ঝাড়ফুঁক-তাবীয : একটি দালীলিক বিশ্লেষণ – মাওলানা এমদাদুল হক [১ম পর্ব]

সমাজে লক্ষ করলে দেখা যায়, আমরা অন্য অনেক কিছুর মত ঝাড়ফুঁক-তাবীয ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বেশ সীমালঙ্ঘন করে চলেছি। আবার ইদানীং কোনো কোনো মহল তাবীযকে ঢালাওভাবে শিরক বলে মুসলমানদের মাঝে এ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনামূলক দালীলিক আলোচনা জরুরি মনে হচ্ছে এবং সীমালঙ্ঘনগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। আল্লাহ্ই তাওফীকদাতা।

মূল প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে প্রথমে ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে, যেগুলোর আলোকে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

 

এক.

আল্লাহর কাছে সবচে’ ঘৃণ্য ও জঘন্যতম পাপ হল শিরক। কুরআন মাজীদে পুত্রের প্রতি লুকমান হাকীমের ওসিয়তগুলো বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে তিনি নিজ পুত্রকে ওসিয়ত করে বলেন-

وَ اِذْ قَالَ لُقْمٰنُ لِابْنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ  اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْمٌ.

স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে নিজ পুত্রকে বলেছিল, বৎস! তুমি আল্লাহ্র সাথে শরীক করো না। কেননা র্শিক নিশ্চয় মারাত্মক অবিচার ও পাপ। -সূরা লুকমান (৩১) : ১৩

আল্লাহ তাআলা নবীকে সতর্ক করে বলেছেন-

وَ لَقَدْ اُوْحِیَ اِلَیْكَ وَ اِلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكَ  لَىِٕنْ اَشْرَكْتَ لَیَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.

নিশ্চয় আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি এই ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, যদি আপনি শিরক করেন তাহলে অবশ্যই আপনার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং নিশ্চিত আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। -সূরা যুমার (৩৯) : ৬৫

অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেছেন-

اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ وَ مَاْوٰىهُ النَّارُ.

আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৭২

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-

اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرٰۤی اِثْمًا عَظِیْمًا.

নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮

একজন মানুষ যত ভালো কাজই করুক কিন্তু সে যদি র্শিক করে আল্লাহ তাআলার কাছে তার কোনো কিছুরই মূল্য নেই। এজন্য কিয়ামতের দিবসে মুশরিকরা যত ভালো কাজই নিয়ে আসুক আল্লাহ তাআলা সেগুলোকে ধুলিকণা-রূপ করে দিবেন। আল্লাহ বলেন-

وَ قَدِمْنَاۤ اِلٰی مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنٰهُ هَبَآءً مَّنْثُوْرًا.

তারা (দুনিয়ায়) যা-কিছু আমল করেছে, আমি তার ফায়সালা করতে আসব এবং সেগুলোকে শূন্যে বিক্ষিপ্ত ধুলোবালি (-এর মত মূল্যহীন) করে দেব।  -সূরা ফুরকান (২৫) : ২৩

যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, জীবন ধারণের সব উপকরণ দান করেছেন, আমাকে অগণিত নিআমত দান করেছেন; তাঁকে অস্বীকার করা বা তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করা এবং অবাস্তব বিশ্বাস করা যে, তারাও তাঁর মত ক্ষমতাবান ও দাতা, এটা শুধু আল্লাহর কাছেই নয়, যে কোনো বিবেকবানের কাছেই জঘন্যতম অপরাধ।

তাই মুশরিকরা যতই ভালো কাজ করুক শিরকের কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের কোনো ‘ভালো’ কাজই গ্রহণ করবেন না।

 

দুই.

শিরক দুই প্রকার: এক. শিরকে জলী, দুই. শিরকে খফী। শিরকে জলী সবচেয়ে মারাত্মক। শিরকে জলীর অনেক প্রকার রয়েছে। যেমন ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ তাআলার হক, তাতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে শরীক করা, উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বের বিষয়ে গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, উপায়-উপকরণকে উপায়-উপকরণের সৃষ্টিকর্তার মান দেওয়া, গাইরুল্লাহকে উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতাধারী মনে করা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলি এবং এ ধরনের আরো অনেক বিষয় শিরকে জলীর অন্তর্ভুক্ত। ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থে দলীলসহ বিস্তারিতভাবে বিষয়গুলি আলোচনা করা হয়েছে আর সংক্ষিপ্তাকারে ‘বেহেশতী জেওর’ প্রথম খণ্ডেও আলোচনা আছে। গ্রন্থদ্বয় দেখে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা, অতপর এগুলো থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা কর্তব্য।

 

তিন.

কিছু বিষয় আছে এমন, যা তাওহীদ-পরিপন্থী তো নয়, তবে তা ‘তাওয়াক্কুলে’র সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিম্নস্তরের। এ ধরনের বিষয়গুলোকে শিরক বলা স্পষ্ট ভুল। যে বিষয়ে যতটুকু কমতি আছে তাতে ততটুকু কমতির কথাই বলা উচিত। বাড়াবাড়ি করে বিদআতকে শিরক বলে দেওয়া অথবা তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিপন্থী বিষয়কে তাওহীদের পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে শিরক বানিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

 

চার.

দুআ (আল্লাহকে ডাকতে থাকা, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাওয়া) এবং ইস্তেআনাত (আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা) তাওহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং অনেক বড় ঈমানী আমল। যা প্রতিটি মুমিনের কাছে সবসময় কাম্য। এই দুআ ও ইস্তেআনার একটি অংশ হল, কুরআন-হাদীসে শেখানো ঝাড়ফুঁকের দুআসমূহ। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাকে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী মনে করা মূর্খতা। কারণ, এটি তো দুআ ও ইস্তেআনার অংশ, যা ঈমান ও তাওহীদ এবং তাওয়াক্কুলের গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। তাই এক্ষেত্রে অবহেলা করা বাস্তবেই অনেক বড় লোকসানের কারণ।

 

পাঁচ.

যে-ঝাড়ফুঁক ‘মা’ছূর’ নয়, কিন্তু তার উপকারিতা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত এবং তাতে ঈমানবিরোধী ও শরীয়তবিরোধী কোনো বিষয় নেই তা মুবাহ উপায়-উপকরণের পর্যায়ে। যেমনিভাবে অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত উপকারী ওষুধ-পথ্য ব্যবহার করা মুবাহ, তেমনিভাবে এই ঝাড়ফুঁকও মুবাহ।

 

ছয়.

তাবীযের (تعويذ) হাকীকত হল, আশ্রয় প্রার্থনা করা। তাবীয ব্যবহারকারী যদি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার নিয়তেই তাবীয ব্যবহার করে এবং তাবীযের লেখা যদি কুরআন-হাদীসেরই কোনো দুআ হয় তাহলে এই তাবীয ব্যবহার মুবাহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু তাবীয ব্যবহারকারীর পক্ষ থেকে তার নিজের কোনো আমল পাওয়া যাচ্ছে না, আবার এই আশঙ্কাও থাকে যে, তাবীয ব্যবহারকারী অবচেতনভাবে দুআ ও ইস্তেআনার বদলে তাবীযের উপরই নির্ভর করে বসবে, তাই সালাফের কতক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব একে পছন্দ করেননি, কিন্তু এমন নয় যে, তারা একে না-জায়েয বলেছেন। তাইতো সালাফের একটি বড় জামাত এটি মুবাহ হওয়ার প্রবক্তা।

 

সাত.

কারো কারো অভ্যাস হল, আপদ-বিপদে নিজে দুআ ও ইস্তেআনাতের প্রতি গুরুত্বারোপ না করে কারো কাছ থেকে তাবীয গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়। জানা উচিত যে, এটি অনেক বড় মাহরূমি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি -কোনো সন্দেহ নেই- তাওয়াক্কুল পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি, যা নিঃসন্দেহে সংশোধনযোগ্য।

মূল কাজ হতে হবে, দুআ ও ইস্তেআনার প্রতি নিজেই যত্নবান হওয়া। এই বিষয়ের মা’ছূর দুআ ও আমলগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া। তারপর ঝাড়ফুঁক নেওয়া হলে তাও ভালো। আর মা’ছ‚র তাবীয নিলে তাও নিষিদ্ধ নয়।

 

আট.

কেউ কেউ তাবীয নেওয়ার ক্ষেত্রে এত বাড়াবাড়ি করে যে, অনেক সময় বে-দ্বীন ও বে-শরা লোকদের কাছ থেকেও তাবীয নিতে যায়। স্পষ্টতই এ ধরনের লোকের তাবীযে লিখিত শব্দ-বাক্য শিরকী হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। মহিলারা অনেক সময় পর্দার হুকুম লঙ্ঘন করে গায়রে মাহরামের সামনেও চলে যায়, যা স্পষ্ট হারাম। এই কার্যাবলি এবং এ ধরনের সকল বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকা ফরয।

 

নয়.

তাবীযে যদি কুফরী বা শিরকী কোনো কথা লেখা থাকে অথবা তাবীযের নামে যাদু করা হয় বা তাবীয প্রদানকারী/তাবীয গ্রহণকারীর কেউ -আল্লাহ মাফ করুন- তাবীযকেই সরাসরি সমস্যা সমাধানকারী এবং প্রয়োজন পূরণকারী মনে করে। তেমনি যদি তাবীযের সঙ্গে গাইরুল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কৃত মান্নতকে জুড়ে দেওয়া হয় কিংবা অন্য কোনো শিরকী কাজ তাবীযের সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে এই তাবীয কুফর ও শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ থেকে যদি খালেস দিলে তওবা করে সম্পূর্ণরূপে তা পরিত্যাগ না করা হয়, তাহলে ঈমান ও ইসলামের নিআমত থেকেই মানুষ মাহরূম হয়ে যাবে।

 

দশ.

আমাদের এই আলোচনা কেবল মা’ছূর ও মুবাহ তাবীয সম্পর্কে। যারা বাড়াবাড়ি করে একে শিরক বলে দেয় এবং যারা التمائمشرك -এই হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা বুঝে বসে আছে, দলীলসহ তাদের খণ্ডন করাই কেবল এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। এ প্রবন্ধকে কোনো ‘মুনকার’ তাবীয অথবা কোনো মুনকার দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন মনে করা ভুল হবে।

 

এগার.

শিরক যেমন আল্লাহর কাছে  সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয় তেমনিভাবে তাওহীদে বিশ্বাসী কোনো মুসলিমকে মুশরিক বলা বা শিরকের অপবাদ দেয়াও আল্লাহর কাছে জঘন্য অপরাধ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু   আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَيّمَا امْرِئٍ قَالَ لِأَخِيهِ: يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا، إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ، وَإِلا رَجَعَتْ عَلَيْهِ.

কোনো ব্যক্তি তার অপর ভাইকে যদি বলে, ‘হে কাফের!’, তাহলে একথা এ দুজনের কোনো একজনের উপর পতিত হবেই হবে। যে ব্যক্তিকে কাফের বলা হয়েছে সে যদি  কাফের হয় তাহলে তো হলোই, অন্যথায় যে বলেছে (কথাটি) তার দিকেই ফিরে আসবে। -সহীহ মুসলিম হাদীস ৬০; সহীহ বুখারী হাদীস ৬১০৪

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ.

কোনো ব্যক্তি কোনো মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল সে যেন মুমিন ব্যক্তিটিকে হত্যাই করে ফেলল। (অর্থাৎ কুফরীর অপবাদ দেওয়াটা হত্যার সমানই অপরাধ।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১০৫

তাই এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে তাওহীদে বিশ্বাসী কারো উপর কুফর বা শিরকের অপবাদ না দেওয়া।

 

মূল প্রসঙ্গ

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। ইসলামের আগমনের পূর্বে জাহিলিয়্যাতের যুগে রোগ-বালাই থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের উপায় ও পন্থা অবলম্বন করা হত। তন্মধ্যে একটি হল ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা। ঐ যুগে যেহেতু আল্লাহপ্রদত্ত কোনো ধর্ম তারা অনুসরণ করত না তাই তাদের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাওহীদ-পরিপন্থী কর্ম ও চরিত্র এবং মানবতা বিবর্জিত বহু বিষয় তাদের ধর্ম বা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ইসলাম এসে তাদের পূর্বের সকল রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করে; যেগুলো তাওহীদ-পরিপন্থী সেগুলো নিষিদ্ধ করে আর যেগুলো এসব থেকে মুক্ত সেগুলোকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়। ঔষধ-পত্রের মাধ্যমে চিকিৎসাতে যেহেতু তাওহীদ-পরিপন্থী তেমন কিছু নেই তাই ইসলাম এসে তা পূর্বের ন্যায় বহাল বা বৈধ রাখে। তবে, ইসলাম তাতে এ সংশোধনী অবশ্যই এনেছে যে, ঔষধকে সুস্থতাদানকারী  মনে করা যাবে না; বরং সুস্থতাদানকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ আর ঔষধ মাধ্যমমাত্র। আর যারা এ চিকিৎসাকর্মে  নিজেকে নিয়োজিত করবে সে যেন পরিপূর্র্ণরূপে চিকিৎসা-জ্ঞান অর্জন করে এবং পুরো পারদর্শী হয়ে এ কাজে ব্রত হয়; আংশিক বা ভুল জ্ঞান ও অপরিপক্ক জ্ঞান নিয়ে যেন এ কাজে অগ্রসর না হয়। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল :

হযরত আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি চিকিৎসাজ্ঞান অর্জন করা ছাড়া চিকিৎসা শুরু করে, আর তার চিকিৎসায় কেউ মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে এর দায় ঐ ব্যক্তির উপরই বর্তাবে (তার ক্ষতিপূরণ তাকেই বহন করতে হবে)। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৫৭৭

হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত, নবীজীর যুগে এক ব্যক্তির শরীর যখম হয় এবং ফুলে রক্ত-পুঁজ জমে যায় তখন লোকটি বনী আনমারের চিকিৎসক দুই ভাইকে ডাকলেন। নবীজী তাদের উভয়জনকে দেখে বললেন, চিকিৎসায় তোমাদের মধ্যে কে বেশি পারদর্শী? তারা দুজনে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! চিকিৎসাকর্ম কি ভালো? তখন নবীজী বললেন, যিনি রোগ নাযিল করেছেন তিনি চিকিৎসাও নাযিল করেছেন। -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ১৭৫৭

হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, আমি একদা অসুস্থ হই, তখন নবীজী আমাকে দেখতে আসেন এবং তাঁর হাত আমার বক্ষে রাখেন। আমি তাঁর হাতের শীতলতা আমার কলিজা পর্যন্ত অনুভব করি। তখন নবীজী  আমাকে বললেন, তুমি হৃদরোগী, তুমি হারেস ইবনে কালদার কাছে যাও, সে চিকিৎসক। সে যেন সাতটি আজওয়া খেজুর নেয় এবং তা বিচিসহ চূর্ণ করে, অতপর যেন তোমাকে পান করায়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭১

হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ রোগও নাযিল করেছেন এবং তার নিরাময়কও। আর তিনি প্রত্যেক রোগের জন্য নিরাময়কও রেখেছেন তাই তোমরা চিকিৎসা কর,  তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭০

হাদীস ও আসারের কিতাবে এ বিষয়ে বহু হাদীস, সাহাবা-সালাফের উক্তি ও নির্দেশনা রয়েছে। এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হল।

 

ঝাড়ফুঁক

রোগ-বালাই নিরাময়ে জাহেলিয়্যাতের যুগে যেসব উপায় অবলম্বন করা হত তন্মধ্যে আরেকটি হল ঝাড়ফুঁক অর্থাৎ কিছু পড়ে রোগীর গায়ে দম করা। এ ঝাড়ফুঁকের প্রচলন সে যুগে বেশি ছিল। এমনকি অনেক রোগের জন্য বিশেষ বিশেষ মন্ত্রও ছিল, যা পড়ে এ রোগের রোগীকে দম করা হত। সাপে কাটলে এক মন্ত্র, জ্বরের জন্য আরেক মন্ত্র, বদ নজরের জন্য এক মন্ত্র, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপনে আরেক মন্ত্র ইত্যাদি। এ ঝাড়ফুঁককে আরবীতে বলা হয় الرقية (আররুকইয়া)। বলাবাহুল্য, জাহিলিয়্যাতের যুগে এসব তন্ত্র-মন্ত্রের অধিকাংশই ছিল কুফর আর শিরক সম্বলিত। আর ইসলামের প্রধান ভিত্তি হল তাওহীদ। তাই ইসলাম এসেই কোনো প্রকার শর্র্ত ছাড়াই এ ধরনের সকল ঝাড়ফুঁককে নিষিদ্ধ করে দেয়। নবীজী তখন ঘোষণা করেন-

إِنّ الرّقَى، وَالتّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ.

নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তামীমা (পাথরবিশেষ) ও তিওয়ালা (স্বামীকে আকৃষ্ট করার মন্ত্রবিশেষ) শিরক । -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭৯

এবং ঝাড়ফুঁকের ব্যাপারে কঠোরভাবে শর্ত করে দিলেন যে, তাতে কোনো শিরকী-কুফরী শব্দ বা বিষয় থাকতে পারবে না। এ ধরনের শিরকমুক্ত ঝাড়ফুঁক হলে নবীজী তার অনুমোদন তো দিয়েছেনই সাথে সাথে যারা এসব ঝাড়ফুঁক জানে তাদের তা চালিয়ে নিতে এবং অন্যকে শেখাতেও বলেছেন। আর স্বয়ং নবীজীও ঝাড়ফুঁককারীদের মন্ত্রগুলো শুনতেন এবং দেখতেন তাতে কোনো কুফরী কথা আছে কি না, থাকলে তা নিষিদ্ধ করে দিতেন আর না থাকলে তার অনুমোদন দিতেন।

হযরত আউফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। আমরা নবীজীকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বিষয়টি কেমন মনে করেন? তখন নবীজী বললেন-

اعْرِضُوا عَلَيّ رُقَاكُمْ لَا بَأْسَ بِالرّقَى مَا لَمْ تَكُنْ شِرْكًا.

তোমরা ঝাড়ফুঁকে কী বল তা আমাকে শোনাও। যতক্ষণ পর্যন্ত ঝাড়ফুঁক শিরকমুক্ত হবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৬

হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমা বিনতে উমাইস রা.-কে বললেন-

مَا شَأْنُ أَجْسَامِ بَنِي أَخِي ضَارِعَة أَتُصِيبُهُمْ حَاجَةٌ قَالَتْ لَا وَلَكِنْ تُسْرِعُ إِلَيْهِمْ الْعَيْنُ أَفَنَرْقِيهِمْ قَالَ وَبِمَاذَا فَعَرَضَتْ عَلَيْهِ فَقَالَ ارْقِيهِمْ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আসমা বিনতে উমাইস রা.-কে বললেন, (আসমা নবীজীর চাচাতো ভাই ও প্রসিদ্ধ সাহাবী জাফর তাইয়ার রা.-এর সহধর্মিণী) আমার ভ্রাতুষ্পুত্রদের কী হল, তারা সকলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তারা কি অভাবে রয়েছে? আসমা বললেন, না, তবে তাদের প্রতি বদ নযর বেশি লাগে; আমরা এর জন্য কি ঝাড়ফুঁক করব? নবীজী বললেন, কী পড়ে তোমরা বদ নযরের জন্য ঝাড়ফুঁক কর- তা আমাকে শোনাও। তখন আসমা রা. তা পড়ে শোনালেন। তখন নবীজী বললেন, অসুবিধা নেই এ দিয়ে ঝাড়ফুঁক কর। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৫৭৩

হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. বলেন-

كنت أرقي من حمة العين في الجاهلية فلما أسلمت ذكرتها لرسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : ” اعرضها علي ” فعرضتها عليه فقال : “ارق بها فلا بأس بها” . ولولا ذلك ما رقيت بها إنسانا أبدا. (رواه الطبراني وإسناده حسن)

আমি জাহিলিয়্যাতের যুগে বদ নযরের   ঝাড়ফুঁক করতাম। যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন নবীজীকে বিষয়টি বলি, নবীজী বললেন, তুমি যা বলে ঝাড়ফুঁক কর তা আমাকে শোনাও। আমি তাঁকে শোনালাম। তখন নবীজী বললেন-

ارق بها، ليس بها بأس.

অসুবিধা নেই এ দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে পার ।

আল্লাহর কসম, নবীজী আমাকে অনুমতি না দিলে আমি কোনো এক লোককেও ঝাড়ফুঁক করতাম না। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৮৪৪৪ (তবারানীর বরাতে। হায়ছামী বলেছেন, এর সনদ হাসান।)

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كَانَ خَالِي يَرْقِي مِنَ الْعَقْرَبِ، فَلَمّا نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَنِ الرّقَى، أَتَاهُ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنّكَ نَهَيْتَ عَنِ الرّقَى، وَإِنِّي أَرْقِي مِنَ الْعَقْرَبِ، فَقَالَ: ” مَنْ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَفْعَلْ “.

আমার মামা বিচ্ছুর দংশনের ঝাড়ফুঁক করতেন। যখন নবীজী ঝাড়ফুঁক নিষিদ্ধ করেন তখন তিনি নবীজীকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঝাড়ফুঁক থেকে নিষেধ করেন, আমি তো বিচ্ছু কাটার ঝাড়ফুঁক করি। নবীজী বললেন কেউ তার ভাইয়ের উপকার করতে পারলে সে যেন তা করে। -মুসনাদে আহমাদ ৩/৩০২, হাদীস ১৪২৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৯

আমর ইবনে হাযম-এর পুরো পরিবার ঝাড়ফুঁক করত। নবীজী যখন ঝাড়ফুঁক নিষেধ করেন তখন আমর ইবনে হায্ম-এর পরিবার নবীজীর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঝাড়ফুঁক নিষেধ করেছেন, আমরা বিচ্ছুর দংশনের ঝাড়ফুঁক করি; এই বলে তারা তাদের পঠিত কথাগুলো পড়ে শোনায়। তখন নবীজী বললেন, কেউ তার ভাইয়ের উপকার করতে পারলে সে যেন তা করে। -মুসনাদে আহমাদ ৩/৩০২, হাদীস ১৪৩৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৯

যেহেতু হযরত জাবেরের মামা এবং  এই আনসারী সাহাবীর ঝাড়ফুঁকে পঠিত কথাগুলোতে শিরক ছিল না তাই নবীজী তাদেরকে এমন বলেছেন।

হযরত আয়েশা রা. বলেন-

رخص رسول الله صلى الله عليه و سلم لأهل بيت من الأنصار في الرقية من كل ذي حمة.

নবীজী আনসারী এক পরিবারকে বিষাক্ত প্রাণীর ঝাড়ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৩

অর্থাৎ তাদের পরিবার এ ঝাড়ফুঁক করত।

হযরত আয়েশা রা.আরো বলেন-

كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يأمرني أن أسترقي من العين.

নবীজী আমাকে বদ নযরের জন্য ঝাড়ফুঁক নিতে বলেছিলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৫

একবার উম্মে সালামার বাদীর মুখ হলদে বর্ণ হয়ে যায়, তখন নবীজী বলেন-

بها نظرة فاسترقوا لها.

এর প্রতি কারো বদ নযর লেগেছে, তাই বদ নযরের ঝাড়ফুঁক করাও । -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৭

শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ বলেন-

دخل علي رسول الله صلى الله عليه و سلم وأنا عند حفصة فقال لي ” ألا تعلمين هذه رقية النملة (النملة قروح تخرج في الجنبين ) كما علمتها الكتابة؟

একদা আমি হাফসা রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। নবীজী ঘরে আসলেন এবং আমাকে বললেন, তুমি হাফসাকে যেভাবে লেখা শিখিয়েছ তাকে ‘নামলা’ (এক ধরনের গোটা বিশেষ)-এর ঝাড়ফুঁক  শিখিয়ে দাও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৭

যেহেতু এতে পঠিত কথাগুলোতে শিরক নেই এবং এর দ্বারাও মানুষের উপকার হয়, তাই হাফসাকে তা শিখিয়ে দিতে বললেন।

সাহাবী উমায়ের বলেন-

عرضت على النبي صلى الله عليه و سلم رقية كنت أرقي بها من الجنون فأمرني ببعضها ونهاني عن بعضها وكنت أرقي بالذي أمرني به رسول الله صلى الله عليه و سلم.

আমি উন্মাদের ঝাড়ফুঁক করতাম। নবীজীকে আমার পঠিত কথাগুলো শোনালাম। তখন নবীজী কিছু বাক্যের অনুমোদন দিলেন (অর্থাৎ এগুলো পড়ে ঝাড়ফুঁক করা যাবে) আর কিছু বাক্য থেকে নিষেধ করলেন (এগুলো পড়ে ঝাড়ফুঁক করা যাবে না)। নবীজী যেগুলোর অনুমতি দিয়েছিলেন পরবতীর্তে আমি শুধু তা দিয়েই ঝাড়ফুঁক করতাম। -শরহু মাআনিল আসার, হাদীস ৭০৪৫

কুরায়ব আলকিন্দি বলেন-

أخذ بيدي علي بن الحسين، فانطلقنا إلى شيخ من قريش يقال له : ابن أبي حثمة يصلي إلى أسطوانة، فجلسنا إليه، فلما رأى عليا انصرف إليه، فقال له علي : حدثنا حديث أمك في الرقية قال : حدثتني أمي أنها كانت ترقي في الجاهلية فلما جاء الإسلام قالت : لا أرقي حتى أستأذن رسول الله صلى الله عليه و سلم فأتته فاستأذنته.

একদা আলী ইবনুল  হাসান আমাকে কুরায়শের এক বৃদ্ধ লোকের কাছে নিয়ে যান। তিনি তখন মসজিদের এক খুঁটির কাছে নামায পড়ছেন। আমরা তার কাছে গিয়ে বসলাম। আলীকে দেখার পর তিনি তার দিকে ফিরলেন, তখন আলী তাকে বললেন, আপনি আমাদেরকে ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে আপনার আম্মার হাদীসটি শোনান। তিনি বললেন, আমার আম্মা আমাকে বলেছেন, তিনি জাহিলিয়্যাতের যুগে ঝাড়ফুঁক করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি বললেন, আমি নবীজী  থেকে অনুমতি নেওয়া ব্যতীত আর কোনো ঝাড়ফুঁক করব না। তাই তিনি নবীজীর কাছে আসলেন, এবং বিষয়টি বললেন। তখন নবীজী উত্তরে বললেন-

ارقي ما لم يكن فيها شرك.

শিরক-কুফর ব্যতীত অন্য সবকিছু  দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে থাক। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬০৯২

ইমাম ইবনে হিব্বান রাহ. এই হাদীসের শিরোনাম দেন-

ذِكْرُ الْخَبَرِ الدّالِّ عَلَى أَنّ الرّقَى الْمَنْهِيّ عَنْهَا إِنّمَا هِيَ الرّقَى الّتِي يُخَالِطُهَا الشِّرْكُ بِاللهِ جَلّ وَعَلَا دُونَ الرّقَى الّتِي لَا يَشُوبُهَا شِرْكٌ.

আপাতত এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেই এ প্রসঙ্গ সমাপ্ত করা হচ্ছে। হাদীসের কিতাবে এ সংক্রান্ত আরো বহু হাদীস আছে, যা উদ্ধৃত করলে  আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, যেসব ঝাড়ফুঁকে শিরক আছে তা হারাম ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আর যে সবে কুফর-শিরক নেই সেসব দিয়ে ঝাড়ফুঁক জায়েয। বিষয়টি যেহেতু হাদীসের মধ্যেই ফয়সালাকৃত তাই এটাই পরবর্তী সকল ইমামদের মত। ইমাম মুহাম্মদ রাহ. লেখেন-

لا بأس بالرقي بما كان في القرآن و ما كان من ذكر الله، فأما ما كان لا يعرف من الكلام فلا ينبغي أن يرقى به.

কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর যিকির দ্বারা ঝাড়ফুঁক করতে অসুবিধা নেই। হাঁ, যেসব শব্দাবলীর অর্থ অস্পষ্ট তা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা নিষেধ (কেননা তা শিরকমুক্ত কি না জানা নেই)। -মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, পৃ. ৩৭৩-৩৭৪

ইমাম তহাবী রাহ. লেখেন-

فدل ذلك أن كل رقية لا يشرك فيها فليست بمكروهة

(এসব) হাদীস প্রমাণ করে, যেসব ঝাড়ফুঁকে শিরক নেই তা বৈধ। -শরহু মাআনিল আসার ৪/১৫৩

ইমাম বায়হাকী রাহ. লেখেন-

وهذا كله يرجع إلى ما قلنا من أنه إن رقى بما لا يعرف أو على ما كان أهل الجاهلية من إضافة العافية إلى الرقى لم يجز، وإن رقى بكتاب الله أو بما يعرف من ذكر الله متبركا به وهو يرى نزول الشفاء من الله تعالى فلا بأس به، وبالله التوفيق.

যেসব হাদীসে ঝাড়ফুঁক করতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেসব হাদীস উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাকী রাহ. বলেন, এসব হাদীসের অর্থ হল, যদি অস্পষ্ট কোনো শব্দাবলি দ্বারা ঝাড়ফুঁক করে অথবা জাহেলী যুগের মনোভাব নিয়ে ঝাড়ফুঁক করে যে, আল্লাহ নয় এ ঝাড়ফুঁকই রোগ ভালো করে তাহলে তা জায়েয নেই।

হাঁ, যদি কুরআনের আয়াত বা আল্লাহর যিকিরের দ্বারা ঝাঁড়ফুক করে এবং এটা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহই সুস্থতা দানকারী তাহলে এ ঝাড়ফুঁকে কোনো অসুবিধা নেই। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৯/৫৮০

ইমাম বায়হাকী এ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের শিরোনাম দেন এভাবে-

باب إباحة الرقية بكتاب الله عز وجل وبما يعرف من ذكر الله.

আল্লামা ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন-

لا أعلم خلافا بين العلماء في جواز الرقية من العين أو الحمة، وهي لدغة العقرب وما كان مثلها، إذا كانت الرقية بأسماء الله عزوجل، ومما يجوز الرقي به.

এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মাঝে কোনো মতভেদ নেই যে, বদনযর সাপ-বিচ্ছুর দংশন বা এ ধরনের আরো যত বিষয় আছে সেগুলোতে ঝাড়ফুঁক করা বৈধ। যদি সে ঝাড়ফুঁক আল্লাহর নাম দ্বারা হয় অথবা এমন কথা দিয়ে হয়, যা দিয়ে ঝাড়ফুঁক বৈধ। -আলইসতেযকার ৮/৪০৫

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন-

وقد أجمع العلماء على جواز الرقي عند اجتماع ثلاثة شروط: أن يكون بكلام الله أو بأسمائه وبصفاته. وباللسان العربي أو بما يعرف معناه من غيره، وأن يعتقد أن الرقية لا يؤثر بذاتها بل بذات الله تعالى…

এ ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরাম একমত যে, তিনটি শর্তে ঝাড়ফুঁক বৈধ। এক. আল্লাহর কালাম বা তাঁর নাম-সিফাত দিয়ে হতে হবে। দুই. (আল্লাহর নাম-সিফাত বা আল্লাহর কালাম দিয়ে না হলে) আরবী ভাষায় বা এমন শব্দাবলী দ্বারা হতে হবে, যার অর্থ বুঝা যায় (এবং তাতে ‘মুনকার’ কিছুও নেই)। তিন. এমন বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহই সুস্থতা দানকারী, ঝাড়ফুঁক নয়। -ফাতহুল বারী ১০/২৪০

আল্লাহর যাত-সিফাত, নাম-কালাম দিয়ে স্বয়ং নবীজীও ঝাড়ফুঁক করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম করলে তার সমর্থনও করেছেন। হাদীসের কিতাবে নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের ঝাড়ফুঁক বিষয়ক বহু বর্ণনা ও ঘটনা উল্লেখ আছে। নমুনা স্বরূপ কয়েকটি উল্লেখ করা হল।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان ينفث على نفسه في المرض الذي مات فيه بالمعوذات، فلما ثقل كنت أنفث عليه بهن وأمسح بيد نفسه لبركتها.

নবীজী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর সময় অসুস্থ হলে সূরা ফালাক ও নাস পড়ে উভয় হাতে ফুঁ দিয়ে শরীরে বুলিয়ে দিতেন। যখন অসুস্থতা এত বেড়ে যেত যে, নিজে নিজে তা করতে পারছেন না তখন আমি নিজেই পড়ে তাঁর গায়ে দম করতাম এবং তাঁর হাত তাঁর গায়ে বুলিয়ে দিতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৩৫

ইমাম বুখারী রাহ. এ হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন-

باب الرقي بالقرآن والمعوذات

তিনি আরো বলেন-

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا آوى إلى فراشه نفث في كفيه بـ “قل هو الله أحد” وبالمعوذتين جميعا، ثم يمسح بهما وجهه وما بلغت يداه من جسده. قالت عائشة: فلما اشتكى كان يأمرني أن أفعل ذلك به.

নবীজী যখন রাতে শোয়ার জন্য বিছানায় আসতেন তখন সূরা ইখলাস-ফালাক-নাস পড়ে দু’হাতে ফুঁ দিতেন। অতপর উভয় হাত, মুখ ও শরীরের যে পর্যন্ত পৌঁছে সে পর্যন্ত বুলাতেন, ইন্তেকালের পূর্বে যখন নবীজী অসুস্থ হন তখন আমাকে তা পড়ে তাঁর গায়ে এমন করে দিতে বলতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৪৮

ইমাম বুখারী রাহ. এ হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন-

باب النفث في الرقية

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,-

أن رهطا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم انطلقوا في سفرة سافروها، حتى نزلوا بحي من أحياء العرب، فاستضافوهم فأبوا أن يضيفوهم، فلدغ سيد ذلك الحي، فسعوا له بكل شيء، لا ينفعه شيء، فقال بعضهم لو أتيتم هؤلاء الرهط الذين قد نزلوا بكم، لعله أن يكون عند بعضهم شيء، فأتوهم فقالوا: يا أيها الرهط إن سيدنا لدغ فسعينا له بكل شيء لا ينفعه شيء ،فهل عند أحد منكم شيء؟ فقال بعضهم: نعم والله إني لراق، ولكن والله لقد استضفناكم فلم تضيفونا، فما أنا براق لكم حتى تجعلوا لنا جعلا فصالحوهم على قطيع من الغنم، فانطلق فجعل يتفل ويقرأ الحمد لله رب العالمين حتى لكأنما نشط من عقال، فانطلق يمشي ما به قلبة، قال: فأوفوهم جعلهم الذي صالحوهم عليه، فقال بعضهم: اقسموا فقال الذي رقى: لا تفعلوا حتى نأتي رسول الله صلى الله عليه وسلم، فنذكر له الذي كان، فننظر ما يأمرنا، فقدموا على رسول الله صلى الله عليه وسلم فذكروا له، فقال وما يدريك أنها رقية؟ أصبتم، اقسموا واضربوا لي معكم بسهم.

সাহাবীদের এক কাফেলা একবার সফরে বের হন। পথিমধ্যে তারা আরবের একটি গোত্রের এলাকায় পৌঁছেন এবং তাদের মেহমান হতে আবেদন করেন, কিন্তু গোত্রবাসী তাদের মেহমানদারী করতে অসম্মতি জানায় । এ সময় গোত্রপ্রধানকে সাপ বা বিচ্ছু দংশন করে এবং গোত্রবাসী বিষ নামানোর জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। অবশেষে তারা সাহাবীদের কাছে এসে বলল, আমাদের গোত্রপ্রধান দংশিত হয়েছেন, আমরা সব ধরনের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফল হচ্ছে না; তোমাদের কাছে কি কিছু আছে? এক সাহাবী বললেন, হাঁ, আমি ঝাড়ফুঁক জানি, কিন্তু আমরা তোমাদের কাছে মেহমানদারীর আবেদন করেছি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছ। তাই আল্লাহর শপথ তোমরা বিনিময় নির্ধারণ করার আগ পর্যন্ত আমি কোনো প্রকার ঝাড়ফুঁক করব না। অবশেষে তারা এক পাল ছাগল দিতে সম্মত হল। সে সাহাবী সূরা ফাতিহা পড়ে ঐ ব্যক্তির গায়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সে এমন সুস্থ হয়ে গেল, যেন সে এইমাত্র বাঁধনমুক্ত হল এবং এমনভাবে হাঁটতে লাগল যেন তার কোনো কষ্টই নেই। অতপর তারা তাদের ওয়াদাকৃত বিনিময় দিল। তখন একজন সাহাবী বললেন, এগুলো আমরা ভাগ করে নিই। তখন যে সাহাবী ঝাড়ফুঁক করেছেন তিনি বললেন, না, নবীজীকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া তা হবে না। তিনি যা বলেন তাই করব। তারা নবীজীর কাছে আসার পর পুরো ঘটনা বলেন। তখন নবীজী বলেন, তোমাদের কে বলল, এটি জাহেলী ঝাড়ফুঁক! তোমরা যা করেছ ঠিকই করেছ। যাও, এগুলো তোমাদের মাঝে বণ্টন করে নাও আর আমাকেও এক অংশ দিয়ো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৪৯

ইমাম বুখারী রাহ. এ হাদীসের শিরোনাম দেন-

باب النفث في الرقية

খারিজা ইবনুস সালত তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন-

أنه مر بقوم عندهم مجنون موثق في الحديد، فقال له بعضهم : عندك شيء تداوي هذا به، فإن صاحبكم قد جاء بخير؟ قال : فقرأت عليه فاتحة الكتاب ثلاثة أيام، كل يوم مرتين، فأعطاه مئة شاة، قأتى النبي صلى الله عليه و سلم، فذكر ذلك له، فقال له صلى الله عليه و سلم : كل، فمن أكل برقية باطل فقد أكلت برقية حق.

তার চাচা একদা এক গোত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, এক লোক উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তখন ঐ লোকের পরিবার খারেজার চাচার কাছে এসে বলল আমরা শুনেছি, তোমাদের রাজা (নবীজী) নাকি উত্তম কিছু নিয়ে এসেছেন। তাই তোমার কাছে কি এ ব্যক্তির চিকিৎসার কিছু আছে? তখন তিনি তিন দিন তাকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করলেন। এতে লোকটি সুস্থ হয়ে গেল এবং তারা তাকে একশটি ছাগল হাদিয়া দিল। তিনি নবীজীর কাছে এসে ঘটনা শোনালেন। নবীজী বললেন, এ ছাগল তুমি খাও (এতে কোনো অসুবিধা নেই)। অন্যরা বাতিল ঝাড়ফুঁক করে খায়, এগুলো তো  তুমি সত্য ঝাড়ফুঁক করে পেয়েছ। -মুসনাদে আহমাদ ৫/৩১১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬১১০

উপরোক্ত হাদীস ও উলামায়ে কেরামের অভিমতগুলো থেকে পরিষ্কার যে, ইসলাম শিরককে কোনোভাবেই মেনে নেয় না। মুসলমানদের জীবনের সকল ক্ষেত্র শিরকমুক্ত হবে। তাওহীদই হল সবকিছুর মূল। তাই নবীজী শিরক অনুপ্রবেশের সকল ছিদ্রপথ কঠোরভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। আর সে অনুসারেই ঝাড়ফুঁকের সীমা নির্ধারণ করে  দেন যে, শিরকসম্বলিত কোনো ঝাড়ফুঁকই মুসলমানদের জন্য জায়েয নেই, হারাম। এতে তার ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে যদি শিরকমুক্ত হয় তাহলে ঝাড়ফুঁক বৈধ। তাই উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আল্লাহর নাম-সিফাত, তাঁর কালাম ও হাদীসের দুআ ইত্যাদি দিয়ে ঝাড়ফুঁক মাসনূন। তেমনি শিরকমুক্ত অন্য যে কোনো কথা দিয়েও ঝাড়ফুঁক জায়েয, তবে এর জন্য জরুরি হল, কী বলছে তার ভাষা বুঝা যেতে হবে। তাতে ‘মুনকার’ কিছু না থাকতে হবে এবং এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহই সুস্থতা দানকারী। যদি ভাষা বুঝা না যায় তাহলে উলামায়ে কেরাম এসব তন্ত্র-মন্ত্রকেও নাজায়েয বলেন। আর যেহেতু নবীজী নিজেই বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দুআ যিকির দ্বারা ঝাড়ফুঁক করেছেন এবং শিখিয়ে গিয়েছেন তাই অন্য সকল ঝাড়ফুঁক থেকে সেগুলোই শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু সমাজের চিত্র দেখলে মনে হয়, ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে যে ইসলামের এমন কঠোর বিধান আছে তা আমাদের  অনেকেই জানে না। মনে করে, যে কোনো ব্যক্তি থেকে ঝাড়ফুঁক নেওয়া যাবে। সে কী দিয়ে ঝাড়ফুঁক করছে তার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ  করে না; বরং সে বিধর্মী, মুশরিক (যেমন, হিন্দু), অগ্মিপূজক হলেও কোনো অসুবিধা মনে করে না। অথচ জানা কথা তার তন্ত্র-মন্ত্র শিরকমুক্ত হবে না। তার পরও বিনা দ্বিধায় তারা হিন্দু, মগ, চাকমা, বৌদ্ধ ইত্যাদি গণক ও মন্ত্রবিদের কাছে যায়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঝাড়ফুঁকের চেয়ে তাদের ঝাড়ফুঁককে বেশি কার্যকর মনে করে (নাউযুবিল্লাহ)।

আমরা অনেকে মনে করি, সকল রোগই  শারীরিক কারণে সৃষ্টি হয়, এখানে অন্য কোনো কিছু কার্যকর নয়। অথচ বিষয়টি এমন নয়। শয়তানও এসব সৃষ্টি করে, যাতে মানুষ শয়তানী মন্ত্রের চিকিৎসা নিয়ে মুশরিক হয়ে যায়।

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. একদিন তাঁর স্ত্রী যায়নাবকে হাদীস শোনান যে, নবীজী বলেছেন, নিশ্চয় জাহেলী ঝাড়ফুঁক শিরক। তখন যায়নাব বলেন, বিষয়টি বুঝলাম না; আমার চোখ ফুলে যেত এবং পানি ঝরত। তাই আমি এক ইহুদী নারী থেকে ঝাড়ফুঁক নিতাম। ঝাড়ফুঁক করালেই সুস্থ হয়ে যেতাম। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, এটা শয়তানের কাজ। সে তোমার চোখে খোঁচা দেয় আর তাতে তা ফুলে যায় ও পানি ঝরতে থাকে আর যখন সে ইহুদী নারী (মন্ত্র দিয়ে) ঝাড়ফুঁক করে তখন শয়তান থেমে যায়। তোমার জন্য তো সে দুআটিই যথেষ্ট, যা নবীজী বলতেন-

أَذْهِبِ الْبَأْسَ رَبّ النّاسِ، اشْفِ أَنْتَ الشّافِي، لَا شِفَاءَ إِلّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا.

-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭৯

তো এসব কারণে অনেক সময় শিরকী মন্ত্রে কাজ হয়, এটা শয়তানেরই চক্রান্ত। কিন্তু কথা হল, ঈমান সবার আগে। ঈমানের জন্যই বাঁচা। শয়তানের নামে মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করে সুস্থ হলাম, কিন্তু শিরকে লিপ্ত হলাম। শিরকওয়ালা জীবনের কী মূল্য?

তাই অবশ্যকরণীয়- আমাদের ঈমান শুধরে নেওয়া। বেশি বেশি আল্লাহর কুদরতের আলোচনা করার মাধ্যমে ঈমানকে মজবুত করা। আর কুরআন-হাদীসে বর্ণিত দুআসমূহকে নিজের ও পরিবারের জন্য রক্ষাকবচ জ্ঞান করা।

এসব দুআ সংকলিত হয়েছে এমন একটি কিতাবের নাম ‘হিসনুল মুসলিম’, যার অর্থ হল- মুসলিমের দুর্গ। বাস্তবেই নবীজীর শেখানো দুআগুলো মুসলিমের দুর্গ। উক্ত কিতাবের লেখকেরই আরেকটি কিতাবের নাম ‘আদ দুআ মিনাল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ’। ইনশাআল্লাহ, আমরা এসব দুআ শিখব এবং দৈনন্দিন আমলে পরিণত করব।

 

প্রসঙ্গ : তাবীয

পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি রোগ-বালাই ও মসিবতে নবীজী অনেক দুআ ও ঝাড়ফুঁক শিখিয়েছেন। সেসব দুআসহ আল্লাহর নাম বা যে কোনো দুআ দ্বারা ঝাড়ফুঁক বৈধ বরং মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে সকল উলামায়ে কেরাম একমত এবং এর উপর সর্বযুগে আমল হয়ে আসছে।  যেহেতু আল্লাহর নাম, সিফাত, কালাম ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ-বালাই ও বিপদ-আপদ দূর হয় তাই এসব দ্বারা যেমন ঝাড়ফুঁক করা হত, তেমনিভাবে অনেকে এক্ষেত্রে আরো একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতেন; আর তা হল, এসব দুআ-যিকির-আয়াত কাগজ ইত্যাদিতে লিখে তা  রোগীর গায়ে লাগিয়ে দিতেন। এ পদ্ধতিটি সাহাবা-তাবেয়ী যুগেও মওজুদ ছিল। সামনে আমরা এ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। আমরা দেখব, সাহাবী-তাবেয়ীযুগে তাবীজের ব্যবহার কেমন ছিল :

১. সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِذَا فَزِعَ أَحَدُكُمْ مِنْ نَوْمِهِ فَلْيَقُلْ: بِسْمِ اللهِ، أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التّامّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَسُوءِ عِقَابِهِ، وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ شَرِّ الشّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ.

তোমাদের কেউ ঘুমে ভয় পেলে সে যেন এ দুআ পড়ে-

بِسْمِ اللهِ، أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التّامّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَسُوءِ عِقَابِهِ، وَمِنْ شَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ شَرِّ الشّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ.

বর্ণনাকারী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরকে এ দুআটি শিখিয়ে দিতেন। আর যারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাদের জন্য দুআটি লিখে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৩৫৪৭; মুসনাদে আহমাদ ২/১৮১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫২৮; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০১০

قال الترمذي : حسن غريب.

২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কোনো নারীর সন্তান প্রসব কঠিন হয়ে গেলে তার জন্য যেন এ দুআ ও এ দুটি আয়াত একটি থালায় লেখা হয়। অতপর তা ধুয়ে সে নারীকে পান করানো হয়। দুআটি হল-

بِسْمِ اللهِ لا إِلهَ إِلاّ هُوَ الْحَلِيمُ الْكَرِيمُ، سُبْحَانَ اللهِ رَبِّ السّموَاتِ السّبْعِ وَرَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، كَأَنّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلّا عَشِيّةً أَوْ ضُحَاهَا. كَأَنّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ২৩৯৭৫

৩.

عَنْ عَائِشَةَ: أَنّهَا كَانَتْ لَا تَرَى بَأْسًا أَنْ يُعَوّذَ فِي الْمَاءِ ثُمّ يُصَبّ عَلَى الْمَرِيضِ.

হযরত আয়েশা রা. রোগীর জন্য পানিতে কিছু পড়ে তা রোগীর গায়ে ঢেলে দেওয়াতে কোনো অসুবিধা মনে করতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ২৩৯৭৫

৪. আবু কিলাবা লাইস এবং মুজাহিদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন-

أنهما لم يريا بأسا أن يكتب آية من القرآن ، ثم يسقاه صاحب الفزع.

তারা উভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত রোগীর জন্য কোনো আয়াত লিখে তা ধুয়ে রোগীকে খাওয়ানোতে কোনো ধরনের অসুবিধা মনে করতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ২৩৯৭৬

৫. হাজ্জাজ বলেন-

أخبرني من رأى سعيد بن جبير يكتب التعويذ لمن أتاه، قال حجاج: وسألت عطاء فقال: ما سمعنا بكراهيته إلا من قبلكم أهل العراق.

বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর নিজে তাবীজ লিখতেন।

বর্ণনাকারী হাজ্জাজ বলেন, আমি আতা ইবনে আবী রাবাহকে তাবীয বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন এতে কোনো অসুবিধার কথা আমরা শুনিনি। কেউ কিছু বললে তোমাদের ইরাকের কেউ বলতে পারে।  -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ, বর্ণনা ২৩৯৭৭

(বিশিষ্ট তাবেয়ী) ইবরাহীম নাখায়ী বিষয়টি নিষেধ করতেন। তিনি ইরাকের। আতা ইবনে আবী রাবাহ সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

ইবনে আবী শাইবা রাহ. এখানে শিরোনাম দিয়েছেন-

فِي الرّخْصَةِ فِي الْقُرْآنِ يُكْتَبُ لِمَنْ يُسْقَاهُ.

৬. আবু ইছমা বলেন-

سألت سعيد بن المسيب عن التعويذ؟ فقال: لا بأس به إذا كان في أديم.

আমি সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিবকে তাবীয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, জবাবে তিনি বলেন, কোনো অসুবিধা নেই যদি চামড়ায় মোড়ানো থাকে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ২৪০০৯

৭. আব্দুল মালিক রাহ. বলেন-

عن عطاء في الحائض يكون عليها التعويذ، قال: إن كان في أديم، فلتنزعه، وإن كان في قصبة فضة، فإن شاءت وضعته، وإن شاءت لم تضعه.

আতা ইবনে আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করা হয়, ঋতুবর্তী নারীর গায়ে তাবীয থাকলে কোনো অসুবিধা আছে? জবাবে বলেন, যদি চামড়ায় লেখা থাকে তাহলে গায়ের থেকে খুলে নিবে। আর যদি রূপার (ইত্যাদি) খোলে থাকে তাহলে খুলে রাখলে ভালো, না খুললেও কোনো অসুবিধা নেই। -প্রাগুক্ত ২৪০১০

৮. ছুওয়াইর রাহ. বলেন-

كان مجاهد يكتب للناس التعويذ فيعلق عليهم.

(আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বিশিষ্ট ছাত্র, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী) মুজাহিদ রাহ. মানুষের জন্য তাবীয লিখতেন। অতপর তাদের গায়ে ঝুলিয়ে দিতেন। -প্রাগুক্ত ২৪০১১

৯. লাইছ রাহ. আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন-

لا بأس أن يعلق القرآن.

কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা নেই। -প্রাগুক্ত ২৪০১৬

১০. নবীজীর বংশধর জাফর সাদিক তাঁর পিতা (এবং হযরত হুসাইন রা.-এর নাতি) মুহাম্মাদ ইবনে আলী থেকে বর্ণনা করেন-

كان لا يرى بأسا أن يكتب القرآن في أديم ثم يعلقه.

মুহাম্মদ ইবনে আলী চামড়ায় কুরআনের আয়াত লিখে তা গায়ে ঝুলানোতে কোনো অসুবিধা মনে করতেন না। -প্রাগুক্ত ২৪০১২

১১. ইউনুছ ইবনে খাব্বাব বলেন-

سألت أبا جعفر عن التعويذ يعلق على الصبيان، فرخص فيه.

আমি আবু জাফর (মুহাম্মাদ ইবনে আলী)-কে শিশুদের গায়ে তাবীয ঝুলানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি, তিনি এর অনুমতি দেন। -প্রাগুক্ত ২৪০১৭

১২. ইসমাঈল ইবনে মুসলিম রাহ. বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবনে সীরীন রাহ.-এর ফাতাওয়া বর্ণনা করেন-

أنه كان لا يرى بأسا بالشيء من القرآن.

ইবনে সীরীন রাহ. কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তাবীয লেখাকে দূষণীয় মনে করতেন না। -প্রাগুক্ত ২৪০১৪

১৩. জুওয়াইবির ইবনে সায়ীদ আলআযদী রাহ. দাহহাক-এর অভিমত বর্ণনা করেন-

أنه لم يكن يرى بأسا أن يعلق الرجل الشيء من كتاب الله، إذا وضع عند الغسل و عند الغائط.

দাহহাক রাহ. কুরআনের আয়াত দিয়ে তাবীয লিখে তা গায়ে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা মনে করতেন না, যদি গোসল ও হাম্মামে যাওয়ার সময় তা খুলে রাখা হয়। (অর্থাৎ যদি খোলের ভেতর না থাকে) -প্রাগুক্ত ২৪০১৮

ইবনে আবী শাইবা রাহ. এ অধ্যায়ের শিরোনাম দেন-

من رخص في تعليق التعويذ

১৪. ইউনুছ ইবনে হিব্বান রাহ. বলেন-

سَأَلْتُ أبا جعفر محمد بن علي أَنْ أُعَلِّقَ التّعْوِيذَ، فَقَالَ: إِنْ كَانَ مِنْ كِتَابِ اللهِ أَوْ كَلَامٍ عَنْ نَبِيِّ اللهِ فَعَلِّقْهُ وَاسْتَشْفِ بِهِ مَا اسْتَطَعْتَ.

আমি আবু জাফর বাকিরকে তাবীয পরিধান  সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, জবাবে তিনি বলেন, যদি কুরআন বা নবীর কথা দিয়ে হয় তাহলে পরিধান কর এবং যত পার তা দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ কর। -যাদুল মাআদ ৪/৩২৭

১৫. আব্দুুল মালিক রাহ. বলেন-

عَنْ عَطَاءٍ، فِي الْمَرْأَةِ الْحَائِضِ فِي عُنُقِهَا التّعْوِيذُ أَوِ الْكِتَابُ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِي أَدِيمٍ فَلْتَنْزِعْهُ وَإِنْ كَانَ فِي قَصَبَةٍ مُصَاغَةٍ مِنْ فِضّةٍ، فَلَا بَأْسَ إِنْ شَاءَتْ وَضَعَتْ، وَإِنْ شَاءَتْ لَمْ تَفْعَلْ.

قِيلَ لِعَبْدِ اللهِ: تَقُولُ بِهَذَا قَالَ: نَعَمْ

ঋতুমতী নারীর গলায় তাবীয বা কুরআনের কোনো আয়াত ঝুলানো থাকে, এতে কোনো অসুবিধা আছে কি না- আতা ইবনে আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যদি চামড়ায় থাকে তাহলে ঋতু চলাকালীন সময়ে যেন তা খুলে নেয়। আর যদি রুপার খোলের ভেতর থাকে তাহলে না খুললেও কোনো অসুবিধা নেই।

আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হল যে, আপনিও এমন বলেন, জবাবে বললেন, হাঁ। -সুনানে দারেমী, বর্ণনা ১২১২; ইমাম দারেমী রাহ. শিরোনাম দিয়েছেন-

باب التعويذ للحائض

১৬.  ইবনে জুরাইজ রাহ. বলেন,

قلت لعطاء، القرآن كان على امراة فحاضت أو أصابتها جنابة اتنزعها؟ قال: إن كان في قصبة فلا بأس. قلت: فكان في رقعة، فقال هذه أبغض إلي. قلت: فلم مختلفان؟ قال: إن القصبة هي أكف من الرقعة.

قال ابن جريج : و سمعته قبل ذلك يسأل أيجعل على الصبي القرآن؟ قال: إن كان في قصبة من حديد أو قصبة ما كانت فنعم، أما رقعة فلا.

আমি আতা ইবনে আবী রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো নারীর শরীরে যদি কুরআনের আয়াত লেখা (তাবীয) থাকে আর সে ঋতুমতী হয় বা তার ওপর গোসল ফরয হয় (অর্থাৎ যে সময়  কুরআন স্পর্শ করা নাজায়েয) তাহলে কি সে তাবীযটি খুলে রাখবে?

জবাবে তিনি বললেন, যদি তা খোলের মধ্যে হয় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। আর যদি কাগজের মধ্যে হয় তাহলে খুলে নিবে। আমি বললাম উভয়ের মাঝে পার্থক্য কী? জবাবে বললেন, যখন তা খোলের ভেতর থাকে তখন তা ভেতরে থাকে; স্পর্শে আসে না। কিন্তু কাগজে থাকলে স্পর্শে আসে। ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি এর পূর্বে (এক ব্যক্তিকে) তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে শুনেছি যে, শিশুদের গায়ে কুরআনের আয়াত লিখে ঝুলাতে কোনো অসুবিধা আছে কি না? তখন জবাবে তিনি বলেছিলেন, যদি লোহা বা এজাতীয় অন্য কিছুর খোলে হয়, তাহলে অসুবিধা নেই আর যদি কাগজে হয় তাহলে নিষেধ। (কারণ, এতে কুরআনের সম্মান রক্ষা সম্ভব হয় না।) -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, বর্ণনা ১৩৪৭

১৭. আলকামা রাহ. বলেন-

سَأَلْتُ ابْنَ الْمُسَيِّبِ، عَنِ الِاسْتِعَاذَةِ تَكُونُ عَلَى الْحَائِضِ وَالْجُنُبِ؟ فَقَالَ: لَا بَأْسَ بِهِ إِذَا كَانَ فِي قَصَبَةٍ أَوْ رُقْعَةٍ يَجُوزُ عَلَيْهَا.

আমি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ.-কে জিজ্ঞেস করলাম, গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তি বা ঋতুমতী নারীর গায়ে তাবীয থাকাতে কোনো অসুবিধা আছে কি না? জবাবে বললেন, যদি কোনো খোলের মধ্যে হয় অথবা কোনো কাগজে মোড়ানো থাকে তাহলে অসুবিধা নেই। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, বর্ণনা ১৩৪৮

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো বড় বড় সাহাবী এবং বিশিষ্ট তাবেয়ীগণের। এসব থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সে যুগে রোগ-বালাই থেকে মুক্তি বা নিরাপত্তার জন্য ঝাড়ফুঁকের ন্যায় তাবীযও ব্যবহার হত। আরো স্পষ্ট হল যে, ঐ যুগেও  তাবীযের প্রচলন ছিল। এমনকি সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ., মুজাহিদ রাহ., সায়ীদ ইবনে জুবায়ের রাহ.-এর মত দ্বীনের এত বড় জ্ঞানী তাবেয়ীগণ নিজেরাও তাবীয লিখতেন। সে তাবীয মানুষ ব্যবহার করত। শিশু-নারী-পুরুষ সকলে ব্যবহার করত।

তাবীযের প্রচলন তাদের মধ্যে ছিল বলেই তো এ প্রশ্ন সামনে এসেছে যে, অপবিত্র অবস্থায় এ তাবীয কী করবে। কারণ, এ সময় কুরআন স্পর্শ করা নাজায়েয; আর তাবীযে তো কুরআনের আয়াতই লেখা থাকে।

শুধু এ প্রশ্নটি ঐ যুগের কত মুফতীর কাছে এসেছে তা আমরা উপরে পড়েছি। এ থেকে বুঝা যায় তাঁদের মাঝে এর প্রচলন কত ব্যাপক ছিল।

মুসলিম যেহেতু তাওহীদে বিশ্বাসী, তাই সে সুস্থতা-অসুস্থতা, আপদ-বিপদ, সুখ-শান্তি একমাত্র আল্লাহর থেকেই হয় বলে বিশ্বাস করে। ঝাড়ফুঁক ও তাবীয ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সে এই বিশ্বাস মনে জাগরুক রাখবে। তাবীয গ্রহণ করলে এই বিশ্বাস মনে জাগরূক রেখেই মুমিন একটি ওসীলা হিসেবে তাবীয গ্রহণ করবে এবং পূর্ণ লক্ষ্য রাখবে যাতে তাবীয শিরকমুক্ত ও সকল বাতিল আকীদা ও নাজায়েয কর্মকাণ্ড মুক্ত হয়।

কিন্তু কিছু মানুষকে দেখা যায় দেদারসে কুফর-শিরক সম্বলিত তাবীয গ্রহণ করছে, ব্যবহার করছে। কেউ কেউ তো বিধর্মীদের কাছেও তাবীয আনতে যায়। আল্লাহর নাম-যিকির বাদ দিয়ে গায়রুল্লাহ বা অস্পষ্ট অনেক কিছু দিয়ে তাবীয লেখা হয়, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

শিরকের ভয়াবহতা ও ঘৃণ্যতার সামান্যতম অনুভ‚তি থাকলে এসবের অল্পতেই গা শিউরে ওঠার কথা। আলোচনার শুরুতে শিরকের ভয়াবহতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি, শিরকের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। তাওহীদের উপর অবিচল রাখুন। সীরাতে মুসতাকীমের উপর থাকার তাওফীক দান করুন।

 

মুহাররম ১৪৪০ – অক্টোবর ২০১৮
মাসিক আলকাউসার