আল কুরআনুল কারীম মানব জাতির সামনে কিছু ইতিহাস তুলে ধরেছে। যেন মুমিন সত্যের শিক্ষা পায়, সত্যে অটল থাকে। মিথ্যাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। বিজয়কে খুঁজে নেয়। পরাজয়কে দু’পায়ে মাড়ায়। আল্লাহকে পেতে চায়। দুনিয়াকে পেছনে রাখে। অত্যাচারী যেন একটু চিন্তায় পড়ে। নিজের কল্যাণকামী হয়ে যুলুম থেকে নিবৃত্ত হয়। কাফির যেন সত্যের আলো পায়, সত্যকে গ্রহণ করে।
আলকুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর বড় বড় যালিমদের ইতিহাস, তাদের যুলুম ও করুণ পরিণতির কথা তুলে ধরেছেন। ‘আসহাবুল উখদূদ’ তাদের অন্যতম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (অর্থ) ‘আসহাবুল উখদূদ’ গর্তের অধিপতিরা ধ্বংস হয়েছে। ইন্ধনপূর্ণ অগ্নিকুন্ডের অধিপতিরাও। যখন তারা অগ্নিকুন্ডের পাশে বসা ছিল। মুমিনদের সঙ্গে তারা যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তাদেরকে তারা কেবল একারণেই শাস্তি দিচ্ছিল যে, তাঁরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল, যিনি মহা ক্ষমতার অধিকারী, প্রশংসার্হ। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁর হাতে। এবং আল্লাহ সব কিছু দেখেন। নিশ্চিত জেনে রেখ, যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে নির্যাতন করেছে, তারপর তাওবাও করেনি, তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি এবং জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি। (বুরূজ (৮৫) : ৪-১০)
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা একটি ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ন করেছেন। খুবই ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় সে দৃশ্যগুলো। যালিমের যুলুমের দৃশ্য। অত্যাচারীর নির্যাতনের চিত্র। সাচ্চা মুমিনের বীরত্বের বিজয়গাঁথা। ইতিহাসে এ ঘটনাটি আসহাবে উখদূদের ঘটনা হিসেবে প্রসিদ্ধ।
এক বাদশাহর একজন যাদুকর ছিল। যাদুতে সে খুবই পারদর্শী। যাদুকর বৃদ্ধ হলে পরে বাদশাহকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, কখন মরে যাই তার ঠিক নাই, সুতরাং আমাকে একটা ছেলে এনে দাও। আমি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিয়ে যাই।
বাদশাহ তার নিকট একটি বালক পাঠিয়ে দিল। যাদুকর সেই বালকটিকে যাদু শিখাতে লাগল। বালকটি যে পথে যাদুকরের নিকট আসত, সে পথে ছিল এক মুসলমান আলেমের দরবার। তিনি সেখানে ইবাদত করতেন। কখনো লোকদের ওয়াজ নসিহত করতেন। বালকটি সেখানে বসে আলেমের কথা শুনতো আর খুবই প্রভাবিত হত। যখনই সে ঐ পথে যাদুকরের নিকট যেত আলেমের নিকট বসত। কথা শুনত। এতে যাদুকরের নিকট যেতে তার দেরি হত। আর যাদুকর তাকে প্রহার করত।
এভাবেই চলছিল বালকের দিনকাল। একদিকে দ্বীনের আলো গ্রহণ করছে। অন্যদিকে শিখছে যাদুবিদ্যা।
একদিন বালকটি পথ চলছে। দেখল, বৃহদাকার এক প্রাণী পথ আগলে বসে আছে। মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে রেখেছে। বালকটি মনে মনে বলল, আজ দেখে নেব, আলেম শ্রেষ্ঠ না যাদুকর শ্রেষ্ঠ। সে একটি পাথর হাতে নিয়ে বলল, হে আল্লাহ! যদি আপনার নিকট যাদুকরের কাজের চেয়ে আলেমের কাজ প্রিয় হয় তাহলে এ পাথরের আঘাতে প্রাণীটিকে মেরে ফেলুন। এ বলে সে পাথরটি নিক্ষেপ করল। আর অমনিই প্রাণীটি মারা গেল। মানুষের পথ উন্মুক্ত হল। লোকজন চলাচল শুরু করল।
বালকটি আলেমের নিকট পৌঁছে এ ঘটনা শোনাল। আলেম তাকে বললেন, আজ থেকে তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠ হয়ে গেছ। তুমি যে স্তরে পৌঁছেছ তা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে, অচিরেই তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। পরীক্ষার সম্মুখীন হলে আমার কথা প্রকাশ করে দিও না যেন।
তারপর থেকে বালকটি অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে ভাল করতে লাগল। মানুষকে সকল ধরনের রোগ থেকে সুস্থ করতে লাগল। এদিকে বাদশাহর এক সঙ্গী ছিল অন্ধ। বালকের এ খবর তার নিকট পৌঁছল। সে অনেক উপঢৌকন নিয়ে বালকের নিকট আসল। সে বালকটিকে বলল, তুমি যদি আমায় সুস্থ করতে পার তবে এ যা দেখছ, সব তোমার। বালকটি বলল, আমি কাউকে সুস্থ করতে পারি না। আসলে সুস্থ করেন আল্লাহ তাআলা। যদি আপনি আল্লাহর উপর ঈমান আনেন আমি আল্লাহর নিকট আপনার জন্য দুআ করব। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দিবেন। বাদশাহর সেই সঙ্গী আল্লাহর উপর ঈমান আনলেন। আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থ করে দিলেন।
বাদশাহর সেই সঙ্গী সুস্থ হয়ে ফিরে গেলেন। পূর্বের মতো বাদশাহর দরবারে বসলেন। বাদশাহ বলল, তোমার দৃষ্টি শক্তি কে ফিরিয়ে দিল? সে বলল, আমার প্রতিপালক। বাদশাহ বলল, আমি ছাড়া তোমার অন্য প্রতিপালক আছে? সে বলল, আমার এবং আপনার প্রতিপালক হলেন আল্লাহ। এতে বাদশাহ চটে গেল। তাকে বন্দি করে নির্যাতন শুরু করল। একপর্যায়ে সে বালকটির কথা বলে দিল। বালকটিকে ডেকে আনা হল। বাদশাহ বালকটিকে বলল, হে বৎস! আমি জানলাম তুমি নাকি যাদু করে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করে তোল। আরো বিভিন্ন রোগ ভাল কর। বালকটি বলল, আমি কাউকে সুস্থ করতে পারি না। আসলে সুস্থ করেন আল্লাহ তাআলা। এতে বাদশাহ বালকটির উপরও চটে গেল । সে তাকে বন্দি করে নির্যাতন শুরু করল। একপর্যায়ে বালকটিও আলেমের কথা বলে দিল।
বাদশাহ আলেমকে ডেকে পাঠাল। আলেমকে আনা হল। আলেমকে বলা হল, আপনি আপনার ধর্ম ত্যাগ করুন। ধর্ম থেকে ফিরে আসুন। আলেম তা অস্বীকার করলেন। তারপর বাদশাহর আদেশে একটি করাত আনা হল। আলেমের মাথায় করাত রেখে তাকে দ্বিখন্ডিত করা হল। তারপর বাদশাহর সঙ্গীকে আনা হল। তাকেও বলা হল, তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ কর। ধর্ম থেকে ফিরে আস। সে-ও ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তাকেও সেই করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করা হল।
অবশেষে বালকটিকে আনা হল। তাকেও ধর্ম ত্যাগের কথা বলা হল। বালকটি অস্বীকার করল। বাদশাহ তাকে তার কয়েকজন লোকের হাতে দিয়ে বলল, তাকে নিয়ে ঐ পাহাড়ে যাও। যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবে, তাকে ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। যদি সে ধর্ম ত্যাগ করে তবে তো ভাল। আর যদি অস্বীকার করে তবে তাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে ফেলে দেবে। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ে আরোহন করল। বালকটি দোয়া করল, হে আল্লাহ! আপনি যেভাবে চান আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করুন। তখনই পাহাড়টি কাঁপতে লাগল। বালকটিকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল সকলেই পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেল। বালকটি বাদশাহর নিকট ফিরে আসল।
বাদশাহ বালকটিকে দেখে আশ্চর্য হল। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে যারা নিয়ে গেল, তারা কোথায়? বালকটি বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তারপর বাদশাহ বালকটিকে আরেক দল লোকের হাতে তুলে দিয়ে বলল, একে একটি বড় নৌকায় করে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাবে। যদি সে তার ধর্ম পরিত্যাগ করে তবে তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবে। তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে গেল। তখন বালকটি আল্লাহর নিকট দুআ করল, হে আল্লাহ! আপনি যেভাবে চান আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করুন। এতে নৌকা একেবারে কাত হয়ে গেল। তারা সবাই ডুবে গেল। আর বালকটি সুস্থ দেহে ফিরে আসল।
বালকটি বাদশাহর কাছে আসলে বাদশাহ বলল, তোমাকে যারা নিয়ে গেল তারা কোথায়? বালকটি বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তারপর বালকটি বাদশাহকে বলল, আপনি যতই চেষ্টা করেন আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে আমি যেভাবে বলি যদি তা করতে পারেন, আমাকে হত্যা করতে পারবেন। বাদশাহ বলল, তা কীভাবে? সে বলল, খোলা ময়দানে সকল মানুষকে একত্রিত করুন। তারপর আমাকে একটি খেজুর ডালে বাধুন। আর আমার তূনীর থেকে একটি তীর নিয়ে ‘‘বালকটির রব আল্লাহর নামে’’ বলে তীরটি আমার দিকে নিক্ষেপ করুন। এতে আমার মৃত্যু হবে।
বাদশাহ সকল মানুষকে এক বিস্তীর্ণ ময়দানে একত্রিত করল। এবং বালকটিকে একটি খেজুর ডালে বাধল। তারপর বালকটির তূনীর থেকে একটি তীর নিয়ে ‘‘বালকটির রব আল্লাহর নামে’’ বলে তার দিকে নিক্ষেপ করল। তীরটি তার চোখ ও কানের মধ্যবর্তী স্থানে বিঁধল। সে তার হাতটি তীর বিধার স্থানে রাখল এবং মৃত্যুবরণ করল। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা বলতে লাগল, আমরাও বালকটির রব আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম। আমরাও বালকটির রব আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম।
এ ঘটনা দেখে বাদশাহর লোকজন তার নিকট গিয়ে বলল, আপনি যেই আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটল। সব লোক বালকটির রবের উপর ঈমান এনেছে। পরে বাদশাহ গলির প্রবেশপথগুলোতে বড় বড় গর্ত খননের আদেশ দিল। গর্ত খনন করা হল। এবং তাতে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হল। তারপর বাদশাহ হুকুম দিল, যারা আল্লাহর ওপর ঈমান ত্যাগ করবে না তাদেরকে এ আগুনে নিক্ষেপ কর। আগুনে পুড়িয়ে মার। অথবা যে ধর্ম ত্যাগ করবে না সে যেন আগুনে ঝাঁপ দেয়। বাদশাহর লোকেরা তাই করল। একে একে আল্লাহ্-বিশ্বাসী বান্দারা আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিল। আর শাহাদাতের সুধা পান করছিল। আর অগ্নিকুন্ডের অধিপতিরা তা দেখছিল। এক মহিলার পালা এলো। তার কোলে ছিল দুধের শিশু। শিশুর মায়ায় সে আগুনে ঝাঁপ দিতে দেরি করছিল। তখন তার কোলের শিশুটি মুখ খুলল। সে বলল, মা তুমি ধৈর্য ধর। তুমি সত্যের পথেই আছ। ( সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০০৫; আল মুসনাদুল জামে, হাদীস ৫৪০৫ অবলম্বনে)
আজ তারা দুনিয়ায় নেই। সেই বিশ্বাসী মুমিন বান্দারাও নেই, যারা ঈমানের জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়েছে। অগ্নিকুন্ডের অধিপতিরাও নেই, যারা শুধু আল্লাহর উপর ঈমান আনার কারণে মুমিনদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল। আর যারা পাশে বসে তাদের মৃত্যু-যন্ত্রণা অবলোকন করেছে, তারা কেউ আজ নেই। কিন্তু এদের সবার পরিণতি কি এক? নির্যাতিত-নিপীড়িত বিশ্বাসী মুমিনের পরকাল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শান্তি, সম্মান ও সুখের। আর অগ্নিকুন্ডের অত্যাচারী অধিপতিরা দুঃসহ অনন্ত আগুনে পুড়ে মরছে। তাই তারা আজ ইতিহাস হয়ে আছে। হয়ে আছে ইতিহাসের শিক্ষা।
আল্লাহ কুরআন-হাদীসের মাধ্যমে তাদের ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। কাউকে নন্দিত করার জন্য। কাউকে নিন্দিত করার জন্য। আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। নিন্দিত নয় নন্দিত হওয়ার জন্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দান করুন।
শাওয়াল ১৪৩৪ . আগস্ট ২০১৩
মাসিক আলকাউসার