কোন মুসলমান মারা গেলে তাকে কবরে দাফন করা ইসলামের অন্যতম শিআর বা বিশেষ নিদর্শন এবং ফরযে কিফায়াহ তথা কিছু লোক এই ফরয হুকুম আদায় না করলে সকলেই গুনাহগার হবে। আর কিছু লোক আদায় করলে সকলেই দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ হুকুম সঠিকভাবে পালন করা যেহেতু জরুরী তাই আমরা এর সাথে সম্পর্কিত কবর খনন করার এবং কবরে মায়্যেতকে দাফন করার শরঈ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করব।
জেনে নেয়া উচিত যে, কবরের সর্বমোট গভীরতার পরিমাণ হচ্ছে মধ্যম গঠনের কোন ব্যক্তির অর্ধদেহ থেকে বুক বা পূর্ণদেহ পর্যন্ত এবং উক্ত ব্যক্তির বুক পর্যন্ত কবর গভীর হওয়া উত্তম আর পূর্ণদেহ পর্যন্ত হওয়া অধিক উত্তম, তবে পূর্ণদেহ থেকে বেশি গভীর না হওয়া উচিত। আর কবরের সর্বাধিক প্রস্থ হচ্ছে মাইয়্যেতের অর্ধদেহ পর্যন্ত । আর দৈর্ঘ্য হচ্ছে মাইয়্যেতের পূর্ণদেহ পর্যন্ত।(ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৩/১৪১)
শরী‘আতের দৃষ্টিতে কবর দুই প্রকার (ক) বগলী কবর (খ) সিন্দূক কবর।
যে স্থানে মাইয়্যেতকে দাফন করা হবে সে স্থানের মাটি শক্ত ও মজবূত হলে সেখানে বগলী কবর খনন করা উত্তম, পক্ষান্তরে ঐ স্থানের মাটি নরম হওয়ার দরুন বগলী কবর ডেবে যাওয়ার আশংকা হলে সিন্দূক কবর খনন করা চাই। (আহকামে মাইয়্যেত পৃ.৮৩)
আমাদের দেশের মাটি নরম হওয়ার দরুন বগলী কবর খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ, তাই সাধারণত সিন্দূক কবর খনন করা হয়।
সিন্দূক কবর খনন ১ম পদ্ধতিঃ
সিন্দূক কবর খনন ও তাতে মাইয়্যেতকে দাফনের শরঈ পদ্ধতি এই যে, কবরের পূর্ণ গভীরতার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ খনন করার পর ঠিক মাঝামাঝি মাইয়্যেতকে ডান কাতে রাখা যায় এমন প্রস্থে কবরের শেষ গভীরতা পর্যন্ত মাইয়্যেতের দৈর্ঘানুপাতে একটি গর্ত খনন করা হবে, তবে উত্তর দিকে মাথা রাখার স্থানে একটু উঁচু রাখা হবে, যাতে মাইয়্যেতকে ডানকাতে শোয়ালে শরীরের সাথে মাথা সোজা থাকে। অতঃপর এই গর্তে মাইয়্যেতকে রাখার সময় এই দুআ পড়বে بسم الله وعلى ملة رسول الله এবং মাইয়্যেতকে সম্পূর্ণ ডানকাতে শোয়ানো হবে, যাতে তার চেহারা , সিনা ও পুরা শরীর কিবলামুখী হয়ে যায়, অতঃপর নীচের গর্তটি মাইয়্যেতের শরীর থেকে এক বিঘত উপরে মজবূত বাঁশ, কাঁচা ইট বা কাঠ দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে কাঁচা ইট বা সিমেন্ট দ্বারা তৈরিকৃত স্ল্যাব ব্যবহার করা যেতে পারে । অতঃপর মাটি দিয়ে বাকি অংশ ভরাট করে জমিনের উপর বুক ও মাথা বরাবর স্থানটুকু কুঁজ সদৃশ এক বিঘত বা এর চেয়ে সামান্য বেশি পরিমাণ উঁচু করা হবে। আমাদের দেশে সম্পূর্ণ কবর যেভাবে মাটি দিয়ে উঁচু করা হয় এর কোন প্রমাণ নেই।
সিন্দূক কবর খনন ২য় পদ্ধতিঃ
সিন্দূক কবর খননের দ্বিতীয় একটি পদ্বতি এই যে, মাইয়্যেতকে রাখার গর্তটি একেবারে মাঝে খনন না করে পশ্চিম পাশে পূর্বের নিয়মে খনন করা হবে এবং মাইয়্যেতকে সুন্নত তরিকায় রাখা হবে। অতঃপর বাঁশ বা কাঠের এক পাশ কবরের পূর্ব দেয়ালের গোঁড়ায় রাখা হবে এবং অপর পার্শ্ব কবরের পশ্চিম দেয়ালের সাথে জমিন থেকে আনুমানিক একহাত নীচে মিলিয়ে রাখা হবে। অতঃপর মাটি দিয়ে বাকি অংশ পূর্বের নিয়মে ভরাট করা হবে। যাতে করে শিয়াল কুকুর অন্য কোন হিংস্র প্রাণী লাশের ক্ষতি করতে না পারে। (বজলুল মাজহূদ ৪/২০৫, মুসনাদে আহমাদ হা.নং- ৪৯৮৯, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬, আততাজরীদ ৩/১০৭২, বাদায়েউস সানায়ে ১/৩২০, এমদাদুল আহকাম ১/৮৩৯)
বগলী কবর খননঃ
যে স্থানে মাইয়্যেতকে দাফন করা হচ্ছে সে স্থানের মাটি শক্ত হলে সেখানে বগলী কবর খনন করা উত্তম। বগলী কবর খনন ও তাতে মাইয়্যেতকে দাফনের শরঈ পদ্ধতি এই যে, মধ্যম গঠনের কোন ব্যক্তির বুক বা পূর্ণদেহ পরিমাণ গভীর ও মাইয়্যেতের পূর্ণদেহ সমপরিমাণ দীর্ঘ ও বেশির থেকে অর্ধদেহ পরিমাণ প্রশস্ত একটি কবর খনন করা হবে। অতঃপর ঐ কবরের নীচের জমীন বরাবর পশ্চিম দেয়ালে নীচের অংশে মাইয়্যেতের দৈর্ঘানুপাতে ও মাইয়্যেতকে ডানকাতে রাখা যায় এই পরিমাণে একটি গর্ত খনন করা হবে এবং তার মাথা ও কোমর বরাবর মাটি,পাথর বা কাঁচা ইট ইত্যাদি রাখা হবে যাতে সে চিত হয়ে না পড়ে এবং কিবলার দিক থেকে তার পুরা শরীর সরে না যায়। অতঃপর মজবূত বাঁশ মাটিতে সোজাভাবে গেড়ে ঐ গর্ত ঢেকে দেয়া হবে এবং পুরা কবর মাটি দিয়ে পূর্বের নিয়মে ভরাট করা হবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২২৩, গুনইয়াতুল মুতামালি পৃ.৫৯৮, ইমদাদুল আহকাম ১/৮৩৯)
কিছু করণীয় কাজ
১. মাইয়্যেতের দাফনের কাজে উপস্থিত ব্যক্তিদের জন্য মুস্তাহার বা করণীয় এই যে, প্রত্যেকে দু’হাত দিয়ে কিছু মাটি মাইয়্যেতের মাথার দিক দিয়ে কবরে তিনবার ফেলবে এবং প্রথমবার منها خلقنا كم দ্বিতীয়বার وفيها نعيد كم ও তৃতীয়বার ومنها نخرج كم تارة اخرى পড়বে। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/৭৬, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬)
২. দাফনের কাজ শেষ হওয়ার পর মুস্তাহাব এই যে, একজন মাইয়্যেতের মাথার নিকট সূরা বাকারার শুরু থেকে مفلحون পর্যন্ত— এবং পায়ের নিকট সূরা বাকারার শেষের দুই আয়াত তথা امن الرسول থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করবে। (শু‘আবুল ঈমান হা.নং ৮৮৫৪, রদ্দুল মুহতার ২/২৪৩)
কিছু বর্জনীয় কাজ
১. অনেক এলাকায় দাফনের কাজ শেষ হওয়ার পর কবরের চার কোনায় চারটি খুটি গাড়ার এবং চার ক্বূল পড়ার প্রথা আছে । কোথাও কবরের মাঝ বরাবর খেজুরের ডাল গাড়া হয়, শরী‘আতের দৃষ্টিতে এর কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং এই প্রথার অনুসরণ সুন্নত বা সাওয়াবের কাজ মনে করা বিদআত বা মারাত্মক গুনাহ। (সহীহ বুখারী হা.নং ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম হা.নং ১৭১৮)
২. আবার কোন কোন জায়গায় কবরে ফুল দেয়া হয় । শরী‘আতের দৃষ্টিতে এটাও নাজায়িয। (নযামুল ফাতাওয়া ২/১৭৬, ফাতাওয়া রহীমিয়্যাহ ১/১২৩)