এ-নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হলো কাদিয়ানীদের রচিত গ্রন্থাদি থেকে নবুওত-দাবিটির স্বরূপ বিশ্লেষণ করা। কোনো পাঠক যদি মির্জা সাহেবের পুস্তকাদি পড়ে থাকেন, তাহলে তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দ্বিধামুক্ত হয়ে যাবেন যে, নবী-দাবি করার জন্য যে যে শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা সম্ভব, পূর্ববর্তী নবীগণ যে শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে তাদের নবুওতের সংবাদ দিয়েছেন মির্জা সাহেবও হুবহু ওই শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে নবুওত দাবি করেছেন। যারা আমাদের এই সহজ মূল্যায়নটুকু মানতে প্রস্তুত নন, তাদের বিবেকের প্রতি অনুরোধ, কী কী শব্দে ও বাক্যে নবুওত দাবি করা যেতে পারে, আপনারা ভেবেচিন্তে প্রথমে তার একটি তালিকা করুন। এরপর নবুওতের দাবি-সংক্রান্ত মির্জা সাহেবের বাক্যগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। ইনশাআল্লাহ আমাদের উপরোক্ত মূল্যায়নের যথার্থতা আপনাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে।
‘লাহোরী গ্রুপ’ কাদিয়ানীদেরই একটি অপাংক্তেয় ক্ষুদ্র অংশ। এদের মতে মির্জা সাহেব পারিভাষিক অর্থে নবী নন। বরং তিনি কেবল প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী ও ঈসা মসীহ। সুতরাং তার নবুওতের দাবিবোধক বক্তব্যগুলি এ-অর্থে প্রযোজ্য। এ-অর্থেই তিনি নিজের নবুওত দাবি করেছেন; স্বতন্ত্র নবী অর্থে নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, মির্জা সাহেব রীতিমতো পারিভাষিক নবী হওয়ার দাবিই করেছেন। এতে কোনো অস্পষ্টতা আগেও ছিলো না, এখনো নেই। অবশ্য লাহোরী গ্রুপের উপরোক্ত গোঁজামিলের কারণে কোনো কোনো সন্দেহপ্রবণ লোকের সামনে ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এমন মনে করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এই বিচ্ছিন্ন বিলুপ্তপ্রায় গ্রুপটির বক্তব্য খোদ মূলধারার কাদিয়ানী-যারা বিশ্বব্যাপী ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ নামে এই মতবাদের প্রচার ও প্রসারে ব্যতিব্যস্ত-তাদের নিকট মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং কাদিয়ানী মতবাদ বিচার্য হবে মূলধারার বক্তব্য অনুসারে। আর জানা কথা, মূলধারার কাদিয়ানীদের নিকট মির্জা সাহেবের নবুওতের বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। প্রকাশ্যেই মির্জা সাহেবকে তারা হাকীকী নবী বলে বিশ্বাস করে। মির্জা সাহেবের মাঝেও একজন নবীর সকল অপরিহার্য্য অনুষঙ্গ ও গুণাবলী বিদ্যমান বলে দাবি করে। তাদের নিঃসংকোচ দাবি হলো, মির্জা সাহেব ঐ অর্থে ঐ ধরনের নবী, যে অর্থে পূর্বেকার নবীগণ নবী, তাদেরকে যারা অস্বীকার করে, তারা যেমন কাফের এবং মুক্তির অযোগ্য, তেমনি মির্জা সাহেবের অস্বীকারকারীও কাফের, নাজাতের অনুপযুক্ত।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের পক্ষ হতে বিভিন্ন সময়ে নবুওত ও কুফরের বিষয়ে যে সমস্ত প্রচারপত্র বিতরণ হয়েছে, পত্রপত্রিকায় এ-জাতীয় যত বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়েছে এবং লাহোরী গ্রুপের জবাবে যত বই পুস্তক লেখা হয়েছে, সেগুলির মাধ্যমে তারা বড় থেকে বড় সংশয়বাদী এবং ব্যাখ্যাপ্রিয় অতি সুধারণাবাদী মানুষের জন্যও মির্জা সাহেবের পূর্ণাঙ্গ নবী-দাবির বিষয়ে কোনো ধরনের দ্বিধা বা সংশয়ের অবকাশ রাখেনি। সেই সব ডকুমেণ্ট থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ আমরা পাঠকের খেদমতে উপস্থাপন করছি।
মির্জা সাহেবের পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র নবী হওয়ার দাবি
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় ইমাম ও খলিফা, মির্জাপুত্র বশীরুদ্দীন মাহমুদ ১৯১৫ সনে ‘হাকীকাতুন নবুওয়াহ’ নামে একটি বই লিখে প্রচার করেছেন। আগেই বলা হয়েছে, তিনি এটি কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপের বিরুদ্ধে লিখেছেন এবং তাতে মির্জা সাহেবের স্বতন্ত্র-শরঈ নবী হওয়ার বিষয় ‘দালীলিক’ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বইটির প্রচ্ছদে বড় অক্ষরে লেখা আছে, ‘প্রতিশ্রুত ঈসা মসীহ-ইমাম মাহদীর নবুওত ও রেসালাত অকাট্য দলীলে প্রমাণিত।’
বইয়ের ১৮৪-২৩৩ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘দলীল-প্রমাণ’ দ্বারা মির্জা সাহেবের নবুওত প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে মূলত লাহোরী গ্রুপের মত খন্ডন করে বিশ প্রকার ‘দলীল’ দেওয়া হয়েছে। তার মাঝে সপ্তম দলীল এমন, ‘খোদ মির্জা সাহেব নিজেকে নবী ও রাসূল বলে উল্লেখ করেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে নবুওত ও রেসালাত দাবী করেছেন’।
বইটির কিছু কিছু বক্তব্য আমরা আমাদের পাঠকের সামনেও তুলে ধরছি। এগুলি আমরা মির্জা সাহেবের মূল কিতাবেও পড়েছি। এখানে আলোচ্য বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছি।
১. আমি ঐ আল্লাহর কসম করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং আমাকে ‘নবী’ বলে নাম দিয়েছেন। (হাকীকাতুন নুবুওয়াহ, পৃ. ৬৮)
২. আল্লাহর হুকুম অনুসারে আমি একজন নবী। (‘আখবারে আম’ পত্রিকায় ২৬ মে ১৯০৮ঈ.তে প্রকাশিত মির্জা সাহেবের সর্বশেষ চিঠি)
৩. আমাদের দাবি হলো, আমি নবী ও রাসূল। (বদর, ৫ মার্চ ১৯০৮ঈ.)
৪. সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীতে ভূমিকম্প হওয়া এবং নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়া আমার নবুওতের নিদর্শন। স্মরণ রাখা উচিৎ, পৃথিবীর এক এলাকাতে আল্লাহর কোনো রাসূলকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করা হলে অন্য এলাকার অপরাধীরাও তখন পাকড়াও-এর শিকার হয়। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ১৬২)
৫. বিভিন্ন এলাকায় শতশত পাহাড়ী মানুষ ভূমিকম্পের আঘাতে হতাহত হয়েছে। তাদের কী অপরাধ ছিলো! কোন্ জিনিসকে তারা মিথ্যা মনে করতো! সুতরাং মনে রাখতে হবে, যখন আল্লাহর কোনো নবীকে অস্বীকার করে মিথ্যুক বলার অপচেষ্টা করা হয়, তা বিশেষ কোনো সম্প্রদায় করুক অথবা বিশেষ কোনো ভূখন্ডের অধিবাসীরা করুক, আল্লাহ তাআলা তখন ব্যাপক আজাব ও শাস্তি নামিয়ে দেন। (হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৮-৯)
৬. আল্লাহ তাআলা তাঁর নিয়ম অনুযায়ী কোনো নবী প্রেরণ করার আগ পর্যন্ত আজাব মূলতবি করে রাখেন। … এখন সে নবীর আগমন হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে অপরাধের শাস্তি দান করার সময়ও এসে গেছে। (তাতিম্মা হাকীকাতুল ওহী, পৃ. ৫২)
৭. কঠিন আযাব কেবল তখনি আসে, যখন নবীর আগমনের পরও তাকে অস্বীকার করা হয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, (অর্থ) আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেই না, যতক্ষণ না (তার কাছে) কোনো রাসূল পাঠাই।’-সূরা বনী ইসরাঈল, (১৭) : ১৫
তাহলে আসল বিষয়টা বুঝতে এত বিলম্ব কেন যে, পুরো দেশ দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে পরিণত হয়েছে, একের পর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ওহে বেখবর! খোঁজ নিয়ে দেখ, তোমাদের মাঝে আল্লাহ তাআলা হয়ত কোনো নবী পাঠিয়েছেন, যাকে তোমরা অস্বীকার করে চলেছ! (যার ফলে এ-সমস্ত দুর্যোগ তোমাদের পিছু ছাড়ছে না)-তাজাল্লিয়াতে এলাহিয়া, পৃ. ৮-৯
৮. আল্লাহ তাঁর নবীকে বিনা সাক্ষ্যে ছেড়ে দিতে চাননি।-দাফেউল বালা, পৃ. ৮
৯. আল্লাহ তাআলা ‘কাদিয়ান’ অঞ্চলকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা করবেন। কেননা এটি তার প্রিয় রাসূলের বিচরণ ক্ষেত্র!-প্রাগুক্ত, পৃ. ১০
১০. প্রকৃত খোদা তিনি, যিনি কাদিয়ানে আপন রাসূলকে প্রেরণ করেছেন। (দাফেউল বালা, পৃ. ১১; মির্জা মাহমুদকৃত হাকীকাতুন নুবুওয়াহ-এর সূত্র অবলম্বনে, পৃ. ২১২, ২১৪)
মির্জা সাহেব এগুলি নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। পাঠক! ইনসাফের সাথে ভেবে দেখুন এবং এসব বাক্যে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ আছে কি না নিজেই বিচার করুন।
তাছাড়া মির্জা সাহেব যে সমস্ত কথাকে ইলহাম অর্থাৎ ঐশী নির্দেশনা বলে চালিয়ে দিয়েছেন, সেখানেও শত জায়গায় কোনো প্রকার রাখঢাক ব্যতিরেকে নিজেকে তিনি নবী ও রাসূল বলে উল্লেখ করেছেন। আর মির্জাপুত্র মাহমুদ তার বইয়ে সেসব ইলহাম থেকে ৩৯টিকে পিতার নবুওতের স্বতন্ত্র ‘দলীল’রূপে একত্রিত করে দিয়েছেন। কৌতূহলী পাঠকের জন্য আমরা এখানে ১০টি ইলহাম তুলে ধরছি।
১. তিনিই আল্লাহ, যিনি তার রাসূল (কাদিয়ানী)কে হেদায়াত, সত্য ধর্ম ও ‘চরিত্র-সংশোধনী’ দিয়ে পাঠিয়েছেন।
২. আমি রাসূলের সঙ্গে উঠবো এবং তিনি যাকে তিরস্কার করবেন, আমিও তাকে তিরস্কার করবো।
৩. আমি রাসূলের সঙ্গে উত্থিত হবো আর ভাঙবো ও রুখবো।
৪. দুশমন বলবে, তুমি প্রেরিত পুরুষ নও। সত্ত্বর তাকে আমি নাকে ও শুঁড়ে (রশি লাগিয়ে) ধরবো।
৫. রাসূলের সঙ্গে আমি উঠবো এবং যার নিন্দা তিনি করবেন, আমি তার নিন্দা করবো।
৬. আমি রাসূলের সঙ্গে অবস্থান করবো এবং সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছুতেই আমি পৃথিবী ত্যাগ করবো না।
৭. আমি থাকবো নবীর সাথে, তিনি যেখানে আমিও সেখানে।
৮. আমি অবস্থান করবো কেবল রাসূলের সঙ্গে।
৯. আহমদ (কাদিয়ানী)কে আমি একটি কওমের নিকট প্রেরণ করলাম। কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, এ তো নিকৃষ্টতম মিথ্যুক!
প্রিয় পাঠক! (এ ইলহামগুলো আরবীতে লেখা হয়েছে) যাদের মোটামুটি আরবী ভাষাজ্ঞান আছে, তারাই মূল আরবীটা পড়লে এর অর্থহীনতা এবং অন্তসারশূন্যতা আঁচ করতে পারবেন (অবশ্য অনেক খেটেখুটে বাক্যগুলির বাংলা তরজমা যথাসম্ভব অর্থপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে)। আর এগুলিকেই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ ওহী ও ইলহাম বলে প্রচার করাটা যে কত বড় মূর্খতা ও নির্লজ্জ মিথ্যাচার তাও আপনি অনুমান করতে পারবেন। বাক্যগুলির ভাষাগত মান এবং ব্যাকরণিক ত্রুটির বিষয়ে এখন কোনো আলোচনা তুলতে চাই না। মির্জা সাহেবের ওই বক্তব্যগুলো সেরেফ এজন্য নকল করেছি যে, তিনি নবুওত দাবি করেছেন এবং বলেছেন, এগুলো আমার উপর নাযিলকৃত ওহী ও ইলহাম। যাতে আমাকে নবী ও রাসূল বলে অভিহিত করা হয়েছে। মির্জা সাহেবের আরেকটি ইলহাম পড়ুন-
১০. দুনিয়াতে একজন নবী আসলেন। কিন্তু পুরো দুনিয়ার তেমন কেউ তাকে গ্রহণ করলো না। অবশ্য আল্লাহ তাকে গ্রহণ করে নেবেন এবং জোরালো হামলা ও আক্রমণের মাধ্যমে তার সত্যতা প্রকাশ করবেন।
মির্জা মাহমুদ তার কিতাবে এ জাতীয় ইলহাম উদ্ধৃত করার পর লিখেছেন-
‘এখন এত ইলহাম বিদ্যমান থাকতেও কী করে প্রতিশ্রুত (কাদিয়ানী) মসীহকে নবী মানতে দ্বিধা করবেন? আল্লাহ তো এক দু’বার নয়, শত শত বার তাঁকে নবী নামে স্মরণ করেছেন। এই ক্ষেত্রসমূহের সবগুলিতেই কি আপনি বক্র ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বলবেন, তিনি নবী নন, নবীগণের কোনো কোনো গুণ কেবল তার ভিতর পাওয়া যায়? পৃথিবীর আর কারো ব্যাপারে কি এমনটা ঘটতে দেখা গেছে?-যাকে আল্লাহ পাক অসংখ্যবার নবী বলেছেন, অথচ বাস্তবে তিনি নবী নন?
‘সকল নবীকে তো আমরা এজন্য নবী বলে স্বীকার করি যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নবী বলেছেন। তাহলে যে আল্লাহ মুসাকে নবী বলেছেন বলে আমরাও তাকে নবী বলছি, ঈসাকে বলেছেন তো তাকেও বলছি, সেই আল্লাহই যখন আমাদের (কাদিয়ানী) মসীহকে নবী বলছেন, তখন আমরা বলে বসছি তিনি নবী নন! এটা কেমন দ্বিমুখী আচরণ!! নবী বানানোর জন্য এমন কোনো শব্দ বাকি থাকলে পেশ করুন, যদ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, পূর্ববর্তী নবীদেরকে এইভাবে নবী বলা হতো, আর আমাদের মসীহকে বলা হয়েছে অন্যভাবে। সুতরাং তিনি নবী নন!’
‘আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে একিনী ও সুনিশ্চিত ওহী সত্ত্বেও কি হযরত (কাদিয়ানী) মসীহের নবুওত অস্বীকার করা সম্ভব? তাঁকে অস্বীকার করলে পূর্ববর্তী নবীদেরও অস্বীকার করা ছাড়া কোনো গতি নেই। কারণ, হযরত মুসা ও ঈসা মসীহের নবুওত যে সমস্ত শব্দে ও দলীলে প্রকাশ পেয়েছে এবং প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিশ্রুত (কাদিয়ানী) মসীহের নবুওত সম্পর্কে তার চেও স্পষ্ট শব্দের মজবুত দলীল মজুদ আছে। সে সকল দলীল সত্ত্বেও হযরত মসীহ কাদিয়ানী যদি নবী না হন, তাহলে বলতে হবে পৃথিবীতে আসলে আজ পর্যন্ত কোনো নবীই আসেননি।’ (হাকীকাতুন নুবুওয়াহ, পৃ ২০০)
পূর্বে যেমনটা বলা হয়েছে, নবুওত দাবির ব্যাপারে মির্জা সাহেবের বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই এবং কোনো ব্যাখ্যারও অবকাশ নেই। কিন্তু কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপ এ-পর্যন্ত যত ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে, সেটা শুধু তাদের দুর্ভাগ্যের প্রমাণ বহন করে। ওই গ্রুপের নেতা মুহাম্মদ আলী এবং খাজা কামালুদ্দীন যথেষ্ট লেখাপড়া জানা মানুষ। তা সত্ত্বেও এরা ভুল এবং সম্পূর্ণ ভুল কিছু বিষয় মানতে হবে বলে গোঁ ধরে আছে। ফলে তাদের পড়াশোনা ও আকল বুদ্ধি তাদের কোনো কাজে আসছে না। আসলেই আল্লাহ তাআলার তাওফীক না হলে মানুষ এমন বিভ্রান্তিতে পড়ে থাকে। তাঁর বিশেষ মদদ ছাড়া যে কেউ কখনো হেদায়েতের আলো পেতে পারে না -এ দুই ব্যক্তি তার বাস্তব উদাহরণ।
যাইহোক, আমরা পূর্ণ নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ও আমানতদারির সঙ্গে পড়াশোনা করে যা বুঝেছি তা হলো, মির্জা সাহেবের পূর্ণ নবুওত দাবি করার বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি কাদিয়ানীদের সম্পর্কে কম পড়াশোনা করে থাকে, কিংবা মির্জা সাহেবেরই অন্যান্য অষ্পষ্ট ও দ্বিমুখী বক্তব্যের ফেরেব বুঝতে না পারে, অথবা কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপের আরোপিত ব্যাখ্যার খপ্পরে পড়ে থাকে, তাহলে তার কাছে বিষয়টিতে কিছু ব্যাখ্যার অবকাশ আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মির্জা মাহমুদের এবং কাদিয়ানীদের মূলধারার সবাই মির্জা সাহেবের নবুওতের ব্যাপারে অনড় এবং তাদের খোলামেলা বক্তব্য হলো, আমরা মির্জা সাহেবকে ঐ অর্থে নবী মনে করি, যে অর্থে কুরআন-হাদীসে পূর্ববর্তী নবীদেরকে নবী বলা হয়েছে। তারা তাদের এই আকীদার উপর দলীল দিয়ে থাকে, মুসলমানদের সাথে মুনাযারা বা বিতর্ক অনুষ্ঠান করে থাকে, এ সকল লোকের আকীদার ব্যাপারে তো সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। ন্যায়বান সমঝদার মানুষের জন্য পূর্বের আলোচনাটুকুই যথেষ্ট। তবু আরও কিছু বক্তব্য ‘হাকীকাতুন নুবুওয়াহ’ থেকে তুলে ধরছি।
১. তিনি নবী। আল্লাহ পাক এবং তাঁর রাসূল ঐ শব্দেই তাকে নবী বলেছেন, যে শব্দে পূর্ববর্তী নবীদেরকে নবী বলা হয়েছে। (পৃ. ৫০)
২. সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে, প্রতিশ্রুত মির্জা মসীহ কোরআনিক নবী, আভিধানিকভাবেও নবী। (পৃ. ১১৬)
৩. অতএব শরীয়তে নবী বলতে যা বোঝায় হযরত মির্জা সাহেবের ক্ষেত্রে ঐ অর্থ নিলে তিনি হাকীকী নবীই হন, রূপক নবী নন। (পৃ. ১৭৪)
৪. নবুওতের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মির্জা সাহেবকে পূর্ববর্তী নবীদের মতোই নবী বলে মান্য করি। (পৃ. ২৯২)
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এক সময় নিজের নবুওতের দাবি অস্বীকারও করেছেন। কখনো নিজেকে আংশিক বা অপূর্ণ নবী বলেছেন। আবার কখনো তার নবুওতকে ‘মুহাদ্দাছ’ তথা ইলহামী বলে ভেলকি লাগিয়েছেন। লাহোরী গ্রুপ মির্জা সাহেবের এ সমস্ত বক্তব্য অবলম্বন করে অন্যান্য স্পষ্ট বক্তব্যগুলির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। মির্জা মাহমুদ তার বইয়ে এ জাতীয় বক্তব্যের উপর লম্বা আলোচনা করে লিখেছেন-
‘১৯০১ সন পর্যন্ত মির্জা সাহেবের ধারণা ছিলো, আমার নবুওত আংশিক এবং অপূর্ণ। এর দ্বারা সম্ভবত তিনি তার নবুওতের ‘মুহাদ্দাছ’ (ইলহামনির্ভর) হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু ১৯০১ সনে আল্লাহ পাকের ওহী তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো যে, তার নবুওত আংশিক নয়। বরং তার নবুওত ঠিক তেমনি, যেমন ছিলো পূর্ববর্তী নবীদের। সুতরাং এরপর থেকে আকীদা বদলে গেলো, পরবর্তীতে কখনো তিনি নিজের নবুওতকে আংশিক বা অপূর্ণ বলেননি।’
মির্জা মাহমুদ এ সম্পর্কে যে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন তাতে অর্থহীন কথাবার্তা এবং বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি প্রচুর। পাঠকের সামনে তার কিয়দাংশ পেশ করা হচ্ছে।
১. যে সমস্ত কিতাবে তিনি নবী হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন, অথবা নিজের নবুওতকে আংশিক বা অপূর্ণ বলেছেন, কিংবা মুহাদ্দাস তথা ইলহামপ্রাপ্তদের নবুওত বলে উল্লেখ করেছেন, ব্যতিক্রমহীনভাবে তার সবই ১৯০১ সনের পূর্বে রচিত কিতাব। ১৯০১ সনের পর রচিত কোনো কিতাবে তিনি নিজের নবুওতকে আংশিক, অপূর্ণ বা ইলহামী বলে আখ্যায়িত করেননি। (পৃ. ১২০)
২. ১৯০১ সনের পূর্বের যে সকল সূত্রে দেখা যাচ্ছে তিনি নবুওত অস্বীকার করেছেন, তার সবই এখন মানসূখ হয়ে গেছে। সেগুলো এখন দলীলযোগ্য নয়। (পৃ. ১২১)
৩. (১৯০১ সনের) পূর্বেও তাকে নবী বলে ডাকা হতো। কিন্তু তিনি এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতেন। কিন্তু যখন বারবার আল্লাহ পাক তাকে নবী ও রাসূল বলে সম্বোধন করলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমি বাস্তবেই নবী। নবী ছাড়া অন্য কিছু নই। প্রথম প্রথম তিনি যাই ভেবে থাকুন, তার ইলহাম (ঐশী নির্দেশনা)-এর মাঝে নবী শব্দ প্রায়ই আসে। এটি তার নবুওতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট। ভিন্ন অর্থের অপেক্ষা রাখে না। (পৃ. ১২৪)
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, মির্জা মাহমুদ তার কিতাবে পিতার নবুওতের বিষয়ে ২০ প্রকার দলীলের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এবার সেগুলোর উপর একটু নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক।
১. যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম ও ইয়াকুব, মুসা ও ইউসুফ, ঈসা ও নূহকে (আ.) নবী বলে ডেকেছেন, তেমনিভাবে আমাদের প্রতিশ্রুত মসীহ কাদিয়ানীকেও আল্লাহ পাক নবী বলে সম্বোধন করেছেন। কুরআনে তাকে রাসূল বলে সম্বোধন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, অর্থ : ‘‘আমি (ঈসা) সেই রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন এবং যার নাম হবে আহমদ। (৬১ : ৬) আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, আগত মসীহকে আল্লাহ তাআলা নবী বলেছেন। সুতরাং কুরআনে যাকে রাসূল বলা হয়েছে, তার নবুওত ও রেসালাতের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হওয়ার সুযোগ কোথায়? অন্য নবীগণকে তো আমরা এই ভিত্তিতে নবী বলি যে, আল্লাহ তাআলা তাদের নাম নবী রেখেছেন। সুতরাং প্রতিশ্রুত মসীহকে কেন নবী বলা হবে না? তার নামও তো কুরআনে এসেছে! যদি হযরত মুসা ও ঈসা নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের কাদিয়ানী মসীহও নবী। তিনি যদি নবী না হন, তাহলে ঈসাও নবী নন। কারণ উভয়ের নবুওতের সাক্ষী একই কুরআন, একই কিতাব। (পৃ. ১৮৮) (পাঠক! কাদিয়ানীর নাম ‘গোলাম আহমদ’; আহমদ নয়!)
২. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী নামে স্মরণ করেছেন। নাওয়াস ইবনে সামআনের হাদীসে তাঁকে নবী-উল্লাহ বলে ডেকেছেন। সুতরাং প্রতিশ্রুত মসীহের নবুওতের বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষী। কুরআনে কারীমেও আল্লাহ পাক তাকে রাসূল বলেছেন। অর্থ : ‘‘তিনিই তো নিজ রাসূলকে হেদায়েতসহ প্রেরণ করেছেন।’’ ৯ : ৩৩ আয়াতে মির্জা মসীহের নবুওতের (?) ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে! সুতরাং নবীজী যার নবুওতের বিষয়ে সাক্ষ্য দেন, কোনো মুমিনের জন্য তার নবুওত অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। (পৃ. ১৮৯-১৯০)
৩. মির্জা মসীহ মাওউদের নবী হওয়ার উপর পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষ্য বিদ্যমান আছে। সবচে পুরানো সাক্ষ্য হলো প্রাচীন পারসিক নবী যরথ্রুস্টের। তারপর হিন্দু অবতার শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষ্য। তৃতীয় সাক্ষ্য ইসরাঈলী নবী দানিয়ালের।
আর ‘তালমুদ’ কিতাবেও তার নবুওতের উল্লেখ আছে। (পৃ. ১৯৭)
‘সকল ন্যায়বান ও সত্য গ্রহণে প্রস্ত্তত ব্যক্তিদের নিকট প্রশ্ন, সুস্থ বিবেক কি এটা কখনো মানতে পারে যে, এক ব্যক্তির নবুওতের উপর হাজার বছর পূর্বে নবীগণও সাক্ষ্য দিয়ে চলেছেন। তবু সেই ব্যক্তিকে আমরা নবী বলে মেনে নেবো না? মির্জা মসীহ মাওউদ সম্পর্কে যত জায়গায় নবী হওয়ার কথা এসেছে সব জায়গাতেই কি ব্যাখ্যা করে বলবো যে, নবী দ্বারা হাকিকী নবী উদ্দেশ্য নয়, বরং বিশেষ কোনো সাদৃশ্যের কারণে মির্জা মসীহকে নবী বলে দেওয়া হয়েছে? এও কি সম্ভব? ব্যাখ্যা বা তাবিলের তো একটা সীমা থাকা চাই!’
‘আমি পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলছি, যে কেউ মুক্তভাবে স্বাভাবিক নিয়মে এ বিষয়ে চিন্তা করবে, তার কাছেই মির্জা মসীহের নবুওতের বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে যাবে। এর বিপরীত বক্তব্যের অসারতাও তার সামনে খুলে যাবে।
‘কী করে সম্ভব, কুরআনে যার নাম ‘নবী’ রাখা হয়েছে; নবীজী, শ্রীকৃষ্ণ, যরথ্রুস্ট, দানিয়াল হাজার বছর পূর্ব থেকে যাকে নবী আখ্যা দিয়ে আসছেন, এতদসত্ত্বেও তিনি নবী নন! এতসব সাক্ষ্যসাবুদের পরও একজন ‘গায়রে নবী’ গায়রে নবী-ই রয়ে যাবেন? এ কেমন কথা!’
‘পূর্ববর্তী নবী ও কিতাবসমূহের বক্তব্য না হয় বাদ দিলাম। কুরআন মাজীদ ও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদগুলোর কী হবে? এখানেও কি তাবীল বা ব্যাখ্যার চোরা পথ এখতিয়ার করা হবে? তাবীল করতে হলে নিজেদের অনুমান ও ধারণার তাবীল করাই কি অধিক নিরাপদ নয়? কেন অকারণে এ সমস্ত মজবুত দলীল ও বাস্তবতাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার এই অপচেষ্টা? (হাকীকতুন নবুওয়াহ পৃ. ১৯৮-১৯৯)
মির্জা মাহমুদের এই প্রগলভতার মাঝেই কথা শেষ নয়। এ সম্প্রদায়ের তার্কিকেরা ‘এজরায়ে নবুওত’ তথা নবুওতের দরজা অবারিত থাকার বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান করে বেড়ায়। বক্তারা গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে বক্তৃতার ‘ফুলঝুরি’ ছড়ায়। এদের বক্তব্য যারা শুনেছেন, তারা জানেন, নবীজীর উপর নবুওতের সিলসিলা ‘খতম’ না হওয়া বরং নবীজীর পরও নবুওতের ধারা অব্যাহত থাকার বিষয়ে এরা কী পরিমাণ মেধা ব্যায় করে থাকে এবং কতটা শক্তি ক্ষয় করে থাকে? আর খতমে নবুওত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসমূহের কেমন বিকৃতি সাধন করে থাকে এবং মির্জা সাহেবের নবুওত প্রমাণে কতটা গলদঘর্ম হয়ে থাকে সেটাও এক ধরনের ‘উপভোগ্য’ বিষয়!
মোটকথা ‘এজরায়ে নবুওত’ হলো কাদিয়ানী ধর্মমতের ‘ইলমুল কালাম’ বা দর্শনশাস্ত্রের একটি মৌলিক বিষয়। এরই উপর ভিত্তি করে কাদিয়ানীরা মির্জার নবুওত অমান্যকারী সকল মুসলমানকে কাফের বলে থাকে!
মির্জার নবুওত অস্বীকারকারীরা কি কাফের?
কাদিয়ানীর খলীফা মির্জা মাহমুদ ‘হাকীকাতুন নবুওয়াহ’ লেখার চার বছর পূর্বে ১৯১১ সনে ‘তাশহীযুল আযহান’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। সেখানে তার একেবারে নিঃসংকোচ ও সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিলো, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমান্যকারী ইহুদী-খৃস্টানরা যেমন কাফের, এই যামানায় মির্জা সাহেবের নবুওত অস্বীকারকারীরাও তেমনি কাফের। মির্জা মাহমুদ বিষয়টিকে পিতার বক্তব্য দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন! ডা. আব্দুল হাকীম, যিনি প্রথমে ধোকা খেয়ে কাদিয়ানী ভক্ত হয়ে পড়েন। পরে আবার কঠিন কাদিয়ানী বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাকে লেখা মির্জা কাদিয়ানীর একটি পত্রও ঐ পুস্তকে স্থান পেয়েছে। তাতে আছে, ‘আল্লাহ আমাকে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং যার কাছে আমার খবর পৌঁছেছে, অথচ আমাকে সে মেনে নেয়নি, সে মুসলমান নয়।’
পত্রের উদ্ধৃতি শেষে মির্জা মাহমুদ লিখেছেন, ‘এই পত্র থেকে কয়েকটি বিষয় অনুমিত হয়। মির্জা সাহেবের ইলহাম হয়েছে যে, যার নিকট আমার দাওয়াত পৌঁছালো, আর সে ঐ দাওয়াত ফিরিয়ে দিলো, সে মুসলমান নয়। যারা মির্জা সাহেবের দাওয়াত কবুল না করে উল্টো তাকে কাফের বলার চেষ্টা করেছেন, কাফের শুধু তারা নয়, বরং শুধু গ্রহণ না করাই কাফের হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (তাশহীযুল আযহান, পৃ. ১৩৫)
বইটিতে আরো আছে, ‘যখন সুদূরে তিববত ও সুইজারল্যান্ডের লোকেরা নবীজীকে না মানার কারণে কাফের, তখন কাছের হিন্দুস্তানীরা মির্জা সাহেবের নবুওত অস্বীকার করে মুমিন থাকে কেমন করে? মির্জা সাহেবের বিরোধিতা সত্ত্বেও যদি মুসলমান মুসলমানই রয়ে যায়, তাহলে তাকে প্রেরণ করার ফায়দাই বা কী?’ (প্রাগুপ্ত, পৃ. ১২২)
এই কারণে কাদিয়ানীদের জন্য মুসলমানদের পেছনে নামায পড়া, তাদের নামাযে জানাযায় অংশ নেওয়া, তাদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি বিষয় যেমনিভাবে অমুসলিমগণের সঙ্গে নিষিদ্ধ, তেমনি মুসলিমগণের সঙ্গেও নিষিদ্ধ। এটা তাদের প্রসিদ্ধ মাসআলা। এর উপরই তাদের আমল। কাদিয়ানী ‘ইয়ার বুওয়াহ’ গ্রুপ এই মাসআলায় কোনো বর্ণচোরা ভাব দেখায়নি। তারা তাদের মত সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। এটা প্রশংসার বিষয়। যদিও অন্যরা বিষয়টাকে গোলমেলেই রেখে দিয়েছে।
পাঠক! ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ বা ‘আহমদিয়া মুসলমান’ নামে পরিচয় দানকারী কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের খতমে নবুওত অস্বীকারের বিস্তারিত বিবরণ আমরা আপনার সামনে তুলে ধরেছি। তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, এরা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে ভিন্ন এক নবীর
অস্তিত্ব স্বীকার করে। সুতরাং এদেরকে মুসলমান বলার অর্থ হবে এটা মেনে নেওয়া যে, ইসলামে নতুন নবী আসার এবং তার উপরও ঈমান আনার সুযোগ রয়েছে। জানা কথা, কোনো মুমিনের পক্ষে এমন বিভ্রান্তিকর কুফরী আকীদা মেনে নেওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। কেননা আমরা জানি, খতমে নবুওতের বিষয়টি যুগপরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত, স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনস্বীকৃত আকীদা। মুসলমান হতে হলে এ আকীদা বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে হয়। এমন কোনো ভিন্ন ব্যাখ্যাও দাঁড় করানো চলে না, যার কারণে যুগযুগের সর্বজনগ্রাহ্য মর্ম ওলট পালট হয়ে যায়।
আকীদায়ে খতমে নবুওতের বিশেষ একটি ফায়দা
‘খতমে নবুওত’ আল্লাহ পাকের একটি হুকুম। এই বিবেচনায় সেটা আমাদের অবশ্যই মান্য সন্দেহ নেই। কিন্তু আকীদায়ে খতমে নবুওত এই উম্মতের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় দান ও মেহেরবানিও বটে। সেই দিক বিবেচনা করেও এই আকীদা হেফাজতের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া উচিৎ।
ইতিহাস সাক্ষী, নতুন নবীর আগমন উম্মতের জন্য কত কঠিন পরীক্ষার মুহূর্ত নিয়ে আসে! পূর্বের নবীর অনুসারীদের ক’জন নতুন নবীর উপর ঈমান আনতে পারে? শেষ দিকের নবী ঈসা আলাইহিস সালামের কথাই ধরুন। মৃতকে জীবিত করার মতো শক্তিশালী মোজেযা নিয়ে তিনি তাশরীফ এনেছেন। কিন্তু মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণের দাবিদার বহু ভ্রান্ত ইহুদী তাকে অস্বীকার করে অভিশপ্ত ও জাহান্নামের ইদ্ধনে পরিণত হয়েছে। এরপর যখন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন হলো, কত কত মোজেযা ও সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী প্রকাশ পেলো, তখন ইহুদী-খৃস্টান তথা পূর্ববর্তী নবী ও আসমানী কিতাবের অনুসারীদের শতকরা কতজন ঈমানের দৌলত অর্জন করে ধন্য হলো? আর কতজন অস্বীকার করে চির জাহান্নামীদের কাতারভুক্ত হয়ে গেলো? এটা ভেবে দেখার মতো বিষয়। সুতরাং আল্লাহ পাক খতমে নবুওতের মাধ্যমে এই উম্মতের প্রতি ইহসান করলেন এবং উম্মতকে এই পরীক্ষা থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।
আমাদের নবীজীর পরও যদি নতুন কোনো নবীর আগমন হতো, তাহলে অতীত উম্মতের যে করুণ অবস্থা হয়েছে, আমাদের অবস্থাও তাই হতো, অর্থাৎ নবীজীর খুব কম সংখ্যক উম্মত নতুন নবীর উপর ঈমান আনতো। অধিকাংশ উম্মতই তাকে অস্বীকার করতো। পরিণামে কাফের হয়ে যেতো। সুতরাং খতমে নবুওতের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য এই ধরনের কুফরে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থেকে আল্লাহ পাক এই উম্মতকে হেফাজত করে রেখেছেন। উম্মতকে নিশ্চিন্ত করে দিয়েছেন যে, আমার এই নবী মুহাম্মদের উপর ঈমান আনো এবং তার দেওয়া হেদায়াতের অনুসরণ করো। এতেই তোমরা কামিয়াব হয়ে যাবে।
আসলে খতমে নবুওত শুধু একটি আকীদাই নয়, বরং এটি আল্লাহ পাকের এই সিদ্ধান্তের শিরোনাম যে, এখন সমগ্র মানবজাতির মুক্তির একমাত্র শর্ত হলো আমার এই নবী মুহাম্মাদের উপর ঈমান আনা এবং তাঁর নির্দেশনাবলি পালন করা। তাই কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের নিশ্চিন্ত মনে তাঁরই অনুসরণ করা কর্তব্য। মানুষের হেদায়েত ও দিকনির্দেশনার জন্য এটা আমার শেষ সিদ্ধান্ত।’
এবার যে ব্যক্তি নতুন নবুওতের দাবি তুলবে অথবা নবী আগমনের সুযোগ বের করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাবে, সে মূলত আল্লাহ তাআলার প্রতিষ্ঠিত এই দ্বীনী নেযাম ও ব্যবস্থাপনাকে বিনষ্ট করার পাঁয়তারায় লিপ্ত হবে। এটা অন্যান্য আকীদাগত গোমরাহী থেকে ভিন্ন। এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম ভাবার মতো। কেননা নতুন নবী আগমনের অর্থ হলো তার উপর ঈমান আনা নাজাত ও মুক্তির জন্য শর্ত! দ্বীনের বিভিন্ন নেযাম ও বিধানের মাঝে পরিবর্তন অনিবার্য! যে তাঁকে মানবে না, সে অভিশপ্ত! আলোচ্য ক্ষেত্রে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যদি নবী হয়, তাহলে মুক্তির জন্য শর্ত হলো তার উপর ঈমান আনা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নয়। কাদিয়ানী সম্প্রদায় এমনটাই বিশ্বাস করে। কত মারাত্মক ব্যাপার চিন্তা করা যায়?
সুতরাং যারা দ্বীন ও ধর্মের মাঝে এত বড় হাঙ্গামা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে এবং আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত সর্বশেষ সুস্থিত এই দ্বীনী নেযামকে নস্যাৎ করে দিতে চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য নাস্তিক-মুরতাদের চেও কঠোর অবস্থানে থাকা মুমিনদের একান্ত কর্তব্য। আর যারা ইসলামী ইতিহাসের কিছু খবরাখবর রাখেন, তারা জানেন, উম্মতের সকল যুগে এদেরকে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি; বরং কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে। নবীজীর জীবদ্দশাতেই মুসাইলামা নামের এক ব্যক্তি নবুওত দাবি করেছিলো। হযরত আবু বকরের খেলাফতকালে সাহাবায়ে কেরাম তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, সেটা এজাতীয় সমস্যা সমাধানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(আল ফুরকান ১৯৭৪ এর অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত)
শাওয়াল ১৪৩৪ . আগস্ট ২০১৩
মাসিক আলকাউসার