ধীরে ধীরে ভারতীয় বাহিনী শ্রীনগরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়। ৪৮ এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়লে শেষে যুদ্ধ অচলাবস্থার দিকে মোড় নেয়। অবশেষে ১৯৪৯ এর পহেলা জানুয়ারী ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতি রেখার ব্যাপারে একমত হয়। ৪৮-এ ভারত ব্যাপারটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলে। ভারতের দাবী ছিল, যেহেতু জম্মু ও কাশ্মীরের রাজা হরিসিং আনুষ্ঠানিকভাবে কাশ্মীরকে ভারতের নিকট হস্তান্তর করেন, অতএব পাকিস্তানকে তার সমস্ত সেনাবাহিনী এবং পাঠান যোদ্ধাদেরকে সরিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবী ছিল, হরিসিং জম্মু ও কাশ্মীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে হস্তান্তরিত করার পূর্বেই কার্যতভাবে নিজ জনগণ কর্তৃক উৎখাত হন। তাই ভারত এবং শেখ আবদুল্লাহর কোন প্রভাব ছাড়াই জম্মু ও কাশ্মীরে একটি অবাধ গণভোটের আয়োজন করতে হবে যার মাধ্যমে কাশ্মীরী জনগণ নির্ধারণ করবে তারা ভারতের সাথে থাকতে চায় নাকি পাকিস্তানে সাথে। এছাড়াও পাকিস্তান জুনাগড় রাজ্যের ঘটনা উপস্থাপন করে ভারতের দ্বিমুখীতার ব্যাপারটি তুলে ধরে। জুনাগড়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল হিন্দু কিন্তু শাসক ছিল মুসলিম, যা ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সম্পূর্ণ উল্টোচিত্র। জুনাগড়ের নবাব জুনাগড়কে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু ভারত এই সংযুক্তি মানতে অস্বীকার করে জুনাগড় আক্রমণ করে সেখানে গণভোটের আয়োজন করে, যার ফলাফল ছিল ভারতের সাথে সংযুক্তির পক্ষে গণরায়। অথচ একই নিয়ম ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল।
অন্যদিকে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্তিতিকে মেনে নেন এ শর্তে যে, কাশ্মীরী জনগণকে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ করে দিতে হবে। ৪৭ এর নভেম্বরে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে জম্মু ও কাশ্মীরে জরুরী অবস্থার সরকার গঠিত হয়। ১৯৫০ এ রচিত ভারতের সংবিধানে ৩৭০নং ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরকে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেয়া হয়, যার ফলে জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে এর প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং পররাষ্ট্রনীতি থাকবে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৫০ এর সংসদীয় নির্বাচনে শেখ আবদুল্লাহর ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ দলটি ৭৫টি আসনের সবগুলোতেই জয়লাভ করে। যদিও এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোয়নপত্র দাখিল খুবই সতর্কতার সাথে সম্পন্ন করা হয় শেখ আবদুল্লাহর নিজের দলের লোক দ্বারা। নির্বাচনে মোট ভোটারের ৫% এর কম ভোটার ভোট প্রদান করে। একমাত্র বিরোধী দল প্রজা পরিষদ নির্বাচন বয়কট করে।
এদিকে শেখ আবদুল্লাহ নির্বাচনে তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিজয়কে কাশ্মীরীদের স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য একটি বিজয় হিসেবে দেখতে শুরু করেন যদিও এ নির্বাচনের ফল হবে ভারতের সাথে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের কোন একটা রকমের সংযুক্তি। তবে শেখ আবদুল্লাহ ভারতের সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ন থাকে এবং এটি যেন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতই আরেকটি রাজ্য না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সংবিধানের ৩৭০নং ধারা যা দ্বারা জম্মু ও কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছিল তা যেন এ সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে না দেয় যে, কাশ্মীরের জনগণ যদি ভবিষ্যতে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে চায় তবে তা পেতে পারে; এ ব্যাপারটি শেখ আবদুল্লাহ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ভারতও এ নির্বাচনকে জাতিসংঘ প্রস্তাবিত কাশ্মীরে গণভোটের আয়োজনের অপ্রয়োজনীয়তার যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে। ভারতের যুক্তি অনুযায়ী এ নির্বাচনের মাধ্যমেই জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ভারতের সাথে সংযুক্তির পক্ষে নিজেদের গণরায় ব্যক্ত করেছে যদিও এ নির্বাচন ছিল বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির দুষ্টে দুষ্ট।
শেখ আবদুল্লাহ ক্ষমতায় আসীন হয়ে সাধারণ চাষীদের কল্যাণের জন্য ভূমি সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেন যাদের বেশীরভাগই ছিল মুসলিম। এ পদক্ষেপের ফলে হিন্দু জমিদারদের ক্ষোভ শেখ আবদুল্লাহর উপর গিয়ে পড়ে। এছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরের স্বাধীন অবস্থা জাহির করার জন্য শেখ আবদুল্লাহ ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ এডলাই স্টিভেনসনকে কাশ্মীরে নিমন্ত্রণ করেন। এসব কিছুই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভালোভাবে নেয় নি।
অন্যদিকে কাশ্মীরে দোগরা বংশের কিছু অভিজাত ও কাশ্মীরী পন্ডিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ভুলুন্ঠিত করে কাশ্মীরকে পুরোপুরিভাবে ভারতের অংশ করার জন্য আন্দোলন করতে থাকে। নেহরু ১৯৫৩ এর মে মাসে কাশ্মীর সফরে গিয়ে শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরকে পুরোপুরি ভারতের অংশ করার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহ রাজি হন নি। ফলে দিল্লীর যোগসাজশে কাশ্মীরের রাষ্ট্রপ্রধান করণ সিং শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে তারই সহযোগী গোলাম মোহাম্মদ বখশকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং শেখ আবদুল্লাহকে অন্তরীণ করা হয়। এরপর থেকে ভারত কাশ্মীরের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে দিল্লীর পাতানো কাশ্মীরের তথাকথিত সংসদ কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব পাশ করে। ১৯৫৯ এর এপ্রিলে ভারতের নাগরিকদের কাশ্মীরে স্পেশাল পারমিট নিয়ে ঢোকার নিয়মটি বাতিল করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারকে কাশ্মীরেও বিস্তৃত করা হয়। কাশ্মীরের হাইকোর্টকে ভারতের অন্যান্য হাইকোর্টের সাথে সঙ্গতিশীল করার প্রচেষ্টা করা হয়। ১৯৬৪ সালে নেহরু কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে শেখ আবদুল্লাহকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে পাঠান পাকিস্তানের সাথে সরাসরি সমঝোতা শুরু করার লক্ষ্যে। শেখ আবদুল্লাহ ফিরে আসার আগেই নেহরু মৃত্যুবরণ করেন। শেখ আবদুল্লাহ ফিরে আসা মাত্রই পুনরায় গ্রেফতার হন। কাশ্মীরে ভারত-বিরোধী সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। গ্রেফতার ও কারাবরণের শিকার হয় অনেকেই। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানকে কাশ্মীর অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে অনুপ্রবেশকারী পাঠানোর দায়ে অভিযুক্ত করে এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ এ কাশ্মীর ফ্রন্টে আবার লড়াইয়ে রত হয় ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির মাধ্যমে ভারত কাশ্মীর ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু থেকে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে পরিণত করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পুনরায় কার্গিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এর কোনটাইতেই ৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখার কোন পরিবর্তন হয় নি। পাকিস্তানের দখলে এক তৃতীয়াংশ এবং ভারতের দখলে রয়েছে দু তৃতীয়াংশ কাশ্মীর।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বি. কে. নেহরু তাঁর ‘Nice Guys Finish Second’ বইতে ফাঁস করে দেন যে, ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত কাশ্মীরের সব মুখ্যমন্ত্রীই ছিল মূলত দিল্লী মনোনীত আর দিল্লীর এই মনোয়নকে বৈধতা দেয়ার জন্য জম্মু ও কাশ্মীরে হাস্যকর রকমের পাতানো নির্বাচন আয়োজন করা হত যেগুলোতে দিল্লী মনোনীত প্রার্থীরা বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করত। তবুও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ভেঙ্গে বাংলাদেশ হওয়ার পর জম্মু ও কাশ্মীরের অনেকে ভাবতে শুরু করলেন, হয়তোবা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোনের মাধ্যমে কাশ্মীরের স্বাধীনতাও অর্জন করা সম্ভব। এজন্য ৭০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ৮০ এর দশকের শুরুর দিকে কাশ্মীরের রাজনীতিতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ৭৭ এ জনতা পার্টির শাসনাধীন নির্বাচনকে কাশ্মীরের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে যদিও এ নির্বাচনও পুরোপুরিভাবে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত ছিল না। ৭৭ থেকে ৮৩ এর নির্বাচনে জনগণের বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক মতামত প্রতিফলিত হয়। কিন্তু ৮৭ এর নির্বাচনে সবকিছু আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। ৮৭ এর নির্বাচন ছিল অন্য নির্বাচন থেকে আলাদা। বিরোধী সব দল এ নির্বাচনে প্রাক্কালে জোটবদ্ধ হয়ে পার্লামেন্টে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পাওয়ার আশা করতে থাকে। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপকহারে কারচুপি করা হয়। ফলে কাশ্মীরের জনগণের পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে মোহভঙ্গ হতে থাকে, ফলে ধীরে ধীরে সহিংস সংগ্রামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৮৯ থেকে কাশ্মীরে ফিলিস্তিনের ইন্তেফাদার আদলে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়।
শিহান মির্জা
মূলঃ পাঠচক্র