কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – ৩য় পর্ব

কুদৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা

কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পুরুষদের জন্য কেবল পরনারীকে দেখা নয়; বরং যদি মাহরামনারীকে দেখলেও কামনা জাগে তখন তাদেরকেও দেখা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বালকদেরকে দেখার ক্ষেত্রেও একই কথা। বরং কোনো পুরুষকে দেখলে যদি গুনাহর চিন্তা আসে তাহলে তাকেও দেখবে না। একই বিষয় নারীদের ক্ষেত্রেও। তাদের জন্য কেবল পরপুরুষ নয়; বরং কোনো ছোটছেলেকে দেখার পর যদি কুকল্পনা আসে তাকেও দেখা থেকে বিরত থাকবে। হযরত আবুহুরাইরা রাযি. ছোটছেলেদের প্রতি স্থির দৃষ্টিতে তাকানো থেকে নিষেধ করতেন। (তালবীসেইবলীস, পৃষ্ঠা : ৩৪৬)

আমাদের মাশায়েখ বলেছেন, তোমরা বালকদের সাথে বসো না। কারণ এটা মেয়েঘটিত দুর্ঘটনা থেকেও খতরনাক। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল, পরমেয়ের সাথে বসার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে, পক্ষান্তরে কমবয়সী ছেলেদের সাথে বসার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। সুতরাং এক্ষেত্রে ফেতনার আশঙ্কা বেশি। অনুরূপভাবে মহিলাদের জন্য পরপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থাকে। কিন্তু নারী নারীর পাশে বসা সহজ। সুতরাং কোনো নারী যদি এই আশঙ্কা করে যে, অমুক মেয়ের পাশে বসলে গুনাহয় জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে, তাহলে তার থেকেও পরপুরুষের মতই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার চেহারার প্রতিও তাকাবে না। তার সাথে গল্প করবে না।

قدم قدم   پہ يہا ں احتياط لازم ہے

كہ منتظر   ہے يہ دنيا كسى بہانے كى

‘এজগতে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রয়োজন সতর্ক থাকার

কারণ দুনিয়া অপেক্ষায় থাকে কোনো বাহানার।’

কুদৃষ্টির কারণে হাতিও টলে যায়

কুদৃষ্টিতে অভ্যস্তব্যক্তি কখনও লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করতে পারে না। শয়তান তাকে কুকৌশলে ধোঁকায় ফেলে রাখে যে, তুমি তো কেবল দেখছ, করছ না তো! অথচ দেখাটাই তো করার ভূমিকা। দৃশ্যত মানুষ যত দৃঢ়চেতার অধিকারীই হোক (এমনকি হাতির মত হলেও) কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে না থাকলে একদিন না হয় একদিন ফেঁসে যাবেই।

اب جس كے جى ميں آ ۓ وہى پا ۓ روشنى

ہم نے تو دل جلا كے سر عام ركهديا

‘এবার যার মনে দাগ কাটবে সেই আলো পাবে।

আমি অন্তর জ্বালিয়ে সবার সামনে রেখে দিয়েছি।’

কুদৃষ্টির তিনটি বড় ক্ষতি

কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে যৌনউদ্দামতার ঝড় সৃষ্টি হয়। মানুষ এ বন্যার তীব্রতায় ভেসে যায়। এর কারণে তিনটি বড় ক্ষতি অস্তিত্বে আসে।

এক. কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে কল্পিতপ্রিয়ার ছবি তৈরি হয়। সুন্দর চেহারা তার দেল-দেমাগে জেঁকে বসে। সে জানে, কল্পিতচেহারার অধিকারীণী পর্যন্ত পৌঁছতে সে পারবে না, তবুও সে নির্জনে তার কথা ভেবে মজা ভোগ করে। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে কল্পনার জগতে গল্প করে। বিষয়টা এ পর্যন্ত গড়ায় যে, কবির ভাষায়-

تم مير ے پاس ہوتے ہو گويا

جب كو ئ   دوسرا نہيں ہوتا

‘তুমি যেন আমার পাশে তখন থাকো,

যখন কেউ থাকে না।’

কুদৃষ্টিকে বাহন বানিয়েই শয়তান মানুষের মনমস্তিষ্কে জেঁকে বসে এবং তাকে শয়তানিকর্মকান্ড করার প্রতি তাড়া দেয়। ফাঁকা নির্জনস্থানে যেমনিভাবে অন্ধকার তার গাঢ় প্রভাব বিস্তার করে, অনুরূপভাবে শয়তানও ওইব্যক্তির অন্তরে বিষাক্ত প্রভাব ঢেলে দেয়। যাতে করে সে তার সামনে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো খুবই আকর্ষণীয়পদ্ধতিতে উপস্থাপন করতে পারে এবং তার সামনে একটি নয়নলোভন মূর্তি তৈরি দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এমনব্যক্তির অন্তর দিবানিশি ওই মূর্তিটার পূজায় লিপ্ত থাকে। ইতরামিপূর্ণ আশা ও কামনা নিয়ে সে মেতে ওঠে। এটাকেই বলা হয় কামপূজা প্রবৃত্তিপূজা নফসপূজা। বরং এটা একপ্রকার মূর্তিপূজাও। এটা শিরকেখফী তথা গোপন শিরিক। আল্লাহতাআলা বলেন-

وَلَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ اَمْرُهُ فُرُطاً

‘আর ওইব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সূরা কাহ্ফ : ২৮)

এসব কল্পিত উপাস্য থেকে নিজের অন্তপ্রাণকে মুক্ত করা ছাড়া ঈমানের স্বাদ ভাগ্যে জুটবে না এবং আল্লাহর নৈকট্যের সিণগ্ধ বাতাস পাওয়া যাবে না। কবির ভাষায়-

بتو ں كو تو ڑ كر تخيل كے ہو ں كے پتهر كے

‘মূর্তিগুলো ভেঙ্গে কল্পনায় হয়ে আছ পাথরের।’

দুই. কুদৃষ্টির দ্বিতীয় ক্ষতি হল, মানুষের মনমস্তিষ্ক বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ঘরে সতী-সাধবী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার অন্তর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় না। স্ত্রী ভাল লাগে না। খুটিনাটি বিষয় নিয়েও স্ত্রীর ওপর রাগ করে। ঘরোয়াপরিবেশ তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। বাইরের মহিলাদের প্রতি সে কুকুর যেমন শিকারের দিকে তাকায়, সেভাবে তাকায়। অনেক সময় কাজকর্মেও তার মন বসে না, ছাত্র হলে পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব ভালো লাগে। ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা থেকে তার মন ওঠে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমালেও শান্তির ঘুম আসে না। কেউ দেখে মনে করবে যে, সে ঘুমিয়ে আছে, মূলত সে কল্পিতপ্রিয়ার কল্পনায় ডুবে আছে।

তিন. কুদৃষ্টির তৃতীয় বড় ক্ষতি হল, হৃদয় সুন্নাত-বিদআত ও হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্তর্দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। দীনের প্রজ্ঞা ও ইলমিবৈভব থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। গুনাহর কাজ তার কাছে গুনাহ মনে হয় না। এরূপ পরিস্থিতিতে দীনের ব্যাপারে শয়তান তাকে সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। নেককারদের সম্পর্কে তার অন্তরে বদধারণা সৃষ্টি হয়। এমনকি পোশাক-আশাকে ও অবয়বে দীনপালনকারী ব্যক্তিবর্গ তার কাছে ঘৃণার পাত্র মনে হয়। সে বাতিল ঘরানার হয়েও নিজেকে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করে। অবশেষে ঈমানহারা হয়ে জাহান্নামী হয়ে যায়।

কুদৃষ্টি সম্পর্কে পূর্বসূরী সলফেসালেহীন যা বলেছেন

এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُوْرَ اِلَيْهِ

‘কুদৃষ্টিদানকারী ও কুদৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী উভয়ের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন।’(বাইহাকী, মেশকাতশরীফ : ২৭০)

দুই. হযরত দাউদ আলাইহিসসালাম নিজের ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বাঘ ও অজগরের পেছনে ছুটতে পার, কিন্তু কোনো নারীর পেছনে নয়।’ উদ্দেশ্য হল, বাঘ ও অজগর উল্টো তেড়ে আসলে মরণঘাটে চলে যাবে। কিন্তু নারী তেড়ে আসলে জাহান্নামের ফাঁদে ফেঁসে যাবে।

তিন. হযরত ইয়াহইয়া ইবনেযাকারিয়া আলাইহিসসালামকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্যভিচারের শুরুটা কিভাবে হয়? তিনি বললেন, চোখ থেকে।

চার. হযরত উমর রাযি. বলেন, দুটো জীর্ণপুরনো হাড়ও একসাথে মিলিত হলে পরস্পরের প্রতি আসক্ত হবে। (জীর্ণহাড় দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা।)

পাঁচ. হযরত সাঈদ ইবনুলমুসাইয়াব রহ. বলেন, যখন তুমি কাউকে দেখবে যে, সে কোনো সুশ্রীবালকের প্রতি অপলক তাকিয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নাও ‘ডাল মেঁ কুচ কালা হায়’।

ছয়. ফতেহমুসিলী রহ. বলেন, আমি ত্রিশজন মাশায়েখের সাথে সাক্ষাত করেছি, যাদেরকে অলি-আবদাল মনে করা হয়, প্রত্যেকেই বিদায়কালে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, কমবয়সী ছেলেদের সংশ্রব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।

সাত. ইবনুযাহির মাকদিসী রহ. বলতেন, কোনোব্যক্তি যদি কোনো পুরুষের প্রতি আসক্ত থাকে তাহলে তার জন্য ওই পুরুষকে দেখা হারাম।

আট. ইমাম গাযালী রহ. বলতেন, মুরিদের ওপর হিংস্রপ্রাণীর থাবাকে আমি ওই পরিমাণ ভয় করি না, যে পরিমাণ ভয় করি তাকে কোনো কমবয়সী ছেলের সান্নিধ্যে দেখলে।

নয়. হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বলতেন, কুদৃষ্টি স্মরণশক্তির জন্য প্রাণনাশকারী বিষতুল্য।

দশ. মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহ. তাঁর মাকতুবাতে লিখেছেন, যার দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে নেই, তার অন্তরও নিয়ন্ত্রণে নেই। আর যার অন্তর নিয়ন্ত্রণে নেই, তার লজ্জাস্থানও নিয়ন্ত্রণে নেই।

কুদৃষ্টির চিকিৎসা

বর্তমানে ইন্টারনেট টিভি ও ভিসিআরের কারণে ঘরে-ঘরে ফ্লিম নাটকের ছড়াছড়ি। নগ্নতা ও অশ্লীলতার তুফান চলছে। যুবতীরা পর্দাহীন হয়ে দেহপ্রদর্শনী করে মার্কেটে-মার্কেটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ্যাডভেটাইসের নামে পথের কিনারায় নারীদের আকর্ষণীয় ছবি দেখা যাচ্ছে। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে নারীদের উত্তেজক ছবি তো এখন সাধারণ বিষয়। এহেন পরিবেশে যুবক তো পরের কথা, বুড়োদের দৃষ্টি সংযত রাখাও মহা আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতচেষ্টা সত্ত্বেও এ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের অন্তরের হেদায়েতের আলো আছে, তারা গুনাহটির ব্যাপকতা দেখে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তরিকতের সালিক-মুরিদ ও শিষ্যরা নিজেদের পীরের কাছে এ থেকে পরিত্রাণের ওষুধ প্রার্থনা করেন। তাই প্রয়োজন মনে হল, এ থেকে পরিত্রাণের কিছু পরীক্ষিত ওষুধ কুরআন-হাদীসের আলোকে পেশ করব। যাতে দৃষ্টি হারামপাত্র থেকে ফিরে এসে হালালপথে ধাবিত হয়। যৌনউম্মাদনার জ্বলে ওঠা আগুন নিভে যায়। পবিত্র ও শালীন জীবনযাপন সহজ হয়ে যায়।

পবিত্র কুরআনের আলোকে

কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার উদ্দেশে পবিত্র কুরআনের আলোকে সাতটি ব্যবস্থাপত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হল-

এক. মহান আল্লাহ বলেন-

قُلْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ

‘মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে।’

কুদৃষ্টির সর্বোত্তম চিকিৎসা হল, নিজের দৃষ্টি অবনত রাখা। সুতরাং সালেক তথা আত্মশুদ্ধি প্রত্যাশীব্যক্তির জন্য আবশ্যক হল, পথে চলতে গিয়ে দৃষ্টিকে অবনত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা। পায়ে হেঁটে চললে দৃষ্টি নিচের দিকে রাখুন। গাড়িতে থাকলে দৃষ্টি এতটুকু উঠিয়ে রাখুন, যেন অন্যান্য গাড়ির চলাচল বুঝতে সক্ষম হন। কারো চেহারার প্রতি দৃষ্টি নয়; কারণ ফেতনার শুরুটা এটা দ্বারাই হয়। দৃষ্টি ভুল করে ফেললে ইসতেগফার করুন এবং দৃষ্টি নামিয়ে নিন। এ অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, এমনকি এটাকে জীবনের অংশ বানিয়ে নিন। অফিসিয়াল কাজে কিংবা কেনাকাটার সময় কোনো নারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে তার চেহারার দিকে তাকাবেন না। যেমনিভাবে কেউ কারো ওপর অসন্তুষ্ট থাকলে কথা বলার সময় পরস্পরের প্রতি তাকায় না। দৃষ্টি বিনিময় করেনা। অনুরূপভাবে কোনো প্রয়োজনে পরনারীর সাথে কথা বলতে হলে এটা মনে রাখবেন যে, আল্লাহর নির্দেশের কারণে আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট, সুতরাং তার চেহারার প্রতি তাকাব না।

দুই. আল্লাহতাআলা বলেন-

فَانْكِحُوْا مَا طَابَ لَكُمْ مِّنَ النِّسَاءِ

‘নারীদের থেকে তোমাদের পছন্দমত বিয়ে কর।’ -সূরা নিসা : ৩

যত দ্রুত সম্ভব দীনদার অনুগত ও সুন্দরীনারী দেখে বিয়ে করে নিন, যাতে করে জৈবিকচাহিদা পূরণ করা যায়। ক্ষুধার্তব্যক্তি যদি অধিক নফল নামায পড়াকে নিজের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থাপত্র মনে করে তাহলে তার চিকিৎসা করা উচিত। ক্ষুধার ওষুধ হল, খানা খাওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষুধা নিবারণের প্রার্থনা করা। অনুরূপভাবে দৃষ্টি পবিত্র রাখার ব্যবস্থাপত্র হল, বিয়ে করা এবং আল্লাহর কাছে পবিত্র জীবনযাপনের জন্য দুআ করা। সুযোগ পেলে স্ত্রীর চেহারার দিকে ভালবাসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকাবেন। আল্লাহর শোকর আদায় করবেন যে, নেয়ামতটি না পেলে কত গস্নানি যে পোহাতে হত! যে কামদৃষ্টি মার্কেটে বিচরণশীল নারীর প্রতি দেন তা স্ত্রীর প্রতি দিন। স্ত্রীকে পরিষ্কার-পচ্ছিন্ন থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন। ভাল কাপড় কিনে দিন। অন্য নারীর কাছে যা কিছু আছে তার সবই আপনার স্ত্রীর কাছেও আছে। ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি তাকাই তাহলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীকে দেখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। হাদীসে আছে-

‘যেব্যক্তি স্ত্রীর প্রতি মুচকিহেসে তাকায় এবং যেস্ত্রী স্বামীর প্রতি মুচকি হেসে তাকায় তখন আল্লাহতাআলা উভয়ের প্রতি মুচকি হেসে তাকান।’

হালালকে দেখুন প্রাণভরে, যেন হারামের প্রতি লোভ না জাগে। যখনই মন পরনারীর প্রতি আকর্ষণবোধ করবে তখনই স্ত্রীর কথা কল্পনায় আনুন। দেখবেন, গুনাহর চিন্তা অন্তর থেকে দূর হয়ে যাবে।

তিন. আল্লাহতা‘আলা বলেন-

اِنَّ الذِّيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ

‘নিশ্চয় যারা আল্লাহতাআলাকে ভয় করে যখন তাদেরকে শয়তানের কোনো দল ঘিরে ধরে তখন তারা আল্লাহর যিকির করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি ফিরে আসে।’

আয়াতটিতে এ রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, যখনই শয়তান আক্রমন করবে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ঢেলে দিবে তখনই যিকিরের অস্ত্র ব্যবহার করে তা প্রতিহত করবে। এজন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সম্ভব হলে তাসবীহ রাখবেন। অন্যথায় মনে-মনে যিকির করবেন। অলসতা গুনাহর অন্যতম ভূমিকা। সুতরাং যিকির দ্বারা অলসতা দূর করুন। যিকিরের আলো অন্তরে অপার্থিব প্রশান্তির জন্ম দেয়। তখন নিষিদ্ধস্থানে চোখও তুলতে মন চায় না।

دو عالم سے كرتى ہے بيگا نہ دل كو

عجب چيز ہے لذت آشنا ئ

‘যখন দুই জগত থেকে হৃদয়কে অপরিচিত করে নেয়,

তখন বন্ধুত্বের স্বাদ মুগ্ধতাছড়ানো হয়।’

চার. আল্লাহতাআলা বলেন-

اَلَمْ يَعْلَمْ بِّاَنَّ اللهُ يَرى

‘সে কি জানে না যে আল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন।’ (সূরা আলাক : ১৪)

আত্মার সংশোধনপ্রয়াসী সালেক যখনই পরনারীর প্রতি তাকানোর ইচ্ছা করবে তখনই এ কল্পনা করবে যে, আল্লাহ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। এতে দৃষ্টির হেফাজত করা সহজ হবে। এর দৃষ্টান্ত হল,ওই নারীর বাবা কিংবা স্বামী যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তবে কি আমি ওই নারীর প্রতি তাকিয়ে থাকতে পারব? তখন কি আমার মনে হবে না যে, ওই নারীর বাবা বা স্বামী আমার ওপর রাগ করবেন? অনুরূপভাবে ভাবুন, আমি যদি পরনারীর প্রতি থাকাই, অথচ আল্লাহ আমাকে দেখছেন, তখন অবশ্যই তিনি রাগ করবেন। যদি তিনি পাকড়াও করেন তাহলে আমার কী অবস্থা হবে?

পাঁচ. আল্লাহতাআলা বলেন-

وَالذَّيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

‘যারা আমার পথে সাধনা করে আমি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখাব।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)

তাফসীরবিশারদগণ লিখেছেন, শরীয়তের ওপর চলার উদ্দেশ্যে মনের বিপরীত আমল করাকেই মুজাহাদা তথা সাধনা বলে। এটা বাস্তব যে, মুজাহাদা দ্বারা ‘মুশাহাদা’ লাভ হয়। সুতরাং পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দিতে যখনই মন চাইবে তখনই নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তার বিরোধিতা করবেন। মনে একথা বদ্ধমূল রাখবেন, এই সাধনার দ্বারা আমার প্রকৃত মাহবুব তথা আল্লাহতাআলার মুশাহাদা বা দর্শন নসিব হবে। এমনিতে এ ধরনের সাধনা হয় কয়েক মুহূর্তের। অথচ মুশাহাদার স্বাদ হবে চিরদিনের জন্য। মনে রাখবেন, যবতে-নফস তথা নফসকে দমানোর নূর দ্বারা অন্তর খুব দ্রুত পরিষ্কার হয়। তাসবিহর দানাও এর সামনে কিছু নয়। সাহসহারা হওয়া সমস্যার সমাধান নয়। হিম্মত ধরে রাখলে সমস্যার সমাধান হয়। সুতরাং মনের ওপর জোর খাটান। তাকে শরীয়তের লাগাম পরিয়ে দিন, যেন কেয়ামতের দিন সৌভাগ্যের মালা পরার ভাগ্য জুটে।

ছয়. আল্লাহতাআলা বলেন-

اِنَّ اللهَ يَاْمُرُكُمْ اَنْ تَؤَدُّوْا الْاَماناتِ اِلى اَهْلِهَا

‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে দিয়ে দিতে।’ (সূরা নিসা : ৫৮)

সংশোধনপ্রত্যাশী সালেক এই কল্পনা ধরে রাখবে যে, আমার চোখ আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। এই আমানত ব্যবহার করতে হবে তাঁরই নির্দেশ অনুপাতে। বিপরীত করলে আমানতের খেয়ানতকারী হয়ে যাব। সাধারণত নিয়ম হল, আমানতে একবার খেয়ানত করলেও তার কছে দ্বিতীয়বার আমানত রাখা হয় না। এমন যেন না হয় যে, দুনিয়াতে আল্লাহর দেয়া দৃষ্টিশক্তি পরনারীর পেছনে ব্যয় করলাম, পরিণামে তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি আখেরাতে ফেরত দিবেন না। ওইদিন যদি অন্ধ হয়ে ওঠতে হয় তাহলে কী অবস্থা হবে? পবিত্র কুরআনে এটার প্রমাণ আছে যে, আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিন কিছুলোককে অন্ধ করে ওঠাবেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করবে-

رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِىْ اَعْمى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا

‘প্রভু! আমাকে অন্ধ বানিয়ে ওঠালেন কেন? আমার তো দৃষ্টিশক্তি ছিল!’

এটা ভাবনার বিষয় যে, আমরা এমন যুগে দুনিয়াতে সৃষ্টি হয়েছি যখন আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ করতে পারি নি। কেয়ামতের দিনও যদি অন্ধ করে ওঠানো হয় তাহলে আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর দর্শনলাভ থেকে বঞ্চিত হব। আল্লাহর প্রিয়বন্ধুর নাম হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দ্বিতীয়বার বঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচান। সুতরাং দৃষ্টিসংরক্ষণ জরুরি, যেন কেয়ামতের দিন আমানতটি দ্বিতীয়বার ফেরত পাই। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

اِنَّ اللهَ تَعَالى جَمِيْلٌ

‘নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর।’ (আলজামিউসসাগীর, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৬৩)

এ কথাটা মাথায় রাখবেন যে, যদি আমি দুনিয়ার সুন্দরীদের প্রতি কুদৃষ্টি দেই তাহলে আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিন তার সৌন্দর্যের দর্শনলাভ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে দেন কিনা!

সাত. আল্লাহতাআলা বলেছেন-

اَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ

‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নি?’

সালেক তথা আত্মার সংশোধনপ্রত্যাশীর মন যখনই কুদৃষ্টির গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার জন্য ইতিউতি করবে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে চিন্তা করবে। তখনই নিজেকে সম্বোধন করে বলবে ‘ঈমানদারের কি এখনও আল্লাহকে ভয় করার সময় হয় নি?’ প্রতিটি কৃদৃষ্টির সময় আয়াতটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ভাবতে থাকুন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে থাকুন। এতে আল্লাহতাআলা নিজের ভয় আপনার অন্তরে তৈরি করে দিবেন এবং কুদৃষ্টি থেকে সত্যিকারের তাওবা আপনার নসিব হবে।

পবিত্র হাদীসের আলোকে

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টিসংরক্ষণের প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষের চেহারার আকর্ষণ তো আছেই, এমন কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবজন্তুর লজ্জাস্থানের প্রতি তাকানো থেকেও নিষেধ করেছেন। তিনি দৃষ্টিকে বলেছেন ‘ইবলিসের একটি বিষমিশ্রিত তীর’। হাদীসশরীফের প্রতি লক্ষ্য করলে কুদৃষ্টির চিকিৎসা সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র পাওয়া যায়। যথাক্রমে-

এক. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পরনারীর প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার পর যদি তার রূপলাবণ্য তোমাকে আকর্ষিত করে তাহলে ঘরে এসে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস কর।’ কারণ পরনারীটির কাছে যা আছে তোমার স্ত্রীর কাছেও তা-ই আছে। এর দ্বারা বোঝা গেল, বৈধ উপায়ে নিজের প্রয়োজন পূরণ করার দ্বারা হারাম থেকে বাঁচা সহজ হয়।

দুই. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এক যুবক এল। বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শাসালেন না; বরং স্নেহের সুরে বললেন, কেউ তোমার মায়ের সাথে ব্যভিচার করাটাকে তুমি কি পছন্দ করবে? যুবক বলল, না। নবীজী বললেন, তাহলে তোমার স্ত্রীর সাথে কেউ ব্যভিচার করুক- এটা কি চাও? যুবক উত্তর দিল, না। নবীজী বললেন, তাহলে তোমার বোনের সাথে ব্যভিচার করা হোক- এটা কি চাও? যুবক এবারও উত্তর দিল, না। এবার নবীজী বললেন, তবে তো তোমার মেয়ের সাথে এমনটি হোক- এটা কামনা কর কি? যুবক এবারও উত্তর দিল, না। যুবকের উত্তরগুলো শুনে এবার প্রিয় নবী বললেন, যার সাথে ব্যভিচার করার জন্য তুমি এতটা আগ্রহী সে তো নিশ্চয় কারো মা কিংবা স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা মেয়ে হবে। যেমনিভাবে তোমার এসব মাহরামনারীর সাথে ব্যভিচার হওয়াটা তোমার জন্য অসহনীয়, অনুরূপভাবে অপরলোকটিও তো তার নিকটাত্মীয় নারীর সাথে এমনটি হওয়াটা কোনোভাবেই কামনা করে না। এ বলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র হাত যুবকটির বুকে রেখে তার জন্য পবিত্রতা ও সম্ভ্রমবোধ সংরক্ষণের দুআ করলেন। এ যুবক সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমার বুক থেকে ব্যভিচারের কামনা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে গেল এবং অন্যান্য গুনাহর চেয়েও ব্যভিচারের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি আরো অনেক বেশি হল।

এর দ্বারা বোঝা গেল, সালেক একথা ভাববে- ‘যেমনিভাবে আমার নিকটতম কোনো নারীর প্রতি পরপুরুষের লোভাতুর শয়তানিদৃষ্টি আমার কাছে বিরক্তিকর ও আপত্তিজনক মনে হয়, তেমনিভাবে অন্যরাও এটা মোটেও পছন্দ করে না যে আমি তাদের নিকটতম কোনো নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাই।’ এরূপ ভাবনার দ্বারা অন্তর স্থির ও শান্ত হয়ে যাবে। কুদৃষ্টির তাড়না নিস্তেজ হয়ে পড়বে। তাছাড়া কোনো কামেল শায়েখের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে তাঁর কাছে রোগটির কথা খুলে বলুন এবং দুআ ও তাওয়াজ্জুহ কামনা করুন। পীর-মাশায়েখ নবীদের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁদের তাওয়াজ্জুহ দ্বারা অন্তরের অন্ধকার দূর হয়। তখন মানুষ প্রবৃত্তির নীচুতা থেকে বের হয়ে আধ্যাত্মিকতার সুউচ্চ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। তাঁদের সান্নিধ্য ওষুধ এবং তাঁদের দৃষ্টি চিকিৎসা হয়ে থাকে।


অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী

কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ১
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ২
কুদৃষ্টি – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – পর্ব ৪