নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’য়ালার জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি, তাঁরই সাহায্য কামনা করি, তাঁরই কাছে ক্ষমা চাই, এবং আমরা আমাদের নফসের সকল অনিষ্টতা ও সকল কৃতকর্মের ভুল-ভ্রান্তি থেকে তাঁরই কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দান করেন তাকে কেউ গোমরাহ করতে পারে না। আর যাকে আল্লাহ গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেন, কেউ তাকে হেদায়েত দান করতে পারে না। এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর বান্দা ও রসূল।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার বাণীঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আলে ইমরানঃ ১০২)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর,যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন;আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর,যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচঞ্ঝা করে থাক এবং আত্নীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। (নিসাঃ ১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে,সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। (আহযাবঃ ৭০-৭১)
অতঃপর, মহানবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর বাণী
“নিশ্চয় সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম পথ হচ্ছে নবীর ﷺ এর পথ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো দ্বীনের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়, প্রত্যেক নতুন আবিষ্কৃত বিষয় বিদআত, প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হলো জাহান্নাম।”(ইবনে মাজাহ, সহীহ)
ইবন আল কায়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত কিতাব লিখেছেন তার মধ্যে সর্বোত্তম একটি কিতাব হলো- “আলফাওয়াইদ”। কিতাবটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে মনে হচ্ছে, তিনি ৮০ বছরের একজন মানুষ এবং তিনি এক জায়গায় বসে তার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই তিনি তার কিতাবয়ের নাম দিয়েছেন-“আল-ফাওয়াইদ” যার অর্থ “জ্ঞানগর্ভ তথা উপকারী প্রবন্ধের সংকলন”। মূলত ইবন আল কায়্যিম যে কিতাবগুলো লিখেছেন সেই কিতাবগুলো ইসলামের কল্যাণে লিখিত সর্বোত্তম কিতাবগুলোর অন্তর্ভূক্ত। বাস্তবিকপক্ষে, ইবন আল কায়্যিম হলেন সেই পরিপক্ক ফল যিনি ইবনে তাইমিয়্যাহ থেকে উদ্ভুত। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) ব্যাপক জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার জন্য বিখ্যাত। তিনি জীবনের একটি বড় অংশ এক যুদ্ধ থেকে অন্য যুদ্ধে মুজাহিদ হিসেবে কাটিয়েছেন। যখন শামের শাসক তাতারদের মোকাবেলা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল এই বলে যে- “আমরা তাদের মোকাবেলা করতে অক্ষম”, তখন ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) নিজে ঐ যুদ্ধ পরিচালনায় সেনানায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন এবং বলেন- “আমরা অবশ্যই তাদের মোকাবেলা করবো”। অবশেষে আল্লাহ তা’য়ালা ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ)-এর দলকে বিজয় দান করেন।
আমি বলিঃ ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) পরিপক্ব এবং উপযুক্ত এক মানুষকে পৃথিবীতে রেখে যান এবং সেই পরিপক্ক-উপযুক্ত মানুষটাই হলেন ইবন আল-কায়্যিম (রহঃ)। ইবন আল-কায়্যিম একাধারে আত্মার গভীরতা এবং ইবাদতের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি আল্লাহকেই সার্বক্ষণিক চিন্তা-চেতনায় রাখতেন। এ কারণে একবার তিনি যখন মক্কা অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি যে পরিমাণে আল্লাহর ইবাদত করতেন, তা দেখে মক্কার লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল।
ইবনে আল-কায়্যিম (রহঃ) যে কিতাবগুলো লিখেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো “আল ফাওয়াইদ”। এছাড়াও তিনি তারবিয়্যাহ সংক্রান্ত কিতাবও লিখেছেন যেমন- “মাদারিজ আস-সালিকিন শারাহ মানাযিল আস-সারিঈন ঈলা রব্ব-আল-আলামিন”। তাঁর ফিকহ্ এবং উসূল সংক্রান্ত কিতাব- “ঈ’লাম আল মুওয়াক্কিন আন রব্বাল আলামীন” এবং মহানবী ﷺ এর সলাত, সিয়াম, হিজরত, যুদ্ধ, চিকিৎসা সম্পর্কিত কিতাব“যাআদ আল-মায়াদ ফি সিরাত খইর আল ঈবাদ”। তাঁর অন্যান্য কিতাব গুলো হলো- “আর রূহ, বাদাঈ আল ফাওয়াঈদ এবং আল জওয়াব আল কাফি ফি আস সুআল আন আদ দাওয়া আশ শাফিঈ।”
যাহোক, আল ফাওয়াঈদ কিতাবয়ের ১৬১-১৬২ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন- এমন দশটি বিষয় রয়েছে যাতে কোন উপকারিতাই নেই-
(১) সেই জ্ঞান যা কাজে পরিণত করা হয় না।
(২) সেই কাজ যাতে ইখলাস নেই এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
(৩) সেই সম্পদ যা জমা করে রাখা হয় কিন্তু মালিক দুনিয়ায় ভোগও করতে পারে না, আবার আখিরাতেও কোন পুরষ্কার পায় না।
(৪) সেই অন্তর যাতে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা নেই; আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছা নেই।
(৫) সেই শরীর যা আল্লাহকে মান্য করে না, আল্লাহর পথে চলে না।
(৬) আল্লাহর প্রতি সেই ভালবাসা যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি চাওয়া হয় না।
(৭) সেই সময় যা আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পাপের কাফফারা আদায়ে অথবা হালাল, সওয়াব পূর্ণ কাজ করার সুযোগ খোঁজায় ব্যয় হয় না।
(৮) সেই অন্তর যা এমন কিছু নিয়ে ভাবে যেগুলো কোন উপকারেই আসে না।
(৯) তাদের পক্ষ নিয়ে কাজ করা যারা আল্লাহর পথে চলতে সহায়তা করে না, আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে না কিংবা কোন উপকার সাধন করার ক্ষমতা রাখে না।
(১০) এমন কাউকে ভয় করা যে কোন উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না, জীবন কিংবা মৃত্যু দিতে পারে না, আল্লাহর কর্তৃত্বাধীনে বাস করে বেঁচে থাকে এবং যার কপাল (ভাগ্য-ভালমন্দ) আল্লাহর ইখতিয়ারে।
যা হোক, আলোচ্য বিষয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ২টি বিষয় তা হলোঃ- অন্তরের অপচয় আর সময়ের অপব্যয়। অন্তরের অপচয় তখনই ঘটে যখন দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জীবনের উপরে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং সময়ের অপব্যয় ঘটে তখনই যখন মানুষের মনে অসংখ্য আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। মূলত, একজন মানুষ যখন নিজের মতানুসারে জীবন অতিবাহিত করে এবং অসংখ্য আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, তখনই তার দ্বারা পাপকাজ সংঘটিত হয়ে থাকে। অপরপক্ষে, কোন মানুষের পক্ষে ভাল কাজ তথা সওয়াবপূর্ণ কাজ করা তখনই সম্ভব হবে যখন সে সত্য-সঠিক-পথ তথা দ্বীন ইসলাম অনুসারে নিজের জীবনকে গড়ে তুলবে এবং নিজেকে আল্লাহর সামনে দাঁড় করানোর ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।
সুতরাং তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন যে, অন্তর এবং সময়ের অপব্যয়ের কারণে সকল পাপ কাজ সংঘটিত হয়। অন্তরের অপচয় তখনই ঘটে যখন দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জীবনের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর অসংখ্য আকাশ কুসুম কল্পনা মানুষের অন্তরে দানা বাঁধলে সময়ের অপব্যয় ঘটে। নিজের অন্তরকে অনুসরণ করাই হলো শয়তানী কর্মের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
সত্য পথের অনুসরণ করা এবং আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার জন্য প্রস্তুতি হলো সকল সৎকর্মের ভিত্তিঃ
فَأَمَّا مَن طَغَىٰ
وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا
فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَىٰ
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ
فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ
“যে ব্যক্তি সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।“ [নাযিয়াতঃ ৩৭-৪১]
দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জীবনের উপর প্রাধান্য দিলে অন্তর কলুষিত হয় এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হবার ভয় করে সে তার সময় অপচয় করে না। মোটকথা নিজেকে সংশোধন করার ক্ষেত্রে দু’টি সুস্পষ্ট পথ হলোঃ
১. আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করা, যার ফলে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সহায়তা করে।
২. সময়ের অপচয় না করা হলে অন্তর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কেননা, মন যেমন চায় তেমন না চলে সত্য পথের অনুসরণ করলে অন্তর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন –
إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
“আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। (সাদঃ ৩৮)
খেয়াল-খুশিকে অনুসরণ করা হল সকল অন্যায়ের মূল এবং সকল অপচয়ের মূলও হলো খেয়াল-খুশির অনুসরণ। সকল অশ্লীল-শয়তানী কাজের মূলমন্ত্র হলো খেয়াল খুশির অনুসরণ। প্রকৃতপক্ষে, যে ব্যক্তি নিজের খেয়াল-খুশিকে অনুসরণ করে সে সত্য ধর্মকে এড়িয়ে চলে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় সম্বন্ধে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন –
وَاتَّبِعْ مَا يُوحَىٰ إِلَيْكَ وَاصْبِرْ حَتَّىٰ يَحْكُمَ اللَّهُ ۚ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ
আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না ফয়সালা করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম ফয়সালাকারী। (ইউনূসঃ ১০৯)
খেয়াল খুশির অনুসরণ মানুষের মধ্যে তখনই গড়ে ওঠে, যখন মানুষের মাঝে “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও” এমন মনোভাব হড়ে ওঠে। অপরপক্ষে, ধৈর্য্য-পরহেজ মানুষ খেয়াল-খুশি অনুসরণের প্রতিকূলে সর্বদাই অবস্থান করে। যেমনঃ যে ব্যক্তি তার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, তাকে অবশ্যই অন্য কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো থেকে বিরত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি তার দৃষ্টিশক্তিকে হেফাযত করতে চায় তাকে এদিক-ওদিক ঘন ঘন তাকানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। যে ব্যক্তি যিনা-ব্যাভিচার পরিত্যাগ করতে চায়, সে ব্যক্তিকে অবশ্যই ঐ অশ্লীল ঘটনার দিকে ঠেলে দেয় এমন প্রত্যেকটি ঘটনা পরিত্যাগ করতে হবে।
যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম ভঙ্গ করে সে ব্যক্তি তার পাকস্থলীর চাহিদাই পূরণ করে; অপরপক্ষে সে যদি ধৈর্যধারণ করত অর্থাৎ সিয়াম রাখত, তাহলে ঐ ধৈর্য অবশ্যই পাকস্থলী তথা নফসের অনুসরণকে প্রতিহত করত। যে ব্যক্তি যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়ভাবে অটল থাকতে চায় তাকে অবশ্যই নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পালানোর প্রবণতা পরিত্যাগ করতে হবে। তাগুত সরকারের জেলে যেয়েও কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রতি সবর করে, তাহলে তাকে কারাগারের বাইরে উন্মুক্ত দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসা-ভালবাসা তথা আকর্ষণ পরিত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তি তার দরিদ্রাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকবে অবশ্যই যখন তার নফস তাকে যেকোন উপায়ে, এমনকি হারাম কাজ সম্পাদন করে হারাম টাকা উপার্জনের জন্য প্ররোচনা দেয়, তখন অবশ্যই ঐ ব্যক্তিকে নফসের খাসিয়াতের (অনুসরণের) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সকল পাপ কাজের ভিত্তি হলো আশা-আকাক্সক্ষার অনুসরণ যা মানুষের সময়ের অপচয় ঘটায়। সময়ের অপব্যয় ঘটাতে ঘটাতে তোমার অজান্তেই তোমার কাছে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তনে আহ্বানকারী ফেরেশতা এসে বলবেঃ ‘এসো, সেই মহান রাজাধিরাজ আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) দিকে প্রত্যাবর্তনের সময় হয়ে গিয়েছে।’
মহানবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেছেন
“পাঁচটি বিষয় আসার পূর্বেই পাঁচটি বিষয় থেকে সুবিধা গ্রহণ করো- বৃদ্ধ হবার পূর্বেই তারুন্য-যৌকিতাবাবস্থা থেকে সুবিধা গ্রহণ করো, অসুস্থ হবার পূর্বেই সুস্বাস্থ্য থেকে সুবিধা গ্রহণ করো, দরিদ্রতা এসে যাবার পূর্বেই সম্পদের সুব্যবহার করো ব্যস্ততা এসে যাবার পূর্বেই অবসর সময়কে কাজে লাগাও এবং মৃত্যু এসে যাবার পূর্বেই ‘জীবন’ নামক এই নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার করো।” (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে হাকিম)
তোমার তারুণ্যকে কাজে লাগাও, যৌবনাবস্থাকে কাজে লাগাও, কারণ এখন তুমি নফল সিয়াম পালন করতে সক্ষম হলেও যখন তুমি তোমার বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হবে- তোমার প্রয়োজন হবে খাদ্য খাবার এবং প্রয়োজনীয় রসদ যোগানোর মাধ্যমে মাংস এবং হাড়কে পরিপুষ্ট রাখার; তাই তখন তুমি সিয়ামের কষ্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। বর্তমানে তোমরা যুবক; তোমরা মধ্যরাত্রিতে ঘুম থেকে উঠে রাত্রে মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে রূকু-সিজদাহ করতে পারো, যাতে রূকু -সিজদাহ গুলো মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে তোমার জন্যে সাক্ষী হয়ে যায়, অন্ধকার গহীন কবরে তোমার সঙ্গী হয়। হে আমার ভাইয়েরা, যৌকিতাবকাল হলো সংগ্রামের সময়, যৌকিতাবকাল হলো এমন একটি সময় যে সময়ে আল্লাহর পথে সচেষ্ট হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা যায়! এই সময়ে তোমার কাঁধে বেশী দায়িত্বের বোঝা চাপেনি। কারণ সম্ভবত তুমি একা অথবা তোমার একটি স্ত্রী এবং সন্তান আছে। আগামীতে, সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তোমার দায়িত্ব আরও বাড়বে, দুনিয়ার সমস্যাগুলো তোমাকে ঘিরে ধরবে। তুমি তোমার পরিবার, সন্তান-সন্ততি এবং আত্মীয় স্বজনের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। এই সব কাজ গুলো করতে তোমার অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যাবে।
তাই তুমি এখন যৌকিতাব বয়সে রয়েছ, যে বয়সে তুমি নিজেকে সংগ্রামী এবং আত্মত্যাগী হিসেবে গড়ে তুলতে পার। আমি প্রায়ই মন্তব্য করে থাকি যে, আমি বিস্মিত হই সেই সব যুবকদের দেখে যারা খুব ভীতু! তাদের কী হয়েছে যে, তারা ভীতু? কী তাদেরকে ভীতসন্তস্ত্র করে? যদি সে এই বয়সে ভীতু হয় তাহলে আগামীতে কী হবে? জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়ই হলো এই যৌকিতাবকাল। যৌকিতাবকাল হলো সেই সময় যে সময়ে মহান রাজাধিরাজ রব্বুল আলামীনের সামনে উপস্থিত হবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়। এ কারণেই আমরা যদি তাদেরকে দেখি যারা আল্লাহর দ্বীনকে প্রথম বিজয়ী করেছিলেন, তাহলে আমরা দেখব তারা প্রত্যেকেই ছিল তরুণ। প্রকৃতপক্ষে, তাদের তিন-চতুর্থাংশ বা চার-পঞ্চমাংশের বয়স ছিল বিশ বছরের নিচে। তারা এমনটি করতে পেরেছিলেন, কারণ যৌবন কালই হলো আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগের সময়।
সহীহাইনে উল্লেখ আছে যে, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) বর্ণনা করেছেন- “বদরের ময়দানে আমি যখন সামরিক সৈন্য বেশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ ডানে এবং বামে দুজন তরুণ দেখতে পেলাম যাদের বয়স বয়ঃসন্ধিকালের কিছুটা কম অথবা বেশী। তাদের উপস্থিতিতে আমি নিজকে নিরাপদ মনে করতে পারলাম না। একটি তরুণ এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলঃ হে চাচা! আবু জাহল কোথায়? আমিও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার কাছে তোমার কি দরকার? মনে মনে ভাবলাম, এই বালক জাহেলদের নেতা আবু জেহেলের কথা জিজ্ঞাসা করছে কেন? এরপর বালকটি উত্তর দিলঃ আমি শুনেছি, সে মহানবী ﷺ কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ‘আমি যদি তাকে দেখতে পাই, আমার ছায়া তাকে অতিক্রম করবে না, যতক্ষণ না আমি তাকে হত্যা করি কিংবা সে আমাকে হত্যা করে।’
তিনি বলেছেন, ‘আমি তার এ কথায় একদম অভিভূত হলাম!’
তারপর, অপর কিশোর বালক আমার কাছে আসল। সে-ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলঃ হে চাচা! আবু জাহল কেথায়? আমিও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার কাছে তোমার কী দরকার? বালকটি উত্তর দিলঃ আমি শুনেছি, সে মহানবী ﷺ কে অনেক কষ্ট দিত, নির্যাতন করত। তাই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ‘আমি যদি তাকে দেখতে পাই, আমার ছায়া তাকে অতিক্রম করবে না, যতক্ষন না আমি তাকে হত্যা করি কিংবা সে আমাকে হত্যা করে।’
তারপর আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, ‘আবু জাহল সামান্য দূরে লোকজনদের মাঝে বিচরণ করছে। আমি তাদেরকে বললাম, ঐ হলো সেই ব্যক্তি যাকে তোমরা খুঁজছো। এই কথা বলার পর আমি আকাঙ্ক্ষা করছিলাম আমি যদি এই তরুণদের মত উৎসাহী এবং উদ্যমী হতে পারতাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে আসল এবং মহানবী ﷺ এর নিকট প্রত্যাবর্তন করল।’
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন-‘তোমাদের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছো?’
মুয়ায বিন আমর বিন ইল জামুহ বলল-‘আমি হত্যা করেছি’ এবং মুয়ায বিন আফরা বলল-‘আমি হত্যা করেছি।’
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পুনরায় বললেন, ‘তোমরা কি
তোমাদের তরবারী পরিষ্কার করে ফেলেছো?’ তারা বলল, ‘না’। তিনি (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন- ‘আমাকে দেখাও’। উভয় তরবারীতে রক্ত দেখতে পেয়ে
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা
করেছো।’
মুয়ায বিন আমর বিন জামুহ বলেছেন, “আমি আবু জাহেলকে আমার লক্ষ্যের কেন্দ্র বিন্দুতে নিলাম এবং তার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে রাখলাম। তারপর যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম, তখনই আক্রমণ করে বসলাম এবং এমনভাবে আঘাত করলাম যে, তার পা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। এদিকে আমি যখন আবু জাহলকে আঘাত করলাম অন্য দিকে তখন তার ছেলে ইকরামা আমার কাঁধে তরবারীর আঘাত করল এবং তাতে আমার হাত কেটে গিয়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে গেল এবং যুদ্ধের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। আমি তাকে পিছনে টেনে সাধারণভাবে যুদ্ধ করতে থাকলাম। কিন্তু সে যখন আমাকে খুবই কষ্ট দিতে লাগল, তখন আমি তার উপর আমার পা রেখে জোরে টান দিয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম।
এরপর আবু জাহলের নিকট পৌঁছে যান মুয়ায বিন আফরা। তিনি তাকে এত জোড়ে আঘাত করেন যে, তার ফলে সে সেখানেই স্তুপে পরিণত হয়ে যায়। সে সময় শুধু তার শ্বাসঃপ্রশ্বাস টুকু অবশিষ্ট ছিল। ”
যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন- “কে আছ এমন যে, দেখে আসবে আবু জাহলের অবস্থা কি হল। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ তখন সৈন্যদের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে আবু জেহেলকে অবশেষে খুঁজে পেলেন। আবু জাহল তখন মৃত প্রায় অবস্থায় ছিলো। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ তার বুকের উপর উঠে বসলেন। এরপর, আবু জাহল চোখ খুলে দেখলো আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ তার বুকের উপর। এতে আবু জাহল অপমানবোধ করে বললো, ‘তুমি মক্কায় রাখাল ছিলে না?’ ইবনে মাসউদ বললেন, ‘হে আল্লাহর দুশমন, আমি অবশ্যই মক্কাতে রাখাল ছিলাম’। আবু জাহল বললো- হে উটপালক! তুমি অনেক বড় স্থানে চড়ে বসেছো। এত বড় সম্মানিত উচ্চাসনে এর আগে কেউ বসেনি। ইবনে মাসউদ বললেন, ‘আজকে কার দিন? আজকে কে বিজয়ী হয়েছে? আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ বিজয়ী হয়েছেন।”
এছাড়াও আরও উক্তি আছে যে গুলো সহীহ্ সূত্র পাওয়া যায় না। যেমনঃ এরপর আবু জাহল বলল, ‘মুহাম্মদ ﷺ কে জানিয়ে দিও আমি যতক্ষণ আমার শেষ নিঃশ্বাস নিতে পারব ততক্ষণ আমি তাঁর শত্রু থেকে যাবো। ’সহীহ্ সূত্রে আরও কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। যেমনঃ আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ যখন মক্কায় বসবাস করতেন, তখন আবু জাহল তার কানে আঘাত করেছিল। তাই আবু জাহলের বুকের উপর বসে ইবনে মাসউদ আবু জাহলের মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলেন এবং এরপর আবু জাহেলের কানে একটি ছিদ্র করেন, ঐ ছিদ্রের ভিতর দিয়ে দড়ি ঢুকিয়ে তার মাথা টানতে টানতে নিয়ে আসেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতো, আবু জাহেলের মাথা ছিলো বৃহদাকার এবং ইবনে মাসউদ দুর্বল, জীর্ণ-শীর্ণ প্রকৃতির লোক। মুহাম্মদ ﷺ যখন আবু জাহেলের ছিন্ন মস্তক দেখতে পেলেন তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত সিজদায় পড়ে গেলেন এবং বললেন, ‘যে সত্তার কোন শরীক নেই সেই মহান আল্লাহ তা’য়ালার নামে শপথ করে বলছি, প্রত্যেক উম্মাহর জন্য এক একটি ফিরাউন থাকে এবং এই ব্যক্তি হলো আমার উম্মাহর জন্য ফিরাউন। ’পরবর্তীতে মহানবী ﷺ যখন দেখলেন আবু জাহলের কানের ভিতরে রশি ঢুকানো তখন স্মরণ করলেন সেই দিনের কথা যেদিন আবু জাহল ইবনে মাসউদের কানে আঘাত করেছিল। এরপর মহানবী ﷺ বললেন, ‘একটা কানের জন্য একটা কান। আর মাথা হলো অতিরিক্ত।’
আমি বলি, ‘এই হলো আবু জাহেল-দুনিয়াতে যার অস্তিত্বকে নিঃশেষ করেছে দুই তরুণ। তরুণেরা এই কাজ করেছেলো তরুণাবস্থায়। তাদের বয়স ১৭ বছরের কাছাকাছি হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় তারা খুব জোর হাইস্কুলের ছাত্র হবে!! এই বয়সেই তারা কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত নেতা আবু জাহেলের মোকাবেলা করেছে এবং আবু জাহেলকে হত্যা করেছে। এবং আবু জাহলের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ায় মহানবী ﷺ এর মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। আর কেউ যদি বদর, মুতা প্রভৃতি যুদ্ধের দিকে খেয়াল করে তাহলে তরুণ-যুবক ছাড়া কাউকে খুঁজে পাবে না।
দুইটি বিশ্ব যুদ্ধেই ব্রিটেন এবং অন্যান্য শক্তিশালী জাতিরা বিভিন্ন বিপজ্জনক অভিযান পরিচালনার জন্য সতেরো, আঠারো, ঊনিশ বছরের তরুণদের উপর বেশী বিশ্বাস স্থাপন করতো, কেননা তরুণেরা যে কোন কাজ করতে সদা প্রস্তুত থাকে এবং কোন কাজের জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করে না। চাইনিজরা তাদের আত্মঘাতী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতো এবং এই অভিযান পরিচালোনার জন্য তরুণদের উপর ভরসা করতে পরামর্শ দিতো এই বলে যে, ‘যে সব অভিযানে নিজেকে বিপন্ন করার আশংকা থাকে সে সব অভিযানে পরিপক্ক বয়সের একটু বেশী বয়স বিশিষ্ট লোকদের দ্বারা পরিচালনা করা যাবে না, কারণ তারা সমগ্র অভিযানকেই দেরী করিয়ে দিবে’। তারা এমন অভিযানে থমকে দাঁড়ায় এবং নিজেরাই ভাবে, ‘এমন আত্মঘাতী হামলায় ফলাফল কি হবে?’ অথবা ‘এই আত্মঘাতী হামলায় আমাদের কি উপকার আসবে?’ এই ধরনের দর্শনই একজন মানুষকে আত্মোৎসর্গ করার ক্ষেত্রে বিরত রাখে এবং যারা এমন থমকে দাঁড়ায় ও ভাবে, তাদের দ্বারা কোন বিজয় সম্ভব হয় না। বরং আবেগ-আপ্লুত অন্তর বিশিষ্ট লোকদের দ্বারাই বিজয় অর্জন সম্ভব হয়।[১] আবেগ আপ্লুত অন্তর এবং উদ্দীপ্ত অন্তরই অত্মোৎসর্গে সহায়ক হয়। অপরপক্ষে, তথাকথিত (বাতিল) যুক্তি বিচার-বুদ্ধিই মানুষের মনকে বলে, ‘নিজেকে উৎসর্গ করো না, নিজেকে এমনভাবে বিলীন করে দিও না’। এই ধরনের মানুষের অন্তর সাধারণত শান্ত, স্থির, নিশ্চল, নিষ্ক্রিয় এবং নিজেকে উৎসর্গ করার ব্যাপারে কোন প্রবণতা-ইচ্ছা নেই। এমন দর্শনই তাকে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন করে। তাই যখন তার আবেগ, তার অনুভূতি তাকে বলে- ‘আল্লাহর পথে সচেষ্ট হও, অর্থ ব্যয় করো। আল্লাহ তোমাকে প্রতিদান দেবেন। ’তখন তার অন্তর তাকে বলে, ‘তোমার সম্পদ কমিও না।’ যদি তার অনুভূতি তাকে বলে, ‘নিজেকে উৎসর্গ করো’। তখন তার অন্তর বলে, ‘তুমি বেঁচে থাকো; তাহলে এতে ইসলামের আরও অনেক উন্নতি হবে এবং আরও কত কি!!!
এই কারণেই, তুমি যদি বিভিন্ন ভাবুক, দার্শনিক ব্যক্তিদের জীবনগুলো পর্যালোচনা কর, তাহলে দেখবে তাদের ধারণা-কথাবার্তা সর্বদা আকাশছোঁয়া হয়ে থাকে কিন্তু তাদের জীবন পড়ে থাকে পর্বতের পাদদেশে। অর্থাৎ তাদের চাওয়া-পাওয়া, ধ্যান-ধারণার সাথে বাস্তব জীবনে তাদের প্রাপ্তির অনেক ব্যবধান রয়েছে। তাই তরুণাবস্থাকে গুরত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আনাস বিন মালিক বলেন- ‘মহানবী ﷺ যখন সাহাবীদের নিয়ে মদীনাতে আসলেন তখন আবু বকর ছাড়া কারও মাথায় সাদা চুল ছিল না আর তিনিই দাঁড়িতে মেহেদী দিতেন। তখন আবু বকর এর বয়স ছিল ৫১ বছর এবং উমার এর বয়স ছিল ৪১ বছর। মহানবী ﷺ হিজরত করেছিলেন তার নবুয়াতের তের বছর পর। সুতরাং যখন মুহাম্মদ ﷺ তাঁর দাওয়াত প্রচার করেছিলেন এবং আবু বকর যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন তার বয়স ৩৮ বছর এবং অন্যান্যদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছিল।
কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন প্রত্যেক যুবককে একটি নির্দিষ্ট প্রশ্ন করবেন।“একজন বান্দার দুই পা ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জায়গা থেকে নড়বে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ঃ তার জীবন সম্বন্ধে এবং জীবনের প্রতি সে কেমন ব্যবহার করেছে তা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে; তার যৌবনাবস্থা সম্বন্ধে এবং কিভাবে কোন পথে তা ব্যয় করেছে; তার জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করেছে কিনা সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে; সে কোন পথে অর্থোপার্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এরপরও তিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করবেন আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো তার যৌবনাবস্থা সম্পর্কে। যদিও যৌবন কাল জীবনেরই একটি অংশ তারপরও আল্লাহ তা’য়ালা যৌবনাবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আল্লাহ তয়ালা কি কোন চিন্তাভাবনা, কোন যুক্তি, কোন কারণ ছাড়াই অনেক কিছুর মধ্যে যৌবনাবস্থাকে প্রশ্ন করার বিষয় সম্পর্কে বেছে নিলেন?
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَلِيمُ الْقَدِيرُ
আল্লাহ তিনি দূর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন অতঃপর দূর্বলতার পর শক্তিদান করেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। [সূরাহ রূম: ৫৪]
অবশ্যই, তোমরা এমন এক বয়সে উপনীত হয়েছো যে বয়সে শয়তান পড়াশোনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অবিরাম আশা গঠনের মাধ্যমে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। যদি তোমাদেরকে বলা হয় সেই মহান রাজাধিরাজ আল্লাহকে ডাকো অথবা আল্লাহর পথে কিছুটা সময় ব্যয় কর। শয়তান তখন এই বলে তোমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টো করবে যে, ‘এখনি এমনটি করবে? তুমি এখন স্কুলে, কিছুদিন পর তুমি তোমার ডিগ্রি অর্জন করবে- সমাজে সম্মান বাড়বে তুমি তখন আল্লাহ তায়ালার জন্য ভাল কাজ করতে পারবে।’
এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কথা হলো, তোমরা জানো না কবে তোমরা ডিগ্রি অর্জন করবে এবং তোমরা জানো না কবে তোমরা মারা যাবে এবং তোমরা জানো না কি অবস্থায় আল্লাহর সামনে তোমাকে দাঁড়াতে হবে (আখিরাতে)। এ কারণে এমন আকাশ কুসুম কল্পনা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখো।
দ্বিতীয়ত, তোমরা যদি এই বয়সেই আল্লাহর পথে সময় ব্যয় করার ব্যাপারে কৃপণ বা কঞ্জুস হও, তাহলে ভবিষ্যতে যে সময় আসছে সেই সময় তোমাকে আরও কঞ্জুস অথবা কৃপণে পরিণত হবে। প্রকৃতপক্ষে, যৌবন বয়সে যে ব্যক্তি নিজেকে ইসলামের রঙে রঙিন হয়েছে আর যে ব্যক্তি বৃদ্ধ বয়সে ইসলামে প্রবেশ করেছে এই দুজনের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। আসলেই, এই এই দুইজনের মধ্যে বিদ্যমান কত বিশাল পার্থক্য! এর মূল কারণ হলো, এই বয়স থেকে ইসলামের নিয়ম-কানুন পালন করা অনেক সহজ। তুমি যদি যৌবনাবস্থায় ইসলামকে তোমার জীবনের একটি অংশ ধরে নাও, তাহলে তোমার অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, দেহ, শরীর, আত্মা তথা সমগ্র জীবনই ইসলামের একটি অংশ হয়ে দাঁড়াবে। বাস্তবে, তুমি ইসলামের একটি অংশে রূপান্তরিত হবে। একটি কচি গাছ এবং বড় বৃক্ষ দ্বারা উদাহরণ দিলে এটি আরও স্পষ্ট হবে। বড় বৃক্ষে প্রতিষ্ঠিত কান্ড, গুঁড়ি এবং শুকিয়ে যাওয়া বাকল বিদ্যমান। একারণে বড় বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা গুলো যে সব দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে- সে সব দিক থেকে ঐ শাখা প্রশাখাগুলোর দিক পরিবর্তন কষ্টসাধ্য। অপরপক্ষে, ছোট বৃক্ষের দিক সহজেই পরিবর্তন সাধ্য। কেননা, হাত দিয়ে নিজের সুবিধামত একে পরিবর্তন করা যায়।
উপরিল্লিখিত কারণে বিশ্বজাহানের রব মহান আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) সেই সব যুবকদেরকে যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করেছে তাদেরকে কিয়ামতের দিন ছায়া প্রদান করবেন, যখন অন্য কোন ছায়া থাকরে না। সেই দিন (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। সেই দিন আল্লাহ তায়ালা সাত ব্যক্তিকে তার আরশের নীচে ছায়া প্রদান করবেন “…একজন যুবক, যে আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পন করা অবস্থায় বেড়ে উঠেছে।”
সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজে লক্ষ্য করে দেখেছি যে, তরুণ-যৌবন অবস্থায় যারা ইসলামের দাওয়াহ কবুল করে তারা সম্পূর্ণ আলাদা তাদের থেকে যারা বৃদ্ধ বয়সে ইমলামের দাওয়াহ কবুল করে। স্কুলে পড়ন্ত অবস্থায় যদি একজন ছাত্র ইসলাম এবং ইসলামের প্রতি আসক্ত হয়, তাহলে ঐ ছাত্র ইমলামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
অপরপক্ষে, বৃদ্ধ ব্যক্তি যে সামাজিক অবস্থান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ছেলেমেয়ে বিশেষ করে দুনিয়া যার মাথা বিগড়ে দিয়েছে, সেই ব্যক্তি যদি অনুতপ্ত হয়ে ইসলাম মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, সে শর্ত সাপেক্ষে ইসলাম মানার চেষ্টা করবে।
তাই কেউ যদি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মন্ত্রী থাকে তাহলে সে ইসলাম গ্রহণের পরেও আগের মত সম্মানিত হওয়ার আশা করবে, সে ইসলাম গ্রহণের পরও তার সম-পর্যায়ের লোকদের সাথে উঠাবসা করবে, যেমনটি সে পূর্বেও করত। তাই ইসলামের রঙে পুরোপুরি রঙিন হয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব(অনেক কঠিন)। দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা, দুনিয়ায় সম্মানিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, এমনকি অনেক জাহেলী রীতিনীতিসহ সে ইসলামে প্রবেশ করে। তার পক্ষে সমাজের লোকদের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে মেলামেশা করা সহজ নয়।
আল্লাহ তায়ালা যেমনভাবে ইসলামকে নাযিল করেছেন, যে আইন-কানুন দিয়েছেন তা সম্পর্কে অবহিত হওয়াও এমন ব্যক্তির জন্য সহজ নয়। এরপরও জাহেলি যুগের যেসব রীতিনীতিকে ইসলাম শিকড়সহ উপড়িয়ে ফেলেছে সেই সব রীতিনীতিই হয়তো তার জীবনে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছে। উদাহরণ স্বরূপঃ তার স্ত্রী বিভিন্ন পার্টি তে নাচ-গান করতে অভ্যস্ত, তার মেয়ে ছেলেদের সাথে বেড়াতে অভ্যস্ত, তার আত্মীয়-স্বজন তার সামনে মদ পানে অভ্যস্ত, তার অপর কন্যা তার বাড়িতে আগত পুরুষ অতিথিদের সাথে করমর্দন করে, তার বোন অতিথিদের সাদরে আমন্ত্রন জানানোর পর তাদের সামনে এক পায়ের উপর আর এক পা তুলে বসে থাকে, তাদের সাথে চা-কফি পান করে। এই সবগুলোকে অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার, যদি সে ইসলামী জীবনধারায় নিজের জীবনকে অতিবাহিত করতে চায়। তাহলে দ্বীনানুসারে উপরিল্লিখিত বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনয়ন করা তার পক্ষে অনেক দূরুহ ব্যাপার হবে। তাকে অনেক কষ্টকর-অসন্তোষজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
এটাই হলো, তরুন বয়সে সে যদি ইসলামী দাওয়ায় প্রবেশ করত, ইসলামকে জানত-চিনত তার সাথে বর্তমানে বৃদ্ধাবস্থায় ইসলাম গ্রহণের বিশাল পার্থক্য। সে যদি তরুণ বয়সে ইসলাম কবুল করত, তাহলে এখন এমন কষ্টকর সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। তরুণ অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ না করায় তাকে অনেক কষ্ট পেতে হচ্ছে। কিন্তু সে যদি তরুণাবস্থাতেই ইসলাম গ্রহণ করতো, তাহলে সে সত্যিকার মুসলিম মেয়ে ব্যতীত বিবাহ করতো না; যেহেতু সে একজন মুসলিম। তাই ইসলামই হবে তার বিবাহের জন্য মূখ্যশর্ত । অপরপক্ষে যে ব্যক্তি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ইসলামী জীবনধারায় কাটায়নি, সে ব্যক্তি এমন মেয়ে খুঁজতে পারে যে মেয়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে অথবা সে কোন রাজকন্যা; কোন মন্ত্রীর মেয়ে কিংবা কোন ধনীর দুলালী। ঐ ব্যক্তি এমন মেয়েকে বিবাহ করবে এই কারণে, যাতে সে ঐ মেয়েকে অবলম্বন করে সমাজে উন্নতি লাভের সিড়িতে আরোহণ করতে পারে। ঐ ছেলে মেয়ের পরিবারের কথা লোকজনের সাথে বলে বেড়ায়, ‘আমি এখন অমুক মন্ত্রীর সাথে সংশ্লিষ্ট, আমি এখন তার পরিবারের অংশ’। এই সব চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে যখন সে ইসলাম নামক মহাপরীক্ষার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন তার কাছে ইসলাম অনেকটা মহাসঙ্কটের মত কঠোর মনে হয়। তাহলে, সুদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত কোস্পানি কি সে চালাতে পারবে? সে ঐ জমির ব্যাপারে কি করবে যা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনা? সেই সব দুনিয়াবী বন্ধু যারা ঐ জমি নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সে কি করবে? এই সব বিষয়ে তার আচরণ কেমন হবে? এগুলো হতে কি সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, সে কি তার সঙ্গী-সাথীদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, সে কি নাইট পার্টি এবং নাচানাচি বন্ধ করে দেবে-সে কি পারবে সব খারাপ কিছু শেষ করতে? একজন ব্যক্তির পক্ষে একবারে সব খারাবীকে উৎখাত করে এক আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া সহজ ব্যাপার নয়।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময় হলো যৌবন। আমাকে বিশ্বাস করো,
আমার ভাইয়েরাঃ আমি এমন কিছু লোকদের চিনি যারা বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর রহমতে
সালাত-যাকাতের সাথে পরিচিত হয়েছে, আল্লাহর পথে চালিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে
একজন আমাকে বলেছে- আমি মনে করি আমি মুনাফিক হয়ে গিয়েছি। কেননা, সুদ ছাড়া
আমি আমার কোম্পানি চালাতে পারিনা। কারণ শত-শত, হাজার-হাজার অর্থ আমার
প্রয়োজন হয় প্রতি মাসে। যখন আমি সালাত পড়ার জন্য উঠি, তখন আমি অন্তরে ব্যথা
অনুভব করি এবং আমি এর থেকে মুক্ত হতে পারি না। একই সাথে আমি আল্লাহর দিকে
ধাবিত হতে চাই। তাই বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরে যাওয়া অতীব
কষ্টের।
আমার মনে পড়ে আমরা আম্মানে একটি আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলাম। ঐ আলোচনায়
সমাজের উচ্চপদস্থ লোকেরা, কোম্পানি মালিকসহ অনেক সম্মানিত লোকেরা উপস্থিত
ছিল। যেখানে একজন উপস্থিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি ঐ ব্যক্তি
সম্বন্ধে কি মনে করছেন যার বয়স ৪০-৫০ বছর কিন্তু জীবনে কোনদিন সিয়াম পালন
করেনি?’ আমি তাকে বললাম, ‘হানাফীদের থেকে একটি ফাতওয়া প্রচলিত আছে যে, কেউ
যদি নির্দিষ্ট কাজের একটির জন্য কাযা আদায় করে, তাহলে ঐ ধরণের সকল কাজ
যেগুলো সে আদায় করেনি তার কাযা আদায় হয়ে যাবে। তাই কেউ যদি ধারাবাহিকভাবে
দুই মাস সিয়াম পালন করে, তাহলে সে জীবনে যত সিয়াম আদায় করেনি তার কাযা আদায়
হয়ে যাবে। এ কথাটি অপর এক উপস্থিত ব্যক্তি খুব পছন্দ করে যার বয়স ছিল ৪০
বছর। সে কখনও সালাত আদায় কিংবা সিয়াম পালন করেনি এবং আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত
হতে চায়। তাদেরকে এই দারছ দেওয়ার পর কিছুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখি।
পরবর্তীতে, আমি যেই বাড়িতে এই শিক্ষাটি দিয়েছিলাম সেই বাড়িতে যাই এবং যে ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তাকে দেখে আশ্চার্যান্বিত হই। আমাকে দেখার পর ঐ প্রশ্নকারী আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি জানেন না? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি জানব? সে বলল, ‘আপনি যে ফতোয়াটি উল্লেখ করেছিলেন সেই ফতোয়াটি অমুক ব্যক্তি শুনেছিল এবং পরের দিন থেকে সে সালাত-সিয়াম আদায় করতে শুরু করে এবং ঐ ব্যক্তি ছিল একজন ব্যবসায়ী’। সে জুলাই এর মাঝের দিকে এমনভাবে সিয়াম পালন করতে শুরু করে যে, এতে তার পরিবারের সদস্যরা তার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাই তারা অন্য আর এক আলেমের কাছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে ঐ আলেম তাদেরকে বলে, ‘যদি সে অনুতপ্ত হয়, তাহলে তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সে ততগুলো সিয়াম পালন করতে পারে।’ আমি তাকে বললাম-ঐ ব্যবসায়ী লোক সম্বন্ধে আমি তো কিছুই জানি না।
যে ব্যক্তি অনুতপ্ত হয়েছিল সেই ব্যক্তি পরবর্তীতে আমাকে বলেছিল- ঐ মাসের মাঝামাঝি সময়ে লোকজন আমার কাছে আসত। আমি মনে করি, জুলাই এর তিন-চার দিনে আম্মানে এমন গরম পড়েছিল যে, আম্মানবাসী কখনও এমন উত্তাপ দেখেনি। ঐ ব্যক্তি ছিল ব্যবসায়ী এবং তার তিনটি দোকান ছিলঃ একটি ছিল আম্মানে, একটি মাউন্ট হুসাইনে এবং আরেকটি মাউন্ট আল-উবাইদায়। সে আমাকে আরও বললঃ আমি যখন সিয়াম পালন করছিলাম তখন লোকজন আমার রেফ্রিজারেটর থেকে পানি নিতে আসছিল। সারাদিনে আমার মুখের ভিতরে আমার থুথু মধুর মত গাঢ় হয়েছিল। মূলত, তার কাছে সিয়াম পালন এতো কষ্টের ছিল। বর্তমানে সে দ্বীনের কোন বিষয়ে অত্যন্ত কড়া। সে মহিলাদের বস্ত্রের দোকানের মালিক ছিল এবং ঐ দোকানে মহিলারা পোশাক ট্রায়াল দেবার জন্য আসত। তারা সেখানে বাইরের এবং ভিতরের পোশাকও ট্রায়াল দিত। এ কারণেই সে অনুভব করলঃ একাজ তার ইসলামী নিয়মানুসারে যাপিত জীবনের সাথে মিলে না। তাই সে মনস্থির করল, খুব শীঘ্রই এমন ব্যবসার সমাপ্তি ঘটানো দরকার। সে তিনটি দোকান থেকে মেয়েদের পোশাক সরিয়ে দোকানকে পবিত্র করল এবং অনেক পোশাক নিয়ে আমার কাছে এসে বলল- ঐ পোশাকগুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে। এর বিনিময়ে সে কিছুই চায় না; শুধু চায় যে ব্যবসা মহিলাদের আকৃষ্ট করে তেমন ব্যবসার সমাপ্তি ঘটুক। এরপর সে এই ব্যবসার পর কার্পেট বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করে এবং বলে কার্পেটের দোকান মহিলাদের আকৃষ্ট করে না।
কিছুদিন পরে, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘এখন তোমার কেমন লাগছে?’ সে
উত্তর দিলঃ আমি প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার জর্ডানিয়ান ডলার মূল্যের পোশাক
বিক্রয় করতাম যা আমেরিকান ডলারে ছয় থেকে সাত হাজার ডলারের সমান। এবং এর
মধ্যে অর্ধেক কিংবা এক-তৃতীয়াংশই লাভ থাকত। যাহোক, এরপরও আমি এতে অসন্তুষ্ট
থাকতাম। আমার কাছে মনেই হতো না আমি সম্পদশালী। বর্তমানে আমি আগের তুলনায়
এক-দশমাংশ বিক্রয় করি এবং বর্তমানে যে লাভ হয় তাতে আমি সন্তুষ্ট। আল্লাহ
আমাকে রহমত করেছেন।
আমি এই উদাহরণ একটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার জন্য প্রয়োগ করলাম যে
বিষয়টি হলোঃ ‘বৃদ্ধ বয়সে অনুতপ্ত হলে অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করতে
হয়।’ এই ব্যক্তিকে সিয়াম পালন করার পর তার ব্যবসার দিকে নযর দিতে হয়েছে।
তার ব্যবসাকে সংশোধন করার পর তার পরিবারে পরিবর্তন আনার জন্য-পরিবারের
সদস্যদের সংশোধন করার জন্য এক সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। তার
স্ত্রী-কন্যা কেউই লম্বা জামা পরত না। তারা আম্মানে অনেক আধুনিক জীবনযাপন
করত এবং সে তার জীবনের অধিকাংশ সময় জার্মানীতে কাটিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, তার
সাথে তার স্ত্রীর অনেক বাদানুবাদ হয়েছে, হয়েছে অনেক সমস্যা। তার স্ত্রীকে
এমন কি এমন শর্তও দিতে হয়েছে, ‘হয় ইসলাম মেনে আমার সাথে থাকো অথবা আমাকে
ত্যাগ করে তোমার বাবার বাড়ি চলে যেতে পারো।’ অবশেষে ঐ ব্যক্তি তার স্ত্রীকে
জয় করতে সক্ষম হয়। আমি আগেই বলেছি এই ব্যক্তিটি ছিল অত্যন্ত জেদী এবং সে
তার জেদ অনমনীয় ভাবে কাঠিন্যতার সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মাঝে বজায় রেখছিল।
যা হোক, এহেন সংগ্রামে ঐ ব্যক্তিকে অনেক চড়াই উৎরাই পার করতে হয়েছে।
কিন্তু হে যুবক ভাইয়েরা, তোমাদের ক্ষেত্রে তোমাদের প্রত্যেকটা বিষয় তোমাদের হাতের মুঠোয়। তুমি তোমার স্ত্রী নির্বাচন করে নিতে পারো, তোমার জীবনের পথ নির্বাচন করতে পারো। এমনকি তোমার চাকুরিও আল্লাহর শরীয়াহ এবং সন্তুষ্টি অনুসারে নির্বাচন করতে পারো। তাই এখন থেকেই তোমার জীবনের সমস্ত সংযোগ ইসলামের সাথে জুড়ে দাও। তুমি যদি এমনটি কর, তাহলে ভবিষ্যতে তোমার কোন সমস্যাই হবে না। তাই তুমি যদি তোমার যৌবন বয়সের সুবিধা গ্রহণ কর- যৌবন বয়সকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পার, তাহলে ভবিষ্যতে বৃদ্ধ বয়সটা অনেক সুখে শান্তি তে কাটাতে পারবে। তোমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইসলাম মেনে চলা, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা তোমার পক্ষে অনেক কষ্টকর হবে। এ কারণেই উমর বলতেন, ‘জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে যা শেখার তা শিখে নাও’।
আবদ-আল-মালিক বিন মারওয়ানকে মদীনার সবচেয়ে সাহসী আলেম মনে করা হতো। তিনি ফিকহ্, হাদীস এবং আরবী জানতেন। আমির আশ শাবী ফিকহ্ এবং হাদীসে পারদর্শিতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। যদিও তিনি কুরআন মুখস্তকারীদের একজন এবং আরবী ভাষায় একজন দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন, তবুও তিনি আবেদ-আল মালিক বিন মারওয়ানের সাথে প্রতিযোগিতা করে পারতেন না। যখন মারওয়ান মারা গেলেন, তখন খবর এসে পৌঁছালো যে, আশ-শাবীকে এখন নেতৃত্ব দিতে হবে, নেতৃত্বের দায়িত্ব বহন করতে হবে। এ খবর পাওয়ার পর, আশ-শাবী কুরআনকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কুরআনের দিকে তাকিয়ে বললেন “বিদায়”। সে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আন্তরিকতার সহিত আবেগ প্রনোদিত হয়ে কুরআনকে বিদায় জানালেন। কারণ তিনি জানতেন যে, নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের সাথে যে সমস্যা আসে তা অধ্যয়ণ, তিলাওয়াত এবং মুখস্ত করা থেকে তাকে বিরত রাখবে।
তাই, হে আমার ভাইয়েরা,
তুমি তোমার জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়ে রয়েছো। এই সময়টাই হলো প্রচেষ্টার সময়,
উদ্যোগী হবার সময়, এই সময়টাই হলো ইবাদত করার সময় এবং এই সময়টাই হলো দাওয়াহ
দেবার সময়। এই সময়টাই হলো গতিময়তার সাথে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কর্মতৎপর
হবার সময়। তাই এখন তোমার অবশ্যিক দায়িত্ব হলো ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়া,
ইসলামকে জানা, ইসলামকে বাস্তবায়ন করা, মেনে চলা এবং ইসলামের দিকে মানুষকে
ডাকা। জ্ঞান আহরণ কর, আমলে পরিণত কর এবং তা প্রচার করো! যদি এই সুযোগ
অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে এমন সুবর্ণ সুযোগের আর কখনও পুনরাবৃত্তি ঘটবে
না। ইউনিভার্সিটিতে কত অবসর সময় পাওয়া যায়, আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য
প্রচুর সময় ইউনিভার্সিটিতে পাওয়া যায়। কত মজা! ইউনিভার্সিটি জীবনে আল্লাহর
ইবাদত করা এবং জানা-অজানা সহকর্মী ও বন্ধুদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া কত
আনন্দের!
فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنتَ مُذَكِّرٌ
لَّسْتَ عَلَيْهِم بِمُصَيْطِرٍ
“অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো কেবল একজন উপদেশদাতা,আপনি তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নন” (গাশিয়াঃ ২১-২২)
রসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেছেন, “পাঁচটি জিনিস এসে যাবার
পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে উত্তমরূপে ব্যবহার করো, ‘যৌবন বয়সকে সদ্ব্যবহার করো
বৃদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও অসুস্থ হয়ে যাবার
পূর্বে ই……।”
আজকে তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে পারছো এবং আগামীতে তুমি বসে ছাড়া সালাত আদায় করতে পারবে না। আজকে তুমি সিয়াম পালন করতে পারছো কিন্তু আগামীতে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে, সিয়াম পালন করতে পারবে না। তোমার সুস্থতার জন্য আল্লাহ তোমার কাছে মূল্য চায়। আর সুস্বাস্থের সেই মূল্য তথা ট্যাক্সই হলো ইবাদত, যা তোমার শরীর, তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংশোধন করবে এবং ধ্বংসের হাত থেকে তাদেরকে বাঁচাবে। তুমি যত ইবাদত করবে, তুমি তত উপকার লাভ করবে এবং ইবাদতের পরিমাণ বাড়ালে তোমার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হবে না; বরং সুস্থতা বাড়বে এবং এর উৎকর্ষ সাধন হবেঃ-
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ
তোমাদের পালন কর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর,অতঃপর তাঁরই প্রতি
মনোনিবেশ কর; তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি ধারা প্রেরণ করবেন এবং
তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন (হূদঃ ৫২)
তাই আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করলে, তাঁর কাছে অনুতপ্ত হলে শক্তি বৃদ্ধি পায়।
এটাই স্বাভাবিক, যেহেতু ইবাদত করলে শরীর এবং স্নায়ুগুলো শান্তি-আরাম পায়
এবং এগুলোই পরবর্তীতে শরীর গঠন করে।
একজন আফগানবাসী আমাকে জানালো যে, তার পিতার বয়স ১২০ বছর এবং বর্তমানে তার একটি দাঁতও পড়েনি! সে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে জামাআতের সাথে আদায় করে, বিশেষ করে ফযর এবং এশা। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তার দেহকে সংরক্ষণ করেছেন।“…আল্লাহর ব্যাপারে সচেতন হও, মনোযোগী হও এবং তিনিই তোমার যত্ন নেবেন। তাই ইবাদত হলো সেই জিনিস যা দেহকে রক্ষা করে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে সুসম্পর্ক থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত শরীরও ভাল থাকে। “আল্লাহর দিকে মনোযোগী হও এবং তিনি তোমার যত্ন নেবেন।”
“পাঁচটি জিনিস থেকে সুবিধা গ্রহণ করো, পাঁচটি জিনিস এসে যাবার পূর্বেইঃ যৌবন বয়স থেকে সুবিধা গ্রহণ করো বৃদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বেই, সুস্বাস্থ্য থেকে সুবিধা গ্রহণ করো অসুস্থ্য হয়ে যাবার পূর্বেই এবং সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাও দরিদ্র তা এসে যাবার পূর্বেই…।” কারণ আলী বিন আবি তালিব বলেন, ‘আমি সেই কৃপণ লোককে দেখে বিস্মিত হই সে উপার্জিত সম্পদ থেকে নিজেকে দূরে রাখে এবং দরিদ্র তার সাথে জীবিকা নির্বাহ করে যা থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছিল।’ এ ব্যক্তি দুনিয়ায় দরিদ্রাবস্থায় জীবনযাপন করে, অথচ সে আখিরাতে তাকে হিসাব দিতে হবে ধনী ব্যক্তির মত। সে সম্পদ জমা করে সেই সম্পদ দিয়ে তার সন্তানকে অ্যালকোহল কিনে দেয়েছে, গাড়ি কিনে দিয়েছে এবং মেয়েদের পিছনে ঘুরাঘুরির সুযোগ করে দিয়েছে। এ কারণে সে মুনকার নাকীরের এবং কবরের আযাবের ফেরেশতাদের লোহার হাতুড়ি তলে পিষ্ট হবে। এবং সে যত সম্পদের মালিক ছিল তার প্রতিটি কণার হিসাব আল্লাহ তায়ালার আদেশে ফেরেশতারা গ্রহণ করবেন।
একটা গল্প প্রচলিত আছে যা নিছকই একটি প্রতীকী গল্প কিন্তু তা আমাদের
অনেক ভাববার খোরাক দেয়। গল্পটি হলো- একজন বিশাল সম্পদের অধিকারী একদা মারা
গেলেন। তখন তার সন্তানেরা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা তাদের পিতার কবরে সঙ্গী
হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে এক রাতের জন্য রেখে দেবে। তাই তারা দুইটি গর্ত
খনন করল এবং একটির সাথে আরেকটির সংযোগ স্থাপন করল। তারা একটি গর্তে তাদের
পিতাকে রাখল এবং অন্যটি ফাঁকা রাখল। এরপর তারা এই মৃতদেহের পাশে শুয়ে থাকতে
পারে এমন সাহসী ব্যক্তিকে খোঁজা শুরু করলো। তারা এ কাজের জন্য এক চাকরকে
পেয়েও গেল এবং তারা ঐ চাকরকে বলল, ‘তুমি যদি আমাদের বাবার কবরের পাশে
একরাত্রি থাকো, তাহলে তোমাকে আমরা এক হাজার দীনার দেব।’সে ভাবল, সে টাকাটা
নেবে। যদি সে মারা যায় তাহলে তার সন্তানেরা ঐ টাকায় জীবিকা নির্বাহ করতে
পারবে। আর যদি সে বেঁচে যায় তাহলে সে ঐ টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে।
কথামতই কাজ হলো। রাত্রে আযাবের ফেরেশতারা কবরে আবির্ভূত হলো। এরপর তারা
বলল, এখানে দুইজন লোক রয়েছে। একজন জীবিত, একজন মৃত। একজন এখানে একরাত্র
থাকবে এবং অপর জনকে চিরতরে এখানেই থাকতে হবে। তাই চলো যে কাল সকালে চলে
যাবে তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি।
তারা জিজ্ঞাসা করলোঃ ‘কে তুমি? ’
ব্যক্তিঃ আমার নাম অমুক।
ফেরেশতাঃ তুমি জীবিকা অর্জনের জন্য কি কর?
ব্যক্তিঃ আমি একজন ভৃত্য। আমি মানুষের জন্য বিভিন্ন জিনিস বহন করি।
ফেরেশতাঃ তুমি মানুষের জন্য জিনিসপত্র বহন করো? ঐ বহন কাজে তুমি কি ব্যবহার কর?
ব্যক্তিঃ আমি আঁশ নির্মিত দড়ি ব্যবহার করি।
ফেরেশতাঃ তুমি কি নিশ্চিত এই ব্যপারে যে, আঁশে বিশুদ্ধতা রয়েছে এবং এতে কোন
ভেজাল নেই? দড়ি কিনতে যে দশ শিলিং ব্যয় হয়েছে তা কিভাবে উপার্জন করেছিলে?
ব্যক্তিঃ আমি অমুক ব্যক্তির কাজ করে দিয়েছিলাম।
ফেরেশতাঃ তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে ঐ ব্যক্তি ঐ অর্থ হালাল উপায়ে অর্জন করেছে, হারাম উপায়ে নয়?
যাহোক, ফেরেশতারা এভাবে সূর্যাস্ত থেকে সকাল পর্যন্ত ঐ ব্যক্তিকে দড়ি এবং
তার কাজ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করল। জিজ্ঞাসাবাদের পর ঐ ব্যক্তি কবরস্থান
ত্যাগ করল। এরপর মৃত ব্যক্তির সন্তানেরা ঐ ব্যক্তির কাছে আসল এবং কি ঘটল তা
জিজ্ঞাসা করল। ঐ ব্যক্তি তখন উত্তর দিল- ‘তোমার পিতার কিয়ামত পর্যন্ত কোন
শাস্তি হবে না।’ তারা জিজ্ঞাস করল, ‘কেন?’ সে তখন উত্তর দিল ফেরেশতারা
আমাকে এই দড়ি নিয়েই সমগ্র রাত্র প্রশ্ন করেছে। আমি এটা কোথায় পেয়েছি, এটা
নিয়ে কোথায় যাই প্রভৃতি। তাই তোমার পিতার কি হবে, যার অনেক বাগান, রাজ
প্রাসাদ, …রয়েছে? কখন ফেরেশতারা তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করবে?
সত্যি কথা বলতে, এটা নিছক একটা প্রতীকী চরিত্র। এর গভীর অর্থ রয়েছে যা মানসপটে গভীর চিন্তার খোরাক যোগায়।
জবাবদিহিতা খুব শীঘ্রই করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতা খুব শীঘ্রই করতে হবে। এই ব্যাপারটি হালকা নয়। তাই এখন থেকেই তোমার সঞ্চয় প্রস্তুত কর এবং আল্লাহ তায়ালার সামনে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো। জেনে রেখো আগামী কালকেই, তুমি আল্লাহ তায়ালার সামনে হাজির হবে, তোমাকে প্রত্যেকটা কাজের হিসাব দিতে হবে।
وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنقَلَبٍ يَنقَلِبُونَ
যারা খারাপ কাজ করে তারা শীঘ্রই জানতে পারবে কোন স্থলে তারা প্রত্যাবর্তন করবে (শুয়ারাঃ ২২৭)
সুতরাং, হে আমার ভাইয়েরা,
আমি তোমাদের কতবার বললাম, তোমরা তোমাদের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়ে রয়েছো এবং এই সময়েই তোমাকে ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তা আমলে পরিণত করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে! এটা আসলে খুবই সহজ- শেখা, পালন করা, শেখানো। তুমি যদি তা এই সময়ে না করে সুযোগ হাতছাড়া করো তাহলে এই সুযোগ আর কোনদিন আসবে না। অবসর সময় আসলেই অপ্রতিস্থাপনযোগ্য! তুমি আর কখনই এত অবসর সময় পাবে না। তাই এর সুবিধা গ্রহণ করো। অবাঞ্চিত কল্পনা এবং অন্তরের অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকো। অবাঞ্চিত আকাশ কুসুম কল্পনা তোমার সময় অপচয় করবে আর অন্তরের অনুসরণ তোমার হৃদয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এবং আমি তোমাদেরকে পরামর্শ দিই কুরআন প্রতিদিন পড়তে। আমি তোমাদেরকে পরামর্শ দিই প্রতিদিন কুরআন কমপক্ষে অর্ধ পারা করে পড়ার জন্য, যাতে দুই মাসে একবার কোরআন খতম করতে পারো।
আমি তোমাদেরকে আরও পরামর্শ দিই সকাল-সন্ধ্যায় বিভিন্ন যিকির, প্রার্থনা, দোয়া, দরূদ, সালাতে নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে নিতে। যিকির, দোয়া-দরূদ ফযরের সালাতের পরও পড়তে পারো এবং ফযর এবং এশার সালাত জামাআতের সাথে মসজিদে আদায় করো – “কেউ যদি এশার সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে সে যেন অর্ধেক রাত্র ইবাদত করল এবং সে যদি আবার ফযরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে তাহলে সে পূর্ণরাত্র সালাত পড়ার সওয়াব পাবে।”
তিরমিযীতে আরও একটি হাদীস আছে-“কেউ যদি ফযরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে, সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকির করে এবং এরপর দুই রাকাআত দোহার সালাত পড়ে সে পূর্ণ হজ্জ এবং ওমরাহ এর সওয়াব পাবে। সে হজ্জ এবং ওমরাহর পূর্ণ সওয়াব পাবে, সে হজ্জ এবং ওমরাহর পূর্ণ সওয়াব পাবে।”
তাই ফযরের সালাত মসজিদে আদায় কর। এরপর কুরআন পড়, সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর ক্ষমা অন্বেষণ করো, এরপর দোহার নামায পড়ো এবং ইউনিভার্সিটিতে যাও। তোমাদের ক্লাসের পড়া দিনে দিনেই করে ফেলবে, কোনটিই ফেলে রাখবে না। আকাশ-কুসুম অবাঞ্চিত অসংখ্য কল্পনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো যা তোমার সময়ের অপচয় ঘটায়। দিনে দিনে সব কিছুর প্রস্তুতি গ্রহণ করো। মনে রেখো, তোমার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের হিসাব তোমাকে দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত করবে। তাই ফযরের সালাত, কুরআন তিলওয়াত, ইস্তিগফার, জামাআতের নামায, সপ্তাহে দুই দিন সিয়াম, বিদ্যালয়ে ভাল-সঠিক পথের অনুসারী বন্ধুদের সাথে চলা আল্লাহর দাওয়াহ, ইসলামের দাওয়াহ পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করবে।“আল্লাহর কাছে তোমার মাধ্যমে একজন মানুষকে পথ দেখানো তোমার জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উট (অনেক দামী সম্পদ) অপেক্ষা উত্তম।” এবং আল্লাহর কাছে তুমি পরিপূর্ণ রূপে দায়বদ্ধ যে, তুমি আল্লাহর দ্বীনকে প্রচার করবে, যেহেতু আল্লাহ তোমাকে মুসলিম হিসেবে সৃষ্টি করেছেন- মানব গোষ্ঠীর মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ জাতিতে তোমার স্থান দিয়েছেন।
تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (আলে ইমরানঃ ১১০)
[১] তবে একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, আবেগকে ইসলাম দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। এখানে সেই আবেগের কথা বুঝানো হয়নি যা শরিয়াহকে অনুসরণ করে না।