কুদৃষ্টির কারণে আমলের তাওফিক ছিনিয়ে নেয়া হয়
শাইখুলহাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রহ. বলেন, কুদৃষ্টি অত্যন্ত খতরনাক রোগ। এ বিষয়ে আমার নিজেরও একটা অভিজ্ঞতা আছে। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব যিকির ও মুজাহাদার প্রথম দিকে জোশ ও মজার ঘোরে থাকেন। কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে ইবাদতের মজা হারিয়ে ফেলেন। পরিণামে ধীরে ধীরে ইবাদত ছেড়ে দেয়ার দিকে অগ্রসর হন।(আপবীতী খন্ড-০৬, পৃষ্ঠা- ৪১৮)
উদাহরণস্বরূপ, সুস্থ যুবকের যদি জ্বর হয়, ভালো হওয়ার নামও না থাকে তাহলে দুর্বলতার কারণে সে চলাফেরাতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। কাজের প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মন চায় বিছানায় পড়ে থাকতে। অনুরূপভাবে কুদৃষ্টির রোগে আক্রান্তব্যক্তিও আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নেককাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিংবা কথাটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, আমলের তাওফিক তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। নেককাজের নিয়তও করে, কিন্তু কুদৃষ্টির কারণে নিয়তে দুর্বলতা চলে আসে। কবির ভাষায়-
تيار تهے نماز كو ہم سن كے ذكر حور
جلوه بتو ں كا ديكھ كر نيت بدل گئ
‘জান্নাতিহূরের কথা শোনে নামাযের জন্য
প্রস্ত্তত ছিলাম, মূর্তিগুলোর দাপানি দেখে নিয়ত পাল্টে গেল।’
কুদৃষ্টির কারণে মুখস্থশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে
মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বলেন, পরনারী কিংবা সুশ্রীবালকের প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকালে মুখস্থশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কথার সত্যতার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, কুদৃষ্টিদানকারী হাফেজের ‘মঞ্জিল’ মুখস্থ থাকে না। হেফজপড়ুয়া ছাত্রদের কুরআন মুখস্থ করা জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
ইমাম শাফিঈ রহ. নিজ শিক্ষক ইমাম ওয়াকী রহ.-এর কাছে মুখস্থশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করেন। তিনি তাঁকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দিকনির্দেশনা দেন। ইমাম শাফিঈ রহ. এ ঘটনাকে কবিতার পোশাক পরিয়ে বলেন-
شَكَوْتُ اِلى وَكِيْعٍ سُوْءَ حِفْظِىْ
فَاَوْصَانِىْ اِلى تَرْكِ ا لْمَعَاصِىْ
فَاِنَّ الْعِلْمَ نُوْرٌ مِّنْ اِلَهِىْ
وَ نُوْرُ اللهِ لَا يُعْطَىْ لِعَاصِىْ
‘আমি ইমাম ওয়াকীর কাছে নিজের মুখস্থশক্তির দুর্বলতা সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, হে ছাত্র! গুনাহ ত্যাগ কর। কেননা, ইলম আল্লাহতাআলার নূর। আল্লাহর নূর কোনো গুনাহগারকে দেয়া হয় না।’
কলেজ ইউনিভার্সিটি বিশেষত মাদরাসার ছাত্রদের জন্য এতে শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ আছে।
কুদৃষ্টি লাঞ্ছণার কারণ
শায়খ ওয়াসিতী রহ. বলতেন, মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে লাঞ্ছিত করতে চান, তখন তাকে সুন্দর চেহারা দেখার অভ্যাসে লিপ্ত করে দেন। বোঝা গেল, কুদৃষ্টি অপমানিত হওয়ার মৌলিককারণ। যেসব সৌভাগ্যবান নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে তারা অনেক আপদ-মুসিবত থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়। মীর তকী মীরের ভাষায়-
اس عاشقى ميں عزت سادات بهى گئ
‘প্রেমের এ খেলায় সাইয়েদদের সম্মানও গেল।’
মির্জা গালিব বলেন-
عشق نے غالب كو نكما كرديا
ورنہ ہم بهى آدمى تهے كام كے
‘প্রেমমগ্নতা গালিবকে করেছে অকর্মা,
অন্যথায় আমিও ছিলাম কাজের মানুষ।’
কুদৃষ্টির কারণে বরকত শেষ হয়ে যায়
কুদৃষ্টির অন্যতম মন্দপ্রভাব হল, এর কারণে রুটি রুজি ও সময়ের বরকত শেষ হয়ে যায়। ছোট ছোটকাজে বড় বড় সমস্যা ছুটে আসে। যাপিতজীবনের কষ্ট ও চেষ্টা সফলতার মুখ দেখে না। আপাতদৃষ্টিতে কাজ সম্পন্ন মনে হলেও যথাসময়ে কাজ অসম্পন্ন দেখা যায়। পেরেশানি ও টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ মনে করে, কেউ কিছু একটা করেছে। অথচ সে নিজের আত্মিককলুষতার কারণে বিপদাপদের মধ্যে পড়ে থাকে। নিজেই স্বীকার করে যে, একটা সময় ছিল যখন সে মাটিতে হাত রাখলেও সোনা হয়ে যেত। আর এখন সোনায় হাত রাখলেও মাটিতে পরিণত হয়। এসবই কুদৃষ্টির কারণে হয়।
কুদৃষ্টিদানকারীর কাছে শয়তানের অনেক আশা-ভরসা
জনৈক বুযুর্গের শয়তানের সাথে দেখা হল। তিনি শয়তানের কাছে জানতে চাইলেন, যে কারণে মানুষ তোমার জালে ধরা পড়ে সে ধ্বংসাত্মক কাজ কোনটি? শয়তান উত্তর দিল, পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টি দেয়া এমন কাজ, আমি তার ব্যাপারে প্রত্যাশা রাখি যে, সে আমার জালে যেকোনো সময় ফেঁসে যাবে। দৃষ্টি অবনত রাখে এমন লোকের ব্যাপারে আমি নিরাশায় ভুগতে থাকি, আমার অনেক চেষ্টা-তদবির তার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যায়। আমি শপথ করেছিলাম, আদমসন্তানকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরব। চারিদিকের মধ্যে নিচের দিক পড়ে না। তাই এই দিকটা নিরাপদ। যেব্যক্তি দৃষ্টি নিচু করে সে আমাকে আশাহত করে।
কুদৃষ্টির কারণে নেকি নষ্ট এবং গুনাহ অনিবার্য
পরনারীর প্রতি কামনার দৃষ্টিদানকারী নগদ হোক কিংবা দেরিতে হোক ইশকেমাজাযী তথা অনৈতিক সম্পর্কে সাধারণত আটকা পড়ে। সে মাখলুককে নিজের প্রেমপাত্র বানিয়ে নেয়। জনৈক লোকের ভাষায়-
تو ہى ميرا دين و ايمان سجنا ں
‘হে প্রিয়তম! তুমিই আমার দীন ও ঈমান।’
এ জাতীয় কাজকে শিরকেখফী তথা গোপন শিরক বলা হয়। অথচ শিরক এমন গুনাহ যার কারণে সকল নেকি ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাকেই বলে, নেকী ধ্বংস এবং গুনাহ অনিবার্য।
কুদৃষ্টির কারণে মহান আল্লাহর অহঙ্কার জেগে ওঠে
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
اَنَا غَيُوْرٌ وَاللهُ اَغْيَرُ مِنِّىْ وَ مِنْ غَيْرَتِه حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَماَ بَطَنَ
‘আমি আত্মমর্যাদাশীল। আল্লাহতাআলা আমার চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাশীল। আত্মমর্যাদাবোধের কারণে আল্লাহ বাহ্যিক ও গোপন অশ্লীলতা হারাম করেছেন।’
কুদৃষ্টি বেহায়াপনার ভূমিকাস্বরূপ। এটিতে কেউ লিপ্ত হলে মহান আল্লাহর অহঙ্কারে আঘাত আসে। তাকে তাঁর মহান দরবার থেকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কুদৃষ্টিদানকারীকে নিজ রহমত থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়। যারা সৎজীবনযাপন করতে চান, তারা যেন কুদৃষ্টির গুনাহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। এতে তাঁর রহমতঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে।
কুদৃষ্টিদানকারী অভিশপ্ত
হাদীসশরীফে আছে-
لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُوْرَ اِلَيْهِ
‘মহান আল্লাহ অভিশম্পাত দেন দৃষ্টিাদানকারী পুরুষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী নারীর ওপর।’ (বাইহাকী, মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-২৭০)
যেসব মেয়ে সাজগোজ করে পর্দার তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়ায় এবং যারা তাদের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকায়- উভয় শ্রেণী অভিশপ্ত। এটা কত বড় ক্ষতির কথা! কুদৃষ্টিদানকারী গুনাহয় লিপ্ত থাকাবস্থায় আল্লাহর রহমত থেকে ছিটকে পড়ে এবং তাঁর লা’নতের পাত্র হয়ে যায়। সুতরাং তাওবা করা উচিত। এমন যেন না হয়, মৃত্যু চলে এল অপরদিকে লা’নতের মধ্যে পড়ে রইল। মহান আল্লাহ বলেন –
خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرِةُ ذَالِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِيْنُ
‘এটা দুনিয়া ও আখেরাতের অপদস্থতা এবং স্পষ্ট অপদস্থতা।’
কুদৃষ্টিকে মানুষ সাধারণ মনে করে
কুদৃষ্টি বড় ধরনের গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ একে সাধারণ মনে করে। এজন্য দেদারসে এটি করে যায়। যৌবনের শুরুতে যৌবনের প্রাবল্যের কারণে গুনাহটি করে থাকে। পরে তা এমন দূরারোগ্যব্যাধিতে রূপ নেয় যে, কবরে যাওয়া পর্যন্ত এটি আর ছাড়াতে পারে না। সুতরাং এটি সাধারণ গুনাহ নয় বরং-
إِنَّهُ مِنْ اَعْظَمِ الْمَصَائِبِ
‘এটি মহা বিপদের একটি।’
কুদৃষ্টি থেকে কুকর্ম পর্যন্ত
হাফেজ ইবনুলকাইয়িম রহ. বলেন, দুর্ঘটনার শুরু হয় দৃষ্টি থেকে। যেমন লেলিহান আগুনের শুরুটা একটিমাত্র কয়লা দিয়ে। সুতরাং লজ্জাস্থানের সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টির সংরক্ষণ জরুরী। (আলজাওয়াবুলকাফী, পৃষ্ঠা : ২০৪)
যেসব লোক কুদৃষ্টিতে জড়িয়ে পড়ে তারাই কুকর্মে লিপ্ত হয়। যাদের দৃষ্টি স্বাধীনতার শিকার হয় তাদের লজ্জাস্থান নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন মানুষ অপরিহার্যভাবে কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং জানা গেল, চোখ প্রথমে শুরু করে এবং লজ্জাস্থান তার শেষটা করে।
কুদৃষ্টির কারণে দেহে দুর্গন্ধ
শাইখুলহাদীস মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. বলেন, এটা খুবই পরীক্ষিত বিষয় যে, কুদৃষ্টির কারণে কাপড়ে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। (আপবীতি)
কুদৃষ্টি কত ক্ষতিকর বিষয় যে, এর প্রতিক্রিয়া নগদ প্রকাশ পায়। এমনকি শরীর ও কাপড় থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসে। পক্ষান্তরে যারা কুদৃষ্টিকে শালীন বানায়, পবিত্র জীবন যাপন করে তাদের দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়ায়। হাদীস থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দেহ থেকে এমন সুগন্ধি ছড়াত যে, সাহাবায়েকেরাম বুঝতে সক্ষম হতেন, এপথ দিয়ে নবীজী গিয়েছিলেন।
একহাদীসে এসেছে, উম্মেসুলাইম রাযি. ছোটদের মাধ্যমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিন্দু-বিন্দু ঘাম শিশিতে সংগ্রহ করে নিতেন। পরে তা যখন সুগন্ধির সাথে মেশাতেন সুগন্ধি আরো বেড়ে যেত।
এই বিষয় দেখা যায় হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাযি-এর মাঝে। হযরত উমর রাযি. বলতেন-
كَانَ رِيْحُ اَبِىْ بَكْر اَطْيَبَ مِنْ رِيْحِ الْمِسْكِ
‘আবুবকরের শরীরের সুগন্ধ মিশকের সুগন্ধির চেয়েও বেশি মোহনীয়।’
এর দ্বারা বোঝা গেল, পবিত্র শালীন জীবনযাপনকারীর শরীরে সুগন্ধির সৃষ্টি হয়, বিপরীতে অশ্লীলতায় লিপ্তব্যক্তির দেহে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। যারা ইউরোপ আমেরিকায় গিয়েছেন তাদের এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আছে যে, ইংরেজরা দেখতে অনেক স্মার্ট মনে হয়, তাদের পোশাকও থাকে বেশ পরিচ্ছন্ন, কিন্তু বিমানে পাশের সিটে বসলে একধরনের উৎকট গন্ধ তাদের শরীর থেকে স্পষ্ট অনুভূত হয়।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন-
إِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجِسٌ
‘নিশ্চয় মুশরিকরা অপবিত্র।’
সারা দুনিয়া জানে অপবিত্রের মধ্যে দুর্গন্ধ থাকে, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
কুদৃষ্টির নগদ সাজা
কুদৃষ্টির একটি ধরন হল, কারো ঘরের দরজা-জানালা কিংবা ছিদ্র দিয়ে দেখা। হাদীসশরীফে এ ব্যপারে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। এমনকি ঘরের মালিককে দর্শনকারীর চোখ ফুঁড়ে দেয়ার অধিকারও দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ اِمْرَأً اِطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ اِذْنِ فَخَذَفْتَه بِحِصَاةٍ فَفَقَأَتْ عَيْنُه
مَا كَانَ عَلَيْكَ مِنْ جَنَاحٍ
‘কেউ যদি অনুমতি ছাড়া তোমার ঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে তুমি তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ কর। এর দ্বারা যদি তার চোখ ফুটো হয়ে যায় তোমার কোনো অপরাধ হবে না।’ (ইবনেকাসীর, খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৮০)
কুদৃষ্টির কারণে পবিত্র কুরআন ভুলে গেল
ইমাম ইবনুলজাওযী রহ. ‘তালবীসেইবলীস’ কিতাবে লিখেছেন, আবুআব্দুল্লাহ ইবনে আজলা বলেন, আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে একটি খৃস্টান সুশ্রীবালককে দেখছিলাম। ইত্যবসরে আবুআবদিল্লাহ বালখী রহ. আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি বললাম, চাচা! একটু দেখুন, এই সুদর্শন চেহারাটিকে কিভাবে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেয়া হবে! আমার এ উত্তর শুনে তিনি তার দুটো হাত দ্বারা আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, এই কুদৃষ্টির ফল তুমি পাবে। বেশ কিছুকাল যদিও চলে গেছে। কিন্তু চল্লিশবছর পর আমি গুনাহটির প্রতিক্রিয়া দেখলাম। পবিত্র কুরআন আমি ভুলে গেলাম।(তালবীসেইবলীস, পৃষ্ঠা : ৩৪৯)
আবুলআইয়ান বলেন, আমি আমার উসতাদ আবুবকর দাক্কাকের সাথে যাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে একটি কিশোরের কমনীয় চেহারার ওপর আমার কামদৃষ্টি পড়ে। উসতাদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন। বললেন, তুমি এর পরিণতি ভোগ করবে। কিছুদিন পর আমি কুরআনমাজীদ ভুলে গেলাম।
কুদৃষ্টি ও ফটো-ভিডিও
কুদৃষ্টির আরেকটি ধরন হল, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে ব্যবহৃত কিংবা যৌনম্যাগাজিনের কভারপেজে ব্যবহৃত নগ্ন ফটো দেখা, টিভির সংবাদ দেখার বাহানায় ফিল্ম-নাটকের অভিনেত্রীদেরকে দেখা, পথে চলতে গিয়ে বিভিন্ন সাইনবোর্ডের মডেলদেরকে দেখা, গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ডের ফটো লুকিয়ে রাখা এবং নির্জন পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যৌনকাতর হয়ে দেখা, ইন্টারনেটে, পেশাদার নারীদের নগ্ন ফটো-ভিডিও দেখা অথবা বস্নুফ্লিম সম্বলিত সিডি দেখা- এসব কিছুই কুদৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। অনেকে বিয়ে-শাদির সময় নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরা সম্বলিত অনুষ্ঠানের ফটো-ভিডিও করে নিজের কাছে রেখে দেয় এবং নিজে দেখে, অন্যদেরকেও দেখায়। মনে রাখবেন, ফটো-ভিডিও দেখা সরাসরি দেখার চেয়েও ক্ষতিকর। পথের দেখা এতটা নিখুঁত ও নিবিড় হয়না, যতটা ফটো-ভিডিও দ্বারা হয়। তাই এর থেকে আরো বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। বিকৃত রুচির জনৈক কবি ফটোর প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন-
تر ے تصوير ميں ايك بات تجھ سے بهى نرالى ہے
كہ جتنا چا ہوبو سے لو نہ جهڑ كى ہے نہ گالى ہے
‘তোমার ছবিতে একটি বিষয় তোমার চেয়ে সুখকর,
যত চাই চুমো দেই, নেই কোনো ঝাড়ি ও গালি।’
কুদৃষ্টি এবং সৌন্দর্যপ্রেমের ধোঁকা
কিছু অজ্ঞলোক বলে থাকে, আমরা সুদর্শন চেহারা দেখে মহান আল্লাহর বড়ত্বের সাথে পরিচিত হই। এটা নিচক প্রতারণা ও শয়তানিপ্রবঞ্চণা। মহান আল্লাহর বহু সৃষ্টি আছে যেগুলো দেখা বৈধ এবং যেগুলো তাঁর বিস্ময়কর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। ফুলের বিচিত্র বাহার দেখুন, সেগুলোর সৌরভ নিয়ে ভাবুন। ফলের সুগন্ধি কিভাবে মানুষের অন্তপ্রাণকে আচ্ছন্ন করে নেয়, তা সম্পর্কে চিন্তা করুন। ফলের বৈচিত্র ও মিষ্টতা সম্পর্কে ভাবুন। মহান আল্লাহ বলেন-
أُنْظُرُوْا إِلى ثَمَرِه إِذَا اَثْمَرَ
‘ফলের প্রতি তাকাও যখন তা পূর্ণতা লাভ করে।’
সমুদ্র লেক ও ঝর্ণাধারাগুলো দেখুন। পৃথিবীর প্রশস্ততা আকাশের উচ্চতা মানুষকে আহবান করে নিজেকে নিয়ে ভাবনার প্রতি। মহান আল্লাহ বলেন-
أَفَلَا يَنْظُرُوْنَ إِلى إِلْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ وَإِلى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ وَإِلى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ وَ إِلى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ
‘তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আকাশের দিকে কিভাবে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে এবং ভূমন্ডলের দিকে কিভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে?’
ভাবতে মনে চাইলে চাঁদ সূর্য তারকার সৌন্দর্য নিয়ে ভাবুন। বাতাসে উড়ন্ত দৃষ্টিনন্দন পাখি, পানির সাতারু বিচিত্র মৎসরাজি কি ভাবনার জন্য যথেষ্ট নয়? শুধু মানুষের চেহারা ভাবনার জন্য রয়ে গেল? এসবই খোঁড়া অজুহাত। গুনাহর অজুহাত নিকৃষ্ট গুনাহর মতই। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর সামনে একবার মনের কাছে পরাজিত একলোক এই অজুহাত পেশ করল যে, আমি তো সুশ্রীচেহারাগুলো দেখি আল্লাহর সৃষ্টিনিপুনতা ও কুদরতের কারিশমা অনুধাবন করার জন্য। তিনি লোকটিকে অত্যন্ত শিক্ষণীয় উত্তর দিলেন, বললেন, তুমি তোমার মায়ের লজ্জাস্থান নিয়ে ভাবো যে, কিভাবে এত সঙ্কীর্ণ পথ দিয়ে তোমার মত মানুষ জন্ম দিয়েছেন!
কুদৃষ্টির অশুভ পরিণাম
হযরত উসমানগণী রাযি.-এর কাছে একব্যক্তি এল যার দৃষ্টি পথে অবাঞ্চিত স্থানে পড়েছিল। তিনি লোকটির চোখ দেখেই বুঝে ফেললেন। বললেন-
مَا بَالُ أَقْوَا مٍ يَتَرَشَّحُ الزِّنَا مِنْ أَعْيُنِهِمْ
‘এজাতির কী হয়ে গেল! তাদের চোখ দিয়ে ব্যভিচার টপকে পড়ছে।’
লোকটি অবাক হয়ে গেল। বলে ওঠল, এখনও অহির ধারা অবশিষ্ট আছে? উসমান রাযি. উত্তর দিলেন, না, এটা তো মুমিনের অন্তদৃষ্টি।
اِتَّقُوْا فِرَاسَةَ الْمُؤْمِنِ فَاِنَّهُ يَنْظُرُ بِنُوْرِ اللهِ
‘মুমিনের অন্তদৃষ্টিকে ভয় কর। কারণ তিনি আল্লাহর নূর দ্বারা দেখেন।’
কাশফের অধিকারীরা লিখেছেন, কুদৃষ্টির কারণে এমন অন্ধকার সৃষ্টি হয় যে, যা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা ধরে ফেলেন। পক্ষান্তরে শালীন ও আল্লাহভীরুব্যক্তির চোখে থাকে নূর।
কুদৃষ্টির দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি
শাইখুলহাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ. বলেন, একব্যক্তির ঘটনা। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন দিল। লোকটি বলল, আমার জিহবা তো কালেমার জন্য নড়ে না। জিজ্ঞেস করা হল, কারণ কী? সে জানাল, এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল তোয়ালে খরিদ করার জন্য। আমার ভালো লেগে ওঠে। আমি কামদৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখেছিলাম।
ইবনুলজাওযী রহ. লিখেছেন, মিসরের জামেমসজিদের মুয়াজ্জিন আযান দেয়ার উদ্দেশে মিনারে ওঠল। পাশের ছাদে দৃষ্টি পড়তে জনৈক সুন্দরী খৃস্টাননারীর প্রতি তার চোখ পড়ল। ভাবল, নতুন ভাড়াটিয়া মনে হচ্ছে, আযানের পর গিয়ে পরিচিত হব। আযানের পর মুয়াজ্জিন গেল ওই প্রতিবেশীর বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়ার পর মহিলাটির বাবা বের হল। কথাবার্তার একটা পর্যায়ে জানা গেল, এতো মহিলা নয়; বরং কুমারী মেয়ে। এখনও বিয়ে হয় নি। মুয়াজ্জিন বিয়ের প্রস্তাব দিল। মেয়ের বাবা শর্ত জুড়ে দিল, আমাদের ধর্মগ্রহণ করতে হবে। মুয়াজ্জিনের অন্তরে কামনার এমন ভূত চেপে বসেছিল যে, সে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল। মেয়ের বাবা বলল, ঠিক আছে, চল, ছাদে গিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। মুয়াজ্জিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠতে লাগল। হঠাৎ পা পিছলে সে পড়ে গেল এবং ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গিয়ে সেখানেই মারা গেল।
نہ خدا ہى ملا نہ وصال صنم
نہ ادهر كے ہے نہ ادهر كے ہے
আল্লাহকে পেল না, প্রতিমারও ঘনিষ্ঠ হল না।
এ কূলও পেল না, ওই কূলও রইল না।
কুদৃষ্টির অনির্ধারিত শাস্তি
আল্লাহতাআলা বলেন-
يَعْلَمُ خَائِنَةُ الْاَعْيُنِ وَ مَا تُخْفِىْ الصُّدُوْرُ.
‘তিনি চোখের খেয়ানত ও অন্তরের মাঝে লুকায়িত বিষয়সমূহ সম্পর্কে জানেন।’
আলোচ্য আয়াতে ‘কুদৃষ্টি গুনাহ’ এটা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত কোনো শাস্তির কথা বলা হয় নি। এর রহস্য হল, মানুষ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের লোক হল, যাদের অনুভূতিশক্তি এতটাই ভোঁতা যে, এরা কথায় নয়; বরং জুতায় মানে। আয়াতটিতে তাদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, আমি চোখের খেয়ানত সম্পর্কে জানি। যদি বিরত না থাকো তাহলে মর্মস্পর্শী শাস্তি দেয়া হবে।
چوريا ں آنكهو ں كى اور سينو ں كى راز
جانتا ہے سب كو توا ے بے نياز
‘চোখের চুরি আর অন্তরের ভেদ,
হে অমুখাপেক্ষী আল্লাহ! তুমি জান সবকিছু।’
আরেক ধরনের লোক হল, অনুভূতিপ্রবণ; তারা যখন অনুধাবন করতে পারে যে, আমাদের মালিক আমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন, তখন তারা লজ্জায় কাতর হয়ে যায়। আয়াতটিতে তাদেরকেও লজ্জা দেয়া হচ্ছে। এদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কুদৃষ্টির সাজা প্রত্যেককেই তার স্বভাব অনুপাতে দেয়া হবে। জনৈক লোকের ভাষায়-
جيسے روح و يسے فرشتے
‘আত্মা যেমন ফেরেশতা তেমন।’
جتنا بے حيا اتنى زياده سزا
‘নিলর্জ্জতা যত সাজাও হবে তত।’
কুদৃষ্টির প্রভাব অন্তরে
হযরতে আকদাস থানবী রহ. বলেন, দৃষ্টিদানের মাধ্যমে অন্তরের গুনাহর অস্তিত্ব আসে। অনেকে পরনারী ও সুশ্রীবালকের দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকায়। তখন অন্তরের এর একটা ছাপ পড়ে যায়। তারপর সে নির্জনে কল্পনার মাধ্যমে উক্ত লালসা চরিতার্থ করে। অন্তরের এ গুনাহ চোখের গুনাহর চেয়েও জঘন্য। ফকীহগণ লিখেছেন, কোনোব্যক্তি নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসকালে যদি পরনারীর কল্পনা করে তাহলে তার ব্যভিচারের গুনাহ হবে।
কুদৃষ্টি এবং নূরবিহীন চেহারা
কুদৃষ্টির কারণে চেহারার নূর চলে যাওয়া কুদৃষ্টির অন্যতম প্রভাব। হাদীসে আছে-
عَنْ اَبِىْ اُمَامَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَتَغُضَّنَّ اَبْصاَرَكُمْ وَلَتَحْفَظَنَّ فُرُوْجَكُمْ اَوْ لَيَكْسِفَنَّ اللهُ وُجُوْهَكُمْ
‘আবুউসামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের চোখ অবশ্যই নিম্নগামী করবে এবং তোমাদের গুপ্তাঙ্গ সংরক্ষণ করবে তা না হলে আল্লাহতাআলা তোমাদের চেহারা বিনষ্ট করে দিবেন।’(তাবারানী বর্ণিত, আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭)
চেহারা বিনষ্ট হওয়ার প্রথম ধাপ হল, চেহারাকে নূরবিহীন করে দেয়া। সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও চেহারার মায়া চলে যাবে।
কুদৃষ্টিমুক্ত থাকার পুরস্কার
যেব্যক্তি দৃষ্টির হেফাজত করবে পরকালে সে দুটি পুরস্কার পাবে। প্রথমত, প্রতিটি দৃষ্টির হেফাজতের বিনিময়ে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ দ্বারা সে ধন্য হবে। দ্বিতীয়ত, এমন চোখ কেয়ামতের দিন কান্না থেকে নিরাপদ থাকবে। পবিত্র হাদীসে আছে-
رُوِىَ عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَاَلَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَيْنٍ بَاكِيَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ اِلَّا عَيْنٌ غَضَّتْ عَنْ مَحَارِمِ اللهِ وَ عَيْنٌ سَهِرَتْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَ عَيْنٌ خَرَجَ مِنْهَا مِثْلُ رَأْسِ الذُّبَابِ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ
‘হযরত আবুহুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন সকল চোখ থেকেই পানি ঝরবে। তবে, কেবলমাত্র আল্লাহ ঘোষিত নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে যে তার চোখ অবনমিত করেছে, যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারায় কেটেছে এবং যে চোখ থেকে আল্লাহর ভয়ে মাছির মাথার পরিমাণ পানি বেরিয়েছে। তা ব্যতীত।’ (আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৪)
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ১
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৩
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৪