উম্মুল মুমিনীন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ)

তিনি হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উযযা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কাআব ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।

ইয়ামানের রাজা তুব্বা হাজরে আসওয়াদ জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করলে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র পিতা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রাজাকে প্রতিহত করার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র মা হচ্ছেন ফাতেমা বিনতে যা’দা ইবনে আসিম (যার নাম জুন্দুব) ইবনে রাওয়াহা ইবনে হাজার ইবনে আবদে মুগীস ইবনে আমের ইবনে লুওয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা চারিত্রিক নির্মলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা আর দানশীলতায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। জাহেলী যুগেও মানুষ তাকে “তাহেরা” (পূত-পবিত্র) উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা পিতা পক্ষে কুসাই আর মাতা পক্ষে লুওয়াইর পুরুষে গিয়ে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশে মিলিত হোন। তিনি পিতা ও মাতা দু’দিক দিয়েই কুরাইশী বংশের মহীয়সী নারী। (১)

তিনি ছিলেন উচ্চ ও ভদ্র পরিবারের কন্যা, দূরদর্শীতা ও উদার স্বভাবের মহিলা, নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং নেক কর্মপরায়ণতায় সকলেই তার প্রশংসা করতো। অতি সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ পরিবারের পরিবেশে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা লালিত-পালিত হোন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিয়ের পূর্বে তার আর দুইবার বিয়ে হয়েছিলো। (২)

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র প্রথম বিয়ে হয় আতীক ইবনে আবিদ ইবনে আবদুল্লাহ মাখযুমীর সাথে। কুরাইশী এই স্বামীর ঘরে তার একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। আর দ্বিতীয় বিয়ে হয় আবু হালা হিন্দ ইবনে যুরারা ইবনে নাববাশ তামীমীর সাথে। এই স্বামীর ঘরে তার হিন্দ নামক ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা একাকী জীবন যাপন করেন। মক্কা এবং কুরাইশের শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিমতী মহিলা হিসেবে তার বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিলো বিধায় গোত্র প্রধান ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা একের পর এক তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু তিনি প্রস্তাব গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকেন। প্রস্তাবকারীদের সম্মান ও মর্যাদা বহাল রেখে অতি নম্রতা, ভদ্রতা আর শ্রদ্ধার সাথে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন অথবা ওজর পেশ করতেন। তবে বিয়েতে তার সম্মতি না থাকা এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব অনুযায়ী বিয়ে না হওয়ার বিষয়টি প্রস্তাবকারীগণ সহজেই বুঝতে সক্ষম হতো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থে স্বামী গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকে তার বিরাট সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তত্ত্বাবধানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণকরণের মানসে যোগাযোগ সীমিতকরণের প্রচেষ্টা চালান আর মক্কার যথেষ্ট ব্যবসায়ী ও নিজ কর্মচারীদের সাথে সম্পর্ক কম করে ফেলেন।

রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তখন যুবক বয়সী মহাপুরুষ। আবদুল মুত্তালিবের বংশের আমীন ও শরীফ এই মহাপুরুষের নাম-ধাম, মক্কার আশেপাশে অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে, ঘরে বাইরে আর ছোট-বড় বৈঠকে ও সমাবেশে আতরের সুগন্ধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবীহুল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে। অত্যন্ত কোমল ও নম্র চরিত্রের অধিকারী, কর্মপরায়ণ, মানুষের সাথে চলাফেরা করে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়ে অযথা সময় নষ্ট করেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রভাবশালী। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখমন্ডলীতে প্রশান্তি ও প্রভাব প্রস্ফুটিত। অত্যন্ত বিনয়ী, আর্থিক দৈন্যতা সত্ত্বেও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারায় গাম্ভীর্য প্রস্ফুটিত। আমানতদার আর দানবীর, মুখমণ্ডলী যেন পূর্ণিমার চাঁদ, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাজুক। মানুষকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব ভালোবাসেন, মানুষও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত মায়া করে আর ভালোবাসে। মানুষ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি সহনশীল, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের প্রতি সহনশীল। হাসিমুখে মানুষের সাথে মিলিত হোন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মিষ্টভাষী, কথাবার্তা বড়ই মধুর। শৈশবকাল থেকে খেলাধুলা ও অনর্থক কাজে শরীক হয় এরূপ লোকদের সংশ্রবে উঠাবসা করেন না। (৩)

কেউ ভৎসনা করলে বা ক্ষিপ্ত হলে নীরবতা অবলম্বন করেন, যুক্তিসঙ্গত উক্তি করেন। তার (সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষা অতি প্রাঞ্জল ও সুস্পষ্ট। অনর্থক ও বাজে কথা বলেন না। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তিতে মানুষের অন্তর পরিপূর্ণ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মতো সন্তান কামনা করে সমস্ত জননীরা। মক্কার প্রতিটি সতী মহিলা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বামী হিসেবে পেতে চায়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝে-শুনেই মূর্তি পূজা আর পৌত্তলিকতা থেকে বিরত থাকেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রখর প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির নিরিখে মূর্তি পূজা আর লক্ষণ বাজীর প্রচলন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সততা, সরলতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও সুবিচারের দক্ষতার কারণে সমাজের সর্বশ্রেণীর লোকেরা কোন বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বিচার প্রার্থী হয়। বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিদ্ধান্তকে এক বাক্যে সকলেই মেনে নেয়।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ব্যবসায়ী কাফেলা বসরার উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই কাফেলার তত্ত্বাবধানের জন্য লোকেরা সুবিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ হাশেমীর (অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র সম্মুখে প্রস্তাব করলে তিনি অনুমোদনের সুরে তা স্বাগত জানালেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশংসা করলেন, আর দ্বিগুণ প্রতিদানের ওয়াদা দিয়ে ব্যবসায়ী কাফেলার মহা-ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করলেন, আর সাহায্যকারী ও সহকারী হিসেবে নিজ গোলাম মাইসারাকে সাথী করে দিলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা গোলাম মাইসারাকে চুপেচুপে বলে দিলেন, “তুমি গোপনে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি তীক্ষ্ণ ও সজাগ দৃষ্টি রাখবে, যাতে ফেরার পর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে পারো।” এরপর দুজন কাফেলাসহ বসরার পথে রওয়ানা হয়ে যান। রওয়ানা হওয়ার পর থেকে মাইসারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সততা, সরলতা, আমানতদারী ও কর্মতৎপরতা দেখে অবাক হতে থাকেন। (৪)

পানাহারের সময় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতের বরকত পরিদর্শন করে মাইসারা অত্যন্ত বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। ব্যবসা-বাণিজ্যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তীক্ষ্ণবুদ্ধি নজীরবিহীন। মাইসারা আরো দেখলেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন অগ্রসর হোন, তখন মেঘরাশি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর স্থির হয়ে ছায়া প্রদান করে, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেমে গেলে মেঘরাশিও থেমে যায়। আশেপাশের বৃক্ষগুলো ডালপালা নিচু করে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাগত জানায় আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঝুঁকে ছায়া প্রদান করে। মাইসারার মতো একজন পাদ্রীও এই বিস্ময়কর ঘটনা পরিদর্শন করে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে পড়ে এবং এই মহান লোকটি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে তা মাইসারার নিকট থেকে জেনে নেয়, আর বলে – এই বৃক্ষের নীচে নবী-রাসুলগণ ছাড়া আর কেউ অবতরণ করেননি।

মক্কাবাসীরা যাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহা সত্যবাদী আর আমীন বলে স্মরণ করে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্যে মাইসারার ভ্রমণকালীন সময়টুকু অত্যন্ত আনন্দে আর প্রফুল্লতার সাথেই কাটতে লাগলো। দীর্ঘ সময় তার কাছে দীর্ঘ মনে হয় না, দীর্ঘ পথ সফরে তার ক্লান্তিবোধ হয় না। এই মহান যুবকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্যে তার রাত্রিগুলো নির্ভয়ে-নিরাপদেই কেটে যাচ্ছে। তবে মাইসারা এই ভ্রমণকালে তাকে দেখে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনাবলী পরিদর্শন করে বিস্মিত হলেন, শ্রদ্ধা ভক্তিতে তার অন্তর আপ্লুত হয়ে উঠলো। মাইসারা ভালোভাবেই অবগত হলেন যে, আমার সাথী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্যদের মতো লাত-উযযার শপথ গ্রহণ করেননি। অথচ মাইসারা ইতিপূর্বে অসংখ্য ব্যবসায়ীকে অবলোকন করেছেন, তারা ব্যবসার স্বার্থে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য অযাচিত কথাবার্তা বলে, অপ্রয়োজনেই শপথ করে থাকে। এরূপ আচরণই মাইসারা ইতিপূর্বে দেখেছে। কিন্তু এবারের সফরসাথী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তেমন নয়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেচা-কেনা ও তাগাদার সময় অত্যন্ত কোমল আর নম্র ও উদারমনা। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মিলিত হলে অন্তরে প্রশান্তি বোধ হয়। যারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বেচা-কেনা করে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মেলামেশা করে আর উঠা-বসা করে, তারা সকলেই তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মায়া করে, মুহাব্বাত করে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংশ্রবে মানুষ আত্মমর্যাদাবোধ এবং ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা লাভ করে। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাগুলো মুক্তার দানার মতো সুশৃঙ্খলিত, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাবার্তা অসারতা, অতিরঞ্জন ও অশ্লীলতামুক্ত।

যেদিন ব্যবসায়ী কাফেলা মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলো, মাইসারা প্রথমেই মুনিবের নিকট সুসংবাদ দিতে ছুটে গেলেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা খবর শুনে সঙ্গিনীদেরকে নিয়ে দোতলা থেকেই পথের দিকে তাকালেন। দৃষ্টি কেবল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামক যুবকের উপর নিবদ্ধ, অন্য কোন দিকে নয়। তিনি দেখতে পেলেন যে, মহাব্যবস্থাপক উটের আরোহী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিক দুপুরে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে ব্যবসায়ীদের বিরাট কাফেলা। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার কাফেলাকে ফিরতে দেখে অত্যন্ত খুশী হলেন। খুশীর একটি কারণ ছিলো যে, সুবিজ্ঞ হাশেমী যুবক নিরাপদে সমস্ত মালামালসহ ফিরে আসছে, পথিমধ্যে কোন অঘটন ঘটেনি। দ্বিতীয় কারণ, এই সুবিজ্ঞ যুবক ব্যবসায়ী ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভ অর্জন করেছে।

গোলাম মাইসারা তার ভ্রমণকালের সাথীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত ঘটনাবলী খোলাখুলি বলতে শুরু করেন। মাইসারা স্বচক্ষে যা দেখলেন, পাদ্রীর নিকট নিজ কানে যা শুনলেন, কিভাবে মালে এতো লাভ হলো – মোটকথা ভ্রমণ কালের সমস্ত কিছু মাইসারা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে বিস্তৃতিভাবে শুনালেন। কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র অন্তর্দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা অধীরচিত্তে অপেক্ষায় আছেন। দেখতে দেখতে অল্পক্ষণের মধ্যেই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র বাসভবনের সামনে অবতরণ করলেন অভিজ্ঞ যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অত্যন্ত লজ্জাভরে, দৃষ্টি নত করে যুবক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। এমন সময় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা অতি আনন্দের সাথে প্রফুল্ল মনে বরকতময় ঐতিহাসিক ভ্রমণ থেকে নিরাপদে লাভবান হয়ে ফিরে আসার কারণে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আন্তরিক ধন্যবাদ ও মুবারাকবাদ দেন, সালাম পেশ করেন। এ সময়ে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে সফর থেকে প্রত্যাবর্তন ও ব্যবসা সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট পেশ করে ব্যবসার পুঁজি ও ও লভ্যাংশসহ সমস্ত মালামাল খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে বুঝিয়ে দিলেন আর বিদায় গ্রহণ করলেন, সামান্য সময়ও অবস্থান করলেন না।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা আর তার বান্ধবীগণ সকলেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যাবর্তন ও প্রতিটি কদম, কদমের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশ্চর্য হচ্ছিলেন। এই অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী যুবক যদি আর একটু সময় তাদের সম্মুখে অবস্থান করতেন! তাহলে সেই মুহূর্তটি তাদের জন্য হতো অত্যন্ত আনন্দের। যদি লজ্জা বাধার কারণ না হতো, তাহলে আর একটু সময় অবস্থানের জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আবেদন করা যেতো।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র বংশ ছিল মক্কার অতি উচ্চবংশ। এই বংশের পুরুষদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন, তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে যাদের যথেষ্ট জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিলো, আর তারা মিল্লাতে ইব্রাহীমীর উপরও বিদ্যমান ছিলেন। তাদের জানা ছিলো যে, সর্বশেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের সময় অতি নিকটে, তারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনের গভীর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ ছিলেন। সূর্যের আলো সদৃশ সেই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশে জন্মগ্রহণ করবেন, এটাই ছিল তাদের আকিদা আর অভিজ্ঞতা।

ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, হাজরে আসওয়াদ জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার জন্য ইয়ামানের তুব্বার অভিযানকে প্রতিহত করে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র পিতা বিশেষ গৌরবের অধিকারী হয়েছিলেন। সমাজের লোকেরা তার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভক্তি পোষণ করতো। আর তার কন্যা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও সংযমশীলা মহিলা। সমগ্র আরব বিশ্বে আর বিশেষত কুরাইশ বংশে প্রচলিত পৌত্তলিকতা ও মূর্তি পূজা থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। এই শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফিলের কাছ থেকে। তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন যে, লাত ও উজ্জাসহ অন্যান্য মূর্তি মানুষের না ক্ষতি করতে পারে, না উপকার করতে পারে। পৌত্তলিকতা যেমন মিল্লাতে ইব্রাহীমী আদর্শের পরিপন্থী, তেমনি তাওরাত ও ইঞ্জিল কর্তৃক প্রবর্তিত তাওহীদী আকিদার পরিপন্থী – এ বিশ্বাস খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র অন্তরে দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয়েছিলো। তাই তিনি তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকার মতো অধীর চিত্তে শেষ যুগের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের অপেক্ষায় ছিলেন, যে নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমন সংবাদ তাওরাত ও ইঞ্জিল বারবার প্রদান করে আসছে।

অপেক্ষার এই মুহূর্তে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে দেখতে পাচ্ছেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন মহান এই যুবকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্মল চরিত্র, উদার স্বভাব এবং সততা সরলতার প্রচার সমগ্র মক্কায় ছড়িয়ে পড়েছে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ব্যবসার মহাব্যবস্থাপক হিসেবে যা ঘটেছে আর গোলাম মাইসারা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে যেসব বিষয়বস্তুর বর্ণনা প্রদান করেছে, এসব কিছুও সমগ্র মক্কা নগরী আর আশেপাশের এলাকায় এ আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শও তাৎপর্যপূর্ণ। কোনদিন মূর্তির সম্মুখে যান না, আর নতশীরও হোন না, আরবদের সাথে তাদের পূজাপাটেও অংশগ্রহণ করেন না, মদ্যপান করেন না, অনর্থক কর্মকাণ্ডে, ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল পাপাচারে অংশগ্রহণ করেন না। তাই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র মনে প্রশ্ন উদিত হয়, তবে কি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের এই যুবকটিই শেষ যুগের সেই প্রতীক্ষিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)? যারা দ্বীনদার-আল্লাহভীরু, তারা সকলেই শেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের নিদর্শনাবলীর প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখছেন। তাদের ধারণা মতে শেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমনের সময় অতীব সন্নিকটে। তবে কি তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই প্রতীক্ষিত শেষ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)?

সময় অতি ধীর গতিতে অতিবাহিত হচ্ছে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র অন্তরে বিভিন্ন প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আশার আলো বুঝি নিকটতম সময়েই প্রজ্বলিত হবে। তাকদীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিকেই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র জন্য নির্বাচিত করে রেখেছে। অনেক সময় একাকী জীবনযাপনের পর একজন উপযুক্ত সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশেষভাবেই উপলব্ধি করছিলেন। তিনি একজন আদর্শ স্বামীর প্রতীক্ষায় ছিলেন, যার পরশে শেষ সময়টুকু কাটাবেন, সাহায্য-সহানুভূতি আর ভালোবাসার সুযোগ পাবেন। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকটিই এমন স্বামী হতে পারেন। কিন্তু মহান এই যুবককে স্বামী হিসেবে লাভ করার উপায় কি? কি করা যায়? কাকে বলা যায়? মনের গোপন এই ভেদ কার কাছে প্রকাশ করা যায়? খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এসব প্রশ্নে মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র দূরদর্শীতা ও বুদ্ধিমত্তা বান্ধবী নাফিসা বিনতে সানিয়্যার কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। তিনি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র উদাসীনতা, চেহারার মলিনতা ও অস্থিরতা অবলোকন করে তার অন্তরের গোপন ভেদ আর গুঞ্জন অনুধাবন করতে সক্ষম হোন এবং তাকে তার মনের কথা প্রকাশে বাধ্য করেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রথম প্রথম গোপন ভেদকে প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। কিন্তু নাফিসা সুকৌশলে অতি আপনজন হয়ে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকের আলোচনা শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামের যুবকটি অবিবাহিত, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন বিয়ে করেন না? কেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাকী জীবনযাপন করছেন? মক্কার উচ্চ খান্দানের বহু লোকেই খাদিজাকে বিয়ে করতে প্রস্তাব করছে, করেই চলেছে, কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন প্রস্তাব করেন না? নাফিসা বললেন, “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসুক তুমি কি তা চাও?”খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা সম্পূর্ণ নীরব। তার মুখে কোন উত্তর ফোটে না। তবে তার নীরবতার আড়ালে উত্তর সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। লজ্জার আবরণে তার মৃদু মুচকি হাসি মনের গুপ্ত বাসনার জানান দিয়ে দেয়। নাফিসা বললেন, “হে আমার বোন, তোমার মনের বাসনা অচিরেই পূরণ হবে।” (৫)

নাফিসা বের হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তালাশে। তালাশ করে করে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সাথে আলোচনায় রত অবস্থায় পেলেন। নাফিসা জিজ্ঞাসা করলেন, বনী হাশিমের মতো উচ্চ বংশ এবং মক্কার শেষ স্বনামধন্য যুবক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে না করার কারণ কি? যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, বিয়ে করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। নাফিসা বললেন, যদি আমি সামর্থ্যের ব্যবস্থা করি, আর অর্থশালী রূপসী ও সুন্দরী মহিলার প্রস্তাব করি? যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তিনি কোন মহিলা? নাফিসা বললেন, কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ মহিলা খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)।

যুবক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ভালো করেই জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। মক্কার গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে ব্যর্থ হয়েছে, আর সেই তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব করছেন! তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবাক হলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাবের বিষয়টি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুরব্বী চাচাদের সম্মুখে পেশ করলেন। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তড়িৎ ব্যবস্থা নিলেন।

হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবু তালিবের পরামর্শক্রমে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র বাসভবনে উপস্থিত হলেন। প্রস্তাবের ভাষণে আবু তালিব বললেন, “মহান আল্লাহ পাকের প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর খান্দান, ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) এর বংশধর এবং মাআদ ও মুজারের নসলে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদেরকে তার পবিত্র ঘরের হেফাজত ও সংরক্ষণের প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, যিনি আমাদের জন্য হারাম শরীফকে সুসংরক্ষিত নিরাপদের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, আর যিনি আমাদের সমস্ত মানুষের উপর তত্ত্বাবধায়ক ও হাকিম নির্ধারণ করেছেন। এরপর, আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ সকলের কাছে সুপরিচিত। যুবকদের মধ্যে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমকক্ষ কেউ নেই, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। হ্যা, সে অর্থ সম্বলহীন, কিন্তু অর্থ সম্পদের কোন স্থায়িত্ব নেই, বরং ছায়ার মতো পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী। আর আমার ভাতিজার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উন্নত চরিত্র ও তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে আপনারা সকলেই অবগত আছেন। সে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদিজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করছে। এ বিয়েতে নগদ ও বাকি সমস্ত মোহরানা আমার সম্পদ থেকে প্রদান করা হবে। আপনারা শুনে রাখুন, অচিরেই সমাজের সম্মুখে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব সূর্যের মতো ফুটে উঠবে।” (৬)

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনপথে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র বিশেষ অবদান ও সৃষ্টিশীল ভূমিকা রয়েছে। তিনি ছিলেন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অত্যন্ত উদারমনা। তিনি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখেননি, নিজের অধিকার আদায়ে কোন সময়ে চাপ দেননি। তার কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অল্প সময় অবস্থানের কারণে কোন সময় আত্মকুণ্ঠিত হোননি। ঘরের যাবতীয় দায়িত্ব খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজেই পরিচালনা করতেন। জীবনোপকরণ সংগ্রহ ও আয়-উপার্জনের ঝামেলা থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুক্ত করে নির্জনে আল্লাহ পাকের ইবাদাত রিয়াযতের সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলেন। যখনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র কাছে উপস্থিত হতেন, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহস যোগাতেন। একজন বিশ্বস্ত সরলপ্রাণ ওয়াফাদারের মতো তার সমস্ত প্রয়োজন মিটাতেন। আন্তরিকতা, নম্রতা আর ভালোবাসা নিয়ে তিনি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়াতেন। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কারণে সৃষ্ট ভীতির মুহূর্তে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন, “অসম্ভব! আল্লাহ পাক আপনাকে কখনো অপমান করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়দের প্রতি সংবেদনশীল, অসহায় মানুষের বোঝা বহন করে থাকেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন ব্যবস্থা করে থাকেন, মেহমানদারী করেন আর হকের পক্ষে সাহায্য করে থাকেন।” সত্যিই সান্ত্বনার এই বানী অত্যন্ত মহান এবং এক মহান বুদ্ধিমতী ও দূরদর্শী মহিলার সাহসী ভুমিকাই বটে।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা শুনে এবং সমর্থন ও সান্ত্বনার বাণী ব্যক্ত করেই নীরব থাকেননি, বরং তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে চাচাতো ভাই ওয়ারাকার কাছে গমন করেন আর গারে হেরায় জিবরাঈল ফেরেশতার হঠাৎ আগমন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাঈল আলাইহিস সালাম’কে কেমন দেখলেন, তার কাছে কি শ্রবণ করলেন ইত্যাদি সব ঘটনাবলী ওয়ারাকাকে শুনালেন।
ওয়ারাকা অত্যন্ত ধীর মস্তিস্কে সবিস্তারে সবকিছু শুনে বললেন, “হে আমার ভাতিজা, সুসংবাদ! সুসংবাদ! এ তো সেই ফেরেশতা জিবরাঈল, যিনি মুসা আলাইহিস সালামের কাছে ওহী নিয়ে অবতরণ করতেন। আফসোস! আমি যদি সেই মুহূর্তে জীবিত থাকতাম, যখন তোমাকে তোমার সম্প্রদায় মক্কা থেকে বহিস্কার করে দিবে!”
রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়ারাকার বক্তব্য শুনে অত্যন্ত অবাক হলেন। বিস্ময়ের সুরে বললেন, “তবে কি তারা আমাকে অবশ্যই বহিস্কার করে দিবে?” ওয়ারাকা উত্তরে বললেন, “হ্যা, অবশ্যই তোমাকে বহিস্কার করবে। কেননা, তোমার পূর্বে যে সমস্ত নবী-রাসুল তাশরীফ এনেছেন, তাদের সাথেও এরূপ ব্যবহারই করা হয়েছে। আমি সেই মুহূর্তে বেঁচে থাকলে তোমাকে আমার সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করবো।” (৭)

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ডক্টর বিনতুশ শাতী লিখেছেন, “খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হেরা গুহার ঐতিহাসিক দাওয়াতে নিঃসন্দেহ চিত্তে, প্রশস্ত মনে, উন্মুক্ত হৃদয়ে ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন আর এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই আল্লাহ’র নবী, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ মোটেই অপমান করতে পারেন না।”

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোন স্ত্রীর ভাগ্যে এরূপ স্বাগত জানানোর সুযোগ জুটেছে কি? হকের জন্য ঈমানের রাস্তায় খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র মতো ভোগ-বিলাস সামগ্রী ও নিয়ামতের অধিকারিণী মহিলা ব্যতীত অন্য কোন মহিলার সাহস হতো কি যে, সে সমস্ত আরাম ও শান্তি দ্বিধাহীনচিত্তে পরিহার করে চতুর্মুখী যাতনা, বেদনা, নির্যাতন, নিপীড়ন সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নিবে?

না, মোটেই না। হ্যা, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে শান্তি ও সাহস যোগানোর জন্য ইয়াতিমের মা হওয়ার জন্য, বীর পুরুষের মনে শক্তি সঞ্চারের জন্য, মুজাহিদের দুর্গ ও আশ্রয়স্থল হওয়ার জন্য আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শান্তি নিরাপত্তা ও ভরসাস্থল হওয়ার জন্য যাকে আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন, কেবল সেই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র জন্যই সম্ভব, অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন, শত্রু ও বিদ্রোহীদের মিথ্যা অপবাদ আর ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়ে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজার নিকট ফিরে আসলে তার ব্যবহারে, তার সান্ত্বনাবাণী শুনে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত কষ্ট-দুঃখ ও মানসিক অবসাদ দূরীভূত হয়ে যেতো, শত্রুদের ষড়যন্ত্রের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়ে যেতো আর নতুন করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে শক্তি ও সাহস সঞ্চার হতো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার মৃত্যু পর্যন্ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এই ভূমিকা পালন করতে থাকেন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন এমন বুদ্ধিমতী ও সুক্ষ্মদর্শী মহিলা, আল্লাহ পাক তার অন্তরকে দয়া-মায়া আর সহানুভূতিশীল করে গড়ে তুলেছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত এই গুণাবলীর সাহায্যে তিনি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনকে সর্বপ্রকার দুশ্চিন্তামুক্ত ও প্রশান্তিযুক্ত করে রাখতে সক্ষম হতেন।

তাছাড়া খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’ও কাফির-মুশরিকদের নির্যাতন-নিপীড়ন হতে মুক্ত থাকতে পারেননি। তিনিও কাফির-মুশরিকদের যুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মুসলমানদের সাথে তাকেও শিয়াবে আবু তালিবের বন্দীখানায় অসহনীয় দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে। কাফিররা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করে রেখেছিলো। তাদের সাথে সামাজিক বয়কটের যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলো। তাদের ঘোষণাপত্র ছিল নিন্মরুপঃ “কুরাইশগণ বনী হাশিমের সাথে সম্পূর্ণ বয়কট করবে। বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-শাদী সম্পূর্ণ বর্জন করবে। তাদেরকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। পানাহার সামগ্রী সরবরাহ করা বন্ধ থাকবে, যাতে বনু হাশেম মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে হত্যা করার জন্য আমাদের কাছে অর্পণ করতে বাধ্য হয়, কিংবা তারা সকলেই বন্দীখানায় অত্যাচারিত আর ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।” (৮)

মক্কার জ্ঞানী-গুণী নেতৃবৃন্দ সকলেই এই সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করে আর সন্ধিপত্রে স্বীকৃতিস্বরূপ সাক্ষর প্রদান করে। এই সন্ধিপত্রের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এই সন্ধিপত্রকে কাবা শরীফে লটকিয়ে রাখা হয়। এভাবে বনী হাশিমের লোকজনকে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করে শিয়াবে আবু তালিবে বেষ্টিত করে তাদেরকে অনাহারে অর্ধাহারে আর জীবন-মরণ সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে, প্রাণ বাঁচার তাগিদে এক ফোঁটা পানি সরবরাহের পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি। এই বিপদের মুহূর্তেও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়ান এবং শিয়াবে আবি তালিবের বন্দীখানায় রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠদের যাতনা কষ্ট বরণ করে নেন। তিনি সমস্ত মুসলমানদের সাথে নির্যাতন ও নিপীড়নের জীবনযাপন গ্রহণ করেন, অধৈর্য ও অধীরচিত্ত হোননি। অথচ খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ পরিবারের মহিলা, সুখ-শান্তির পরিবেশে লালিতা-পালিতা। অনাহার-অর্ধাহার, বালা-মুসিবত, দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি সহ্য করায় তিনি মোটেই অভ্যস্ত ছিলেন না। অপর দিকে তখন তার মধ্যে এতো দুঃখ কষ্ট সহ্য করার মতো শারীরিক শক্তিও ছিলো না। কেননা, প্রায় ৬০ বছরের বার্ধক্য জীবনে উপনীত ছিলেন। এতদসত্বেও তিনি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্যে ত্রুটি করেননি। তার রাসুল স্বামীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য তিনি তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন আর আগত বংশধরের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শ স্থাপন করেন। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত শিয়াবে আবি তালিবের বন্দীখানায় জীবনযাপন করেন। এতো কঠিন মুহূর্তেও তার ঈমানি শক্তি হ্রাস-পায়নি। তিনি ইয়াকিনে কামেল ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারিণী হয়ে থাকলেন, সর্বাবস্থায়ই তিনি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি কামনা করলেন। বালা-মুসীবতে ধৈর্যধারণ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি।

নিঃসন্দেহে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত। আরববাসী তথা সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহ পাকের পথে আহবানকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা আর নবুওয়াতের বিরাট দায়িত্বভার বহনকরণে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য করুণাময় আল্লাহ পাক খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’কে তৈরি করে রেখেছিলেন। তাই তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিপদের মুহূর্তে সাহায্য করেছেন, সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন আর সহানুভূতি জানিয়েছেন, নৈরাশ্যের স্থলে সাহস সঞ্চার করেছেন আর কার্যক্রম ও কর্মসূচী বাস্তবায়নে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি আল্লাহ পাক কর্তৃক রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে প্রতিপালনে সমর্থ হয়েছেন।

একবার কারণবশত ওহী অবতরণে বিলম্ব হয়, এতে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাবলেন, হয়তো আমার উপর আর ওহী অবতীর্ণ হবে না। আল্লাহ পাক এই ধারণা নিরসনের জন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তার অগণিত ইহসানের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেনঃ”পূর্বাহ্ণের শপথ, গভীর রাতের শপথ। আপনার পালনকর্তা আপনাকে ত্যাগ করেননি আর আপনার প্রতি বিরূপও হোননি। আপনার জন্য পরকাল তো ইহকাল অপেক্ষা উত্তম। আপনার পালনকর্তা অতিসত্বর আপনাকে এমন কিছু দিবেন যাতে আপনি সন্তুষ্ট হোন। তিনি কি আপনাকে এতীমরূপে পাননি? এরপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পথ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পেয়েছেন, এরপর আপনাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি আপনাকে নিঃস্ব অবস্থায় পেয়েছেন, এরপর তিনি আপনাকে অভাব মুক্ত করেছেন।” (সূরাহ আদ-দুহা, ৯৩ : ১-৮)

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর অনেক সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে তার ভালোবাসা আর ইহসানের কথা এমনভাবে আলোচনা করতেন যে, এই আলোচনা ও প্রশংসা অন্যান্য স্ত্রীদের জন্য ঈর্ষার কারণ হতো। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র অধিক আলোচনা ও প্রশংসা এজন্য করতেন যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায়, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয়াবহ ও কঠোরতম সময়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে শরীক থেকে জান-মালে আল্লাহ ও তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য সহযোগিতা করেন। সর্বাবস্থায় তিনি সীমাহীন ধৈর্য ধারণ করেন। কোন প্রতিকূল অবস্থাতেই হীনবল হোননি, দুর্বল হোননি, ক্লান্তবোধ ও নৈরাশ্যবোধ করেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে আশা-ভরসা সঞ্চার করতে থাকতেন। শিয়াবে আবি তালিবে বন্দী থাকা অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে অধিক কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবু লাহাব যখন দুই ছেলেকে রুকিয়া ও রুকিয়ার বোন কূলসুম বিনতে খাদিজাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তালাক দেওয়ায় বাধ্য করেছিলো, তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যেরূপ ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা কখনো বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়।

দ্বীনের জন্য খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ইখলাস, ধৈর্য ও মেহনতের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ পাক দুনিয়ায় থাকা অবস্থায় তাকে সর্বশান্তির নিকেতন জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন, তার কাছে জিবরাঈলের মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করেন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে জিবরাঈল হাজির হয়ে বললেন, “হে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), খাদিজা চামড়ার বাসনে পানাহার সামগ্রী ভর্তি করে আপনার জন্য নিয়ে আসছেন। তিনি আপনার দরবারে হাজির হলে আল্লাহ ও আমার পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাবেন, আর নিরাপদ ও মনিমুক্তা খচিত জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবেন।” খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে জিবরাঈলের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেন। এর উত্তরে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, “আল্লাহ পাক সালাম তথা শান্তিময়, তার পক্ষ থেকে সালাম, আর জিবরাঈলের প্রতি সালাম।” (৯)

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র অসাধারণ মর্যাদা ও সম্মানের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। যদি তিনি দীর্ঘকাল হায়াত পেতেন, তাহলে তার চরিত্র ও গুণাবলী সম্পর্কে মানুষ যা জানে আর ইতিহাসে যা সংরক্ষিত আছে, তার চেয়ে অনেক বেশী প্রকাশ পেতো। আমি যদি বলি, তিনি ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন, আর জিহাদের ময়দানেই শহীদ হয়েছেন, তাহলে মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না। কারণ, তিনি শিয়াবে আবি তালিবে আবদ্ধ সময়ের অসহনীয় যাতনা ক্লেশের কারণে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হোন আর শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন। অঙ্গসমূহ ঢলে খসে পড়ে। শিয়াবে আবি তালিব থেকে মুক্তির পর আর সুস্থতা নসীব হয়নি, বরং নানা কারণে রোগ বৃদ্ধির পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ’র সাথে মিলিত হোন যে, আল্লাহ পাক তার প্রতি আর তিনি আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির দশম বছর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র পবিত্র আত্মা তার সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে যায়। আল্লাহ পাক তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন আর নিজ রহমতের দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখুন, আমীন।

যখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা শেষ সময়ে পরিবার-পরিজন আর কন্যাদের কাছ থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করছিলেন, তখন তার কন্যা রুকিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা স্বামী উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে হাবশায় (ইথিওপিয়া) হিজরতে অবস্থান করছিলেন। আর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাশে দাঁড়িয়ে অতি শ্রদ্ধাভাজন জীবনসঙ্গিনীকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ভরাক্রান্ত হৃদয়ে অবলোকন করছিলেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাণপ্রিয়া খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র প্রতি বেদনাভরা দৃষ্টি এমনভাবে নিবদ্ধ করেন যেন তিনি তার জীবনের সবকিছুই তার জন্য বিলিয়ে দিলেন আর আল্লাহ পাকের আমানতকে যথাস্থলে পৌঁছিয়ে দিয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তার শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে এলো। তিনি কেঁদে কেঁদে ঢলে পড়লেন। মক্কার উঁচু এলাকা হাজুন-এর জান্নাতুল মুআল্লা হলো খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র শেষ নিদ্রাস্থল। যেখানে কবর খনন করে নিজে কবরে অবতরণ করে নিজ হাতে সমাহিত করে ঘরে ফিরে পরিবার-পরিজন আর কন্যাদের সাথে বিচ্ছেদ বেদনায় শরীক হোন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা – যাকে গভীর দুঃখ ভরে তার শেষ নিদ্রাগারে আমানত রাখা হয়েছে, স্বামী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রোহীদের উপহাস-বিদ্রুপ ও ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলায় তিনি ছিলেন মজবুত খুঁটি ও সহায়ক। কাফিরদের রুক্ষ আচরণে দুঃখ ও বেদনাহত মনে যখনই বাড়ি ফিরতেন, মহান সুকৌশলী এই স্ত্রী হাসিমুখে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বাগত জানাতেন। তার ভালোবাসা ও মধুর আচরণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মন আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠত। পিছনের দুঃখ কষ্ট সবকিছুই মন থেকে মুছে যেতো। তাকে দেখে, তার সান্নিধ্যে এসে পুনরায় শক্তি সাহস ফিরে পেতেন, নতুন করে আশা ভরসার সঞ্চার হতো আর পরিশ্রম-মেহনত, মুজাহাদা ও আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনুপ্রাণিত ও ব্রতী হতেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র মিষ্টি কথা, তার মধুবাক্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা যোগাতো। তার আশ্বস্ত বাণী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ধৈর্যশীল ও দৃঢ়-প্রত্যয়ী করে তুলতো। হকের উপর সুদৃঢ় হওয়ার জন্য হতো সহায়ক। এমন স্ত্রীকে শেষ বিদায় দেওয়ার সময় বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর যা স্বাভাবিক, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেলায় তা-ই ঘটেছে। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন এতো কেঁদেছিলেন যে, কোন স্বামী তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ বেদনায় এতো অধিক কাঁদে না। (১০)

এজন্যই কেঁদেছিলেন যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য যেমন ছিলেন প্রেমাস্পদ-বন্ধু, তেমনি ছিলেন অতি শ্রদ্ধাভাজন মুরব্বী ও সংবেদনশীল স্ত্রী। এজন্যই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বছরের নামকরণ করেছেন “আমুল হুযুন” অর্থাৎ দুঃখের বছর। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য পাহাড়তুল্য সুদৃঢ় প্রাচীর, সংরক্ষিত দুর্গ। যখন দুনিয়ার মানুষ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যুক বলে ভৎসনা করেছে, তখন তিনি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবীয়ে বরহক বলে স্বীকৃত দিয়েছেন। মানুষ যখন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে যুদ্ধ করেছে, তখন তিনি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমর্থন ও সাহায্য করেছেন। যখন মানুষ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বঞ্চিত করেছে, তখন তিনি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন মনে সাহায্য করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্ত প্রয়োজন মিটানোর যথাযথ ব্যবস্থা করেছেন, প্রচুর অর্থসম্ভারে শক্তিশালী করে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছেন। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তর তার ভালোবাসায় আচ্ছন্ন ছিলো। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এতো অধিক ভালোবাসা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য অনেক স্ত্রীর জন্য ঈর্ষারও কারণ হয়ে উঠত। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, স্বয়ং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, “রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমার বিয়ে খাদিজার মৃত্যুর পর সম্পাদিত হয়েছে। আমি তাকে কোনদিন দেখিওনি। কিন্তু খাদিজার মতো আর কারো প্রতি আমার ঈর্ষা সৃষ্টি হয়নি।”

এই ঈর্ষার কারণ বর্ণনা করে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা তার প্রশংসা করতেন। কোন সময় কোন পশু জবাই হলে খাদিজার বান্ধবীদের অনুসন্ধান করে তাদের বাড়ীতে খাদিজার স্মরণে গোশতের হাদিয়া পাঠাতেন। আমি অনেক সময় বলে থাকতাম, ‘মনে হয় আপনার দৃষ্টিতে সারা পৃথিবীতে খাদিজা ছাড়া আর কোন মহিলাই নেই।’ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলতেন, ‘খাদিজা তো খাদিজা-ই, তার কোন নজীর নেই, আমার সমস্ত সন্তান তারই গর্ভের।’ ”

মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, “বকরী যবাই হলে তার বান্ধবীদের কাছে গোশত হাদিয়া করতে আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন। একদিন আমি অত্যন্ত রাগান্বিত স্বরে বললাম, ‘খাদিজা আবার কে?’ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমার অন্তরে তার গভীর ভালোবাসা বিদ্যমান।’ ” (১১)

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজার কথা স্মরণ করে অত্যন্ত প্রশংসা ও তার জন্য মাগফিরাতের দুয়া করতেই থাকতেন, দমতেন না। একদিন ঈর্ষাতুর হয়ে আমি বললাম, ‘আল্লাহ পাক আপনাকে এই বুড়ীর বদলে আমাকে দান করেছেন।’ এতে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন আর আমার উপর ভীষণ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আমি এ অবস্থা দেখে মুনাজাত করলাম, ‘হে আল্লাহ, আমার উপর আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসন্তুষ্টি দূরীভূত করুন, আমি আমার জীবনে আর কোনদিন খাদিজার ব্যাপারে কটূক্তি করবো না।’ আমার দুরাবস্থা ও অনুতাপ দেখে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি করে এমন কথা খাদিজার সম্পর্কে বলতে পারলে? অথচ সে আমার উপর ঈমান স্থাপন করেছে, যখন সমস্ত মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে উপহাস করেছে। মানুষ যখন আমাকে বয়কট করেছে, তখন সে আমাকে বরণ করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। তার গর্ভে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে, তোমাদের গর্ভে সন্তান জন্ম নেয়নি।’ ” (১২)

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “এরপর এক মাস রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে আসতেন আর ফিরে যেতেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শিথিল করে রাখেন। একদিন খাদিজার বোন ‘হালা’ আসছিলেন, তার কথাবার্তা ও গলার স্বর খাদিজার মতো ছিলো, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আমি ঈর্ষা ভরে বললাম, ‘কুরাইশদের এক লাল গালওয়ালী বুড়ির কথা আর কতো বলবেন, এক যুগ পূর্বে যার মৃত্যু হয়ে গেছে। আল্লাহ পাক তো আপনাকে তার তুলনায় উত্তম একজনকে দান করেছেন।’ এতে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীষণ অসন্তুষ্ট হোন। একেই বলে ভালোবাসা, একেই বলে ওয়াফাদারী। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যুবতী ছিলেন, সুন্দরী মহিলা ছিলেন, বংশ গৌরবও তার ছিল যথেষ্ট, আর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অত্যধিক ভালোও বাসতেন বটে, কিন্তু খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র ব্যাপারে তির্যক রসিকতাকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহ্য করেননি এবং অত্যন্ত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে মহীয়সী এই নারীর প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, ‘না, আল্লাহ’র কসম, অবশ্যই না। আল্লাহ তার বদলে তার তুলনায় আমাকে উত্তম কোন কিছুই দেননি। যখন সমস্ত মানুষ আমার দাওয়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান স্থাপন করেছে। যখন দুনিয়ার মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করেছে, তখন সে আমাকে সমর্থন করেছে। যখন মানুষ আমাকে বয়কট করেছে, তখন সে আমার প্রতি করুণা করেছে। আল্লাহ তার গর্ভে আমাকে সন্তান দিয়েছেন, অন্যদের গর্ভে কোন সন্তান দেননি।’ ” (১৩)

আল্লাহ পাক মুসলমানদের প্রথম জননী খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন, তার প্রতি অফুরন্ত রহমত নাযিল করুন, আর তাকে সন্তুষ্ট করে সর্বশেষ জান্নাত – জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চস্তরে সমাসীন করুন, আমীন। তাকে আর আমাদের সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য নবী-রাসুলগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেককার মুত্তাকীদের সাথে হাশরের ময়দানে জমায়েত করুন, আমীন। কেননা, তারাই হচ্ছেন উত্তম সহচর। আল্লাহ তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আমাদের অন্তরকে উদ্ভাসিত করুন, আর তাদের পদাংকানুসরণে আমাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দানকারী শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ উম্মত হিসেবে কবুল করুন, আমীন। অভিভাবক হিসেবে আল্লাহ পাকই যথেষ্ট।

উৎসঃ নবী পরিবারের প্রতি ভালোবাসা – মাওলানা মাহমুদুল হাসান


টীকাঃ
(১) ইবনে সাআদ – ৫২/৮, সিয়ারু আলামিন নুবালা – ১০৯/২, সাফওয়া – ৭/২, ইস্তিআব – ২৭৯/৪, ইসাবা – ২৮/৪, উসদুল গাবা – ৪৩৪/৫, মাআরিফ – ৫৯, তাহযীবুল আসমা – ৩৪১/২, শাজারাতুয যাহাব – ১৪/১, তারিখুল ইসলাম – ৪১/১, জামিউল উসুল – ১২০/৯, মুস্তাদরাক – ১৮২/৩, কানযুল উম্মাল – ৬৯০/১৩, মাজমাউয যাওয়ায়েদ – ২১৮/৯, ইবনে ইসহাক – ৮২।(২) দালাইল – ২৮৩/৭, মারিফা – ২৬৭/৩, তাবারী – ১৬০/৩, ইবনে ইসহাক – ২৪৫, মাজমা – ২৫৩/৯।(৩) ফাতহুল বারী – ৪৭৪/১, আবু নুয়াইম – ১৪৩, দালাইল – ৩০/২, সুনানুল কুবরাঃ বাইহাকী – ৩৬৬/৬, খাসাইস – ৭৯/১, সুবুলুল হুদা – ১৯৯/২, ইবনে হিশাম ১৮৩, নিহায়া – ২৮৭/২।(৪) দালাইল – ৬৬/২, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক – ৩২০/৫, আবু নুয়াইম – ৫৪/১, ইবনে হিশাম – ১৮৮/১, রাওযুল উনুফ – ২৩৬/২, তাবারী – ২৮০/২, ইবনে সাআদ – ৮২/১, উয়ুনুল আসার – ৬১/১, নিহায়াতুল আরব – ৮৫/১৬।(৫) ইবনে সাআদ – ৩১০/১, মুস্তাদরাক – ১৮২/৩, আহমাদ – ৩১২/১, মুজামে তাবারানী – ১৮৬/১২, মুসান্নাফা – ৩২০/৫, ইবনে ইসহাক – ৮১, আরাকী – ২৬৭/৩, মাজমা – ২২০/৯, ইবনে হিশাম – ১৮৯, মাওয়াহিব – ২০২/১, দালাইল – ৯০/১, মুনতাখাব – ১৯৯।(৬) ইবনে সাআদ – ৮৪/১, সিমতুসসামীন – ৩২/১৬, মুসান্নাফা – ৩২০/৫, দালাইল – ৪২৪/১, মাজমা – ২২১/৯, উয়ুনুল আসার – ৬২/১, মুনতাখাব – ২৫, ইবনে হিশাম – ১৮৯/১, সিরাতে ইবনে কাসির – ২৬৭/১।(৭) বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, শারহুস সুন্নাহ – ২৬৯/৭, বাইহাকী – ৫১/৭, আহমাদ – ২৩২/৬, ইবনে হিব্বান – ১১৫/১।(৮) বুখারী, মুসলিম, ফাতহুল বারী – ৪৫২/৩, ইবনে হিশাম – ৩৫২/১, রাওযুল উনুফ – ২৮৩/৩।(৯) বুখারী, ফাতহুল বারী – ১৩৩/৭, মুসলিম, তিরমিযি, নাসাঈ, সিমতুসসামীন – ২৪, আহমাদ – ২০৫/১, ২০৩/২, তাবারী – ১১/১৩, মাজমা – ২২৩/৯, মুস্তাদরাক – ১৮৫/৩, কানযুল উম্মাল – ১৩০/১২।(১০) দালাইল – ৩৫২/২, হাকিম – ১৮২/৩, ইবনে ইসহাক – ২৪৩, তাবারী – ৩৪৩/২।(১১) বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ফাতহুল বারী – ১৩৩/৭।(১২) তাবরানী – ১৩/২৩, আহমাদ – ১১৭/৩, হাইসামী – ২২৪/৯।(১৩) মাজমা – ২২৪/৯, বুখারী, মুসলিম, ফাতহুল বারী – ১৩৪/৭।