উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর ছোট একটি ‘দুসতুরুল আমল’ আমার হস্তগত হয়, যা তিনি তাঁর সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক যারা রাখেন তাদেরকে দিয়ে থাকেন। এতে যে কাজগুলোর কথা আছে তা যেহেতু প্রত্যেক মুসলিমের জন্যই অনুসরণীয় এজন্য সবার উপকারার্থে তা তরজমা করে প্রকাশ করা হল। এতে নিছক পদ্ধতিগত যে বিষয়গুলো রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো মুবাহ পন্থাই অবলম্বন করা যায়। যাঁরা কোনো হক্কানী বুযুর্গের সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক রাখেন তারা এই সব বিষয়ে নিজের শায়খের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে পারেন। এই লেখাটা এখানে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হল ইসলাহের ক্ষেত্রে বুনিয়াদী বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা। -তত্ত্বাবধায়ক
কারো সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্য রেওয়াজী কোনো সম্পর্ক স্থাপন করা নয়; বরং প্রকৃত অর্থেই তার উদ্দেশ্য হবে নিজের আমল ও আখলাক সংশোধনের নিয়তে এমন কোনো ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়া যার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা আছে যে, তিনি আমার আত্মিক রোগব্যাধি বুঝবেন এবং কল্যাণকামিতার সঙ্গে সেগুলোর চিকিৎসার পথ বাতলে দিবেন।
সুতরাং ইসলাহী সম্পর্কের উদ্দেশ্য এমন না হওয়া চাই যে, এর দ্বারা আমার কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। যেমন ব্যবসায় বরকত হবে, চাকরি পাব, ঋণ পরিশোধ হবে, রোগবালাই থেকে মুক্তি পাব ইত্যাদি। এমনিভাবে এমন কোনো উদ্দেশ্যও না হওয়া চাই যে, এ সম্পর্কের উসিলায় তাবিজ-তুমার দিতে পারব, ঝাড়ফুঁক করতে পারব বা স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পারব। বিশেষত আমি তো এসব বিষয়ে একেবারেই বেখবর। সুতরাং আমাকে অন্তত এ জাতীয় খেদমতে মাজুর মনে করুন।
ইসলাহী সম্পর্কের উদ্দেশ্য যেহেতু নিজের আমল ও আখলাকের সংশোধন করা তাই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর এখন থেকেই কাজ শুরু করে দিন।
১. মুহতারাম আববাজানের পুস্তিকা ‘তাসহীলু কাসদিস সাবীল’ মনোযোগের সঙ্গে পড়ুন। বিশেষ করে তাতে তওবার যে আলোচনা রয়েছে তার উপর গুরুত্বসহকারে আমল করুন।
২. তওবা দু’রকম : এক. এজমালী বা সংক্ষিপ্ত। দুই. তাফসীলী বা বিস্তারিত। সংক্ষিপ্ত তওবার জন্য সালাতুত তওবার নিয়তে দুই রাকাত নামায পড়ে অতীত জীবনের ছোট বড় সকল গুনাহ থেকে বিনীত ও বিগলিত হৃদয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করুন এবং এই সংকল্প করুন যে, ভবিষ্যত জীবনে আর কখনও এসব গুনাহের কাছেও যাব না।
তারপর বিস্তারিত তওবা হল, জীবনে যত অন্যায় কাজ করেছেন তাতে যেগুলোর ক্ষতিপূরণ সম্ভব সেগুলো ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করুন। যেমন :
ক) অতীতে যেসব ফরয ও ওয়াজিব (বিতর) নামায কাযা হয়ে গেছে সেগুলো গুরুত্ব সহকারে আদায় করুন। যদি কাযা নামাযের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ জানা না থাকে তাহলে সতর্কতার ভিত্তিতে অনুমান করে একটা সংখ্যা ঠিক করে নিন। তারপর একটা খাতায় তা নোট করে নিন যে, আমার উপর এত ওয়াক্ত নামাযের কাযা রয়েছে। আজ এত তারিখ থেকে আমি তা আদায় করা আরম্ভ করলাম এবং প্রত্যেক নামাযের সঙ্গে এক ওয়াক্ত কাযা আদায় করার নিয়ত করব। এভাবে আমি নিয়মিত লিখে যাব কত ওয়াক্ত নামায আদায় হয়েছে। যদি আমার মৃত্যু পর্যন্ত এই কাযা নামাযগুলো আদায় করতে না পারি, তাহলে আমার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে যেন তার ফিদয়া আদায় করে দেওয়া হয়। তারপর নিয়মিত নোট করতে থাকবেন কত ওয়াক্ত নামায আদায় হয়েছে এবং উত্তম হল, নিকটতম কোনো প্রিয়জনকে এ নোটের কথা জানিয়ে রাখা।
খ) এমনিভাবে রোযারও একটা হিসাব করে কাযা রোযার পরিমাণ খাতায় নোট করে নিবেন। তারপর তা আদায় করতে আরম্ভ করবেন। আর যেগুলো বাকি থেকে যাবে সেগুলোর ব্যাপার অসিয়ত করে দিবেন। যেমন ‘ক’ তে উল্লেখিত হয়েছে।
গ) যদি যাকাত ঠিকমত আদায় করা না হয়ে থাকে তাহলে যাকাতের সতর্কতামূলক একটা হিসাব লাগিয়ে তা আদায় করার চেষ্টা করবেন। সম্ভব হলে এখনই আদায় করে দিন। অন্যথায় খাতায় হিসাব লিখে রেখে আস্তে আস্তে তা আদায় করতে থাকবেন এবং অসিয়ত করে যাবেন যে, আমি যদি তা আদায় করতে না পারি তাহলে আমার সম্পদ থেকে যেন তা আদায় করে দেওয়া হয়।
ঘ) হজ্বের ব্যাপারেও একই কাজ করবেন। যদি হজ্ব ফরয হওয়া সত্ত্বেও হজ্ব না করে থাকেন তাহলে অসিয়ত লিখে দিবেন, আমি যদি জীবদ্দশায় হজ্ব আদায় করতে না পারি তবে যেন পরিত্যক্ত সম্পদ দ্বারা বদলী হজ্ব করিয়ে দেওয়া হয়।
ঙ) নিজের উপর কারো আর্থিক হক থেকে থাকলে এখনি তা আদায় করে দেওয়ার চেষ্টা করুন। এখন আদায় করা সম্ভব না হলে পাওনাদারকে বলে সময় নিয়ে নিবেন। তারপর সময়ের মধ্যে তা আদায় করার পূর্ণ চেষ্টা করবেন এবং অন্য সব কাজের উপর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা আদায় করে দিবেন।
চ) এমনিভাবে আপনার কারণে যদি কেউ কোনো কষ্ট পেয়ে থাকে, যেমন কারো গীবত হয়েছে, কেউ মনে কষ্ট পেয়েছে বা শারীরিক কোনো কষ্ট পেয়েছে তাহলে তাকে প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। যদি পৃথক পৃথক প্রত্যেকের কাছ থেকে ক্ষমা নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত নিজের পরিচিত জনদের নামে একটি চিঠি দিয়ে দিবেন যাতে এই আবেদন থাকবে যে, আপনাকে আমি যে কষ্ট দিয়েছি আল্লাহর ওয়াস্তে তা আমাকে ক্ষমা করে দিন।
৩. এভাবে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত তওবার পর নিজেকে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করবেন। বিশেষ করে নজর, যবান ও কানের হেফাযত করবেন। কখনও ভুল হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা-ইস্তেগফার করবেন এবং যে কোনো মূল্যে তওবার উপর অটল থাকার চেষ্টা করবেন
।
৪. প্রথম ‘তাবলীগে দ্বীন’ তারপর ‘বাসায়েরে হাকীমুল উম্মত’ পড়বেন এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আলোকে নিজের অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ করবেন এবং হযরত থানভী রাহ.-এর বাতানো তাদবীরগুলোর উপরে আমল করবেন। নিজের মধ্যে কোনো মন্দ স্বভাব সম্পর্কে সন্দেহ হবে সেখানে নিজের শায়খের কাছে তা লিখে নিজের করণীয় জেনে সে অনুযায়ী আমল করবেন।
৫. আরেফ বিল্লাহ হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ. রচিত ‘মামূলাতে ইয়াওমিয়া’ বুঝে বুঝে পড়বেন এবং তা থেকে নিম্নোক্ত কাজগুলো এখন থেকেই শুরু করে দিবেন। ক) সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত খ) মুনাজাতে মাকবুল এক মঞ্জিল করে গ) নিম্নোক্ত যিকিরগুলো একশ বার করে ১. সুবহানাল্লাহ ওয়ালহামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। ২. সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম। ৩. ইস্তেগফার ৪. দরূদ শরীফ। এছাড়াও ‘মামূলাতে ইয়াওমিয়া’ থেকে যে যিকিরগুলো নিয়মিত করতে পারবেন সেগুলো সম্পর্কে আমার কাছে চিঠি লিখে জেনে নিবেন। তবে আমল ঐ পরিমাণ শুরু করবেন যে পরিমাণ আজীবন নিয়মিত করে যেতে পারবেন। কখনও কোনো ওজর দেখা দিলে ঐ আমলগুলো সম্পূর্ণ ছাড়বেন না। পরিমাণে কমিয়ে দিয়ে হলেও সবগুলো আদায় করে নিবেন।
৬. কমপক্ষে পনের দিনে সর্বোচ্চ এক মাসে আমাকে একটি চিঠি লিখবেন যাতে আমলগুলো নিয়মিত হচ্ছে কি না তার উল্লেখ থাকবে এবং ‘বাসায়েরে হাকীমুল উম্মত’-এর আলোকে নিজের মধ্যে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তারও উল্লেখ থাকবে।
চিঠি লেখার নিয়ম হল এক কলামে লিখবেন। এক কলাম খালি রাখবেন। যাতে প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে তার পাশেই লেখা যায়।
৭. অধমের ‘ইসলাহী খুতবাত’ পড়তে থাকবেন বরং উত্তম হয় তার কিছু কিছু ঘরের অন্যদেরকে পড়ে শোনাবেন। যখন তার একটা বড় অংশ পড়া হয়ে যাবে তখন আস্তে আস্তে হযরত থানভী রাহ.-এর মাওয়ায়েজ ও মালফূযাত পড়া শুরু করবেন এবং সারা জীবন তা নিজের পড়ায় রাখবেন।
যারা করাচিতে আছেন তারা বাইতুল মোকাররমে বান্দার সাপ্তাহিক মজলিসে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করবেন। আর যারা দূরে আছেন তারা ঐ মজলিসের ক্যাসেট সংগ্রহ করে শোনার চেষ্টা করবেন এবং নিয়মিত চিঠিপত্রের আদানপ্রদান করবেন।
জুমাদাল উলা ১৪৩০ . মে ২০০৯
মাসিক আলকাউসার