পবিত্র জুমু‘আর দিনের বিস্তারিত নির্দেশনা ও ফযীলত
জুমু‘আর দিনের শ্রেষ্ঠত্ব
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমু‘আর দিন সর্বোত্তম। এই দিন হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিন তাঁকে বেহেশতে দাখিল করা হয়েছে এবং এই দিন তাঁকে বেহেশত থেকে বের করে (পৃথিবীতে পাঠিয়ে) দেয়া হয়েছে এবং জুমু‘আর দিনই কিয়ামত কায়েম হবে।
জুমু‘আর দিন গোসল করা
হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমু‘আর নামাযে যায় সে যেন গোসল করে।
জুমু‘আর দিন সুগন্ধি ব্যবহার ও মিসওয়াক করা
হাদীস: হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমু‘আর দিন যেন প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি গোসল করে, মিসওয়াক করে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সুগন্ধি ব্যবহার করে।
জুমু‘আর নামাযের ফযীলত
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমু‘আর দিন এলে মসজিদের প্রত্যেক দরজায় ফেশেতাগণ বসে যান। তাঁরা একের পর এক আগমনকারীর নাম লিপিবদ্ধ করেন। যখন ইমাম (মিম্বরে) বসে পড়েন তখন তাঁরা নথিপত্র গুটিয়ে আলোচনা শোনার জন্য চলে আসেন। মসজিদে সর্বপ্রথম আগমনকারী ব্যক্তি উট দানকারীর সমতুল্য, তারপর আগমনকারী ব্যক্তি গরু দানকারীর সমতুল্য, তার পরের জন মেষ দানকারীর সমতুল্য, এর পরের জন মুরগী দানকারীর সমতুল্য এবং তারও পরে আগমনকারী ব্যক্তি ডিম দানকারীর সমতুল্য (সওয়াব লাভ করেন)।
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন ফরয গোসলের মত ভালোভাবে গোসল করলো এবং নামাযের জন্য আগমন করলো, সে যেন একটি উট সদকা করলো। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমন করলো, সে যেন একটি গাভী সদকা করলো। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমন করলো, সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা সদকা করলো। যে চতুর্থ পর্যায়ে আগমন করলো, সে যেন একটি মুরগী সদকা করলো। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমন করলো, সে যেন একটি ডিম সদকা করলো। এরপর যখন ইমাম খুতবা প্রদানের জন্য বের হন, তখন ফেরেশতাগণ খুতবা শোনার জন্য হাযির হয়ে যান।
হাদীস: হযরত আলী রাযি. একটি লম্বা হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইমাম খুতবা দেয়া শুরু করলে যে ব্যক্তি চুপচাপ বসে শোনে সে দুইটি বিনিময় প্রাপ্ত হয়। আর যে ব্যক্তি এত দূরে বসে যে, ইমামের খুতবা শুনতে পায় না, তবুও চুপ থাকে এবং অনর্থক কথা বা কাজ না করে, সে একটি বিনিময় প্রাপ্ত হয়। আর যে ব্যক্তি এমন স্থানে বসে যেখান থেকে ইচ্ছা করলে ইমামের খুতবা শুনতে এবং তাঁকে দেখতে পায়, তবুও অনর্থক কথা বা কাজ করে এবং চুপ না থাকে, সে গুনাহগার হয়। হযরত আলী রাযি. বলেন, আমি হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমনই বলতে শুনেছি।
জুমু‘আর দিনে ছয়টি আমলের বিশেষ ফযীলত
হাদীস: হযরত আউস ইবনে আউস রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর নামাযের উদ্দেশ্যে ভালোভাবে গোসল করবে, ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে (আযানের অপেক্ষা না করে) মসজিদে যাবে, পায়ে হেঁটে যাবে, বাহনে আরোহণ করবে না, ইমামের কাছাকাছি বসবে, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনবে, (খুতবা চলাকালীন) কোন কথা বলবে না বা কাজ করবে না, সে জুমু‘আর নামাযে (যাওয়া-আসার) পথে প্রতি কদমে এক বছরের নফল রোযা ও এক বছরের নফল নামাযের সওয়াব পাবে।
জুমু‘আর নামাযে গুনাহ মাফ হয়
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি গোসল করে জুমু‘আর নামাযে এলো, তাউফীক অনুযায়ী নামায আদায় করলো, ইমামের খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলো, এরপর ইমাম সাহেবের সাথে জুমু‘আর নামায আদায় করলো, তার দুই জুমু‘আর মধ্যবর্তী দিনসমূহ এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, এক জুমু‘আ থেকে আরেক জুমু‘আ এবং এক রমযান থেকে অন্য রমযান মধ্যকার সমস্ত গুনাহের জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।
জুমু‘আর নামায ত্যাগকারীর প্রতি সতর্কবাণী
হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. ও হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তাঁরা হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর মিম্বরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, মানুষ যেন জুমু‘আর নামায ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকে। অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে মোহর এঁটে দিবেন, এরপর তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
জুমু‘আর নামাযের জন্য মসজিদে গিয়ে কাউকে উঠিয়ে তার জায়গায় বসবে না
হাদীস: হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন কেউ যেন তার ভাইকে তার বসার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে না বসে। ইবনে জুরাইয রহ. বলেন, আমি নাফে’ রহ. কে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি শুধু জুমু‘আর ব্যাপারে? তিনি বললেন, জুমু‘আ ও অন্যান্য নামাযের ব্যাপারেও।
হাদীস: হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমু‘আর দিন তোমাদের কেউ যেন তার ভাইকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে না বসে। বরং এটা বলতে পারে, জায়গা করে দাও।
জুমু‘আর দিন মসজিদে লোকজনের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে যাবে না
হাদীস: হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, জুমু‘আর দিন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলো তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। সে লোকজনের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে যেতে লাগলো। হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, বসে যাও। তুমি দেরী করে এসে লোকদের কষ্ট দিচ্ছ।
খুতবার সময় ইমামের কাছাকাছি বসা
হাদীস: হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা যিকিরের জায়গায় (জুমু‘আর মসজিদ) হাযির হও এবং ইমামের কাছাকাছি বসো। কেননা যে দূরে দূরে থাকবে, সে জান্নাতী হলেও তার জান্নাতে প্রবেশ বিলম্বিত হবে।
জুমু‘আর দিন খুতবা চলাকালীন চুপ থাকা
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইমামের খুতবা চলাকালে তুমি যদি তোমার সাথীকে বল, ‘চুপ করো’, তবে তুমি একটি অনর্থক কাজ করলে।
হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তাঁরা ইমাম বের হয়ে আসার পর অর্থাৎ মিম্বরে বসার পর কথা বলা ও নামায পড়াকে মাকরূহ বলতেন।
জুমু‘আর আগে চার রাকা‘আত সুন্নাত ও পরে চার রাকা‘আত সুন্নাত
হাদীস: হযরত আবূ আব্দুর রহমান সুলামী রহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. আমাদেরকে জুমু‘আর পূর্বে চার রাকা‘আত ও পরে চার রাকা‘আত নামায পড়ার নির্দেশ দিতেন।
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যখন জুমু‘আর নামায পড়ে সে যেন জুমু‘আর ফরযের পর চার রাকা‘আত নামায পড়ে।
জুমু‘আর পরে চার রাকা‘আত সুন্নাত পড়ে আরো দুই রাকা‘আত পড়া উচিত
হাদীস: হযরত আবূ আব্দুর রহমান সুলামী রহ. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. যখন আমাদের মাঝে (হুকুমতের পক্ষ থেকে) এলেন, তখন তিনি জুমু‘আর পরে চার রাকা‘আত পড়তেন। এরপর হযরত আলী রাযি. তাঁর খিলাফতকালে এসে জুমু‘আর পরে দুই রক‘আত ও চার রাকা‘আত (মোট ছয় রাকা‘আত) পড়তে লাগলেন। (বর্ণনাকারী বলেন, ) এটা আমাদের কাছে ভালো লাগলো। ফলে আমরা এটা গ্রহণ করলাম।
হাদীস : হযরত আলী রাযি. থেকে অপর রেওয়াতে আছে, তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা জুমু‘আর নামায পড়বে তারা যেন ছয় রাকা‘আত পড়ে।
জুমু‘আর দিন দু‘আ কবুলের সময় কোনটি?
হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর দিন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তাতে এমন একটি মুহূর্ত আছে, তখন কোন মুসলমান বান্দা নামাযরত অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে কিছু প্রার্থনা করলে অবশ্যই তিনি তাকে তা দান করেন। তিনি নিজ হাত মুবারক দিয়ে ইশারা করলেন, সেই সময়টি অল্প।
মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় আছে, সেই সময়টি হচ্ছে ইমামের (মিম্বরে) বসা থেকে নামায শেষ হওয়ার মাঝামাঝি সময়।
তিরমিযীর একটি বর্ণনায় আছে, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জুমু‘আর দিনের যে সময়ে আল্লাহর দরবারে দু‘আ কবুলের আশা করা যায়। সে সময়টিকে তোমরা আসরের পর থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত তালাশ করো। ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, জুমু‘আর দিন কাঙ্ক্ষিত দু‘আ কবুলের সময় আসরের পর এবং সূর্য হেলে যাওয়ার পর।
জুমু‘আর দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা
হাদীস: হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, দুই জুমু‘আর মধ্যবর্তী সময়ে তাকে একটি আলোকিত নূর দেয়া হবে।
হাদীস: হযরত আবূ দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা দাজ্জালের ফিতনা থেকে হিফাযত করবেন।
জুমু‘আর দিন বেশি বেশি দুরূদ শরীফ পড়া
হাদীস: হযরত আউস ইবনে আউস রাযি. থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমু‘আর দিন সর্বোত্তম। এই দিনে হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিন তাঁর ওফাত হয়, এই দিন শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে, এই দিন সব সৃষ্টিজীব বেহুঁশ হয়ে যাবে। কাজেই এই দিনে তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দুরূদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দুরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়ে থাকে। হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের দুরূদ আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে যখন আপনার দেহ মাটিতে মিশে যাবে? হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কিরামের দেহগুলোকে মাটির জন্য (বিনষ্ট করা) হারাম করে দিয়েছেন।
জুমু‘আর দিনের বিশেষ একটি দুরূদ শরীফ রয়েছে। আসরের নামাযের পর নিজ স্থানে বসে দুরূদ শরীফটি আশি বার পাঠ করা উচিত। যার ফযীলত এই যে, আমলকারীর আমলনামায় আশি বছরের ইবাদত-বন্দেগীর সওয়াব লেখা হয় এবং আশি বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। দুরূদটি হচ্ছে, اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأٌمِّيِّ وَعَلى الِه وَسَلِّمْ تَسْلِيْمًا
উল্লেখ্য, হাদীসটি যদিও দুর্বল রাবীর কারণে যয়ীফ। কিন্তু ফযীলতের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীসের উপর আমল করার অবকাশ আছে। বিধায় আশা করা যায়, এই দুরূদ শরীফটি পাঠ করলে উক্ত সওয়াব পাওয়া যাবে।