুরআন কারীমের তাফসীরকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়। কোনও মুফাসসিরই সালাফের তাফসীরকে পাশ কাটিয়ে, নিজে স্বতন্ত্র তাফসীর করতে পারেন না। তাদেরকে সালাফের দ্বারস্থ হতেই হয়। সালাফের উক্তি নকল করতেই হয়। এটা মাথায় রেখে এবার জানি, তাফসীর দুই প্রকার,
ক: তাফসীরে তামসীল (تفسير التمثيل)। নমুনামূলক তাফসীর। একটি আয়াতের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। মুফাসসির নমুনাস্বরূপ একটি উক্তি নকল করলেন। বাকি আরও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেন না। এটাই তাফসীরে তামসীল।
খ: তাফসীরুল হাসরি ওয়াল হাদ্দি (تفسير الحصر والحد)। সীমা-চৌহদ্দি নির্ধারক তাফসীর। একটা আয়াতে যতগুলো সম্ভাবনা সালাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে, সবগুলো বর্ণনা করা।
৪৪. সালাফের তাফসীরগুলো হয় সংক্ষিপ্ত। তারা সাধারণত তাফসীরের প্রথম প্রকারকে মানে তাফসীরে তামসীলকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কোনও আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সম্ভাবনা থাকলেও, পছন্দের মতটাকে নিজের তাফসীরে স্থান দেন। বাকিগুলো এড়িয়ে যান। তার মানে এই নয়, তারা বাকিগুলোকে ভুল মনে করেছেন বা দুর্বল মনে করেছেন।
৪৫. খালাফ (পরবর্তীরা) যখন সালাফের তাফসীর পড়তে বসেন, তাদের কেউ কেউ ভুল করে, সালাফের তাফসীরে তামসীলকে মনে করে বসে তাফসীরে হাসর ও হাদ্দ। এখানেই সমস্যা বাঁধে। এ-বিষয়টাকে সর্বপ্রথম সুন্দর ও আলাদা করে নির্ণয় করে দেখিয়েছিলেন, আল্লামা ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালুসি রহ.। মৃত্যু ৫৪২ হিজরী। তার বিখ্যাত তাফসীর আল মুহাররারুল ওয়াজীযে (المُحَرِّر الوجيز)। তিনি লিখেছেন,
وَإِنَّما عَبّر عُلَماءُ السلَفِ في ذلك بِعِباراتٍ على جِهَةِ المِثالاتِ، فَجَعَلها المُتأخِّرُون أَقْوالًا.
সালাফ (কোনও আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে) দৃষ্টান্ত হিশেবে কিছু কথা বর্ণনা করেন, পরবর্তীরা সেটাকে (তাফসীরের ক্ষেত্রে) চূড়ান্ত উক্তি ঠাউরে বসে।
৪৬. আল্লামা ইবনে আতিয়্যাহ রহ.-এর এই চমৎকার উক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, পরবর্তীতে অনেকেই নিজেদের তাফসীরকে সমন্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর আলোকে তাফসীরের একটা কায়েদাও বানিয়েছেন। সালাফের তাফসীর সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
أَنْ يَذكُرَ كُلٌّ منهم مِن الاسم العامِّ بَعضَ أنْواعِه على سبيلِ التمثيلِ، وتنبِيهِ المستمعِ على النوعِ، لا على سبيل الحدِّ المُطابَقِ للمَحدود في عُمومه وخُصوصه.
ক: কিছু শব্দ থাকে আম। ব্যাপক অর্থবিশিষ্ট। শব্দ একটি তবে অর্থ বহু।
খ: সালাফ তাফসীর করতে গিয়ে, আম শব্দটির সব অর্থ উল্লেখ করেন না। গ: তারা এমনটা করেন, দৃষ্টান্তস্বরূপ। শ্রোতা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। ভাবটা এমন, দেখ শব্দটির আরও অর্থ আছে, তার একটি বা কয়েকটি নমুনা হল ‘এই’ ‘এই’।
ঘ: শব্দটির অর্থের চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণ করা তাদের উদ্দেশ্য থাকে না। মানে আমি যা বললাম, এগুলোই সাকুল্যে শব্দ বা বাক্যটির অর্থ, এর বাইরে আর কোনও অর্থ নেই। সালাফ এমনটা বোঝাতে চান না।
৪৭. একটা উদাহরণ টানা যাক। কুরআন কারীমের বিখ্যাত একটি শব্দবন্ধ হল অবশিষ্ট সৎকর্ম (الباقيات الصالحات)। মানে যা টিকে থাকবে। বাকী থাকবে। সালাফকে শব্দবন্ধটির অর্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাদের একেকজন একেক অর্থ বলেছেন। বাকিয়াতুস সালিহাত মানে,
ক: কেউ বলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
খ: কেউ বলেছেন, সুবহা-নাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ।
গ: কেউ বলেছেন, পাঁচ নামায। ইত্যাদি।
পরবর্তীদের কেউ কেউ ভুলবশত ভেবে বসেছেন, সালাফের যিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তিনি এটাকেই বাকিয়াতুস সালিহাতের অর্থ বলে মনে করেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এমন নয়। সালাফ শুধু নমুনাস্বরূপই একটি বা দু’টি অর্থ উল্লেখ করে ক্ষান্ত হয়েছেন। অর্থের বাকি সম্ভাবনাগুলোকে নাকচ করেননি।
৪৮. সালাফের কেউ যদি রাতজাগে ইবাদতের আয়াতগুলোর তাফসীরে, ঈশার নামাযের কথা লিখে থাকেন, তারা সেটা বলেছেন তাফসীরে তামসীল হিশেবে। তাফসীরের দ্বিতীয় প্রকার হিশেবে নয়। তারা এসব আয়াতের একটা অর্থ যে তাহাজ্জুদও হতে পারে, সেটাকে নাকচ করেননি।
তত্ত্ব ছেড়ে জীবনে আসি!
৪৯. আচ্ছা, ঈশা হোক আর তাহাজ্জুদ হোক, রাত জেগে ইবাদতের কথাই বলা হয়েছে আয়াতগুলো, এ-নিয়ে তো কারও দ্বিমত নেই? আর সূরা মুযযাম্মিল নাযিলের সময় তো ঈশার সালাত ছিল না। এখন প্রশ্ন হল, এত উৎসাহ যোগানো ‘ঈমানি জাগরণের’ মূল অর্জন কি?
-এই ঈমানি জাগরণের অর্জনের তালিকা করতে বসলে, শেষ করা যাবে না। এই জাগরণের উপকারিতার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। আমরা তাফসীরে তামসীল হিশেবে একটা অর্থ নিতে পারি। ইস্তেমদাদ (الاستمداد)। সাহায্য সংগ্রহ। রসদ সংগ্রহ। আমি যখন আরামদায়ক ওমমাখা লেপ-তোষকের মায়া ছেড়ে, তড়াক করে উঠে পড়ে, কনকনে শীতে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু সেরে, প্রাণাধিক ‘মাহবূবের’ সামনে দাঁড়াই, শুরু হয়ে যায় আসমানী ‘ইস্তেমদাদ’। রাব্বে কারীমের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা ও প্রাপ্তির সূচনা হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতের অসীম ভাণ্ডার থেকে আমার জন্যে বরাদ্দ হতে থাকে রিযিক, ইলম, তাওফীক, হিদায়াত।
৫০. আল্লাহর রহমতের ভা-ার একবার খুলে গেলে, সেটা বন্ধ করার সাধ্য কারো আছে?
مَّا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِن رَّحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا ۖ
আল্লাহ মানুষের জন্যে যে রহমত খুলে দেন, তা রোধ করার কেউ নেই (ফাতির ২)।
৫১. আমি কি আজ থেকেই অনন্ত অসীম খাযানা (ধণভা-ার) থেকে ইস্তেমদাদ শুরু করতে পারি না? অল্প কিছু করে হলেও?
৫২. ঈশার ও ফজরের সালাত জামাতের সাথে পড়লেও সারারাত জেগে ইবাদতের ফযীলত অর্জন হয়। কিন্তু শহীদ হওয়া এক কথা আর অন্য কোনও আমল করে শহীদের ফযীলত অর্জন করা কি এক?
(দু’জনেই ডক্টর। একজন মাথার ঘাম পায়ে পেলে, থিসিস লিখে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছে। আরেকজন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছে। দু’জন সমান হতে পারে না)।
৫৩. ইলমের চূড়ান্ত মানদ- রাতজেগে ইবাদতে নিহিত। রাতজেগে কিতাবপাঠে নয়। কিতাবপাঠের জন্যে তো সারাদিন, রাতের প্রথমভাগ রয়েছেই। প্রকৃত নবীওয়ালা আলিমের কখনো তাহাজ্জুদ কাযা হতে পারে না। মুত্তাকি আলিম রাতের শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ ছেড়ে কিতাব নিয়ে পড়ে থাকতে পারে না।
৫৪. তাহাজ্জুদের লযযত বা স্বাদের বিভিন্ন স্তর আছে। সবাই সব স্তরের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না। তাহাজ্জুদের সর্বোচ্চ স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন ময়দানের মুজাহিদগণ। তারপরের স্তরে আছেন নজর ও যবানের হেফাযতকারী গৃহীরা। নজর ও যবান হেফাযত করতে না পারলে, তাহাজ্জুদের মজা পাবে না, এমন নয়। আমরা বলেছি সর্বোচ্চ স্বাদের কথা।
৫৫. কুরআন কারীম তাহাজ্জুদের প্রাণভোমরা। সূরা মুযযাম্মিলের চতুর্থ আয়াতের কথা মনে আছে না? রাত জাগার হুকুম দিয়ে, পাশাপাশি তারতীলের সাথে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করতে বলেছেন।
৫৬. সূরা মুযযাম্মিলের বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, তাহাজ্জুদে কুরআন কারীম স্পষ্ট আওয়াজে, ধীরেসুস্থে তিলাওয়াত করা বাঞ্ছনীয়। সম্ভব হলে সুর করে। কান্নার ভান করে তিলাওয়াত করা। আবার আওয়াজ যাতে বেশি উচ্চ না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা। অন্যের ঘুমের ক্ষতি হতে পারে।
৫৭. আমরা দুর্বল! পুরো রাত জাগা সম্ভব নয়। কিন্তু অল্পকিছু সময় বের করা তো সম্ভব। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে, ভোর রাতে জেগে ওঠে কঠিন কিছু নয়। ভোর রাতে উঠলে, স্কুল-কলেজ, অফিসে সারাদিন ঝিমুনি আসবে? উঁহু, হিশেব করে, নিয়তান্ত্রিকভাবে ঘুমুলে, সমস্যা হবে না। ইনশাআল্লাহ।
৫৮. ও হাঁ, ইনসমনিয়া রোগ। কিন্তু ঈমানি ইনসমনিয়া রোগ নয়। এটা বরং সর্বোচ্চ সুস্থ্যতার লক্ষণ। ঈমানি ইনসমনিয়া মানসিক সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ।
৫৯. সবচেয়ে বড় কথা, শেষ রাতে, আমি আর আল্লাহ! দু’জনের মাঝে আর কেউ নেই। কারও আওয়াজ নেই। কারও চোখের শ্যেনদৃষ্টি নেই। এ-এক অপূর্ব মহব্বতের সওদা। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বান্দাদের রাতে জাগিয়ে দেন, তাঁর সাথে কথা বলার জন্যে।