ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী মাইজবাড়ির মিয়াঁ ছাহেব রাহ. – মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

ঘুঘুডাকা গ্রামের রেশ এখনো জড়িয়ে আছে। গাছপালার ঘনত্ব অবশ্য কিছু কমেছে। বেড়েছে ঘরবাড়ি, দালানকোঠা। সেই মাইজবাড়িতে সেদিন গেলাম। এই জানুয়ারির ৩০ তারিখ। প্রশান্তি ও ঐতিহ্যের বিনয়ী মুখ ফকিরবাড়ির আঙ্গিনাজুড়ে। জুমার পর সওতুল হেরা মাদরাসার দফতরে। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির গোরস্তানের সামনে। পুণ্যবান বহু মানুষের মাটির বিছানা। আগেও তো গিয়েছি। পাঁচ-দশ, বিশ বছর আগে এবং তারও আগে। হঠাৎ হঠাৎ এমনিতেই। মাহফিল, বিশেষ মজলিস, আত্মীয়তার নিসবত- ছিল এমনই সব উপলক্ষ। কিন্তু সেদিনের অনুভ‚তি ছিল একটু ভিন্ন।

ময়মনসিংহ শহর থেকে ৮/১০ কি. মি. পশ্চিমে। টাঙ্গাইল মহাসড়কের দক্ষিণে। আমাদের প্রজন্মের সামনে এই বাড়ির দুটি নাম এবং মুখ ছিল বড় উজ্জ্বল। ব্রিটিশবিরোধী অমর সংগ্রামী শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর লড়াকু শাগরিদ মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ. এবং তাঁর চাচাতো ছোট ভাই ফরযন্দে দেওবন্দ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান রাহ.। ছিলেন সংগ্রামের মননে নিঃসঙ্গ এক পথিক মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। কী দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব! ধবধবে ফর্সা মুখ। উঁচু কিশতী টুপির নিচে ঈগলের মতো খাড়া নাক। গালভরা সাদা দাড়ির মাঝে টানা টানা দুটি চোখ। সরাসরি দৃষ্টিপাত, স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে বক্তব্য উপস্থাপন কিংবা কথোপকথন। আমাদের দেখা ও শোনা- দুটোতেই থাকতো অপেক্ষমাণ মুগ্ধতা। কিন্তু আমরা তাঁর আগে তাঁর পরিবারের আর কারো ব্যাপারে তেমন কিছু জানতাম না। অথচ দ্বীন ও ব্যক্তিত্বের এই নিদর্শনেরও আগে ছিল আরো বড় উৎস। তাঁর দাদা, তাঁর দাদার দাদা এবং তাঁর বাবা সবাই ছিলেন দ্বীন-কেন্দ্রিক ইতিহাসের গর্বিত উপাদান। আমাদের সেসব জানাই ছিল না। পরে জানা সম্ভব হয়েছে যে, ইরানী সুন্নী মুসলিম বংশোদ্ভুত হযরত আরিফ রাব্বানী রাহ.-এর দাদা মাওলানা জব্বার বখশ রাহ.-সর্বসাধারণে যার উপাধি ছিল মিয়াঁ ছাহেব- ছিলেন উঁচু স্তরের এক বুযুর্গ এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থানীয় একজন সংগঠক। বালাকোট-উত্তর উপমহাদেশব্যাপি পরিচালিত জিহাদ আন্দোলন, ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব এবং অসফল সিপাহী বিপ্লবের পরে আলেমদের নেতৃত্বে সংঘটিত সীমান্ত জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। জানা গেছে, পরবর্তীকালে তুর্কী খেলাফত রক্ষার সংগ্রামেও তিনি অর্থকড়ি পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। বিশেষভাবে সেই সাধক-সংগ্রামী মনীষীর স্মৃতির ক্ষেত্রটি ঘুরে আসা এবং তাঁর কবর যিয়ারত করাই ছিল সেদিনের বিশেষ উদ্দেশ্য।

দুই.

যতদূর জানা যায়, মাইজবাড়িতে এই খান্দানের প্রথম পুরুষটি ছিলেন নিরাপদ মুসলিম জনপদের সন্ধানে ইরান থেকে হিজরত করে আসা ফার্সীভাষী এক সাধক সুন্নি মুসলিম। নাম শাহ বারাতুল্লাহ রাহ.। এ অঞ্চলে তিনি দাওয়াতী, তালীমী, ইসলাহী কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে কাছাকাছি অঞ্চলেই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তার পুত্রের নাম ছিল শাহ কলন্দর রাহ.। শাহ কলন্দরের পুত্রেরই নাম হচ্ছে শায়খ জব্বার বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.। এই মিয়াঁ ছাহেবের জন্ম ১৮২৬ সনে। ৪/৫ বছর বয়সে তিনি ইয়াতিম হন। এরপর ইলমেদ্বীন অর্জন করেন ময়মনসিংহ শহরের বর্তমান বড় বাজার এলাকায় অবস্থানরত ঢাকা-নিবাসী একজন সাধক আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান রাহ.-এর কাছে। তাঁর কাছ থেকেই তিনি অধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষাও গ্রহণ করেন। এরপর মাইজবাড়ি গ্রামে নিজের দেয়া নাম ‘ফকিরবাড়িতে’ অবস্থান করেই কুরআনী তালীমের প্রচার, শিরক-বিদআতমুক্ত মুসলিমসমাজ গঠন এবং কমজানা মুসলমানদের মাঝে সহীহ মাসায়েলের চর্চার ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। এরই মধ্যে যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি পার করেন বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের জিহাদী তৎপরতায়। দীর্ঘ ১০৮ বছর হায়াত তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছে বালাকোটের ঘটনার মাত্র ৫ বছর আগে। ইন্তেকাল হয় উপমহাদেশ (পাকিস্তান ও ভারত) স্বাধীন হওয়ার ১৩ বছর আগে ১৯৩৪ সনে। বর্ণাঢ্য দীর্ঘ জীবনে তিনি কয়েক পর্যায়ে বিপ্লব-সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্বের সাধক ও দরবেশ রূপটিই জনসমক্ষে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। এজন্য হেদায়েতী ও ইসলাহী নানা সক্রিয়তায় যেমন লোকজন তাঁর কাছে আসতেন, তেমনি দুআ-খায়ের, ঝাড়ফুঁক-তদবিরের জন্যও ভিড় কম হতো না। তাঁর জীবনটি ছিল তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও জিহাদের সমন্বিত পাঠশালা। বহু কারামাতের ঘটনাও তাঁর জীবনে ঘটেছে।

তিন.

বুযুর্গ মুজাহিদ জব্বর বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর প্রপৌত্র মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদীর রচনা ও যবানীতে জানা যায়, মিয়া ছাহেব রাহ. তাঁর যৌবন থেকেই তৎকালীন আলেম সমাজের নেতৃত্বে পরিচালিত ফিরিঙ্গি-বিরোধী সংগ্রামে বরাবর যুক্ত ছিলেন। বিশেষত ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব কালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা নিম্নবঙ্গের গ্রামপ্রধান এলাকাগুলোতে বিপ্লবের অনুকূলে সাংগঠনিক কাজ করার যে অধ্যায় ইতিহাসে স্বীকৃত, তাতে গভীরভাবেই তাঁর যুক্ততা ছিল। মাইজবাড়ির ফকিরবাড়ির জামাতা প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা তফজ্জুল হক হবিগঞ্জীও এক স্মৃতিচারণে সিপাহী বিপ্লব ও তুর্কী খেলাফত রক্ষার আন্দোলনে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর সম্পৃক্ততার কথা শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।

বৃদ্ধ মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-কে শৈশব ও কৈশোরে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তার পৌত্র মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। তাঁর ত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের টুকরো টুকরো ঘটনা, স্মৃতি বা জীবনদৃষ্টি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। নিজের সংগ্রামী জীবনেও সেসব কিছুর অনুসরণ করেছেন। অধস্তন বংশধর ও শাগরিদদের সামনে সেসব কাহিনীর কিছু কিছু দ্যুতিও তিনি ছড়িয়ে গিয়েছেন। তবে বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে সেসব বর্ণনা বা ইতিহাসের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়নি।

অবশ্য লোকমুখের চর্চা এবং আদর্শিক ও পারিবারিক পরম্পরাগত বর্ণনার সূত্রে সেসব ঘটনা প্রায় প্রামাণ্যের পর্যায়ভুক্ত হয়ে আছে। কাগুজে দলিল সেখানে কোনো মুখ্য বিষয় থাকতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। প্রথমত ব্রিটিশ সিভিলিয়ন উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে বালাকোটের (১৮৩১) পর উপমহাদেশব্যাপি জিহাদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গে বা নিম্নবঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী যে বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা একদমই সঙ্গত যে, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার বিভিন্ন পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী হক্কানী আলেমরা সক্রিয় ভ‚মিকা রেখে গেছেন। হযরত মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর জন্ম ১৮২৬ সনে হওয়ায় সিপাহী বিপ্লবের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তাঁর তখন পূর্ণ যৌবন। বালাকোটের পর থেকে আফগানিস্তান সন্নিহিত সীমান্ত এবং সিত্তানা-মুলকা কেন্দ্রিক যে দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাস পাওয়া যায় তা চালু ছিল প্রায় ১৮৯০ সন পর্যন্ত। বিহারের পাটনায় তার বড় একটি ঘাঁটি ছিল। মাওলানা এনায়েত আলী, বেলায়েত আলীসহ সর্বভারতীয় অন্য আলেমদের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের বহু যুবক-প্রাণ আলেম তখন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সিপাহী বিপ্লবকালে ওই সংগ্রামীরা ব্যাপক ভ‚মিকা রাখেন। এর পরেও তারা নিরস্ত হননি।  ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ-লড়াই হয়। সে প্রেক্ষাপটেই ১৮৬৪ সনে আম্বালায়, ১৮৬৮ সনে পাটনায়, ১৮৭০ সনে মালদহ ও রাজমহলে এবং ১৮৭১ সনে কলকাতায় বালাকোট-উত্তর সংগ্রামী মুজাহিদদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ওই সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের ‘ওহাবী আন্দোলন’ ও ওহাবী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও সেটি ছিল ডাহা মিথ্যা। ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোনো যোগসূত্র ছিল বলে জানা যায়নি। মূলত শিরক থেকে সংস্কারবাদী এবং জিহাদ ও তাসাওউফের মিলিত সংগ্রামেরই তাঁরা কর্মী ছিলেন। পূর্বাপর পরিস্থিতি ও বংশ পরম্পরার বর্ণনায় বোঝা যায়, সিপাহী বিপ্লব ও আগের-পরের বালাকোট-উত্তর জিহাদী আন্দোলনেই মিয়াঁ ছাহেব গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ‘বৃহত্তর মোমেনশাহী: উলামা ও আকাবির’ গ্রন্থের ৪৭ তম পৃষ্ঠায় মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী লেখেন: ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিতাড়ন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে মিয়াঁ ছাহেব রাহ. অত্র এলাকার আঞ্চলিক সংগঠক ছিলেন এবং মুক্তিসংগ্রামীদের রসদ সরবরাহে তাঁর বিরাট চেষ্টা ও কোশেশের কথা জানা যায়। মুক্তিসংগ্রামীদের নিরাপদ আশ্রয়ের এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে তাদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য তিনি আঞ্চলিক দায়িত্বশীল ছিলেন।’

প্রখ্যাত সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের ‘আত্মকথা’র ‘বংশ পরিচয়’ অধ্যায়ের অধীনে তার এক পূর্বপুরুষ বালাকোট-বিপ্লবী গাজী আশেকুল্লাহ রাহ.-এর দেশে ফিরে আসা এবং মাঝে মাঝে বিশেষ উদ্দেশ্যে ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়ার একটা বর্ণনা পাওয়া যায়। সে সময়টাও ছিল ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লবের অব্যবহিত পরের। গাজী আশেকুল্লাহ রাহ.-এর বাড়ি ত্রিশালের ধানিখোলা আর মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর বাড়ি মাইজবাড়ির ফকিরবাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহ শহরের দু‘প্রান্তের দুটি এলাকা। আড়াআড়িভাবে দূরত্ব হতে পারে ১৫ কি. মি.-এর মতো। আত্মকথার ৩৫তম পৃষ্ঠায় যা লেখা হয়েছে, ভাষা হুবহু রেখে তার একটি অংশ ছাপিয়ে দেয়া হল: ‘গাজী সাহেব মাঝে-মাঝে নিরুদ্দেশ হইয়া কোথায় যান প্রায় সবাই তা অনুমান করিতে পারিতেন। কারণ অতীতে অনেকবার এমন ঘটিয়াছে। তার যাওয়ার স্থান ছিল সাধারণতঃ মোজাহেদ ভাইদের বাড়ি। দাদাজীর মুখে ছেলেবেলা এইসব মোজাহেদ ভাইদের নাম প্রায়ই শুনিয়াছি। এখন আর সকলের নাম ঠিকানা মনে নাই। যে কয়জনের নাম মনে আছে, তাঁহাদের মধ্যে আটিয়া (বর্তমান টাংগাইল) মহকুমার দেলদুয়ারের মৌঃ ইব্রাহিম, আকালুর খোন্দকার জহিরুদ্দিন ও জামালপুর মহকুমার নূর আলী তরফদারের নাম মনে আছে। নূর আলী সাহেব জেহাদে শহীদ হইয়াছেন। কাজেই তিনি দেশে আর ফিরিয়া আসেন নাই। খোন্দকার জহিরুদ্দিন বোধহয় পুলিশের ধাওয়ায় আকালু ত্যাগ করিয়া জামালপুরের বানেশ্বরদী গ্রামে চলিয়া আসেন এবং সেখানেই বিয়া-শাদী করিয়া বসবাস করিতে শুরু করেন। শহীদ নূর আলী সাহেবের এক পুত্র ছিলেন। তিনি তখন বিবাহ করিয়াছিলেন। কাজেই গাজী সাহেবের যাওয়ার স্থান ছিল আটিয়ার একটি : মৌঃ ইব্রাহিমের বাড়ি, আর জামালপুরে দুইটি : খোন্দকার জহিরুদ্দিনের এবং নূর আলী তরফদারের বাড়ি। দাদাজী ও আত্মীয়েরা এসব জায়গায় খোঁজ করিতেন না, শুধু অনুমান করিতেন। তৎকালে খোঁজ-খবর লওয়ার ও যাতায়াতের মোটেই সুবিধা ছিল না। কিছু দিন নিরুদ্দেশ থাকিয়া গাজী সাহেবই ফিরিয়া আসিয়া এই সব ও অন্যান্য জায়গার নাম করিতেন।’

এই বর্ণনায় প্রথমত দেখা যাচ্ছে, গাজী সাহেব যাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন সবার নাম লেখকের মনে নেই। হতে পারে বর্ণিত জায়গাগুলোর বাইরেও তিনি আরো কিছু কিছু মুজাহিদ-সঙ্গীর বাড়িতে যেতেন। যার বর্ণনা এখানে দেয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত এ-বর্ণনায় অন্তত এটা পরিষ্কার হয় যে, ওই সময়ে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় এবং শহরের আশেপাশে এমন বিপ্লবী সাধক-মুজাহিদ বা ব্রিটিশ বিরোধী বুযুর্গ স্বাধীনতা সংগ্রামীর অবস্থান ছিল। তখনকার ইসলামী মহল বা উলামা সম্প্রদায়ের একটি আগ্রহের ও কর্মের বিষয় ছিল ওই সংগ্রামে সম্পৃক্ততা। সুতরাং সে হিসেবে মাইজবাড়ির জব্বর বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদী সংগ্রামে যুক্ত থাকার যুক্তি বা প্রাসঙ্গিকতাটি দূরবর্তী কোনো কল্পনার বিষয় নয়। তাছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষে ‘জিহাদ আন্দোলন’ নামের দীর্ঘ নিবন্ধটিতে এ বিষয়ে মৌলিক, প্রাসঙ্গিক ও পারিপার্শিক যে বিবরণ রয়েছে, তাতেও মাইজবাড়ির মতো জায়গা থেকে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর সংগ্রামী ভ‚মিকা রাখার ইতিহাসের প্রতি সত্যায়নই ঘটে থাকে। অপরদিকে বর্ষীয়ান ইসলামী লেখক, মাসিক মদীনা সম্পাদক এবং এতদঞ্চলের ইতিহাস-গবেষক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের (আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুস্থ করুন ও দীর্ঘ হায়াত দান করুন) মুখে মাইজবাড়ির মিয়াঁ ছাহেব রাহ. এবং তাঁর জামাতা আরেক দরবেশ বুযুর্গ মাওলানা আব্বাস আলী লক্ষ্মীপুরী রাহ.-এর ত্যাগী ও সংগ্রামদীপ্ত আলোচনা বহুবার শোনার সুযোগ হয়েছে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এদেশের গত এক-দেড়শ বছরের ইতিহাসের যেসব চরিত্র ও উপাত্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বুকের মধ্যে লালন করেন এবং সুযোগ হলেই ব্যক্ত করেন- এ দুটি নামও সেখানে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

মিয়াঁ ছাহেব রাহ. দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। ফলে ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লবের কালে যৌবন অতিবাহিত করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে তুর্কী খেলাফত রক্ষার দুনিয়াব্যাপি আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গ থেকে তিনিও যুক্ত ছিলেন। অবশ্য তখন তিনি নব্বই বছরের বৃদ্ধ। তাঁর চতুর্থ পর্যায়ের বংশধর মাওলানা সাদী আরো লেখেন : ‘পরবর্তীকালের তুর্কী খেলাফত রক্ষার আন্দোলনেও তাঁর বিশেষ অবদানের কথা স্বয়ং তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়। তাঁর নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা থেকে তিনি গোপনে বিরাট অংকের নগদ অর্থ সংগ্রহ করে নিরাপদ রোডে বর্তমান পাক-আফগান সীমান্ত এলাকার ইংরেজ প্রভাবমুক্ত অঞ্চলের রসদ সংগ্রহশালা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।’ এ বিষয়ে লেখকের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ তথ্যটি পুরোপুরি প্রমাণিত ও দালিলিক। এখান থেকে বর্ধমানে একজন ব্যক্তির হাতে প্রথমে অর্থ সহায়তা যেত। সেখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো হত। বর্ধমানের ওই ব্যক্তিটির নাম এখন আমাদের মনে নেই।’ মোটকথা উনবিংশ শতাব্দীর মাঝ থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত অমর এই সাধক মনীষীর সংগ্রামী অধ্যায় ইতিহাসের পাতা অমলিন করে রেখেছে। পরের প্রজন্মের অজ্ঞতা ও বিস্মৃতি ইতিহাসের সেই সমৃদ্ধ পাতাকে মলিন করতে পারবে না।

চার.

মাইজবাড়ি গ্রামের ফকিরবাড়িই হচ্ছে ইরান থেকে আগত শাহ বারাতুল্লাহ রাহ.-এর ভিটা। শাহ বারাতুল্লাহর অন্যতম নাতি (তৃতীয় পুরুষ) হলেন সাধক সংগ্রামী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও তুর্কী খেলাফত রক্ষা আন্দোলনের কর্মী শায়খ জব্বর বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.। মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর অন্যতম নাতি (তৃতীয় পুরুষ) হলেন শাইখুল ইসলাম মাওলানা মাদানীর শিষ্য সংগ্রামী আলেম মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। ফকিরবাড়ির গোরস্তানে এঁরা সবাই শুয়ে আছেন। আছেন মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ হাবীববুর রহমান রাহ.-সহ ওই পরিবারের বিভিন্ন ধাপের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। মসজিদের উত্তরপাশের ছোট্ট গোরস্তানের সামনে দাঁড়ালাম। উত্তর পশ্চিম কোনে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর কবর। দেখালেন এক উত্তর পুরুষ। যিয়ারতের জন্য দাঁড়িয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হল। এইসব ত্যাগী মনীষীর মাকাম জান্নাতে আল্লাহ আরো উঁচু করুন। আমীন!

জুমার পর, শীতের দুপুর। অনেকের সঙ্গে দেখা হল। বাড়ির সামনের মাদরাসা: সওতুল হেরা। সুন্দর ছিমছাম ভবন। সামনে মাঠ। ওই মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুস্তাফিজুর রহমানসহ উস্তাযবৃন্দ, ফকিরবাড়ির বয়োবৃদ্ধ কয়েকজন বিনয়ী মুরব্বী, মাইজবাড়ির সংগঠক আলেমেদ্বীন মাওলানা মনসুরুল হক খান, বাড়িরই সন্তান মাওলানা মাহদী মুর্তজা-এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভালোলাগার মধ্যে তাদের স্নিগ্ধ সৌহার্দময় আচরণ আরো ভালো লাগলো।

পূর্বপুরুষের পুরো আকার-আকৃতি তেমনভাবে বাকি থাকে না হয়তো কোথাও। তবে বুযুর্গদের দুআয় বহু ক্ষেত্রে যুররিয়াত (অধস্তন বংশধরদের) মাঝে নেকির শুভ্রতা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকে। মাইজবাড়িতে গেলেও দ্বীনদারি, বিনয় আর পুণ্যের একটি ঐতিহ্য যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। ফকিরবাড়ি ও আশপাশে পরিবারজুড়ে আলেম কিংবা দ্বীনদার, শালীনতা ও গায়রত এখনও দৃশ্যমান। বাড়ির সামনে মাদরাসা, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির দিকে। ভালো লাগলো। ফেরার সময় সফরসঙ্গী মাওলানা তাজুদ্দীন ও ক্বারী নূর আহমদ মাসুমকে নিয়ে অটোরিক্সায় উঠলাম। একটা আফসোস রয়ে গেল। বর্তমানে ফকিরবাড়ির নেতৃত্বশীল মেধাবী আলেম মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী ছাহেবের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যেত! তবে তো দেখাও হতো, বিষয়টি নিয়ে আরেকটু কথাও শোনা যেত তার। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা, ফিরে আসার সময় টাঙ্গাইল মহাসড়কে উঠার আগেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। কিছু কথাও হলো সেদিন এবং পরে আরেক দিন।

ময়মনসিংহ শহরের পশ্চিমে। মাইজবাড়ির ফকিরবাড়ির দহলিজে শুয়ে আছে ইতিহাসের সোনালী দাস্তান। আমাদের কত জনই তো কত কারণে সেদিকে যাই। যবান ও দিলে সালাম তিলাওয়াত, তাসবিহাত ও দুআ নিয়ে সেইসব ইতিহাসের সামনে একটু দাঁড়ানোর সময় কি আমাদের হবে না?

জুমাদাল উলা ১৪৩৬ – মার্চ ২০১৫
মাসিক আলকাউসার