সুলতান মাহমুদ গজনবী, ভারতবর্ষে তাওহীদের পতাকা উত্তোলন যাঁর হাতে

(সুলতান মাহমুদ গজনবী। ভারতবর্ষে তাওহীদের পতাকা বীরত্বের সঙ্গে তিনিই উত্তোলন করেছিলেন। বিশ্রাম কিংবা পরাজয় বলতে কোনো শব্দ ছিল না তাঁর অভিধানে। জীবনভর তিনি লড়ে গেছেন কাফের সাম্রাজ্য ও শাসকদের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষে একে একে ১৭টা অভিযান পরিচালনা ক্রেছিলেন তিনি। ৩০ এপ্রিল, ১০৩০ সালের এ দিনে মহান এ সিপাহসালার ইন্তেকাল করেন।)

সুলতান মাহমুদ গজনবীর মূলনাম ইয়ামিনুদ্দৌলা আবুল কাদিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগীন। পিতা সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর সুলতান মাহমুদ ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে গজনির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানের সামানীয়দের পরাজিত করে স্বীয় আধিপত্য মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর মাহমুদ ইবনে সবুক্তগীন ‘সুলতান’ উপাধি গ্রহণ করে তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা কাদির বিল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে পত্র প্রেরণ করেন। এতে খলিফা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘ইয়ামিন-উদ-দৌল্লা’ এবং ‘আমিন-উল-মিল্লাত’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বিজেতা হিসেবে সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। বীরোত্তম সুলতান মাহমুদ তাঁর তেত্রিশ বছরের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে সর্বমোট ১৭ বার যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন এবং এতে তাঁর ২৭ বছর ব্যয় হয়।তাঁর ভারত অভিযানের কাহিনি ইতিহাসে আজও অমলিন হয়ে আছে।

ভারতবর্ষে সুলতান মাহমুদ সর্বপ্রথম ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে লামদানা ও পেশোয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সীমান্ত দুর্গগুলো অধিকার করেন এবং এতে তাঁর রাজ্যের সীমান্ত সুরক্ষিত হয়।

১০০১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ পিতৃশত্রু জয়পালের মোকাবেলা করেন। সবুক্তগীনের কাছে দুবার পরাজিত হয়েও জয়পাল মুসলিম আক্রমণের বিরোধিতা ও তাদের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করে। জয়পাল ১২ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক এবং ৩০০ হস্তিবাহিনী নিয়ে সুলতান মাহমুদের মোকাবেলা করেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি সুলতান মাহমুদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। পুত্র-পরিবার-পরিজনসহ জয়পাল যুদ্ধে বন্দী হলে কতিপয় শর্তে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। মুসলমানদের কাছে পরাজয়ের গ্লানি মোচন করতে না পেরে জয়পাল স্বীয়পুত্র আনন্দ পালের ওপর রাজ্যভার অর্পণ করে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় আত্মহুতি দেয়।

সুলতান মাহমুদ জয়পালকে পরাজিত করে সিন্ধু নদের তীরবর্তী উপ-শহর অধিকার করে গজনিতে ফিরে আসেন।

১০০৪-৫ খ্রিষ্টাব্দে ভীরার রাজা বিজয় রায়ের বিরুদ্ধে মাহমুদ এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বিজয় রায় সুলতান মাহমুদকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করলে মাহমুদ তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। সুলতান মাহমুদের বাহিনীর সাথে বিজয় রায়ের সৈন্যদলের তিন দিন ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলে, কিন্তু চতুর্থ দিনে মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ভীরার দুর্গ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। রাজা বিজয় রায় ধৃত হলে তিনি আত্মহত্যা করেন। এ বিজয়ের ফলে ভীরা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাহমুদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

অপরদিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে এক মুসলিম শাসক। মুলতানের শাসনকর্তা আবুল ফাত্তাহ দাউদ সুলতান মাহমুদের সম্প্রসারণবাদকে প্রতিহত করার জন্য জয়পালের পুত্র আনন্দপালের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে। মুলতানের শাসনকর্তার অনৈসলামিক কার্যকলাপ এবং বিদ্বেষ ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে সুলতান মাহমুদ ১০০৫-৬ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে মুলতানের দিকে অগ্রসর হন। কারামাতি নেতা দাউদের প্ররোচণায় আনন্দপাল মাহমুদের গতিরোধ করলে আনন্দপাল পরাজিত হয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় আশ্রয় নেয়। অতঃপর সুলতান মাহমুদ দাউদকে সমুচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য মুলতান অবরোধ করেন। সাতদিন অবরুদ্ধ থাকার পার দাউদ মাহমুদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইসলাম-বিরোধী ধর্মমত কারামাতি ত্যাগ করে শরিয়ত মোতাবেক ধর্মীয় অনুশাসন পালন এবং বার্ষিক ২০ হাজার দিরহাম প্রদানের অঙ্গকারে সুলতান মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করে। মুলতান হতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে মাহমুদ আনন্দপালের পুত্র সুখপালের ওপর শাসনভার অর্পণ করেন এবং মোঙ্গল নেতা ইলাক খানের আকস্মিক গজনি রাজ্য আক্রমণের সংবাদে দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। সুখপাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেওয়াশা শাহনাম ধারণ করেন।

সুলতান মাহমুদ ও মোঙ্গল নেতা ইলাক খানের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলার সুযোগে সুখপাল ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বলখের যুদ্ধের সমাপ্তির পর মাহমুদ সুখপালকে শায়েস্তা করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু সীমান্তে পৌঁছৈ সংবাদ পান যে, তার আমিরগণ সুখপালকে পরাজিত ও বন্দী করেছেন। সুখপালকে চার লক্ষ দিরহাম জরিমানা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

মুলতানে পরাজিত দাউদ বশ্যতা স্বীকারের পর তাঁকে সহায়তার জন্য ১০০৮-৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আনন্দপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সমূহ বিপদের আশঙ্কায় আনন্দপাল পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজন্যবর্গের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান, তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে উজ্জয়িনি, কনৌজ, কালিঞ্জর, দিল্লি এবং আজমিরের হিন্দু রাজন্যবর্গের সম্মিলিত বাহিনী মাহমুদের গতিরোধের জন্য পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘হিন্দু রমণীকূল তাদের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের নিমিত্ত অর্থ প্রেরণ করেন। উপরন্তু দুধর্ষ এবং নীতিজ্ঞানশূন্য ‘ঘোক্কার’ উপজাতি সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীতে যোগদান করে। হিন্দুরাজাগণ এবং ঘোক্কার উপজাতি মুসলমানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী পেশোয়ার ও ওয়াইহিন্দের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হিন্দুদের নির্মমভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করেন।

মুসলিম বাহিনীর দক্ষতা এবং যুদ্ধকৌশল, অন্যদিকে হিন্দু সৈন্যবাহিনীর বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা মুসলিম বিজয়কে নিশ্চিত করে। বিজয়ী সুলতান মাহমুদ বীরবীক্রমে নগরকোর্ট, ভীমনগর, কাংড়াদুর্গ অধিকার করে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন লাভ করেন। কথিত আছে যে, নগরকোর্ট দুর্গ থেকে মাহমুদ সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, ৭০০ মণ স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্র, ২০০ মন খাঁটি সোনা, ২ হাজার মণ অপরিশোধিত রূপা এবং ২০ মণ বিভিন্ন ধরনের রত্নাদি লাভ করেন।

১০০৯-১০ খৃষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে সপ্তম অভিযান পরিচালনা করেন। তবে তাঁর এ অভিযানের উদ্দেশ্য দেশ জয় ছিল না, বরং পরাজিত হিন্দু রাজাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল। হিন্দু সংঘের পতনে হিন্দু রাজাদের নৈতিক শক্তির লাঘব হয় এবং বিশেষ করে আনন্দপালের পরাজয়ের ফলে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে সামরিক অভিযানের পথ প্রশস্ত হয়। নগরকোট বিজয় ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে অভিযানের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

১০১০ খ্রিষ্টাব্দে দুর্ধর্ষ ঘোর উপজাতিদের বিদ্রোহ নির্মূল করেন সুলতান মাহমুদ। অপরদিকে মুলতানের শাসনকর্তা দাউদ পুনরায় বিশ্বাসঘাতকতা করে। সুলতান আবার তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন, দাউদ যুদ্ধে পরাজিত হলে তাকে ঘোরের দুর্গে বন্দী করা হয়।

সুলতান মাহমুদ ভারতে জয় লাভ করে কোনো এক কারণে ভারতের এই অঞ্চলে তিনি শাসনব্যবস্থা শক্তশালী করেননি। ফলে কিছুদিন পর পর বিদ্রোহ লেগেই থাকত। সুলতানের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেছিল আনন্দপাল। পরবর্তীতে সে লবণগিরি অঞ্চলে গিয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে, তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ত্রিলোচনপাল নন্দনায় রাজধানী স্থানান্তর করে সৈন্যবাহিনীকে সংঘবদ্ধ করে। ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ত্রিলোচনপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ত্রিলোচনপাল কাশ্মীরে পলায়ন করে। কাশ্মীরে গমন করে মাহমুদ ত্রিলোচনপাল ও তার আশ্রয়দাতা রাজা তুঙ্গরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ত্রিলোচনপান পরাজিত হলে তার পুত্র ভীমপাল মারগালা গিরিপথে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু গজনির এই বীর সিলাহসালারকে কোনো প্রতিরোধই থামাতে পারেনি। তিনি ভীমকে পরাজিত করেন৷ ভীম নন্দনার দুর্গে আশ্রয় নেয়। ভীমের শক্তি বিনাশের জন্য মাহমুদ সমগ্র পাঞ্জাব অধিকার করে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করেন। ভীম প্রাণভয়ে আত্মগোপন করে।

১০২৬ খ্রিষ্টাব্দে ভীমপাল মারা গেলে হিন্দুশাহী বংশের পতন ঘটে।

সুলতান মাহমুদের সামরিক অভিযানের অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনা ছিল থানেশ্বর বিজয়। ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুধর্মের এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মাহমুদ অভিযান করলে স্থানীয় হিন্দু রাজা বশ্যতা স্বীকার করে।

সুলতানের পরবর্তী ভারত সফর ছিল কাশ্মীর অভিমুখে। ১০১৫-১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো কাশ্মীরে অভিযান পরিচালনা করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং লোহকোট দুর্গের দুর্ভেদ্যতায় এ অভিযানে ভাটা পড়ে।

১০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ তাঁর বহু দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। হিন্দুস্তানের ক্ষত্রিয় আধিপত্যের প্রাণকেন্দ্র কনৌজের অভিযান ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাহমুদের এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সাথে খোরাসান ও তুর্কিস্তানের কয়েক সহস্র স্বেচ্ছাসেবক যোগদান করলে সৈন্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। পথে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মাহমুদ ঝিলাম নদী পার হয়ে বুলন্দশহরে উপস্থিত হলে সেখানকার হিন্দু রাজা হরদত্ত বশ্যতা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর সুলতান মাহমুদ মাহওয়ানের হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে মথুরার দিকে ধাবিত হন। মথুরা দখল করার পর মাহমুদ বৃন্দাবনে আগমন করার পূর্বেই তথাকার হিন্দু নগরপাল পলায়ন করে। অসীম বীরত্বের সাথে সৈন্য পরিচালনা করে সুলতান মাহমুদ ১০১৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কনৌজের ফটকের সামনে উপস্থিত হন। হর্ষবর্ধণের রাজধানী কনৌজ সুসমৃদ্ধ ছিল এবং এ নিরাপত্তার জন্য সাতটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। সুলতানের আগমনে ভীত-সন্ত্রস্ত প্রতিহার রাজা রাজ্যপাল বিনাশর্তে আনুগত্য স্বীকার করে। একদিনেই সুলতান সাতটি দুর্গ অধিকার করেন। কনৌজ বিজয় সুলতান মাহমুদের শৌর্য-বীর্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং এর ফলে তিনি গঙ্গার ওপারেও সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনা করতে সমর্থ হন।

কনৌজের রাজা রাজ্যপাল সুলতান মাহমুদের আনুগত্য স্বীকার করলে অন্যান্য পরাক্রমশালী রাজপুত অধিপতিগণ অপমান বোধ করেন। কালিঞ্জরের চান্দেলা রাজা গোন্তা গোয়ালিয়রের রাজপুত রাজার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত ও হত্যা করেন। নৈতিক দিক থেকে চিন্তা করে সুলতান মাহমুদ তাঁর মিত্র হিন্দু রাজা রাজ্যপালের হত্যার প্রতিশোধকল্পে ১০১৯ খ্রিষ্টাব্দে চান্দেলা রাজার বিরুদ্ধে সমরাভিযান পরিচালনা করেন। চান্দেলা রাজা গোন্তা মাহমুদের বাহিনীর প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। সুলতান বিজয়ীর বেশে চান্দেলার রাজধানীতে প্রবেশ করেন। চান্দেলা রাজার সাথে গোয়ালিয়রের রাজার ষড়যন্ত্রের ফলে রাজ্যপালের হত্যার প্রতিশোধকল্পে কেবল চান্দেলা রাজাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েই সুলতান মাহমুদ ক্ষান্ত ছিলেন না, ১০২১-২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গজনি থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে চতুর্থদশবারের মতো অভিযান পরিচালনা করেন। পাঞ্জাবে একটি সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুলতান এ অভিযানে অসংখ্য কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রী ও কামারকে সাথে নিয়ে যান। সীমান্ত অঞ্চলের সোয়াত, বাজাউর এবং কাফিরিস্তানের বিদ্রোহী উপজাতিদের বিদ্রোহ নির্মূল করে তিনি গোয়ালিয়রের দিকে ধাবিত হন। গোয়ালিয়রের হিন্দু রাজা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করলে তিনি গজনিতে ফিরে যান।

সুলতান মাহমুদ ১০২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চদশবারের মতো ভারতবর্ষে অভিযান করেন। গোয়ালিয়র অধিকৃত হলে তিনি একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কালিঞ্জরের হিন্দু রাজা নন্দার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। নন্দা প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করে সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেন।

সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষে অভিযানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোমনাথ বিজয়। উত্তর ও মধ্য ভারতের অঞ্চলসমূহে মাহমুদ উপর্যুপরি কয়েকবার সমরাভিযান পরিচালনা করে প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেন। গুজরাটের কাথিওয়াড়ের সমুদ্র উপকূলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিখ্যাত এবং ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেব-মন্দির অবস্থিত ছিল। ইবনে আসিরের মতে, সোমনাথ বিগ্রহের খ্যাতি ছিল সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এবং সেবায়েত-ব্রাহ্মণগণ মনে করতো যে, বিগ্রহের অসীম অলৌকিক ক্ষমতার বলে মাহমুদের পক্ষে তা জয় করা সম্ভব হবে না। সোমনাথের পুরোহিতগণের ধারণা ছিল, সোমনাথের বিগ্রহের অধীনস্থ ভারতবর্ষের অন্যান্য ক্ষুদ্র বিগ্রহসমূহের ওপর সোমনাথের দেবতার অসন্তুষ্টি এবং রোষের কারণে মাহমুদের পক্ষে ভারতবর্ষে সামরিক অভিযান সফল হয়।

সোমনাথ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গ ১০ হাজার গ্রাম মন্দিরের সম্পত্তিরূপে দান করেন। সোমনাথ মন্দিরের পূজা-পার্বন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য এক হাজার ব্রাহ্মণ নিয়োজিত ছিল। সর্বদা দেবতার তুষ্টির জন্য পাঁচশ’ নর্তকী এবং দুশ’ গায়িকা নৃত্য-গীত করতো। ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাগণ তাদের কুমারী কন্যাদের এ মন্দিরের সেবিকার হিসেবে উৎসর্গ করে কৃতার্থ হতো। তিনশ’ নাপিত তীর্থযাত্রীর মস্তক মুণ্ডন করার জন্য নিয়োজিত ছিল। সমুদ্র সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে পাথরে নির্মিত মন্দিরটিতে ৫৬টি অলংকৃত স্তম্ভ ছিল। ‘তারিখ-ই জাইনুল মাসির’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, যে কক্ষে পাথরের লিঙ্গ-বিগ্রহ ছিল তা ছিল অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সমগ্র গৃহকক্ষটি ঝুলন্ত ঝাড়বাতিতে সংলগ্ন উজ্জ্বল রত্নের আভায় আলোকিত হতো। বিগ্রহটি পাঁচ গজ লম্বা ছিল। এর মধ্যে দুই গজ মাটির নিচে এবং তিন গজ মাটির উপরে ছিল।

১০২৫-২৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনি থেকে তাঁর সুশিক্ষিত বাহিনী এবং ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ গুজরাটের দিকে অগ্রসর হন। তিনি মুলতান ও রাজপুতনার মধ্য দিয়ে আজমীরে উপস্থিত হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকে সোমনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সোমনাথ মন্দিরের নিকটে উপস্থিত হয়ে মাহমুদ মন্দিরের প্রাচীর-গাত্রের সম্মুখ বরাবর তাঁর বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেন। হিন্দু রাজপুত নৃপতিগণ সংঘবদ্ধ হয়ে মাহমুদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে সম্মিলিত হিন্দু বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। ১০২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সোমনাথ মন্দিরের প্রাচীর ভেঙে মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসলিম বাহিনী। সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দির থেকে অফুরন্ত ধনরত্ন লাভ করেন। কথিত আছে, এ মন্দির থেকে সুলতান মাহমুদ দুই কোটিরও বেশি দিনার মূল্যের ধন-সম্পদ লাভ করেন। মন্দিরের বিগ্রহ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, প্রধান পুরোহিত মাহমুদকে অসংখ্য ধনরত্নের বিনিময়ে বিগ্রহটিকে অক্ষত অবস্থায় রাখার অনুরোধ করেন। কিন্তু সুলতান মাহমুদ প্রত্যুত্তরে বলেন, বিগ্রহ বিক্রেতা অপেক্ষা বিগ্রহ ধ্বংসকারীরূপে তিনি পরিচিত হতে চান। এ কথা বলে মাহমুদ তরবারির আঘাতে প্রস্তর নির্মিত লিঙ্গ বিগ্রহটি ভেঙে ফেলেন এবং এর ফলে প্রস্তরের ভেতর থেকে অসংখ্য ধনরত্ন বেরিয়ে আসে। তবে এ ঘটনা নিয়ে ইতিহাসবিদদের বিতর্ক রয়েছে।

১০২৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ সপ্তদশ ও সর্বশেষবারের মতো দুর্ধর্ষ জাঠ উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনে গজনি থেকে ভারতবর্ষে সমরাভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর এ অভিযান ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। চৌদ্দশত নৌকার একটি সুসজ্জিত নৌবহর তৈরি করে সুলতান মাহমুদ মূলতান থেকে জাঠদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। প্রতিটি নৌকায় ২০ জন তীরন্দাজ এবং অগ্নি নিক্ষেপণের সরঞ্জাম ছিল। মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক জাঠরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং অসংখ্য জাঠ প্রাণ হারায়।

সুলতান মাহমুদ গজনবী ছিলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর জীবনে বিশ্রাম বলে কোনো শব্দ ছিল না। তিনি ছিলেন অশ্বের মতো দ্রুতগামী একজন যোদ্ধা। সামরিক মেধা ও দক্ষতায় তৎকালীন কোনো নৃপতিই তাঁর সমকক্ষ ছিল না। ১৭ বার ভারত অভিযানে তিনি প্রতিবারই বিজয়ী হন। ভারত অভিযানে তিনি যে বীরত্ব ও রণদক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন তাতে তাঁর নাম ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ৩০ এপ্রিল ১০৩০ সালে এই মহান সিপাহসালার ইন্তেকাল করেন।


আবু জর
সূত্রঃ fateh24