ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার কর্মপন্থা – আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদীর্ঘ দু’শ বছরব্যাপী ইংরেজদের গোলামি আমাদের জীবনধারাকে এতোটাই বদলে দিয়েছে যে, জীবনের কোনো অংশ এবং প্রান্ত এখন আর নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত নয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই সর্বব্যাপী অমঙ্গলকে বিনাশ করে আবারো ইসলামি জীবনধারা প্রবর্তন করা বেশ দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি নিঃসন্দেহে এ কথাও সত্য যে, এই কাজ ততোটা দুরূহ নয়, বাহ্যত যতোটা দুরূহ বোধ হয়। এর সাফল্যের পথে আশার প্রদীপ এবং সবচে সুদৃঢ় ভিত্তি— আমাদের জনসাধারণের দীনি জযবা, আজও যারা ইসলামের জন্য নিজেদের সব কিছুকে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত। তারা যদি কোনো নেতৃত্বের ওপর এই ভরসা করতে পারে যে, নেতাগণ বাস্তবেই তাদেরকে ইসলামি জীবনের পথে পরিচালিত করবে, তাহলে সেই পথ ধরে চলার অগণন বাধার কথা তারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যাবে।

হাঁ, এ কথা সত্য যে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সীমাহীন পরিশ্রম, ত্যাগ, জাতির জন্য দরদ ও ভালোবাসা এবং হেকমতের প্রয়োজন। এর কোনোটিরও যদি কমতি থাকে, তাহলে তা লক্ষ্য অর্জনের পথে উপকারের বদলে ঢের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এটা তো সবাই বোঝে যে, কোনো জাতির পরিবর্তিত জীবনধারাকে রাতারাতি সংশোধন করে ফেলা যায় না। আর এটা সম্ভবও নয় যে, পরিবর্তিত অবস্থার প্রতিটি জীবাণু এক নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। এজন্য যে ব্যক্তি পরিবর্তিত জীবনব্যবস্থা খতম করে ইসলামি জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করার স্বপ্ন দেখে, প্রথমে তাকে সেসব উৎসমূলকে বন্ধ করে দিতে হবে, যেখান থেকে সকল ফেতনা-ফাসাদ উৎসারিত হয়; যেগুলো পরিবর্তিত এবং বিকৃত সমাজব্যবস্থার মূল উৎসের ভূমিকা রাখে।

আমাদের দৃষ্টিতে এর উৎস চারটি—

  1. শিক্ষা
  2. আইন
  3. অর্থনীতি
  4. সমাজ ব্যবস্থা

জীবনের এই চারটি শাখার ওপর যদি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে অতি সহজেই পুরো সমাজ সংশোধন করে ফেলা সম্ভব।

এই চার শাখার মধ্যেও আমাদের দৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্ব রাখে— শিক্ষা। দুনিয়ার ইতিহাস এ কথার সাক্ষী— মানসিকতা গঠন করা ছাড়া নিরেট আইন কখনো কোনো সমাজে বিপ্লব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। আর এই মানসিকতা গঠনের সবচে কার্যকর পন্থা হলো, শিক্ষা। এই ব্রিটিশ বেনিয়ারাই যখন আমাদেরকে তাদের রঙ্গে রঙ্গিন করার স্বপ্ন দেখলো, তখন তাদের সর্বপ্রথম এবং সবচে কার্যকর পদক্ষেপ ছিলো, তারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে আমাদের ওপর এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিলো, যা তাদেরই ভাষায় ‘হিন্দুস্তানি ইংরেজ’ তৈরি করার মানসে প্রণয়ন করা হয়েছে। যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, হিন্দুস্তানের নাগরিকদের এমন মন-মানসিকতা গঠন করা, যা পশ্চিমা ধারায় বিচার-বিশ্লেষণ করতে অভ্যস্ত হয়ে গড়ে ওঠে এবং যাদের মানসপটে সর্বদা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ শক্তি এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ভয় রীতিমতো দানবের রূপে অঙ্কিত থাকে। সেই লর্ড মাইকেল প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছে, চিন্তা-ভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আর তার ফলশ্রুতিতে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

এখন এই পশ্চিমা ধারাকে অবলুপ্ত করার জন্য সম্ভাব্য পন্থা হলো, সর্বপ্রথম আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ইসলামি চিন্তাধারা এবং ইসলামি মানসিকতা পুশ করবো। এবং সম্পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পাশ্চাত্যের বিষ বের করে আনবো, যা আমাদের উত্তর প্রজন্মের মন-মানসিকতাকে বিষাক্ত করে রেখেছে, তাদের সামনে ইসলামি জীবনধারায় প্রবেশের পথকে আবৃত এবং রুদ্ধ করে রেখেছে।

এই প্রস্তাবনার অর্থ এ নয় যে, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে নতুন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো। তেমনই তার অর্থ এও নয় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় পশ্চিমা বিশ্ব যে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, আমরা তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবো। বরং এর উদ্দেশ্য হলো, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতায় ইসলামকে এমনভাবে গেঁথে দেবো, তাদের মানসপটে ইসলামি রুচি-প্রকৃতিকে এমনভাবে অঙ্কিত করবো, যার মাধ্যমে তারা দুনিয়ার সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল্যায়নধর্মী বিশ্লেষণ করতে পারবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনা এবং অভিজ্ঞতার সামনে গোলামির মানসিকতা নিয়ে অধ্যয়ন করবে না। বরং প্রতিটি নতুন বিষয়কে পূর্ণ স্বাধীনতা, সচেতনতা এবং মুক্তচিন্তার সাথে পর্যালোচনা করবে। সেগুলোকে সত্য এবং বাস্তবতা, দীন এবং দীনের চেতনার নিক্তিতে মাপবে। এরপরই সেগুলোর ব্যাপারে একসেপ্ট বা রিজেক্টের (গ্রহণ বা বর্জনের) সিদ্ধান্ত নিবে।

এখানে শিক্ষাব্যবস্থার সংশোধনের ধারাগুলোকে সবিস্তারে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। ‘আলবালাগ’[১] পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগে এ বিষয়ে যথেষ্ট বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। শিক্ষাব্যবস্থা সংশোধনের জন্য আমলি রূপরেখা কেমন হবে— তাও আলোচনা হয়েছে।[২] এখানে শুধু এতোটুকু বলা হচ্ছে যে, যখন কোনো অঞ্চলে ইসলামি বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে করা হয়, তখন যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের দাবি রাখে, তা হলো শিক্ষাব্যবস্থার সংশোধন। যদি এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ না করা হয়, তাহলে অন্যান্য সকল প্রচেষ্টা বেকার এবং ফলহীন সাব্যস্ত হয়। এজন্য আযাদ কাশ্মীর সরকারের কর্তব্য, সর্বপ্রথম এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করা।[৩]

* * * * *

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আইনের সংশোধন। আল্লাহ তাআলার দয়া এবং অনুগ্রহে মুসলমানদের কাছে এমন এক আইন রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে দুনিয়ার অপরাপর আইনের থেকে অধিক সুদৃঢ় এবং বাস্তবসম্মত। ইসলামি আইন বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে পৃথিবীতে কিছুতেই ন্যায় এবং ইনসাফ, শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রয়োজন শুধু, ইসলামি আইনকে যুগের দাবির আলোকে সংকলিত এবং বিধিবদ্ধ করা। আর বর্তমান পৃথিবীতে নিত্যনতুন যে সকল মাসায়িল দেখা দিচ্ছে, কোরআন সুন্নাহ ইজমা এবং কিয়াসের আলোকে সেসবের সমাধান খোঁজা।

এই উদ্দেশ্যে আযাদ কাশ্মির সরকার একটি কমিশন গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে। এখনও জানা যায়নি, সেই কমিশনের জন্য কোন ধরনের ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি মৌলিক পরামর্শ দেয়া সঙ্গত মনে করছি। পাকিস্তানে বিগত ২৩ বছরে বেশ কয়েকবার ইসলামি আইন সংকলন এবং বিধিবদ্ধ করার জন্য অসংখ্য বোর্ড এবং কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও কথা যেমন ছিলো, তেমনই রয়ে গেছে। ইসলামি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ অগ্রগতিটুকুও হয়নি।

ভাবনার বিষয় হলো, এই সকল কমিশনের ব্যর্থতার পেছনে মৌলিক কারণটা কী? এ বিষয়ে আমরা যতোদূর ভেবেছি, তাতে বোধ হয়েছে, এর একমাত্র কারণ হলো, এই কমিশনগুলো গঠন করার সময় সঠিক প্রক্রিয়ায় সদস্য নির্বাচন করা হয়নি। কোনো বিভাগ যতোই নেক নিয়ত এবং উত্তম লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হোক না কেনো, বিভাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত হয় না, বরং মানুষই তা পরিচালনা করে। পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা যদি তার যোগ্য এবং উপযুক্ত না হয়, তাহলে বিভাগ প্রতিষ্ঠাকারীদের হাজারো নেক নিয়ত সত্ত্বেও কখনো তা নিজ লক্ষ্যে সফলকাম হতে পারে না।

এ কথা তো দুনিয়ার সকল কমিশনের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বিশেষভাবে ইসলামি আইন-কানুন সংকলন ও বিধিবদ্ধ করা এমন এক কাজ, যার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন করা সবচে বড় এবং মৌলিক বিষয়। কেননা বর্তমান সময়ে ইসলামি আইন-কানুন বিধিবদ্ধ করা, যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা চূড়ান্ত পর্যায়ের জটিল একটি বিষয়। এই কাজ যথাযোগ্যভাবে সম্পাদন করা এমন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যিনি একদিকে ইজতিহাদ-ইসতিদলাল সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন এবং তিনি তার সারাজীবন এ কাজেই ব্যয় করেছেন, অন্যদিকে তিনি বর্তমান যুগের মাসআলাসমূহ যথাযথভাবে বোঝেন এবং বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানদের সামনে যে আমলি সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে, সুস্থ স্বাধীন চিন্তার সাথে সেগুলোরও সঠিক সমাধান দিতে পারেন।

এখন পর্যন্ত ইসলামি আইন-কানুন সংকলন করার জন্য যতোগুলো বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলোতে এই শর্তগুলোর প্রতি লক্ষ রাখা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বিভাগের জন্য এমন সব লোকদেরকে নির্বাচন করা হয়েছে, যারা না কোরআন এবং সুন্নাহ বোঝে, না ইসলামি শরিয়তের রুচি-প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারে আর না তারা তাদের জীবনের বড় অংশ ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের পেছনে ব্যয় করেছে। ফল এই হয়েছে যে, পাশ্চাত্যের চেতনা-মানসিকতায় ভীত হয়ে তারা ইসলামের মধ্যেই বিকৃতি সংযোজনের ধারার অবতারণা করে বসেছে। এর কারণে মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা-বিভক্তির ফেতনা আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভার মতো আগের থেকেও দ্বিগুণ জোরে ছড়িয়েছে।

আযাদ কাশ্মীর সরকার বাস্তবেই যদি চায় যে, ইসলামি আইন বাস্তবায়নের জন্য এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হোক, তাহলে তাদের জন্য এই মৌলিক বিষয়টি কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া উচিত হবে না যে, এই অঞ্চলের মুসলমানরা সেই দীনের বাস্তবায়ন চায়, যে দীন নিয়ে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন মুহাম্মাদে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সেই মডার্ন ইসলামের প্রতি তাদের কোনো চাহিদা-আকর্ষণ নেই, যা পাশ্চাত্যের ভয়ে কম্পমান-ভীত মস্তিষ্ক প্রসব করেছে এবং যা নিজে পরিবর্তিত হওয়ার বদলে খোদ কোরআনের মধ্যে পরিবর্তন সাধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে।

 * * * * *

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ধারার সংশোধন। বর্তমান সময়ে আমাদের এখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জায়গিরদারি প্রথা এবং পুঁজিবাদি ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই উভয় ধারায় হালাল-হারাম, জায়িয-নাজায়িয কোনো আলোচ্যবিষয়ই নয়। এখানে অর্থ থেকে অর্থ উপার্জনের সকল পন্থা স্বীকৃত এবং প্রশংসনীয়। সুদ, জুয়া, জুয়াবাজি এবং সম্পদ পুঞ্জীভূত করা— এমন চার মৌলিক উপাদান, যা সম্পদের প্রবাহ শুধু পুঁজিপতিদের দিকেই ফিরিয়ে রেখেছে। দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত লোকেরা জীবনের সকল পর্যায়ে বিপদ এবং সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে আছে।

এজন্য অর্থনীতিকে ইসলামি মূলনীতির ওপর অধিষ্ঠিত এবং ইসলাম প্রদত্ত ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচলিত সারহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই চার ভিত্তিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। যাতে পুরো দেশে ইনসাফের সাথে সম্পদ বন্টন হতে পারে।

এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত, সুদি ধারার ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে খতম করে তার স্থলে শিরকাত এবং মুযারাবার ধারায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সকল অসুদি ব্যাংকের একাধিক রূপরেখা, কার্যক্রম এবং কর্মপন্থার ব্যাপারে যৌক্তিক অসংখ্য প্রস্তাবনা এ যাবত সামনে এসেছে। তাই বর্তমান সময়ে আলিম এবং বিশেষজ্ঞ ব্যাংকারদের পারস্পরিক আলোচনাক্রমে এ ধরনের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা অর্জন করা তেমন কোনো দুরূহ বিষয় নয়। আমাদের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংশোধনের জন্য এটা সেই মৌলিক পদক্ষেপ, যার পরে আমাদের অসংখ্য অর্থনৈতিক সমস্যা আপনাআপনি দূর হয়ে যাবে।

এছাড়াও গত বছর পাকিস্তানের সকল ঘরানার ১১৮ জন আলিমের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থপনা সংশোধনের জন্য একটি রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক কর্মপন্থা হিসেবে সেই রূপরেখা একটি উত্তম এবং সুদৃঢ় ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

* * * * *

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এক সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠন করা। যেমন ওপরে বিবৃত হয়েছে— মন-মানসিকতা গঠনের পূর্বে শুধু আইন প্রয়োগ করে কোনো জাতিগোষ্ঠীর সংশোধন সম্ভবপর হয় না। মন-মানসিকতা গঠনের সবচে কার্যকর পন্থা যদিও শিক্ষাব্যবস্থা, কিন্তু এমন এক সমাজ, যেখানকার অধিকাংশ সাধারণ নাগরিক অশিক্ষিত, সেখানে শুধু শিক্ষাব্যবস্থা সংশোধন করে ফেলা সকল মানুষের মন-মানসিকতা গঠন করার জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য এই ধরনের সমাজকে সংশোধন করার জন্য সামাজিক অবস্থা উত্তমতর করা জরুরি।

এর জন্য কার্যকর পন্থা হলো, হুকুমতের পক্ষ থেকে সারাদেশে এমন এক উদ্যমপূর্ণ গণজাগরণের অবতারণা করা হবে, যা জনতার মাঝে নতুন প্রতিজ্ঞা, নতুন স্বপ্ন এবং নতুন জযবা সৃষ্টি করবে। এই জাগরণ তাদের সামনে এমন এক সুউচ্চ মাকসাদে যিন্দেগি পরিস্ফুট করে তুলবে, যাকে তারা ভালোবাসতে পারে এবং যার ভালোবাসা তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবে। প্রচার-প্রসারের সকল মাধ্যম (প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রভৃতি) -কে কাজে লাগিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে দীনি গায়রত ও আত্মমর্যাদাবোধ, জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি, সামাজিক জাগরণ এবং অমুসলিম সম্প্রদায়কে পেছনে ফেলে দৃপ্ত পদবিক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা জাগিয়ে তোলা হবে; যাতে করে জনসাধারণের অন্তরে নিজেদের দীন, নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং নিজেদের সামাজিক মূল্যবোধকে যথাযথ মুল্যায়ন দেয়া এবং সেগুলোকে উত্তরোত্তর উন্নতির পথে এগিয়ে নেয়া, সারা দুনিয়াকে সেদিকে আহ্বান করা এবং উন্নতির এ যুগে অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা জাগ্রত হয়। এই চেতনা ও মূল্যায়নবোধই কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বৈপ্লবিক আন্দোলনের সূত্রপাত করতে পারে। এছাড়া সংশোধনের উপরিউক্ত প্রচেষ্টাসমূহ সাধারণত ফলপ্রসূ হয় না।

এই সুদৃঢ় সামাজিক চেতনা জাগ্রত করার পরে জনসাধারণকে যে কাজই দেয়া হবে, তাদের পূর্বের জীবনের বিচারে তা যতোটাই আজনবি হোক না কেনো, তারা সেটাকে যওক-শওক এবং জযবা-আগ্রহের সাথে সম্পন্ন করবে। কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থাকে সাহসের সাথে প্রতিহত করবে। তাদের মধ্যে জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সীমাহীন কোরবানি দেয়ার প্রেরণা জাগ্রত হবে। আর প্রথমে যদি জনসাধারণের মন-মানসিকতাকে বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা এবং এই উদ্যমপূর্ণ দীনি এবং জাতীয় চেতনা ও মূল্যায়নবোধ জাগ্রত করা ছাড়াই আচমকা তাদেরকে এমন কর্মপন্থা ধরিয়ে দেয়া হয়, যা তাদের কাছে আচম্বিত এবং কিম্ভূতকিমাকার মনে হয়, তাহলে সেটাকে যথাযোগ্যভাবে জারি এবং চলমান রাখতে গেলে কঠিন কঠিন বিপদ-বাধা সামনে আসতে থাকবে এবং সংশোধনের লক্ষ্যও ঠিকঠিকভাবে অর্জিত হবে না।

* * * * *

হাঁ, আরেকটি বিষয় আছে, যা ওপরের সবগুলোর থেকেও অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি পদক্ষেপ কার্যকর হওয়ার জন্য অত্যাবশ্যক শর্ত। আর তা হলো, দুনিয়ার মধ্যে কোনো সামাজিক কার্যক্রম সফলতা লাভ করে না, যতোক্ষণ না তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত কর্মী গড়ে তোলা সম্ভাবিত হয়। সরকারে দো আলম মুহাম্মাদে আরাবি সা. মক্কিজীবনের তেরোটি বছর এ কাজেই ব্যয় করেছেন এবং লক্ষ্যার্জনের স্বপ্নে বিভোর এক জানবাজ জামাত তৈরি করেছেন।

নিকট অতীতে ইসলামি জীবনধারা বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন ঘরানার পক্ষ থেকেই আন্তরিকতাপূর্ণ উদ্যোগ ও প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তারা শুধু এজন্য কামিয়াব হতে পারেনি, কারণ এ সকল আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের আশপাশে একনিষ্ঠ এবং সমমনা সাথী-কর্মীর অভাব ছিলো। তাদের ইখলাসপূর্ণ প্রয়াস এবং উদ্যোগ সেসকল লোকদের হাতেই ব্যর্থতার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, যারা তাদের বন্ধু এবং সুহৃদ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলো। তাছাড়া হাল-অবস্থা সংশোধনের জন্য শুধু আইন-কানুন প্রণয়ন করা এবং বিধান জারি করে দেয়াই যথেষ্ট নয়— যতোক্ষণ না সেসব বিধানকে কার্যত বাস্তবায়নকারী মেশিনারি সেসব বিধানের আত্মা (মূল স্পিরিট) -এর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ না করবে এবং তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ না হবে।

এজন্য আযাদ কাশ্মীর সরকার যে দীনি সংশোধনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে চলছেন, তার জন্য সর্বপ্রথম উপযুক্ত কর্মী-সহচর অনুসন্ধান করা জরুরি, যারা এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের সমমনা এবং সমচিন্তার অধিকারী হবে। তার প্রায়োগিক অনুশীলনের পন্থা হলো, নতুন সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন বিভাগে তাদের দায়িত্বগ্রহণের সময় সেই লক্ষ্যের সঙ্গে তাদের একাত্মতার বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হবে। যে-সকল কর্মী আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজে সহযোগিতার মানসে অংশগ্রহণ করবে, তাদের উদ্যম যোগানো হবে। আর এক্ষেত্রে যাদের মধ্যে ত্রুটি দেখা যাবে, তাদের মানসিকতা গঠনের ফিকির করা হবে।

এটা তো একটা স্পষ্ট বিষয় যে, তাৎক্ষণিকভাবে এমন আন্তরিক সঙ্গীদের বড় জামাত পেয়ে যাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এতোটুকু তো অবশ্যই করা হবে, যে চারটি বিভাগের আলোচনা ওপরে বিবৃত হলো, সেই বিভাগগুলো পরিচালনা করার জন্য এমন লোকদেরকে নির্বাচন করা হবে, যারা দীনের রুচি-প্রকৃতি অনুধাবন করে এবং দীনকে বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা রাখে। এরপর ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে এমন লোকদের এক বড় জামাত আপনাআপনিই তৈরি হতে থাকবে।

আমাদের অন্তরপ্রসূত দোয়া থাকবে, আল্লাহ তাআলা আযাদ কাশ্মীর সরকারকে সুস্থ এবং নিরাপদ মানসিকতার সাথে দীনের সহিহ খেদমত করার তাওফিক দান করুন। যেসকল কল্যাণমূলক পদক্ষেপ এ পর্যন্ত সামনে এসেছে, তা শুধু এক সাময়িক আলোড়ন হিসেবে প্রতীয়মান না হোক— সেটাই আমাদের কামনা।


অনুবাদঃ আলী হাসান উসামা

[১] দারুল উলুম করাচির মুখপত্র মাসিক পত্রিকার নাম ‘আলবালাগ’। —অনুবাদক

[২] ইসলামি ই-বুক সিরিজের পরবর্তী কোনো বইয়ে আমরা ইনশাআল্লাহ সেই লেখাগুলোর অনুবাদ প্রকাশ করবো। —অনুবাদক

[৩] এই রচনাটি ১৩৯১ হিজরিতে সেই সময়ে প্রকাশিত হয়, যখন আযাদ কাশ্মীরের প্রধান নেতা নিজ অধ্যুষিত এলাকায় ইসলামি আইন বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। আযাদ কাশ্মীর সরকারকে উদ্দেশ্য করেই এই রচনাটি লেখা হয়েছিলো। তাই রচনার একাধিক জায়গায় তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে।