বর্তমান সময়ে ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক, নারী পুরুষ সম-অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতায় ইসলামের হস্তক্ষেপ, পৃথিবীজুড়ে আলোচনার বিষয়। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে এসবের অভিযোগ উত্থাপন করে তারাও যেমন যুক্তি তর্ক পেশ করছে, আবার ঠিক বিপরীত পাশে একদল লোক পালটা যুক্তি পেশ করে বুঝাতে চেষ্টা করছে যে ইসলামে আসলে কোন সন্ত্রাসবাদ নেই, ইসলাম নারী পুরুষ সম-অধিকারে বিশ্বাসী, নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী, ইসলাম আসলে গণতান্ত্রিক, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং এভাবে তারা ইসলামকে ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করে।
আশ্চর্যের বিষয়, তারা কিভাবে ইসলামকে ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করে যেখানে ইসলাম যেকোন প্রকার দোষত্রুটির উর্ধ্বে! এটা কোনভাবেই আমাদের দ্বীনের জন্য, আমাদের আত্বমর্যাদার জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়।
একটা বিষয় আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, ইসলাম এই সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ তা’আলা থেকে আগত পৃথিবীতে একমাত্র অবিকৃত দ্বীন যার কিনা কোন প্রকার খুঁত, অসম্পূর্ণতা নেই। অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে মাধ্যমে যে দ্বীন ইসলাম আল্লাহ্ আমাদের দিয়েছেন সেই আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলাই এই দ্বীনকে বিশুদ্ধ অবস্থাতেই হিফাজত করবেন। কিছু মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু ইসলামের রীতির কোন পরিবর্তন নেই।
আরেকটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এই দ্বীন অনেক মজবুত একটি দ্বীন; এটিকে ডিফেন্ড করতে আমাদের কারো প্রয়োজন নেই।
“আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল হিজর, ১৫: ৯]
এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ তাঁর কিতাবকে সংরক্ষণ করবেন, কিতাবের ব্যাখ্যাকারী তাঁর রাসূলের সুন্নাহকে সংরক্ষণ করবেন এবং এই শরীয়াহকে সংরক্ষণ করবেন। তাই দ্বীন ইসলাম সুরক্ষিত। আর এই দ্বীনের মধ্যে কোন ভুল ত্রুটি নেই যে, এটাকে আমাদের ডিফেন্ড করতে হবে! আমরা মুসলিমরা মনে করি না, ইসলামে হালালকৃত কোন বিষয় হারাম হওয়া উচিত ছিল, এবং হারামকৃত কোন বিষয় হালাল হওয়া উচিত ছিল; বরং এটা এমন একটা দ্বীন যা মানুষের ফিতরাতে সাথে কোন রকম সাংঘর্ষিক নয়।
এবার অন্য একটি গুরুত্বপুর্ণ পয়েন্টে আসা যাক, কারা ইসলামের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো পেশ করছে? ইসলামের ভালো মন্দ বিচার করছে? এরা হল তারাই যারা তাদের দ্বীন থেকে নিজেরা সরে এসেছে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলকে বিকৃত করেছে, সর্বোপরি দ্বীনকে বিসর্জন দিয়েছে। উদাহরণস্বরুপ এই খৃষ্টানরা তাদের দ্বীনকে সপ্তাহের একদিন রবিবার নিজেদেরকে চার্চে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে, এবং ইয়াহুদীরাও নিজেদেরকে সাব্বাতের কিছু আমলের ভিতর নিজেদের দ্বীনকে আটকে রেখেছে, নিজেদের জীবন থেকে দ্বীনকে আলাদা করেছে। আর এসব লোকেরা যারা নিজেদের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়েছে আর তারাই কিনা ইসলাম এবং মুসলিমদের বিচার করতে আসে!
তারা নিজেদের মস্তিস্ক প্রসুত সীমাবদ্ধ চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো নীতিমালা প্রনয়ণ করে। আর আশ্চর্যের বিষয়, এ দিয়ে তারা আমাদের বিচার করছে! এই মানব মস্তিস্কপ্রসূত চিন্তা চেতনার অসারতা এবং সাংঘর্ষিকতা বর্তমানের অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান; অনেক চিন্তা, গবেষণা আর জরিপ চালিয়ে একটা নীতিমালা প্রনয়ণের দু-চার বছর অতিক্রম না করতেই তার অসারতা বের হয়ে আসে। তখন তারা এই নীতিমালাগুলোকে নিজেরাই নিজেদের মতো কাট ছাট করে এমনকি মাঝেমাঝে বাতিল করে দেয় আর এটাই স্বাভাবিক। মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরি নীতিমালার ধরন এমনই হয়। আর এই জাতিগুলোই কিনা তাদের সকল দোষত্রুটিপূর্ণ চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা নিয়ে ইসলামকে এবং মুসলমানদের বিচার করতে আসে!! আমাদের কখনোই তাদের এসমস্ত ত্রুটিপূর্ণ মানদন্ড গ্রহণ করা উচিত হবে না!!
তাই যারা ইসলাম বিরোধী দাবীগুলোর জবাব পশ্চিমাদের মাপকাঠিতে দিতে চেষ্টা করে অর্থাৎ প্রমাণ করতে চায় ইসলামে আসলে সন্ত্রাসবাদের কোন জায়গা নেই, ইসলাম সবচেয়ে বেশী গণতান্ত্রিক, ইসলাম নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে তারা অবশ্যই ভুল করছে। এ ধরণে চরম পরাজিত মানসিকতা বর্জন করা উচিত! ইসলামের অবস্থান সব জীবন ব্যবস্থার উপরে, এবং আমরা মুসলিমরা এমন কোন দোষ করিনি যে সবসময় নিজেদেরকে ডিফেন্ড করে চলতে হবে।
সবচেয়ে উত্তম এবং সঠিক পদ্ধতি হলো, ইসলামের আক্বীদা-বিশ্বাস, মৌলিক বিষয়গুলোকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা, দ্বীনকে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করা, ইসলামী মূল্যবোধ, নৈতিকতা তুলে ধরা; এতে তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তবে খুবই ভালো যদি না করে, তবে জেনে রাখুন,
“ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মেরঅনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহর কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই।” [সূরা বাকার্ ২: ১২০]
আমাদের উচিত ইসলামের উপর অবিচল থেকে আল্লাহ্ সন্তুষ্টি অর্জন করা, অন্য কারো মনোরঞ্জন নয়। এবং এটা অত্যন্ত গুরুতর একটি বিষয়। আমাদের তরুণদের উচিত ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা। অনেকেই আজকে ইসলামের সাধারণ মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ! তারা জানে না, ইসলাম পশ্চিমার তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে কী বলে, ইসলামে শূরা এবং গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী? ইসলামে নারীর অধিকার এবং দায়িত্বসমূহ কী? এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর আজকের মুসলিম তরুণদের জানা নেই কারণ তারা নিতান্তই তুচ্ছতাতুচ্ছ বিষয় নিজে মজে আছে। এসব প্রশ্নে তারা খুবই অস্বস্থিবোধ করে যা কিনা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা আছে। এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ইসলামের শত্রুরা ইসলামের বিষয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের বীজ তরুণদের মনে বুনে দিচ্ছে। এটা এ কারণে নয় যে তারা সত্য বলছে, তারা সত্যের ধারক, বরং এ কারণে যে আমাদের তরুণরা ইসলামের মাহাত্ম্য সম্পর্কে গাফেল, ইসলামের সঠিক বুঝ সম্পর্কে অজ্ঞ।
এই যে পশ্চিমারা নানান অভিযোগ উত্থাপন করে—ইসলাম সন্ত্রাসবাদ উৎসাহ দেই, ইসলামে গণতন্ত্র নেই, ইসলাম নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী না, ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই—আরো কত কিছু। অধিকন্তু আমি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছি, আজকের পশ্চিমের জনগণ কী সুখী জীবন যাপন করতে পারছে? তারা কি আদো শান্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে? তাদের নিজেদের মূল্যবোধ কি আজ তাদের হাতে সুরক্ষিত? তাদের বস্তুবাদী চিন্তাধারা দিয়ে কি তারা একটি নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা দাড় করাতে পেরেছে? এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বরঞ্চ আমরা আজকে সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমার চিন্তা চেতনা সর্বোপরি জীবন ব্যবস্থা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সমাজের ভারসাম্য আনয়নে ব্যর্থ, বরং তারা নিজেদের অশান্তি, অস্থিরতা আর যুদ্ধ-বিগ্রহই বাড়িয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী তাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এবং দুর্বল সামাজিক বন্ধন এরই কিছু নমুনা।
তাই যেটা বলছিলাম আমরা মুসলিমরা নিজেদের মধ্য থেকে পরাজিত মানসিকতা পরিহার করব, সবসময় নিজেদের দোষী ভেবে মুখ থুবড়ে পড়ব না। আমরা তাদের তৈরি করে দেয়া মানদন্ড কখনোই গ্রহণ করব না। আমরা এমন কোন ভুল করিনি যার কারণে তাদের নিকট আমাদের নির্দোষ প্রমাণ করে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে কারণ এই দ্বীন ইসলামে কোন রকম খুঁত নেই। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের দ্বীন নিখুত এবং পরিপূর্ণ। বরঞ্চ আমাদের উচিত পশ্চিমার ক্রটিপূর্ণ অসার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা এবং ত্রুটিপূর্ণ আদর্শের উপর আঘাত হানা।