পাশ্চাত্য ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র (৩য় পর্ব) – শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ)

এক ফরাসী সাংবাদিকের ইসলাম গ্রহণ

আফগান সীমান্তে আমার সাথে একজন ফরাসী সাংবাদিকের সাথে দেখা হয়। সে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য এসেছে। আমি তাঁকে বললাম, তুমি কি আল্লাহর উপর ঈমান রাখ? সে বলল, আমি শোনতাম যে, পৃথিবীর একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন । কিন্তু আফগানরা আমাকে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বাধ্য করেছে। আমি বললাম কীভাবে? বলল, যখন আফগানদেরকে দেখি তাদের দ্বারা বিশাল বিশাল ট্যাংক বহরকে পরাজিত করছে। এর মানে যুদ্ধের ময়দানে অদৃশ্য একটি শক্তির হাত রয়েছে, যাকে আমরা দেখছি না। আর তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্। এটা ফরাসী সাংবাদিকের কথা । অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, তুমি আফগানিস্থানে কতদিন অবস্থান করেছ? বলল, চার মাস। বললাম, তুমি কীভাবে মুজাহিদদের মত জীবন যাপন করলে? বলল, ‘এটা সহজ। সকালে একবার চা ও রুটি। দুপুরে আরেকবার চা ও রুটি। ‘তবে আপনারা মনে করবেন না যে, আফগানরা এত সহজে এ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে।

আফগান জনগণের ট্রাজেডী

এখন আফগানিস্থানের প্রতিটি ঘর মাতম ও এতীম খানায় পরিণত। সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে। বলছে আমার আব্বা কোথায়? বলা হচ্ছে তারাকীর আমলে নিহত হয়েছে। বলছে আমার বড় ভাই কোথায়? বলা হচ্ছে হাফীযুল্লা আমীনের আমলে নিহত হয়েছে। বলছে আমার বোন কোথায়? আমার মা কোথায়? বলা হচ্ছে অমুক জায়গায় লাশের সাথে দাফন করা হয়েছে। আমাদের এখানে মুস্তারী নামে একজন ড্রাইভার আছে। লোকজন বলল, শায়খ আবদুল্লাহ আপনি এর ঘটনা শুনেছেন? তখন আমি তাঁকে বললাম তার ঘটনা খুলে বলতে। সে বলল, আমাদের পরিবারের লোক সংখ্যা বার জন। আমি বাজারে গিয়েছিলাম। আমি যাওয়ার পর বিমান এসে আমাদের ঘরের উপর বোম ফেলে চলে যায়। আমি এসে দেখলাম ঘর ও লোকজন কেউ নেই। দেখলাম এদিক-সেদিক কিছু গোস্তের টুকরো ছড়িয়ে আছে। আমি মাটির উপর থেকে গোস্তের টুকরোগুলো নিয়ে একত্রিত করতে লাগলাম। এতে বার জন লোকের বার কেজির মত গোশত পাওয়া গেল।

কত মানুষ আফগান জিহাদের কারণে নিহত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। হেকমতিয়ারের ঘরে একজন এতীম শিশু রয়েছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম এ কে? বললেন, এ ছেলের কোন আত্মীয় স্বজন পাওয়া যায়নি। তাই আমি তাঁকে নিয়ে এসে আমার ঘরে লালন-পালণ করছি।

উত্তর আফগানিস্থানে কিছু সময়

আমি উত্তর আফগানিস্থানের একটি পাহাড়ে উঠেছিলাম। পাহাড়টি চার হাজার মিটার উচু। পাহাড়টিতে বরফ জমেছে। পা রাখলে পিছলে যায়। আমাদের উঠতেই হবে। বাধ্য হয়ে আমি উভর পায়ের সাথে সাথে উভয় হাতও মাটিতে রেখে উপরে উঠতে লাগলাম। আফগানরা তাদের রসদ ও খাবার নিয়ে উপরে উঠছে, আমি আমার জ্যাকেটটিও সাথে নিতে পারলাম না। উঠার পথে কিছু মৃত ঘোড়া ও গাধা দেখতে পেলাম। এগুলো ক্লান্ত হয়ে পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তুমি উভর পা ও হাত দিয়ে উঠার সময় কোন মাটি চেপে ধরতে বা কোন মৃত গাধায় হেলান দিতে চাইবে । আমরা ফজরের নামায পড়ে রওয়ানা দিয়ে মাগরিবের আযান পর্যন্ত সময়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌছতে পারিনি। একজন লোককে দেখলাম সে তার গাধাসহ পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছে। সে গাধাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করল। না পেরে গাধা তার উপর থাকা মাল সামানা বাদ দিয়ে সে নিজে নিজে মৃত্যুমুখে পতিত হল । তোমরা কি বিশ্বাস করবে গাধা ও খচ্চর আত্মহত্যা করে? হ্যাঁ! আফগানিস্থানে অধিক ক্লান্তির দরুন গাধা খচ্চর ও ঘোড়া নিজেদের আর স্থির রাখতে না পেরে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে আত্মহত্যা করে।

নব্বই থেকে একশ কেজি ওজনের এক আরব যুবক ক্লান্তির দরুন বলল,আমি আর উঠতে পারব না। আমাকে ছাড়ুন, আমি মরলে এখানে মরব। তারা তাঁকে ছেড়ে চলে গেলো । সে বরফের মাঝে ঘুমের ব্যাগের উপর শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। রাত্রে সে অদৃশ্য থেকে আওয়াজ শুনতে পায়, আল্লাহ্ তোমার সাথে রয়েছে। ক্ষুধা ও ঠাণ্ডায় তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঐ পথ দিয়ে যাওয়া একটি কাফেলা তাঁকে দেখতে পায়। তারা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তার পা বরফের কারণে অবশ হয়ে গিয়েছিল। ফলে হাসপাতালে নেয়ার পর তার পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়। এ রকম কত মানুষ বরফের মধ্যে মরে গেছে তার হিসাব নেই। এমনকি ছয় মাস পর বরফ গলে যাওয়ার পরও অনেক মৃতদেহ মানুষের নজরে আসে। এক মহিলা তার শিশুপুত্রকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার সময় ক্লান্তির দরুন তাঁকে রেখে চলে যায়। কারণ, তাঁকে নিয়ে উঠতে গেলে উভয়ের মৃত্যু নিশ্চিত । তাই সে বাধ্য হয়ে তার ছেলেকে রেখে চলে যায়। আট দিন পর সে মুজাহিদদদের নিকট এসে বলল, পাহাড়ের অমুক জায়গায় বরফের নীচে আমার ছেলে রয়েছে। আপনারা তাঁকে খুঁজে এনে দাফন করলে ভাল হয়। মুজাহিদরা তার দেখানো জায়গায় গিয়ে বরফ উঠালে দেখতে পায় যে, তার ছেলে জীবিত।

বাস্তবেই আফগানিস্থানের কাহিনী খুব শোকাহত ও দুঃখজনক। সাথে সাথে যারা পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে চায়, তাদের জন্য তা গৌরব ও ইজ্জতের লড়াইও বটে।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন-

إِن تَكُونُوا تَأْلَمُونَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُونَ كَمَا تَأْلَمُونَ ۖ وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا [٤:١٠٤]

“তোমরা যদি কষ্টের সম্মুখীন হও, তাহলে তো ওরাই তোমাদের ন্যায় কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তারা আল্লাহর কাছে যা আশা করে না, তোমরা সেটার আশা করছ। ”[নিসাঃ১০৪]।

আফগানদের গুন

আমি আফগানদের সাথে আট বছর ধরে বাস করছি। দিন দিন তাদের প্রতি আমার বিশ্বাস ও ভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হ্যাঁ ! তারা পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত একটি জনগোষ্ঠী। তাদের মাঝে সকল প্রকার দোষও বিদ্যমান। আমি তাদের দোষের ব্যাপারে অবহিত। তবে তাদের গুন, তাদের দৃঢ়তা, তাদের আতিথেয়তা, তাদের বীরত্ব ও তাদের লজ্জাবোধ সকল দোষ-ত্রুটিকে ঢেকে রেখেছে। তাদের মাঝে চোর, মিথ্যুক ও মাদকসেবী রয়েছে। কিন্তু এসবের মাঝে একটি খাটি ও উন্নত জনগোষ্ঠীও রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এরকম একটি জনগোষ্ঠী আছে বলে আমার জানা নেই।

আফগান জ্বিহাদ আমাকে যা শেখাল

আফগানরা আমাকে অনেক অনেক কিছু শিখিয়েছে। তারা আমাকে শিখিয়েছে ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদীদের হাত থেকে ফিরিয়া আনা সহজ ব্যাপার।

শুধু সহজ ব্যাপার না, ইনশাআল্লাহ্ খুবই সহজ। আমি এ ব্যাপারে পূর্ণ আশাবাদী। আমাদের কাছে যদি দু’হাজার ফিলিস্তিনী যুবক এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ও যুদ্ধের কৌশল শিখে নেয় এবং তাদের কাছ থেকে গোয়েন্দাদের ভয় দূর হয়ে যায়, তাহলে আমি নিশ্চিত যে, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা সম্ভব। ফিলিস্তিনীরা যেখানে যায়, সেখানে গোয়েন্দাদের ভয়ে ভীত থাকে। আলহামদুলিল্লাহ এখানে আমাদের গোয়েন্দা ভীতি দূর হয়ে গেছে। জ্বিহাদ মানুষের মনকে রিজিক ও মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্ত করে।

বিপদকে ভয় করা সাজে না কখনো আমার

কেননা আমি বিপদকে ভয় করে পাইনি কোন উপকার।

এখানে এসে আরব যুবকদের অন্তর পরিপক্ক হয়েছে ও তাদের হিম্মত উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও জর্ডানের যুবকদের, যারা ইনশাআল্লাহ্ ফিলিস্তিন মুক্ত করার পবিত্র জিহাদের উপকরণ হবে বলে আশা করছি। আট বছর ধরে আমি এখানের এ কণ্টকাকীর্ণ ও মিষ্ট পথে অবস্থান করায় ফিলিস্তিনে আমার দেশবাসী বলাবলি করছে, ‘শায়খ আবদুল্লাহ আযযাম আফগান সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আফগান সমস্যা কি ফিলিস্তিন সমস্যা থেকে গুরুত্বপূর্ণ?’

আফগানিস্থান থেকে ফিলিস্তিন

হিন্দুকুশে আহত হওয়া মুজাহিদদের রক্ত বাইতুল মাকদিস মুক্তকারী ফিলিস্তিনের যুবকদের জন্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমি দেখছি হেলমন্দের আশে-পাশে আহত ও নিহত হওয়া শিশুরা গাজা, হাইফা, ইয়াফা, নাবলূস ও আলখলীলের* শিশু ও বিধবাদের আর্তচিৎকার পুনরাবৃত্তি করছে । তোমরা কি আমাকে পাথর মনে কর, যার কোন রক্ত নেই এবং দেশ, পরিবার, বাইতুল মাকদিস ও পবিত্র ভূমির প্রতি যার কোন টান নেই।

আমরা ও আফগানিস্থানে আসা প্রতিটি ফিলিস্তিনী ও জর্ডানি যুবকের চিন্তা জিহাদের এ উজ্জ্বল চিত্র মসজিদুল আকসা, আলখলীল ও বেথলহেমে ফুটিয়ে তোলা। আমরা আফগানিস্থানে এসেছি এখান থেকে আল্লাহ্ চাহে তো জিহাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করে তা ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে প্রয়োগ করার জন্য।

শাহাদাতের খোঁজে

হ্যাঁ ! অনেকে আমার কাছে এসে বলে যে, আমরা ফিলিস্তিনে জ্বিহাদ করতে চাই। কারন, তারা তাদের দুনিয়াকে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আল্লাহর পথে মৃত্যু বরণ তাদের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। দুনিয়া নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই। সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রাণকে তারা হাতে নিয়ে আল্লাহর কাছে নিবেদন করছে যাতে তাঁকে তার পথে কবুল করে নেন। যার প্রাণকে আল্লাহ্ তার পথে কবুল করছেন না, সে পেরেশান।

আলহামদুলিল্লাহ বর্তমান আফগানিস্থানে এক হাজারেরও বেশী আরব মুজাহিদ রয়েছে। তাদের অধিকাংশই হারামাইনের দেশের (সৌদিআরব), যার দিকে ইসলাম পুনরায় ফিরে যাবে। এ পর্যন্ত এ দেশের চল্লিশজন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কাবুল, কান্দাহার ও জালালাবাদের চতুষ্পার্শে তাদের পাঁচ শতাধিক যুবক পাহারারত রয়েছে।

গত সপ্তাহে তাদের বিশজন শাহাদাত বরণ করেছে। আমি তাদের একজনের কফিন বহন করেছি। কফিনে তার রক্ত পড়েছে। তার নাম খালিদ বিন মুআল্লা আল আহমদ আল হারবী। আল্লাহর কসম! তার রক্ত থেকে দাফন করার পূর্বে পাঁচ দিন পর্যন্ত মেশকের মত সুগন্ধি বের হয়েছে। তার কফিন যেখানে রাখা হয়, সেখানে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে । মানুষ তার রক্তের সুগন্ধি শোঁকার জন্য তার লাশ পাকিস্থান থেকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যুবকরা তাদের জীবনকে আল্লাহর রাস্তার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছে। এদের মধ্যে মন্ত্রী ও ধনকুবের ছেলেরাও রয়েছে। তাদের অনেকেই বাপসহ চলে এসেছে। উসামা বিন লাদেন সে মধ্যে প্রাচ্যের সর্ববৃহৎ কোম্পানির মালিক। সে তার পিতার যাকাতের শত শত মিলিয়ন রিয়াল নিয়ে এসেছে। মসজিদে নববী সম্প্রসারণের আট হাজার মিলিয়ন রিয়ালের কাজ ফেলে এসেছে। সে এখন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জালালাবাদে পাহারা দিচ্ছে। সে একজন হাল্কা-পাতলা ও লম্বা যুবক। তার প্রেসারের রোগী ও তার নার্ভ দুর্বল। তার পকেট লবনে পূর্ণ। তার এক হাতে রয়েছে পানির বোতল। সে লবণ গিলে খায় এবং এর পরে পানি পান করে। এ করে সে প্রেসার দূর করার চেষ্টা করছে, যাতে জিহাদের ময়দানে সব সময় থাকতে সক্ষম হয়। তোমরা কি মনে কর আল্লাহর দ্বীন সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে? এ যুবকের বয়স এখন উনত্রিশ কিংবা ত্রিশ। তার চারজন স্ত্রী রয়েছে। তাঁদেরকে ছেড়েই চলে এসেছে সে। জিহাদের জন্য সে তার ধন-সম্পদসহ সব কিছু ত্যাগ করে চলে এসেছে।

ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা কী চায়?

কিছু লোক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। তাদের বলতে চাই আমরা কি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু প্রাণকে কি সামান্য ভূখন্ডের জন্য উৎসর্গ করব? ফিলিস্তিনের মাটি আর ফুজাইরার* মাটির মুল্যতে একই। ঘর তো আমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে নির্মাণ করা সম্ভব। ব্যাপারতো জমি আর মাটির নয়। ব্যাপার হচ্ছে দ্বীনের, আকীদার, পবিত্র ভূমির, মসজিদুল আকসার ও সে সব লোকদের, যারা হুর ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যদি জান্নাত ও হুর না পাই, তাহলে কেন আমি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করব? যে সব বামপন্থীরা ফিলিস্তিনের প্রচার মাধ্যম দখল করে রেখেছে, তারা ফিলিস্তিনের পবিত্র সন্তানদের মাথার খুলিতে আরোহণ ছাড়া আর কিছুই করছে না।

আমি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন তাদের রেডিওতে বলা হত যুবকরা ইমবিরিয়ালিয়ার (সাম্রাজ্যবাদ) বিরুদ্ধে তীব্র ভাবে লড়েছে।

অথচ যুবকরা ইমবিরিয়ালিয়া কি চিনে না। তাঁদেরকে যদি ইমবিরিয়ালিয়া কি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে হয়তো সে ভাববে ইমবিরিয়ালিয়া রাশিয়ার একটি শহর। আমি কি আমার প্রাণ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করব? যেমন তুরস্ক, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ ও সরকারী চাকুরী করতে গেলে হিজাব খুলে যেতে হয়। জর্জ হাবশ, রায়াহ গাদী ও নায়েফ হাওয়াতিমা** এখন আরব আমিরাতে। আমি জানি না এরা ফিলিস্তিনে কী করতে চায়? এরা ফিলিস্তিনের সন্তানদেরকে তাদের দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এরা ফিলিস্তিনের নামে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা ১৯৬৯ সালে জ্বিহাদ করার সময় যখন আল্লাহু আকবর বলতাম, তখন নায়েফ হাওয়াতিমা গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বলত-

আমাকে যদি জিজ্ঞেস কর আমার মূল্যবোধ কী?

তাহলে শোন আমি মার্কসবাদী, লেনিনবাদী ও জাতীয়তাবাদী।

এরা ফিলিস্তিনের যুবকদের নষ্ট করেছে। এখনো তারা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, বামপন্থা ও সমাজবাদের নামে যুবকদের ধবংস করছে। রেডিওর প্রোগাম শুরু হয় এ বলে-

হে ভাই! আমি ঈমান এনেছি ধবংস ও বিতাড়নের স্বীকার জনগোষ্ঠীতে

এবং নিয়েছি অস্ত্র হাতে যাতে নিতে পারে পরবর্তী প্রজন্ম কাস্তে হাতে।

ফিলিস্তিনের লড়াই কি কম্যুনিজমের আন্তর্জাতিক প্রতীক কাস্তের জন্য? ওহে বস্তুবাদীরা তোমরা তোমাদের প্রাসাদে থেকে মনে করছ যে, ফিলিস্তিনের যুবকেরা তোমাদের পক্ষ নিয়েছে। তোমরা বোকার স্বর্গে বাস করছ। এ ফিলিস্তিনী যুবকদের আন্দোলিত করছে ইসলাম, মসজিদুল আকসা ও শাহাদাতস্পৃহা । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ইরশাদ-

“শহীদের জন্য তার প্রভুর কাছে সাতটি পুরস্কার রয়েছে। তার রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁকে ক্ষমা করা হবে, তার জান্নাতের আসন দেখানো হবে, কবরের আযাব থেকে তাঁকে রক্ষা করা হবে, কেয়ামতের বিভীষিকা থেকে নিরাপদ রাখা হবে, একটি সম্মানের তাজ পরানো হবে, যার একটি ইয়াকুত দুনিয়া ও তাতে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম, বাহাত্তরটি ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হুরের সাথে বিবাহ দেয়া হবে ও তার পরিবারের জাহান্নামে প্রবেশ যোগ্য সত্তরজনকে ক্ষমা করণে তার সুপারিশ গৃহীত হবে । ”[হাদীসটি সহীহ এবং ইমাম আহমদ,তিরমিযী ও ইবনে হাব্বান কর্তৃক বর্ণীত]।

ইসরাঈলকে ধ্বংস করতে প্রয়োজন দু’হাজার মুজাহিদের

আমি এখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, যদি আমার হাতে আল্লাহর উপর ঈমান আনয়নকারী ও শাহাদাত

কামনাকারী দু’হাজার মুজাহিদ থাকে, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা ইসরাঈলকে ধবংস করতে সক্ষম হব। প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কীভাবে ইসরাঈল পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হব? এর উত্তর একটাই, যদি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আমাদের সততা ও নিষ্ঠা দেখেন, তাহলে তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য পথ খুলে দিবেন, যেমন খুলে দিয়েছেন আফগানিস্থানে। চিরঞ্জীব আল্লাহ্ ব্যতীত আমাদের কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই।

বিশ্বব্যাপী আফগান জিহাদের প্রভাব

আমি বলছি এখন আফগানিস্থান তার ত্যাগের বিনিময়ে গন্তব্যে পৌছে গেছে। মানুষ এখন আফগানিস্থান নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছে। বিশ্বাস করুন রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবী মুজাহিদদের হাতে ক্ষমতা না যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কার্লচলীকে ন্যাটোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা এক বৈঠকে বলল, মনে হচ্ছে গর্বাচেভ পাশ্চাত্যের ব্যাপারে তার রাজনীতিতে পরিবর্তন আনছে। কারণ, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, পূর্ব ইউরোপ থেকে তিনি শিগগিরই ১০ লক্ষ সৈন্য ফিরিয়ে নিবেন। কার্লচলী বলল, আপনারা কি এটা বিশ্বাস করেন আফগানরা বিশ্ব নিয়ে গর্বাচেভের যে চিন্তাধারা ছিল তাতে পরিবর্তন এনে দিয়েছে?

রিগ্যান হেকমতিয়ারের সাথে সাক্ষাত করার জন্য কত চেষ্টা করেছে ! কিন্তু হেকমতিয়ার তা বার বার প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্থানী রাষ্ট্রদূত বলল, আপনি কি পাগল? ৬০ জন রাষ্ট্র প্রধান রিগ্যানের সাথে সাক্ষাতের আবেদনের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু রিগ্যান তাদের সমর পিছিয়ে দিচ্ছে এবং না করে দিচ্ছে। আর আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চাওয়ার পরও আপনি তা প্রত্যাখ্যান করছেন! হেকমতিয়ার বললেন, হ্যাঁ! যদি তোমরা বেশী চাপাচাপি কর, তাহলে আমি এখনই আমেরিকা ছেড়ে চলে যাব। জাতিসংঘ প্রতিনিধি কর্ডফেজ ইউনুস খালিছের সাথে কতবার সাক্ষাত করতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন । রাশিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিনিধি ফ্রান্টসফ গত অক্টোবরে জাতিসংঘের শেষ অধিবেশনে বলেছে, আমি রব্বানীর সাথে গোপনে সাক্ষাত করতে চাই। রব্বানী বললেন, না। সাক্ষাত করলে প্রকাশ্যে ও পৃথিবীর লোকেরা জানে মত করতে হবে। বলল ,তাহলে রাশিয়ায় হোক। রব্বানী বললেন, না, কোন ইসলামী রাষ্ট্র যেমন পাকিস্তান বা সৌদি আরবে হতে হবে। এ কথা বলে রব্বানী জাতিসংঘ থেকে সৌদি আরবে চলে আসলেন।সৌদি আরবে আসার পর টেলিফোন আসল যে, রাশিয়ানরা রব্বানীর সাথে সাক্ষাত করার জন্য সৌদি আরবে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু কীভাবে আসবে? সৌদি আরবে তো তাদের দূতাবাস নেই! বাদশা ফাহদের কাছে অনুমতি চাও। রাশিয়া বাদশা ফয়সলের আমলে দূতাবাস খোলার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, যারা আল্লাহকে চিনে না, তাঁদেরকে আমরাও চিনি না।

অনুমতি চাওয়ার পর বাদশা তাদের প্রবেশের অনুমতি দেন। ফ্রান্টসফ তার দল নিয়ে আসল। রব্বানী বললেন, আমাদের তিনটি শর্ত। প্রথমত সম্মেলন কক্ষে তোমাদের আগে প্রবেশ করতে হবে, যাতে আমরা প্রবেশ করলে তোমরা দাঁড়িয়ে আমাদেরকে সম্মান করতে পার।

তারা বলল, ঠিক আছে । দ্বিতীয়ত, আমরা তোমাদের সাথে করমর্দন করব না। তৃতীয়ত আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে তোমরা কোন প্রভাব খাটাতে পারবে না। নজীবের সরকারই তোমাদের শেষ সরকার। আলোচনা শুরু হল। ফ্রান্টসফ শুধু একটি আবেদনই করল। আর তা হচ্ছে নজীবের সরকারে মুজাহিদদের পক্ষ থেকে তিনজন ক্ষমতাসীন হওয়া। যাতে আমরা বিশ্বকে বলতে পারি যে, আমরা মুজাহিদদের সাথে চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে এসেছি। তার এ কথায় তাঁকে বলা হল, ইসলাম যেখানে মুরতাদকে বেঁচে থাকার অধিকার দেয় না, সেখানে আমরা কীভাবে কম্যুনিস্ট নজীবকে আমাদের সাথে দেশ শাসনের অধিকার প্রদান করতে পারি? আমরা একজন কম্যুনিস্টকেও আমাদের সরকারে গ্রহণ করব না। দেখুন ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়াকে আকড়ে ধরে মুজাহিদরা মর্যাদার কত শীর্ষে আরোহণ করেছে।

জ্বিহাদ ও গৃহযুদ্ধ

জিহাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ভয়ের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায় এখন বলা শুরু করেছে যে, আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলছে । আমরা বলতে চাই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ জাহলের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেটাও তাহলে গৃহযুদ্ধ । কারণ, আবু জাহল ও রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়ে মক্কার অধিবাসী ছিলে। অতএব, বদর, উহুদ, খন্দকসহ প্রায় যুদ্ধই গৃহযুদ্ধ ছিল । এখন তাহলে মুসলমানরা এসব যুদ্ধকে কোন ধরণের যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করবে? মূলত আমাদের দ্বীন গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে । তবে এ যুদ্ধ কেবল আকীদা ও দ্বীন কেন্দ্রীক যুদ্ধ।

কম্যুনিস্টরা ছাগলের মত বিক্রি হচ্ছে

আক্ষেপ! যদি আরব বিশ্বের বামপন্থীরা এসে আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির পরিণাম দেখে যেত! রাশিয়া যখন তার সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিল, তখন রুশ সৈন্যরা এসে মুজাহিদদের কাছে আফগান কম্যুনিস্টদের বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। একজন কম্যুনিস্টের মূল্য আড়াই ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে।

এরা তাঁদেরকে ছাগলের মত বিক্রি করে দেয়া শুরু করে। এরা যাওয়ার আগে মুজাহিদদের কাছে একজনকে পাঠিয়ে প্রস্তাব দিত যে অমুক কেন্দ্রে ১০০ জন কম্যুনিস্ট আছে। আড়াইশ ডলার দিয়ে ওদেরকে যা ইচ্ছা তাই করুন। প্রথমে আমি এটা বিশ্বাস করতাম না। কাবুলের মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ, যাদের সাথে এ ঘটনা ঘটেছে, তারা যদি আমাকে সরাসরি না বলতেন, তাহলে এটাকে আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। মুজাহিদরা কম্যুনিস্টদেরকে অর্থ দিয়ে কিনে হত্যা করছে। রুশ সৈন্যরা তিনটি মুরগীর বিনিময়ে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিস বিক্রি করে দিয়েছে।

রাশিয়া আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টিকে মুজাহিদদের সামনে যে বাঘের সামনে ছাগল রেখে যাওয়ার ন্যায় রেখে চলে গেছে, তা যদি আরব বিশ্বকে ধবংসকারী কম্যুনিস্ট জর্জ হাবশ, মাহমুদ দরবেশ ও হেনা আলজাবেরীরা এসে প্রত্যক্ষ করে যেত!

মানুষ আফগানিস্তান নিয়ে শঙ্কা বোধ করছে যে, ভবিষ্যতে মুজাহিদদের মাঝে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে । আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, কোন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে না। মুজাহিদরা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্বার প্রান্তে পৌছে গেছে। অবশ্যই এ নিয়ে পুরো বিশ্বে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়া ধবংস হওয়ার জন্য যে আমেরিকানরা এ জ্বিহাদ নিয়ে ছয়-সাত বছর ধরে আনন্দিত, তারা পর্যন্ত মুজাহিদদের ব্যাপারে আশঙ্কায় ভুগছে।

ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে ভীতি

কোন কোন লোক মুজাহিদ নেতৃবৃন্দকে এ বলে ভয় দেখাচ্ছে যে, আপনারা যে সরকারের ঘোষণা দিয়েছেন, তার প্রতি মার্কিনীরা সন্তুষ্ট নয়। মুজাহিদরা প্রথমে মুহাম্মদ নবীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ও আহমদ শাহকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তখন সাইয়াফ তাঁদেরকে বললেন, আমরা সরকার গঠন করেছি আফগানিস্তানের জন্য; আমেরিকার জন্য নয়। তোমরা কি মনে করছ আমরা সরকার গঠন করেছি আমেরিকার জন্য! হেকমতিয়ার তাঁদেরকে বললেন, পশ্চিমারা কী চায়, তা আমরা বুঝার চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা তাদের মতামতের উপর নজর রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। বলল, পশ্চিমারা চাচ্ছে সাতজনের মধ্য থেকেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোক। তারা মুহাম্মদ নবী,সাইয়াফ ও আহমদ শাহকে বিবেচনায় আনতে চায় না।

তাই আমি বিস্মিত হয়েছি যে, আফগানিস্তানই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রাষ্ট্র, যার সরকার রক্ত সাগর ও শহীদের লাশের স্তুপের উপর গঠিত হয়েছে। যাকে একমাত্র সৌদিআরব ব্যতীত আর কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। আল্লাহ্ তাঁদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। অথচ ফিলিস্তিনের সরকারের পায়ের নীচে কোন মাটি না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে একশটি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে। কবি বলেন-

সবচেয়ে দামী রাষ্ট্র তাই, যা নির্মিত হয় তরবারী দ্বারা

যার প্রেমিকদের কাছে আঘাত মনে হয় মধুর ধারা।

এমনকি আমার কলম পর্যন্ত বলেছে এ কথা যে,

সম্মান তরবারীর জন্য,নয় সম্মান কলমের জন্যে।

আর কোন মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। কোথায় আজ ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ? কোথায় আজ দ্বীনের জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন ও শত্রুতা পোষণের আকীদা ।

 

প্রথম লক্ষ্য মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার

হ্যাঁ! আমেরিকা মুজাহিদদের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। কারণ, তারা মৌলবাদী ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনড়। তারা তাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম ধারার উল্লেখ করছে যে, আমাদের রাষ্ট্র জিহাদের রাষ্ট্র, যার প্রথম করনীয় হচ্ছে মসজিদুল আকসাকে উদ্ধার করা। আমেরিকা সৌদি আরবকে বলেছে, মুজাহিদদের সরকারকে তোমরা কীভাবে স্বীকৃতি দান করলে, অথচ আমরা এখনো তাঁদেরকে স্বীকৃতি দেইনি! তোমরা এ মারাত্মক কাজ কীভাবে করলে?

জিহাদের প্রভাব

প্রায় এক বছর ধরে আমেরিকা মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে । সাইয়াফ আমেরিকান প্রতিনিধি লামকোষ্টকে বলেছেন, তোমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুষ্ট লোক । তোমরা ইসলামকে ঘৃণা কর। তোমরা রক্ত পিপাসু। তোমরা আমাদেরকে জিহাদের ফল থেকে বঞ্চিত রাখার ষড়যন্ত্র করছ।

মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিনিধি সাইয়াফকে বলেছে যে, তিনি জংলী লোক। সে বলেছে, আমি যে মার্কিন পররাষ্ট্র প্রতিনিধি তা সবাই জানে। কিন্তু এ লোক জানে না। সাইয়াফের কথায় তার চেহারা লাল হয়ে যায়। সাইয়াফ বললেন, আমরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই। আমাদের কাছে তোমাদের প্রয়োজন নেই। তোমরা চলে যাও।

তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হোক। তারা বলছে, আগামীতে এদের উপর আমরা অর্থনৈতিক অবরোধ করব। কিন্তু আফগানরা অর্থনৈতিক অবরোধকে ভয় করে না। তারা রুটি ও চিনি ছাড়া চা খেয়ে থাকতে পারে। তাদের দেশে চা উৎপন্ন হয়। হ্যাঁ ! পশ্চিমা দেশগুলো গম, চাউল ও চিনি উৎপন্ন করে, যা আফগানদের প্রয়োজন মেটায়। এরপরও দুনিয়াকে তারা সালাম জানিয়ে দেশ পরিচালনা করতে পারবে। তাদের রাষ্ট্রীয় বাজেট কোন দেশের প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। লোগারে তাদের কাছে তামার খনি আছে। রাশিয়া এ তামার মূল্য থেকে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলার নিয়ে নিত। শিবরগানে তাদের গ্যাসের খনি আছে। তা থেকে বছরে সত্তর বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপন্ন হয়। রাশিয়া তা থেকে নিজের প্রয়োজন সেরে প্রতিবছর পশ্চিমা দেশগুলোকে পাঁচশ মিলিয়ন ডলারের মত বিক্রি করত। কান্দাহারে তাদের ইউরিনিয়ামের খনি আছে। পানজশীরে মরকত (মনি) উৎপন্ন হয়, যার অর্ধাঙ্গুল পরিমাণ একটি টুকরো বিক্রি হয় অর্ধ মিলিয়ন ডলারে। জাইয়ূন  নদীর তীরে স্বর্ণ উৎপন্ন হয়। বামিয়ানে* রয়েছে লোহার খনি। এ লোহা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিস্কার লোহা । তাদের আর কিসের প্রয়োজন?

জ্বিহাদ ভীতি

কিন্তু গোটা পৃথিবী রণাঙ্গনে পরিপক্কতা লাভকারী ইসলামী আন্দোলনের এ যুবকদের ভয় করছে । আল্লাহ্ তাঁদেরকে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য জীবিত রাখুন, যাতে তারা মানুষের দ্বীন, সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তাস্থল হতে পারে। পশ্চিমারা আফগানিস্তান পৃথিবীর মুসলমানদের জিহাদের ঘাটিতে পরিণত হওয়ার ভয় করছে। তারা ভয় করছে আফগানিস্তান বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার। আমেরিকাতে লেখালেখি হচ্ছে যে, শিগগিরই মুজাহিদরা পূর্ব সোভিয়ত ইউনিয়নের ইসলামী অঞ্চলগুলোতে তাদের জ্বিহাদ ছড়িয়ে দিবে। অতঃপর সোভিয়ত ইউনিয়নকে টুকরো টুকরো করে ইউরোপ পর্যন্ত চলে আসবে এবং ইউরোপের অঞ্চলগুলো তাঁদেরকে আবার জীযয়া দিতে বাধ্য হবে, যেমন দিয়েছিল তুর্কীদেরকে। ইয়াহুদীরা পশ্চিমাদেরকে এসব বলে সতর্ক করছে। আমি কয়েক বছর ধরে উপলব্ধি করছি যে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনের জিহাদকে প্রচন্ড ভয় করছে। তাদের ভাষায় ইন্তাফাদা নামের এ জ্বিহাদ ফিলিস্তিনীদের নতুন ভাবে জাগিয়ে তুলেছে। আলহামদুলিল্লাহ ফিলিস্তিনীরা এখন আল্লাহু আকবারের ধ্বনিতেই আন্দোলিত হচ্ছে। হামাস ইসলাম থেকে বিচ্যুত যুবকদের সিরাতুল মুস্তাকীমে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছে। আমাদের উপর যে বিভিন্ন ভাবে চাপ আসতে শুরু করেছে তা আমি অবশ্যই টের পাচ্ছি। ইয়াহুদীরা জেনেভা সম্মেলনে পাকিস্তানের মুজাহিদ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে, যাতে কোন আরব সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে না পারে। অধিকৃত ভূমিতে আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এক যুবকের অপারেশনে ইয়াহুদীরা হতবাক হয়ে গেছে।

বর্তমানে পাকিস্তানী ভিসার ব্যাপারে যে সব কড়াকড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা আমেরিকান ও পশ্চিমা চাপের ফলে হচ্ছে। চার বছর আগেও পৃথিবীর যে কোন দেশ ও যে কোন ধর্মের লোক পাকিস্তানে ভিসা ছাড়া প্রবেশ করতে পারত। বর্তমান পেট্রো ডলারের দেশগুলোতে প্রবেশ করা পাকিস্তানে প্রবেশ করার চেয়ে অনেক সহজ। পাকিস্তানে প্রবেশের ব্যাপারে এসব কড়াকড়ি আন্তর্জাতিক চাপের ফলে করা হচ্ছে। এয়ার লাইন্স কোম্পানীগুলোর প্রতি নির্দেশ এসেছে, ভিসা ছাড়া কাউকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবে না। যদি পাসপোর্ট চেক করার পর কারো ভিসা পাওয়া না যায়, তাহলে তাঁকে ফেরত পাঠাবে। অনেক যুবককে ভিসা না থাকার কারণে বিমান বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফেরত পাঠানোর খবর শোনে কোন কোন যুবক জিহাদের প্রতি অত্যাধিক অনুরাগের ফলে বিমান বন্দরে বেহুঁশ পর্যন্ত হয়ে গেছে।

ভাইয়েরা! আফগানিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষালয়। যার প্রতি মনোযোগ দেয়া ও যার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সকল মুসলমানদের কর্তব্য। কথা অনেক দীর্ঘ। জিহাদের আলোচনা মনের কাছে খুব প্রিয়। কিন্তু সব এখানে বলে শেষ করা যাবে না। আমি জিহাদের ব্যাপারে মনকে এ কথা বলে প্রবোধ দেই-

তোমার ভালবাসা স্থান করে নিয়েছে আমার মনে

সে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছে না আমাকে কোথাও যেতে।

তোমার ভালোবাসার কারণে পাওয়া তিরস্কার আমাকে

উৎসাহিত করছে বার বার স্মরণ করতে তোমাকে।

অতএব, যার ইচ্ছা করুক তিরস্কার আমাকে

এ করে সে পারবে না আমাকে তোমায় ভুলাতে।

আমি এখন তোমাদের মাঝে উপস্থিত। কিন্তু আমার মন এখন আফগানিস্তানে, জালালাবাদে। আমি যখন ক্যাম্প থেকে পেশোয়ারে আমার পরিবারের সাথে দেখা করতে আসি, তখন আমার কষ্ট লাগে। অথচ আমি যাচ্ছি পরিবারের সাথে দেখা করতে। যদি আমাকে ইসলামাবাদে যেতে হয়, তাহলে পথের দূরত্বের কারণে আমার কষ্ট আরো বেড়ে যায়। এমনকি হজের সময় যখন বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করি, তখনও আমার অন্তর ঘুরে বেড়ায় আফগানিস্তানের মুজাহিদ ক্যাম্পে।

হেরেমের অবস্থানের চেয়ে জিহাদের পথে থাকা উত্তম

কারণ আমি জানি যে, আফগানিস্তানে রণাঙ্গনে অবস্থান করা হেরেমে অবস্থান করার চেয়ে উত্তম। যেমন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“আল্লাহর রাস্তায় কিছুক্ষণ পাহারাদির করা আমার কাছে লাইলাতুল কদরে হাজারে আসওয়াদকে সামনে নিয়ে ইবাদত করার চেয়ে অধিক প্রিয়।”[ইবনে হাব্বান]।

আল্লাহর রাস্তায় একদিন ব্যয় করা কেবল ইমারাত, জর্ডান ও কায়রো নয়; সারা দুনিয়া থেকেও উত্তম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“আল্লাহর রাস্তায় একদিন অবস্থান করা দুনিয়া ও তাতে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম।”[বুখারী]।

শাহাদত সৌভাগ্য

গৌরব ও বীর ভূমি আফগানিস্তানে শাহাদত বরণকারী যুবকদের কথা মনে পড়লে আমার নিজেকে ছোটই মনে হয়। কারণ, কয়েক বছর ধরে আমি শাহাদতের সন্ধান করছি। এসব যুবকদের কামনা তিনি পূরণ করছেন। কিন্তু আমার কামনা আল্লাহর কাছে এখনো প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছে। তাই আমার মনে হয়, আমি এখনো আল্লাহর কাছে সম্মানের পাত্র হয়নি। যদি আমি তার কাছে সম্মানের পাত্র হতাম, তাহলে এ যুবকদের ন্যায় আমাকেও তিনি শাহাদতের জন্য নির্বাচিত করতেন।

ভাইয়েরা! মুজাহিদের অনেক কারামত প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তারা কারামতের কারণে বিজয় অর্জন করেনি। তারা বিজয় অর্জন করেছে আল্লহর উপর তাওয়াক্কুল করার মধ্য দিয়ে। আফগানরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের আকীদা মানুষের অন্তরে নতুন ভাবে জাগ্রত করেছে। তাঁদেরকে আল্লাহ্ মানুষের অন্তরে ঈমান পুন জাগ্রত করার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাৎপদ, দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠী। তাঁদেরকে আল্লাহ্ পৃথিবীর সর্বাধিক সেনাবাহিনীর রাষ্ট্র সোভিয়ত ইউনিয়নের মোকাবেলা করার জন্য নির্বাচিত করেছেন। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা সোভিয়ত ইউনিয়নকে পরাজিত করে আমাদেরকে তার এ কথার সত্যতা দেখিয়ে দিয়েছেন-

كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ [٢:٢٤٩]

“আল্লাহর হুকুমে অনেক ক্ষুদ্র দল অনেক বড় দলের উপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহ রয়েছেন ধৈর্য্যশীলদের সাথে।”[বাকারাহঃ২৪৯]।