بسم الله الرحمن الرحيم
দৃষ্টির লাগামহীনতাই অধিকাংশ অশ্লীলতার প্রধান উৎস। এজন্য গবেষকরা বলে থাকেন, কুদৃষ্টি সকল অনিষ্টের মূল। এদু’টি ছিদ্র দিয়েই ফেতনার বন্যা ছুটে আসে। সমাজের মাঝে অবস্থিত থৈ থৈ করা নগ্নতার মূল কারণও এ দু’টি ছিদ্র। তাই ইসলাম ছিদ্র দু’টির ওপর পাহারাদার নিযুক্ত করে দিয়েছে। প্রত্যেক মুমিনকে দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ এটাও ইসলামের ফলপ্রসূ শিক্ষারই চমৎকার বহিঃপ্রকাশ। এতে পরনারীর প্রতি দৃষ্টি যায় না, যৌনতার উদ্দামতা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে না। বাঁশও থাকে না, বাঁশিও বাজে না। নীতির কথা হল, Nip the evil in the bud. অর্থাৎ মন্দের উৎসটা শেষ করে দাও। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যাদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত নয় তাদের মাঝে জৈবিকচাহিদার আগুন জ্বলতে থাকে। এই লাগামহীনতাই মানুষকে ধীরে ধীরে বেহায়াপনার অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দেয়।
দৃষ্টিসংরক্ষণ : পবিত্র কুরআন কী বলে?
এ সুবাদে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ يَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذَالِكَ اَزْكى لَهُمْ
اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ
‘হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। তারা যা করে মহান আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।’(সূরা নূর : ৩০)
পবিত্র কুরআনের আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। তাফসীরবিশারদগণ লিখেছেন, আয়াতটিতে রয়েছে শিষ্টাচার, সতর্কতা ও চ্যালেঞ্জের বিবরণ। নিম্নে তা উপস্থাপন করা হল-
ক. আয়াতের প্রথমাংশে রয়েছে শিষ্টাচারের বিবরণ। অর্থাৎ যেসব বস্ত্ত দেখা মুমিনদের জন্য অবৈধ, তা থেকে যেন দৃষ্টিকে অবনত রাখে। গোলামের কৃতিত্ব হল মনিবের আনুগত্য করা। আয়াতটিতে এ শিক্ষাও রয়েছে যে, দৃষ্টির হেফাজত প্রথম কাজ। লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সর্বশেষ কাজ। একটির জন্য অপরটি অপরিহার্য। সুতরাং দৃষ্টির লাগাম ধরতে না পারলে লজ্জাস্থানও অনিবার্যভাবে নিয়ন্ত্রণের গন্ডিতে রাখা যায় না।
খ. ذَالِكَ اَزْكى لَهُمْ অর্থাৎ এতে রয়েছে তাদের জন্য পবিত্রতা। আয়াতের এ অংশে রয়েছে সতর্কতা। দৃষ্টির হেফাজতে রয়েছে অন্তরের পবিত্রতা। ফলে গুনাহ্র কুমন্ত্রণা অন্তরে ইতিউতি করে না। ইবাদতে মনোযোগ আসে। প্রবৃত্তিপনা, শয়তানিপনা, পাশবিকতাড়না ও কুমন্ত্রণা প্রভৃতি থেকে অন্তপ্রাণকে বাঁচানো যায়। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির কারণে অন্তরের প্রশান্তি চলে যায়। অব্যক্ত অনুশোচনার অব্যাহত ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ফেতনায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে ওঠে।
গ. আয়াতের শেষাংশ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহতাআলা তারা যা করে তা সর্ম্পকে জানেন।’ এর মাঝে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। আল্লাহর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে যে, বান্দা যদি উক্ত দিকনির্দেশনার তোয়াক্কা না করে তাহলে যেন মনে রাখে যে, মহান আল্লাহ অসচেতন নন। তিনি বান্দার প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জানেন। অবাধ্যদেরকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়- তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন।
মনে রাখবেন, পুরুষদের মতই নারীদেরকেও সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারাও যেন দৃষ্টি সংযত রাখে। কারণ নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীরই সৃষ্টির উপকরণ অভিন্ন। সুতরাং যৌনতার প্রতি আকর্ষণ নারীপ্রকৃতিতেও রয়েছে। তাই আল্লাহতাআলা নারী জাতির উদ্দেশে বলেছেন-
قُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ يَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ
‘হে নবী! ঈমানদার নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করে।’
উক্ত আয়াতদ্বয়ের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এ বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণহীনতা বেহায়াপনার বিস্তৃতি ঘটায় এবং লজ্জাস্থানের শিহরণ তৈরি করে। এ জাতীয় পরিস্থিতিতে মানুষের বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে যায়। মানুষ তখন বিবেকবুদ্ধির দিক থেকে অন্ধ হয়ে যায়। গুনাহে জড়িয়ে পড়ে লাঞ্ছণার অতল সাগরে ডুব দিয়ে বসে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতই নারীদের অবস্থা হয়। বরং নারীরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। অল্পতেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সুতরাং তাদের দৃষ্টি কোনোদিকে ঝুঁকে পড়লে ক্ষতির আশঙ্কা অধিক থাকে। সুতরাং তাদের দৃষ্টি অবনত রাখার গুরুত্বটা একটু বেশি। ইমাম গাযালী রহ. বলেন-
ثُمَّ عَلَيْكَ وَفَّقَكَ اللهُ وَاِيَّانَا بِحِفْظِ الْعَيْنِ فَاِنَّهَا سَبَبُ كُلِّ فِتْنَةٍ وَافَةٍ
‘অতঃপর তুমি দৃষ্টির সংরক্ষণ অবশ্যই করবে। আল্লাহ তোমাকে এবং আমাকে তাওফিক দান করুন। কেননা, এটা প্রত্যেক ফেতনা ও আপদের কারণ।’ (মিনহাজুল আবিদীন, পৃষ্ঠা : ২৮)
এর দ্বারা জানা গেল, চোখের ফেতনা নিদারুণ ভয়াবহ। সমূহ ফেতনার মূল উৎস এটি।
দৃষ্টি সংযত রাখা সম্পর্কে হাদীসে যা রয়েছে
১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
غُضُّوْا اَبْصَارَكمُ وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ.
‘তোমরা দৃষ্টি অবনত রাখো এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর।’(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪)
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. লিখেছেন, দৃষ্টি জৈবিকচাহিদার পিয়ন ও রাহবার হয়ে থাকে। দৃষ্টির সংরক্ষণ মূলতঃ লজ্জাস্থান ও যৌনচাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগের সংরক্ষণ হয়ে থাকে। যে দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়েছে সে নিজেকে ধ্বংসের মাঝে ফেলে দিয়েছে। মানুষ যেসব আপদে নিমজ্জিত হয় এর মূলভিত্তি হল দৃষ্টি।’(আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা-২০৪)
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلنَّظْرَةُ سَهْمٌ مَسْمُوْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ
‘দৃষ্টি হল ইবলিসের বিষাক্ত তীরসমূহের অন্যতম।’ (প্রাগুক্ত)
৩. জনৈক মনীষী বলেছেন-
اَلنَّظْرُ سَهْمٌ سَمَّ اِلَى الْقَلْبِ.
‘দৃষ্টি একটি তীর যা অন্তরে বিষ ঢেলে দেয়।’(ইবনুকাছীর, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ২৮৩)
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ
‘চোখের ব্যভিচার হল দেখা।’ (মুসলিমশরীফ)
এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়, যেব্যক্তি পরনারীর চেহারার প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকায় সে তার সঙ্গে মনে মনে ব্যাভিচারও করে ফেলে। পূর্বসূরী বুযুর্গানেদীন দৃষ্টিকে বলেছেন, ‘ভালোবাসার বাহক’। জুলাইখা ইউসুফ আলাইহিসসালামের চেহারার প্রতি না তাকালে নিজের জৈবিককামনার কাছে এভাবে নেতিয়ে পড়ত না এবং গুনাহের প্রতি আহবানও করত না। ক্ষণিকের লাগামহীন আচরণের কারণে পবিত্র কুরআনে তার নাম লাঞ্ছণার সাথে আলোচিত হয়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত তার দিকে নির্লজ্জা কাজের জন্য ইঙ্গিত করা হবে। শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত, কত ভয়াবহ ও করুণ হয় কুদৃষ্টির লাঞ্ছণা।
দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যাওয়া ক্ষমাযোগ্য
অনেক সময় এমন হয়, পথে-ঘাটে আচমকাভাবে পরনারী সামনে এসে পড়ে। হঠাৎ তাদের চেহারার দিকে দৃষ্টি পড়ে যায়। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলী রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন-
يَا عَلِىُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ. فَاِنَّ لَكَ الْاُوْلى وَلَيْسَتْ لَكَ الْاخِرَةَ
‘হে আলী! আচমকা দৃষ্টি পড়ে গেলে তুমি পুনরায় দৃষ্টি দিওনা। কেননা, প্রথমদৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য এবং দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়।’ (মেশকাতশরীফ)
বোঝা গেল, একবার দৃষ্টি পড়ে গেলে তা ক্ষমাযোগ্য। তবে যদি প্রথমবারের দৃষ্টিপাতটাও স্বেচ্ছায় হয় তাহলে এটাও হারাম। প্রথমদৃষ্টিপাত বৈধ হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অপলক নয়নে গভীরভাবে একবার দেখা। কারণ এটাও হারাম।
জারীর ইবনুআবদিল্লাহ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে যায় তার বিধান কী? তিনি বলেন-
اِصْرِفْ بَصَرَكَ
‘দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নাও।’ (মেশকাতশরীফ)
অনেক সময় শরীয়তসম্মত কোনো অপারগতার কারণে বিচারক, ডাক্তার ও জজ পরনারীর চেহারা দেখতে হয়। এক্ষেত্রে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হবে।
কুদৃষ্টি অনিষ্টের মূল
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকানো সকল অনিষ্টের মূল। শয়তান পরনারীর চেহারাকে খুব নয়নলোভন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করে। দূর থেকে সব জিনিস ভালোই দেখায়। এজন্যই প্রবাদ আছে, দূরের ঢোল শ্রম্নতিমধুর হয়। কুদৃষ্টির ফলে মানবহৃদয়ে পাপের বীজ তৈরি হয়। সুযোগ পেলেই তা ফুলে-ফেঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। কাবিল হাবিলের স্ত্রীর রূপ-যৌবনের প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছিল। পরিণামে তার কাঁধে এমনই ভূত চড়ে বসেছিল, আপন ভাইকে হত্যা করতেও তার কলিজা কাঁপে নি। পবিত্র কুরআনে তার এহেন কর্মকান্ডের আলোচনা এসেছে। গুনাহর ভিত্তি রচনা করার কারণে কেয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল হত্যার বোঝা তার ঘাড়েও চাপানো হবো।
বোঝা গেল, প্রথমদৃষ্টির ব্যাপারে তো ছাড় আছে। কিন্তু দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে এই ছাড়টা আর থাকবে না।
چلے كہ ايك نظر تيرى بزم ديكھ آئيں
يہا ں جوآ ے تو بے اختيار بيٹھ گے
‘চল, একপলক দেখে আসি সভা তোমার,
মনের অজান্তেই এখানে এসেই তুমি বসে পড়লে।’
এজন্য এটাই শ্রেয় যে, প্রথমদৃষ্টির হেফাজত করবে। আশঙ্কার ভেতরে পড়ে যাওয়া সচেতন লোকদের স্বভাব নয়।
কুদৃষ্টি ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَلْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظْرُ وَالْاُذُنَانِ زِنَاهُمَا الْاِسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُمَا الْككَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهُمَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهُمَا الخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوِىْ وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَالِكَ الْفَرْجُ اَوْ يُكَذِّبُه
‘দুই চোখের ব্যভিচার হল হারাম দৃষ্টি দেয়া, দুই কানের ব্যভিচার হল পরনারীর কণ্ঠস্বর শোনা, যবানের ব্যভিচার হল অশোভন উক্তি, হাতের ব্যভিচার হল পরনারী স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হল গুনাহর কাজের দিকে পা বাড়ান, অন্তরের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা আর গুপ্তাঙ্গঁ তা সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।’ (মেশকাতশরীফ, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩২)
ইমাম গাযালী রহ. বলেন, ‘দৃষ্টি অন্তরে খটকা তৈরি করে। খটকাটা কল্পনায় রূপ নেয়। কল্পনা জৈবিকতাড়নাকে উসকে দেয়। আর জৈবিকতাড়না ইচ্ছার জন্ম দেয়।’ সুতরাং বোঝা গেল পরনারীকে দেখার পরেই ব্যভিচারের ইচ্ছা জাগে। না দেখলে ইচ্ছাও জাগবে না। প্রতীয়মান হল, ব্যভিচারের প্রথমসিঁড়ির নাম হল কুদৃষ্টি। প্রবাদ আছে, পৃথিবীর সবচে দীর্ঘতম সফর এক পা ওঠালেই শুরু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির মাধ্যমে শুরু হয় ব্যভিচারের সফর। ঈমানদারের কর্তব্য হল সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলা থেকে বিরত থাকা।
কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকার মাঝে রয়েছে ঈমানের স্বাদ
মুসনাদেআহমাদে এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ اِلى مَحَاسِنِ الْمَرْأَةِ اَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَه
اِلَّا اَحْدَثَ اللهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حَلَاوَتَهَا
‘কোনো মুসলিমব্যক্তি কোনো নারীর সৌন্দর্য্যের দিকে তাকাল, এরপর সে তার দৃষ্টি নামিয়ে নিল, আল্লাহতাআলা তার অন্তরে ইবাদতের এমন স্বাদ দান করবেন, যা সে অনুভব করবে।’
তাবারানীশরীফে পরনারী থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে-
مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه
‘যে আমার ভয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে, আমি অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব, যাতে সে তার স্বাদ পাবে।’(আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৩৭)
কত উপকারী বেচাকেনা। কুদৃষ্টির সাময়িক ও তুচ্ছ স্বাদ ছেড়ে দিলে ঈমানের স্থায়ী মিষ্টতা ভাগ্যে জুটে। প্রতীয়মান হল, মহান আল্লাহ এমন ব্যক্তির বুকে প্রশান্তি দান করেন। এটা নিয়মের কথাও যে, আমলের প্রতিদান অনুরূপ বস্ত্ত দ্বারা দেয়া হয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার ক্ষণিকের মজা ছেড়ে দিলে, এর বিনিময়ে আল্লাহ ঈমানের স্বাদ দান করবেন।
কুদৃষ্টি দ্বারা কখনও তুষ্ট হওয়া যায় না
হযরত থানবী রহ. বলেন, কুদৃষ্টি যতই দাও, এমন কি হাজার হাজার নারী-পুরুষ চোখের সামনে ঘোরালেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুদৃষ্টি দিলেও পরিতৃপ্ততার নাগাল পাওয়া যাবে না।
কুদৃষ্টি এমন পিপাসার নাম যা নিবারণ হয় না। পানিখেকো রোগীর মত। পানি যতই পান করুক, এমন কি পেট ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হলেও যেন পিপাসা মিটে না।
সৌন্দর্য আপেক্ষিক বিষয়। আল্লাহতাআলা একজনের চাইতে আরেকজনকে বেশি সৌন্দর্য দান করেছেন। যত সুন্দরী নারীই দেখুক না কেন, আরেকজনকে দেখার পিপাসা অন্তরে রয়েই যায়। এই সমুদ্রে সারাজীবন সাতার কেটেও তীরের নাগাল পাবে না। কারণ এই সমুদ্র কূল-কিনারাবিহীন।
কুদৃষ্টি ক্ষতকে গভীর করে
কুদৃষ্টির তীর বিঁধে গেলে অন্তরের জ্বালা শুধু বাড়তেই থাকে। কুদৃষ্টির বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃদয়ের এ ক্ষত আরো গভীর হতে থাকে। হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন, দৃষ্টির তীরে প্রথমে বিদ্ধ হয় নিক্ষেপকারী নিজেই। কারণ হল, দৃষ্টি নিক্ষেপকারী অপরপক্ষের দৃষ্টিবিনিময়কে নিজের ক্ষতের ওষুধ বলে মনে করে। অথচ তা ক্ষতকে আরো গভীর করে। (আলজাওয়াবুলকাফী : ৪১৭)
لو گ كا نٹو ں سے بچ كے چلتے ہيں
ہم نے پھو لو ں سے زخم كھا ۓ ہيں
‘লোকেরা চলে কাঁটা এড়িয়ে আর আমি
ফুলের আঘাতে আহত।’
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন-
اَلصَّبْرُ عَلى غَضِّ الْبَصَرِ اَيْسَرُ عَلى الصَّبْرِ عَلى الْقَدِّ بَعْدَهُ
‘চোখ বুজে নেওয়া কঠিন নয়, তবে চোখ খোলা রাখার পরবর্তী কষ্টে ধৈর্যধারণ করা কঠিন।’ (প্রাগুক্ত)
এ থেকে বুড়োরাও নিরাপদ নয়
ব্যভিচার থেকে অনেকেই বেঁচে থাকতে পারে। কারণ, এটি করার জন্য পস্ন্যান ও আয়োজন লাগে। প্রথমত সঙ্গীর সম্মতি লাগে। দ্বিতীয়ত উপযুক্ত স্থান ও সুযোগের দরকার হয়। তৃতীয়ত মানুষের সামনে ধরা খেলে লাঞ্ছিত হতে হয়, তাই নির্জনতারও প্রয়োজন হয়। এজন্য ভদ্র ও সম্মানিতলোকেরা এতে কম জড়ায়। পেশাদারনারীর সাথে ব্যভিচার করতে হলে টাকা-পয়সা পানির মত ঢালতে হয়। তাছাড়া এইডস সিফিলিস টাইপের যৌন রোগের ভয় তো আছেই। পক্ষান্তরে কুদৃষ্টির গুনাহ করতে হলে এত কিছুর দরকার হয় না। এতে মানসম্মান যাওয়ার ভয় থাকে না। কারণ, কে কোন্ দৃষ্টিতে কার দিকে তাকাচ্ছে- এটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। বৃদ্ধ লোকটি যে কি-না যৌনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সেও খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে পারে। বরং অনেক সময় সে গুনাহ না করতে পারার আফসোসেও কুরে কুরে জ্বলতে পারে। কবির ভাষায়-
جوا نى سے زياد ہ وقت پيرى جوش ہوتا ہے
بهڑ كتا ہے چراغ صبح جب خاموش ہوتا ہے
‘অনেক সময় যৌবনের চাইতে বার্ধক্যের তেজ বেশি হয়,
(যেমন) নিস্তব্ধ ভোরে প্রদীপ জ্বলে ওঠে।’
অনেকে দেহের দিক থেকে বৃদ্ধ হলেও অন্তরের দিক থেকে সতেজ থাকে। এরা যৌবনের স্মৃতি সবসময় নিজেদের মাঝে খুঁজে ফিরে। কবির ভাষায়-
پيرى تمام ذكر جوانى كٹ گئ
كيا رات تھى كہ ايك كہانى ميں كٹ گئ
‘যৌবনস্মৃতিতে চলে গেল গোটা বার্ধক্য,
কী সে রাত ছিল যে, এককাহিনীতেই শেষ হয়ে গেল।’
অনেকের এক পা চলে যায় কবরে, কোমরটা সোজা রাখতে পারে না, তবুও খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া যৌবনকে। কবির ভাষায়-
عہد پيرى ميں جوانى كى امنگ
أه كسى وقت ميں كيا ياد آيا
‘বৃদ্ধবেলায় যৌবনের উদ্দামতা,
আহ! কোন্ সময় কী যে মনে পড়ে গেল।’
তামাশার আরেকটি দিক হল, অনেক সময় নারীরা পরপুরুষকে ‘বুড়োমানুষ’ মনে করে পর্দা করে না, ফলে বুড়োমানুষটি কুদৃষ্টির গুনাহ সহজেই করে নিতে পারে। কামনালিপ্সু বৃদ্ধরা চুল সাদা করে ফেলে, কিন্তু অন্তর থাকে কলুষিত। বিচারদিবসে সময়ের ভাষাতে বলবে-
ناكرده گنا ہو ں كى بهى حسرت كى ملے داد
يا رب! ا گران كرده گنا ہو ں كى سزا ہے
‘না করা গুনাহগুলোর যে আফসোস, তারও আজ সাজা হবে।
প্রভু হে! যদি শুধু কৃত গুনাহগুলোর শাস্তি হত।’
হযরত থানবী রহ. বলেন, একবৃদ্ধকে আমি চিনতাম। অনেক কাজে তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু। কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, তিনি কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্ত। কুদৃষ্টির গুনাহ এতটাই ভয়াবহ। বুড়োমিয়া কবরের পাড়ে চলে গেছেন কিন্তু পুরনোরোগ তার সাথে লেগেই আছে।
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ২
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৩
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৪