কাশ্মীরিদের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক পুরনো, কিন্তু বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পূর্বাপর পরিস্থিতি কাশ্মীরের জনসাধারণকে প্রতিবাদী করে তুললেও তাঁদের সে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামে রূপ নেয় মূলত আশির দশকের শেষ দিকে।
কাশ্মীরিদের বঞ্চনার ইতিহাস
পৃথিবীর স্বর্গ খ্যাত অপরূপ এ উপত্যকায় খ্রিষ্টাব্দ অষ্টম শতাব্দীতে ইসলামের আগমন ঘটে তারপর কালের পরিক্রমায় পুরো উপত্যকাই একসময় মুসলিম অধ্যুষিত হয়ে ওঠে। ১৫৮৬ সালে মোঘল সম্রাট আকবরের সময় কাশ্মীর মোঘল সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগিরের সময়কাল অবধি দুর্দণ্ড প্রতাপে তা পরিচালিত হয় মোঘল শাসকদের হাতে। আওরঙ্গজেবের ইন্তেকালের পর এখানে মোঘল কর্তৃত্ব দুর্বল হতে শুরু করে এবং ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে আফগান শাসক আহমদ শাহ দুররানি কাশ্মীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখ রাজা রঞ্জিত সিং মুসলিম অধ্যুষিত এ ভূমি দখল করে নেন এবং এর মধ্য দিয়েই মূলত কাশ্মীরি মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাসের সূচনা হয়। সাতাশ বছরের শিখ শাসনে পর্যুদস্ত হয় এ জনপদ। গরু জবাই নিষিদ্ধের পাশাপাশি ভারী করের বোঝা চাপানো হয় কাশ্মীরি মুসলমানদের ওপর। হাজার হাজার মানুষ জুলুমের আতিশয্যে ঘরবাড়ির মায়া ত্যাগ করে হিজরত করতে বাধ্য হয়।
১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ-শিখ যুদ্ধের পর দুপক্ষের মধ্যে অমৃতসার চুক্তি সাক্ষরিত হলে কাশ্মীর চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কিন্তু চতুর কোম্পানি এ অঞ্চল নিজেদের কাছে না রেখে পাশ্ববর্তী জম্মু অঞ্চলে তাদের আজ্ঞাবহ দোগরা শিখ শাসক গুলাব সিংয়ের কাছে ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। আর এর মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় আজকের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য।
উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন বিলুপ্তির আগ অবধি জম্মু-কাশ্মীর দোগরাদের শাসনাধীন ছিল বটে, কিন্তু এর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো ইংরেজদের হাতেই। প্রায় ১শো বছরের দোগরা শাসনে মুসলমানরা কেবল পর্যুদস্তই হয়েছে, যা ছিল পূর্বকার শিখ শাসনের ধারাবাহিকতা এবং সম্প্রসারণ। মুসলমানদের জন্য শিক্ষাদীক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না, সরকারি কাজে তাদেরকে বেগার খাটানো হতো। বিনা মূল্যে সরকারি কাজ করে দিতে বাধ্য করা হতো মুসলিম জনসাধারণকে। চাষীদের কাছ থেকে এতো বেশি রাজস্ব আদায় করা হতো যে রাজস্ব আদায়ের পর তাদের কাছে খেয়ে পরে বাঁচার মতো শষ্যও থাকত না।
বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠা
শত বছর ধরে চলে আসা এই জুলুম ও বঞ্চিতির কোনো প্রতিবাদ করত না কাশ্মীরের মুসলমানরা। অশিক্ষার অভিশাপ তাদেরকে এতটাই গ্রাস করে রেখেছিল যে, অন্তহীন এ জুলুমে বিরুদ্ধে যে সোচ্চার হওয়া যায়, সে বোধটুকু তাদের ছিল না। কিন্তু নিজেদের ধর্মানুভূতিতে যখন আঘাত হানল শাসকশ্রেণি, তখনই তাঁদের প্রতিবাদী সত্তা জেগে উঠল।
জম্মু ও কাশ্মীরের দোগরা শাসকদের প্রতি তাঁদের মনে যে একটি সাধারণ ক্ষোভ কাজ করত তা সহসাই দোগরা শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয় ১৯৩১ সালের একটি ঘটনার ফলে।
জম্মুতে কয়েকটি জায়গায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা মসজিদ ও কোরআন শরিফের অবমাননা করলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে একটি সমাবেশে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে আসা আবদুল কাদির নামে একজন রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিলে সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৩ জুলাই ১৯৩১-এ শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কয়েদখানায় আবদুল কাদিরের মামলার শুনানি ধার্য করা হয়। সেদিন শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কয়েদখানার সামনে বিশাল জনসমাবেশের সৃষ্টি হয়। সেখানে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ২২ জন নিহত হয়। ১৩ জুলাইকে এখনো কাশ্মীরে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
ভারতের অধিভুক্তি
তারপর নানা ঘটনা উপঘটনা। দোগরা শিখদের অত্যাচারে জম্মু থেকে ৫ লাখ মুসলমান গৃহহারা হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে, যাদের মধ্যে ২ লাখ মানুষের সন্ধান পরবর্তীতে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটল তারপর, ভারত-পাকিস্তান হলো ভাগ। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য যেহেতু ইংরেজদের সরাসরি শাসনাধীন ছিল না, দেশ ভাগের পর তা তাই কার্যত স্বাধীন হয়ে যায়। সেখানকার মুসলমানরা দোগরা রাজার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে পাকিস্তানের সহায়তায়। তাঁরা আজাদ কাশ্মীরের ঘোষণা দিয়ে জম্মু কাশ্মীরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূমি নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়। এ ঘটনা ১৯৪৭-এর অক্টোবরের।
দোগরা রাজের রাজধানী শ্রীনগর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল আজাদ কাশ্মীরের ধারক বিপ্লবী বাহিনী, আরও একটা আক্রমণ করলেই শ্রীনগর দখল করে নিতে পারত তারা। কিন্তু সে আক্রমণে বেশ দেরি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে দোগরা রাজা হরিসিং শ্রীনগর থেকে জম্মুতে পালিয়ে গিয়ে ভারতের কাছে সাহায্য কামনা করেন। ভারত শর্তারোপ-পূর্বক তাঁকে সাহায্য করতে সম্মত হয়। শর্ত হলো কংগ্রেস-ঘনিষ্ট কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে সেখানে জরুরি অবস্থার একটি সরকার গঠন করতে হবে। হরিসিং শর্ত মেনে নেন। আর এর মধ্য দিয়েই কাশ্মীরে প্রবেশ করে ভারতীয় মিলিটারি। ১৯৪৭-এর ২৭ অক্টোবর ভারত বিশাল আকারে এয়ারলিফটিং-এর মাধ্যমে প্রায় ১০০টি সিভিল এবং মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট বিমান ব্যবহার করে দুই ব্যাটেলিয়ন ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন শ্রীনগর এয়ারফিল্ডে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়। এবং এর মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতাকামীরা যে অংশটুকু ইতিমধ্যে আয়ত্তে নিতে পেরেছে, সে অংশটুকুর ওপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজাদ কাশ্মীরের জন্ম হয়। যা পাকিস্তানের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে এখন বিবেচিত। আর বাকি ভূমিটুকু জবর দখল করে রাখে ভারত। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা মুতাবিক এ অঞ্চলকে যদিও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি, যোগাযোগ ও সামরিক বিভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখা হয়। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ ৭০ বছরের অধিক কাল ধরে সামরিক জান্তা বাহিনী দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের ওপর হিন্দু শাসিত ভারত নানাভাবে নিপীড়ন, ধর্ষণ ও গণ হত্যা চালিয়ে এসেছে।
তারপরও এ অঞ্চলের মানুষ এতদিন ভিটেমাটি নিয়ে থাকতে পেরেছে, কারণ ৩৭০ ধারার সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাজ্যের বাইরের কেউ এখানে এসে জমিক্রয় বা বসতি স্থাপন করতে পারত না। গতকাল ৫ আগস্ট সোমবার ভারতের সংসদে বিজেপি সরকার সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরকে নিজেদের পুরোপুরি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে নতুন এক ষড়যন্ত্র এঁকেছে। এখন থেকে সেখানে শুরু হবে মুসলিম বিতাড়ন। ফিলিস্তিনে যেভাবে ইহুদিদের মাইগ্রেসনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে উৎখাত করা হয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরে অচিরেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে হয়তো।
কাশ্মীরিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম
ভারতের দীর্ঘকালব্যাপী এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে নানা রকমের প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে কাশ্মীরি মুসলমানেরা। ৪৭-এর পর থেকে ভারতীয় দখলদারির মোকাবেলায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তারা মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করলেও দীর্ঘ দিন এ পন্থায় সংগ্রাম অব্যাহত রেখে ভারতীয় চক্রান্ত ও নাটকীয়তার কাছে তাদের হার মানতে হয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের বিধান থাকলেও পাতানো ও ব্যাপক কারচুপিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দিল্লি বারবার জম্মু-কাশ্মীরের সর্বময় ক্ষমতা নিজেদের আজ্ঞাবহ লোকদের হাতেই রেখেছে। তাই ইসরায়েলি আগ্রাসনের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন ‘ইন্তিফাদা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাশ্মীরের জনগণ ১৯৮৯ সালে ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনে নামে।
আর এ প্রতিরোধেই তাদেরকে সময়ে সময়ে অসংখ্য প্রাণ ও রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। নির্মমভাবে ধর্ষিতা হতে হয়েছে কাশ্মীরী নারীদের।
১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি কাশ্মীরিদের ইন্তেফাদা দমানোর লক্ষ্যে চরম মুসলিম-বিদ্বেষী জগমোহনকে কাশ্মীরের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় দিল্লি। জগমোহন তাঁর নিয়োগের দিন রাতেই কাশ্মীরে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের নামে সামরিক বাহিনী দিয়ে সাঁড়াশি তল্লাশি চালান। এতে গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ৩০০ লোককে। ফলে পরদিন দিনের বেলায় জগমোহনকে যখন গভর্নরের শপথবাক্য পাঠ করানো হচ্ছিল, নিরস্ত্র কাশ্মীরীরা কারফিউ অমান্য করে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীরা যখন ঝিলাম নদীর উপরে অবস্থিত গাওয়াকাদাল ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, ভারতীয় প্যারামিলিটারী বাহিনী ব্রিজের উভয় পারে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায়। বেশীরভাগ বিক্ষোভকারী গুলির আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন, কেউ কেউ গুলি থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে ডুবে শহীদ হন। এই ঘটনায় ১০০-এর উপর কাশ্মীরি শাহাদাতবরণ করেন।
প্রতিরোধ সংগ্রামে ভারতীয় বাহিনীদের হাতে এমন আরও কত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কাশ্মীরিরা, তার হিসেব হয়তো কারও কাছেই নেই। কুখ্যাত কয়েকটি নির্মমতার ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
যাকুরা ও টেংপোরা হত্যাকান্ড : বিক্ষোভকারীরা কাশ্মীরের স্বাধীনতা প্রশ্নে জাতিসংঘের রেজ্যুলুশন অনুযায়ী গণভোটের আয়োজনের দাবীতে ১৯৯০-এর পহেলা মার্চ যাকুরা শ্রীনগরের ক্রসিং ও টেংপোরা বাইপাস রোডে জমা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের উপর গুলি চালায়। ৩৩জন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়।
কুনান পুশপুরা গণধর্ষণ : ১৯৯১-এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার কুনান পুশপুরা গ্রামে তল্লাশী চালায়। গ্রামের পুরুষদের এক জায়গায় জড়ো করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের গণধর্ষণ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ১০০-এর উপর মহিলা ধর্ষিত হয়।
লাল চৌক অগ্নিকান্ড : জনগণ কর্তৃক বিএসএফের কিছু পরিত্যক্ত দালান জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ স্বরূপ বিএসএফ শ্রীনগরের লাল চৌকে জনবসতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মানুষ পালাতে যাওয়ার সময় বিএসএফ গুলি চালায়। ফলে ১২৫ জন নিহত হয়।
বিজবেহারা হত্যাকান্ড : ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক হযরতবাল মসজিদ অবরোধের প্রতিবাদে ১৯৯৩ এর ২২শে অক্টোবর বিজবেহারাতে আয়োজিত বিক্ষোভে বিএসএফের ৭৪নং ব্যাটেলিয়ন গুলি চালায়া। ৫১ জন নিহত এবং ২০০ জন আহত হয়।
সোপুর হত্যাকান্ড : কাশ্মীরের বারোমোল্লা জেলার সোপুর থানায় বিএসএফ ও জম্মু-কাশ্মীরে লিবারেশন ফ্রন্টের যোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলির সময় বিএসএফ আশেপাশে বিভিন্ন ভবনে আগুন ধরিয়ে, যানবাহনে হামলা চালিয়ে এবং নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালিয়ে প্রায় ৫৫ জন নিরস্ত্র কাশ্মীরিকে হত্যা করে।
বান্দীপোড়া হত্যাকান্ড : ১৯৯৩ সালের ২৭ অক্টোবরে বান্দীপোড়ায় কালো দিবস পালন করার সময় গুলি করে ১৯জন কাশ্মীরীকে শহীদ করা হয়।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল—এই সময়টায় নানা প্রতিবন্ধকতায় কাশ্মীরিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম খানিকটা ঝিমিয়ে পড়লেও ২০০৮ সালে আবার তা পূর্ণ উদ্যমে জেগে ওঠে। কাশ্মীরের প্রায় একশত একর জমি অমরনাথ তীর্থস্থান বোর্ডকে (যেটি কাশ্মীরে অমরনাথ তীর্থস্থানের দেখভালের জন্য নিয়োজিত ছিল) দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কাশ্মীরী মুসলিমরা ব্যাপারটিকে জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে থেকে হিন্দু এনে কাশ্মীরের মধ্যে হিন্দু জনবসতি গড়ে ইসরাইলী কায়দায় কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোগ্রাফী পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে থাকে এবং এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ উপলক্ষে কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় জনসভায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ জড়ো হয় যা কাশ্মীরের ইতিহাসে ছিল সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ। এসময় বিভিন্ন জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৬০জন কাশ্মীরী গুলিবিদ্ধ হয়। ২০১০ সালে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী বারোমোল্লা জেলার নাদিহাল গ্রাম থেকে তিনজন যুবককে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং পরে সাজানো এনকাউন্টারে হত্যা করে। পরে এ তিনজনকে পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এ হত্যাকান্ড কাশ্মীরে আবার গণবিক্ষোভের সূচনা করে। এবারের গণবিক্ষোভে প্রায় ১২০জন কাশ্মীরী বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী।
২০১৬ সালে কাশ্মীরের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানী তাঁর দুজন সঙ্গীসহ ত্রালে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে গোলাগুলি বিনিময়ের সময় শাহাদাত বরণ করেন। বুরহান ওয়ানী তাঁর তারুণ্য, সাহস এবং বীরত্বের জন্য শাহাদাতের আগেই কাশ্মীরের ঘরে ঘরে উচ্চারিত একটি নাম হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শাহাদাত কাশ্মীরে নজিরবিহীন বিক্ষোভ উস্কে দেয়। শুধুমাত্র তাঁর জানাযাতেই কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২ লক্ষ লোক হাজির হয়।
২০১৬-এর শেষেরদিকে শুরু হওয়া গণজাগরণ ও বিক্ষোভ ছিল কাশ্মীরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণজাগরণ এবং এর উপর ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর চালানো দমন নিপীড়নও ছিল নজিরবিহীন। ১০০-এরও বেশি বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে শহীদ হন আর আহত হন ১৫ হাজরেরও বেশি। এই গণজাগরণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তাবাহিনী পেলেট বন্দুক ব্যবহার করে। পেলেট গান হচ্ছে শটগানের মতই যা থেকে গুচ্ছাকারে ধাতব শার্পনেল নিক্ষেপ করা হয়। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী পেলেটবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছে, যাদের অনেককেই স্থায়ী চেহারা বিকৃতি এবং অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরও কাশ্মীরিদের প্রতিরোধ সংগ্রাম থেমে নেই। বরং দিনদিন তাঁরা আরও গোছালো, আরও পরিপক্ক হয়ে উঠছেন ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। একসময় আদর্শিক মতানৈক্য এসব সংগ্রামীর মধ্যে বিভেদ ছড়িয়ে দিলেও বর্তমানে সেটা আর নেই। তরুণ প্রজন্মের সংগ্রামী যাঁরাই এ পথ বেছে নিচ্ছেন, ইসলামকে নিজেদের অনুপ্রেরণায় জায়গায় রাখছেন, এবং মতাদর্শ হিসেবে ইসলামকে অবলম্বন করে লড়ে যাচ্ছেন ইতিহাসের অসম এক লড়াই। যে লড়াই থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে আজকের পৃথিবীর।
রাগিব রব্বানি
সূত্রঃ fateh24