১৯৯০ সালের একটি ঘটনা কাশ্মীরের আযাদী আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করে। এ হত্যাকান্ড গাওয়াকাদাল হত্যাকান্ড হিসেবেও পরিচিত। ঘটনার সূচনা এভাবে যে, কাশ্মীরে সশস্ত্র আযাদী আন্দোলন দমনের জন্য শ্রী জগমোহনকে পুনরায় কাশ্মীরের গভর্নর করে পাঠানো হয়। জগমোহন তার আন্দোলন দমনে কঠোরতা ও মুসলিমবিদ্বেষের জন্য আগে থেকেই কুখ্যাত ছিলেন। এর আগের কার্যকালে কাশ্মীরের গভর্নর থাকাকালে, জম্মু- কাশ্মীর প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তিনি মুসলিমদের বরখাস্ত করেন। তার সময়ে শ্রীনগরে মদের বারের সংখ্যা অস্বাভাবিকরকম বৃদ্ধি পায়। তাছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিলেবাসকে হিন্দুত্বকরণের প্রচেষ্টাও নেয়া হয়। ৯০এর ১৯শে জানুয়ারী তাকে যখন আবার কাশ্মীরের গভর্নর করে পাঠানো হয় সেদিন দিবাগত রাতেই শ্রীনগরের ঘরে ঘরে তল্লাশী চালানো হয় জঙ্গী এবং অস্ত্র আটকের নামে। সে রাতেই প্রায় ৩০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়। ফলে ৮৭ এর বানোয়াট নির্বাচনের পর থেকে কাশ্মীরীদের মধ্যে যে ক্ষোভ একটু একটু করে জমছিল তা এ ঘটনার মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়। পরদিন দিনের বেলায় জগমোহনকে যখন গভর্নরের শপথবাক্য পাঠ করানো হচ্ছিল, নিরস্ত্র কাশ্মীরীরা কারফিউ অমান্য করে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীরা যখন ঝিলাম নদীর উপরে অবস্থিত গাওয়াকাদাল ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, ভারতীয় প্যারামিলিটারী বাহিনী ব্রিজের উভয় পারে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায়। বেশীরভাগ বিক্ষোভকারী গুলির আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন, কেউ কেউ গুলি থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে ডুবে শহীদ হন। এই ঘটনায় ১০০ এর উপর কাশ্মীরী শাহাদাতবরণ করেন।
এরপর থেকে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন দ্বারা প্রণীত বিভিন্ন এক্টের আশ্রয়ে দন্ডমুক্ততা নিয়ে সাধারণ কাশ্মীরী জনগণের উপর এধরনের হত্যাকান্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ধর্ষণসহ বিভিন্ন কায়দায় দমন নিপীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে। এর বহু উদাহারণ আছে। বিখ্যাত কয়েকটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
নাম | বিবরণ |
যাকুরা ও টেংপোরা হত্যাকান্ড | বিক্ষোভকারীরা কাশ্মীরের স্বাধীনতা প্রশ্নে জাতিসংঘের রেজ্যুলুশন অনুযায়ী গণভোটের আয়োজনের দাবীতে ১৯৯০ এর পহেলা মার্চ যাকুরা শ্রীনগরের ক্রসিং ও টেংপোরা বাইপাস রোডে জমা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের উপর গুলি চালায়। ৩৩জন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়। |
কুনান পুশপুরা গণধর্ষণ | ১৯৯১ এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার কুনান পুশপুরা গ্রামে তল্লাশী চালায়। গ্রামের পুরুষদের এক জায়গায় জড়ো করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের গণধর্ষণ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ১০০ এর উপর মহিলা ধর্ষিত হয়। |
লাল চৌক অগ্নিকান্ড | জনগণ কর্তৃক বিএসএফের কিছু পরিত্যক্ত দালান জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ স্বরূপ বিএসএফ শ্রীনগরের লাল চৌকে জনবসতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মানুষ পালাতে যাওয়ার সময় বিএসএফ গুলি চালায়। ফলে ১২৫ জন নিহত হয়। |
বিজবেহারা হত্যাকান্ড | ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক হযরতবাল মসজিদ অবরোধের প্রতিবাদে ১৯৯৩ এর ২২শে অক্টোবর বিজবেহারাতে আয়োজিত বিক্ষোভে বিএসএফের ৭৪নং ব্যাটেলিয়ন গুলি চালায়া। ৫১ জন নিহত এবং ২০০ জন আহত হয়। |
সোপুর হত্যাকান্ড | কাশ্মীরের বারোমোল্লা জেলার সোপুর থানায় বিএসএফ ও জম্মু-কাশ্মীরে লিবারেশন ফ্রন্টের যোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলির সময় বিএসএফ আশেপাশে বিভিন্ন ভবনে আগুন ধরিয়ে, যানবাহনে হামলা চালিয়ে এবং নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালিয়ে প্রায় ৫৫জন নিরস্ত্র কাশ্মীরীকে হত্যা করে। |
বান্দীপোড়া হত্যাকান্ড | ১৯৯৩ সালের ২৭ অক্টোবরে বান্দীপোড়ায় কালো দিবস পালন করার সময় গুলি করে ১৯জন কাশ্মীরীকে শহীদ করা হয়। |
এরকম আরো অনেক হত্যাকান্ড চালানো হয় কাশ্মীরী জনগণের উপর বিভিন্ন সময়ে। (বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ http://www.kmsnews.org/news/2012/07/31/a-bloody-account-of-mass-massacres.html)
১৯৯২ তে ভারত র’ এর মাধ্যমে অভিনব একটি চাল চালে। অপারেশন টাইগার নামে একটি প্রজেক্ট শুরু করা হয় যাতে জেলগুলোতে ভারতীয় বাহিনীর টর্চার সহ্য করতে না পারা ধরা পড়া বা আত্মসমর্পণ করা কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে তাদের দ্বারা বিভিন্ন বিদ্রোহী-বিরোধী (Counter-insurgency) সশস্ত্র গ্রুপ খোলা হয় যাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিতো র’ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী। এরকম বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিলঃ ইখওয়ানুল মুসলিমুন, মুসলিম লিবারেশন আর্মি, তালিবান, কাশ্মীর লিবারেশন জিহাদ ইত্যাদি। ধারণা করা হয়, জম্মু-কাশ্মীরে বিভিন্ন সময় অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের দ্বারা নিরস্ত্র হিন্দু ও শিখদের উপর যে হত্যাকান্ড চালানো হয় তার অনেকগুলোর পিছনে ছিল এই বিদ্রোহী-বিরোধী গ্রুপগুলো, যাদের ভারতীয় সেনাবাহিনী ও র’ কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বের কাছে বদনাম করার অভিপ্রায়ে ব্যবহার করে। ১৯৯৩ এর ফেব্রুয়ারীতে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার জন্য ‘হুররিয়াত কনফারেন্স’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় যার বর্তমান চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান নেতা সাইয়েদ আলি শাহ গিলানী। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুজাহিদরা যেখানে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে হুররিয়াত কনফারেন্স কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন করে যাচ্ছে। ২০০৪-২০০৭ সময়কালে কাশ্মীরের সশস্ত্র আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। সেইসাথে অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন ধারা শুরু হয় কাশ্মীরে।
এসময় ভারত সরকার ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করে যে, তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সাল আসতে না আসতেই কাশ্মীরে পুনরায় গণজাগরণ শুরু হয়। কাশ্মীরের প্রায় একশত একর জমি অমরনাথ তীর্থস্থান বোর্ডকে (যেটি কাশ্মীরে অমরনাথ তীর্থস্থানের দেখভালের জন্য নিয়োজিত ছিল) দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কাশ্মীরী মুসলিমরা ব্যাপারটিকে জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে থেকে হিন্দু এনে কাশ্মীরের মধ্যে হিন্দু জনবসতি গড়ে ইসরাইলী কায়দায় কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোগ্রাফী পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে থাকে এবং এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ উপলক্ষে কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় জনসভায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ জড়ো হয় যা কাশ্মীরের ইতিহাসে ছিল সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ। এসময় বিভিন্ন জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৬০জন কাশ্মীরী গুলিবিদ্ধ হয়। ২০১০ সালে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী বারোমোল্লা জেলার নাদিহাল গ্রাম থেকে তিনজন যুবককে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং পরে সাজানো এনকাউন্টারে হত্যা করে। পরে এ তিনজনকে পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এ হত্যাকান্ড কাশ্মীরে আবার গণবিক্ষোভের সূচনা করে। এবারের গণবিক্ষোভে প্রায় ১২০জন কাশ্মীরী বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী।
২০১৬ সালে কাশ্মীরের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হিযবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানী তাঁর দুজন সঙ্গীসহ ত্রালে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে গোলাগুলি বিনিময়ের সময় শাহাদাত বরণ করেন। বুরহান ওয়ানী তাঁর তারুণ্য, সাহস এবং বীরত্বের জন্য শাহাদাতের আগেই কাশ্মীরের ঘরে ঘরে উচ্চারিত একটি নাম হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শাহাদাত কাশ্মীরে নজিরবিহীন বিক্ষোভ উস্কে দেয়। শুধুমাত্র তাঁর জানাযাতেই কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২ লক্ষ লোক হাজির হয়। ২০১৬ এর শেষেরদিকে শুরু হওয়া গণজাগরণ ও বিক্ষোভ ছিল কাশ্মীরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণজাগরণ এবং এর উপর ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর চালানো দমন নিপীড়নও ছিল নজিরবিহীন। ১০০ এরও বেশী বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে শহীদ হয় আর আহত হয় ১৫০০০এরও বেশি। এই গণজাগরণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তাবাহিনী পেলেট বন্দুক ব্যবহার করে। পেলেট গান হচ্ছে শটগানের মতই যা থেকে গুচ্ছাকারে ধাতব শার্পনেল নিক্ষেপ করা হয়। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী পেলেটবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছে, যাদের অনেককেই স্থায়ী চেহারা বিকৃতি এবং অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে।
এই ধরনের চলে আসা দমন নিপীড়নের ফলে ২০১০ এর পর কাশ্মীরের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম যেন পুনঃজীবন লাভ করে। কাশ্মীরের এই নতুন প্রজন্মের প্রতিরোধযোদ্ধারা আগের প্রজন্মের থেকে অনেক দিক দিয়েই আলাদা। কাশ্মীরে ৮৯ এর ইন্তেফাদার পর যে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় তা ছিল একটি স্রোতের মত, যাতে যোগ দেয়ার একটা হুজুগ পড়ে যায় সাধারণ জনগণের মধ্যে। দীর্ঘদিন ভারতের জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়ার ফলে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ধীরে ধীরে, তা নিঃসন্দেহে এর পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আর বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলোর মধ্যে সেক্যুলার কাশ্মীরী জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থী, সব আদর্শের ধারকবাহকই ছিল। ইসলাম অনুপ্রেরণার বড় একটি উৎস হলেও, অনেকের মধ্যকার আদর্শিক এবং তা থেকে উৎসরিত নৈতিক শক্তি ও মনোবল আজকের মত এতটা শক্তিশালী ছিল না। সেজন্য দেখা যায় আগের প্রজন্মের অনেক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা চাপ বা লোভের কাছে নতিস্বীকার করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, এমনকি ভারতীয় বাহিনীর হয়ে কাউন্টার ইনসার্জেন্সী প্রজেক্টেও কাজ করেছে, যার উল্লেখ পূর্বে করা হয়েছে। তাছাড়া স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের একটি বড় অংশ ছিল অশিক্ষিত এবং অল্পশিক্ষিত। সশস্ত্র আন্দোলনের জড়িত হওয়ার হিড়িক পড়ে যাওয়ার কারণে সে সুযোগে সশস্ত্র যোদ্ধাদের তালিকায় সুযোগসন্ধানী কিছু অপরাধীও যোগ দেয় যারা হাতে অস্ত্র পেয়ে ডাকাতি এবং লুটপাটের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।
এখনকার প্রতিরোধযোদ্ধাদের আদর্শিক ভিত্তি ও অঙ্গীকার আগের প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যে বলতে গেলে এখন শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদেরই দেখা যায়। এরা সংখ্যায় অল্পসংখ্যক হলেও আগের থেকে বেশি সংগঠিত, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং উচ্চশিক্ষিত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, পুরো কাশ্মীরে ২০০ এর চাইতে কিছু বেশি সশস্ত্র যোদ্ধা বিদ্যমান যাদের অধিকাংশই বেশিরভাগই ভারত দখলকৃত কাশ্মীরের অধিবাসী। সবচেয়ে বড় কথা, এখন সশস্ত্র যোদ্ধারা আগের প্রজন্মের সশস্ত্র যোদ্ধাদের মত বর্ডার পার হয়ে আযাদ কাশ্মীরের ট্রেইনিং ক্যাম্পগুলোতে প্রশিক্ষণ নিতে হচ্ছে না। স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গ্রুপগুলো ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে বিভিন্ন ট্রেইনিং ক্যাম্প গড়ে তুলছে। নতুন প্রজন্মের প্রতিরোধযোদ্ধারা প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতাসম্পন্ন। এরা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে করে নিজেদের বার্তার ভিডিও ও প্রশিক্ষণ বা গ্রুপের ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে ইন্টারনেটে যা কাশ্মীরের অন্যান্য তরুণদের অনুপ্রাণিত করছে সশস্ত্র সংগ্রামে শরীক হতে। এর একটি ভালো নমুনা হচ্ছে বুরহান ওয়ানী ও তাঁর সঙ্গীরা ২০১৫-তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম (যা সম্ভবত নিহত ভারতীয় সেনাবাহিনী সদস্যদের থেকে সংগৃহীত) পরিধানরত অবস্থায় অপরিচিত স্থানে একটি আপেল বাগানে গ্রুপ ছবি তুলে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। কাশ্মীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর অনেক কড়াকড়ি ও নজরদারী করা হলেও, এই ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়। একই ব্যাপার ঘটেছিল বুরহান ওয়ানীর বের করা দুটো ভিডিও বার্তার ক্ষেত্রেও। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই পারদর্শিতার ফলে কাশ্মীরের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তা কাশ্মীরী জনগণের কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে এবং কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্মের কাছে সশস্ত্র আন্দোলন পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর বুরহান ওয়ানীসহ সশস্ত্র সংগ্রামে শহীদদের করে তুলছে জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মহিমান্বিত প্রতীক হিসেবে।
কাশ্মীরের প্রতিরোধ সংগ্রাম অনেক কারণেই অপরিহার্য একটি জিনিস। দুনিয়ার যেকোন এক জায়গায় জুলুম সব জায়গায় জুলুমকে উৎসাহিত করে। যার সবচেয়ে উত্তম নজরানা হচ্ছে ইসরাইলের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক । ভারত বর্তমানে ইসরাইলের তৈরী অস্ত্রের সবচেয়ে বড় আমদানীকারক। দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে এটাই যে, দুদেশই মনে করে, তারা উভয়েই তাদের সাধারণ শত্রু হচ্ছে ‘ইসলামী চরমপন্থা’ দ্বারা আক্রান্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসরাইলের ক্ষেত্রে এই তথাকথিত ইসলামী চরমপন্থীরা হচ্ছে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী মুজাহিদগণ আর ভারতের ক্ষেত্রে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুজাহিদগণ। ২০০৮ এর দিকে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী উচ্চস্থ পর্যায়ের একজন অফিসার মেজর জেনারেল আভি মিযরাহী এক অনানুষ্ঠানিক সফরে কাশ্মীরে আসেন এটা দেখার জন্য যে, ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের ইসলামী বিদ্রোহীদের থেকে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। মিজরাহী তিনদিন ভারতে ছিলেন। এসময় তিনি ইসরাইলী প্রতিরক্ষাবাহিনী (IDF) দ্বারা ভারতীয় সন্ত্রাস-বিরোধী বাহিনীকে (Counter-terror Force) প্রশিক্ষণের পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চস্থা কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেন। এছাড়াও ভারত বাইরে থেকে হিন্দুদের এনে জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যে তাদের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা পরিসংখ্যান পরিবর্তনের যে চাল চেলেছিল সে কায়দাটিও ইসরাইল থেকেই শেখা, অনেকটা ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনীদের অধিকৃত ভূমিতে ইহুদী বসতি স্থাপন করে ইহুদী সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েমের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এভাবেই নব্য সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শুরু হওয়া তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে (পড়ুন ইসলামের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ) ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়ানক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
একইভাবে দুনিয়ার এক জায়গায় জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অন্য জায়গায় জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে জুলুমের প্রণোদনা যখন একই হয়। উত্তর-উপনিবেশবাদ এই যুগে ইসলামী মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে মুসলিমদের স্বাধিকার অর্জন তথা ইসলামী সভ্যতা পুনঃজাগরণের যেকোন প্রচেষ্টাকে ঠেকানোর জন্য পাশ্চাত্য এবং এর সাথে যোগ দেয়া পাশ্চাত্যায়িত(Westoxified) অনেক অমুসলিম এবং মুসলিম সরকার (এবং পাশ্চাত্যায়িত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবি শ্রেণী) দ্বারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে প্রজেক্ট শুরু হয়েছে তাতে কাশ্মীরে ভারতের আর ফিলিস্তিনে জায়োনিষ্টদের জবরদখল, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্ব, সিরিয়ায় আসাদ ও মিশরে সিসির কসাইগিরী, বাংলাদেশে বাঙ্গালী সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের নামে ইসলাম অবদমন ইত্যাদি সব একই সুতোয় বাঁধা হয়ে গিয়েছে। ঠিক একইভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোরও আর বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। তাই কাশ্মীরের প্রতিরোধ আর শুধু কাশ্মীরের নেই, বরং পুরো উম্মাহর প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন উম্মাহর সভ্যতাগত (civilizational) পুনঃজাগরণের পাল্টা প্রতিরোধী প্রজেক্টের সীমারেখার বাইরে কাশ্মীরের প্রতিরোধের কোন অস্তিত্ব নেই। আর বুরহান ওয়ানীও সেটা বুঝতেন বলেই তার প্রথম ভিডিও বার্তায় ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধকে শুধুমাত্র কাশ্মীরে নয় বরং সারা দুনিয়ায় খিলাফতী নিজাম কায়েমের অংশ হিসেবে দেখেছেন। কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী ধারার একেবারেই ম্রিয়মাণ বা লুপ্তপ্রায় হয়ে যাওয়াটাও এর অনেক বড় একটি প্রমাণ। বুরহান ওয়ানীসহ হাজারো শহীদদের রক্তের স্রোত যে একই স্রোতে গিয়ে মিশেছে সে অনুপ্রেরণার আবে হায়াত থেকে পান করে যাবে স্বীয় প্রভুর সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করায় অপেক্ষমান উম্মাহর হাজারো তরুণ। কাশ্মীরের প্রতিরোধ সে আবে হায়াতের একটি স্রোত হিসেবে তাই অপরিহার্য।
শিহান মির্জা
মূলঃ পাঠচক্র