মানসা মুসা ও তাঁর স্বর্ণের খনির সাম্রাজ্য

হজের সফরে চলছেন রাজা। সাথে আছে ৬০ হাজার সঙ্গী। এর মধ্যে রাজার সেবকই আছেন প্রায় ১৪ হাজার। প্রতিজন সেবকের কাছে আছে সোনার বার। এই কাফেলার সাথে আছে ১০০ উট-বোঝাই স্বর্ণ। মালি থেকে মিসর হয়ে হেজাজের পথে যেখানেই কাফেলা বিরতি দিল, রাজা দুহাতে স্বর্ণ দান করলেন স্থানীয়দের। তাঁর স্বর্ণদানের কারণে মিসরে সোনার দামই কমে গেল।

মক্কায় হজ সেরে আরো তিনমাস অবস্থান করলেন রাজা। ততদিনে তাঁর বিশাল ধনভাণ্ডার শূন্য হয়ে গেছে। এবার তিনি ব্যবসায়ীদের থেকে ঋণ নিলেন। ঋণের টাকায় কিনলেন ফিকহে মালেকির বইপত্র। এবার চললেন নিজের রাজ্যের দিকে। সাথে জুটিয়ে নিলেন আলেম, কবি, সাহিত্যিক ও ইঞ্জিনিয়ারদের এক বিশাল জামাতকে। উদ্দেশ্য, এঁদেরকে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাবেন। রাজ্যকে সমৃদ্ধ করবেন।

রাজা ফিরলেন দেশে। লোকেরা বলল, ‘বাহ, উটভর্তি সোনা নিয়ে গেলেন, ফিরে এলেন উটভর্তি বই নিয়ে!’

এই রাজার নাম মানসা মুসা। তিনি ছিলেন বর্তমান মালির শাসক। রাজ্যে সোনার খনি ছিল। তাই অভাবের মুখ দেখেননি কখনো। যেভাবে সোনা এসে কোষাগারে ঢুকত সেভাবেই আবার তা বিলি করে দিতেন দুস্থ-দরিদ্র প্রজাদের মাঝে। মানসা মুসাকে বলা হয় সর্বকালের ধনীদের একজন। ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ১০ জনের তালিকা করে। এতে সর্বকালের সেরা ধনী বলা হয় মানসা মুসাকে।

মানসা মুসা সিংহাসনে আরোহণ করেন ৭১২ হিজরিতে (১৩১২ খ্রিস্টাব্দ)। ইবনু আমির হাজিব মনসা মুসাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কীভাবে এই রাজত্ব লাভ করলেন?’

মনসা মুসা শুনিয়েছিলেন নিজের সিংহাসন আরোহণের গল্প। ‘আমাদের অঞ্চলে লোকজনের বিশ্বাস ছিল আটলান্টিক মহাসাগরই পৃথিবীর শেষ। এর ওপাড়ে আর কোনো ভূখণ্ড নেই। আমার আগে যিনি শাসক ছিলেন, দ্বিতীয় আবু বকর কেইতা, তিনি মনে করতেন আটলান্টিকের ওপাড়েও ভূখণ্ড আছে। তিনি দুইশো জাহাজ দিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীকে কয়েক বছরের রসদ দেয়া হয়। তাদের উপর আদেশ ছিল, তারা আটলান্টিকের ওপাড়ে নতুন ভূখণ্ড সন্ধান করে বেড়াবে। নতুন ভূখন্ডের সন্ধান না পেলে তাদের ফিরে আসা নিষেধ ছিল। এই বাহিনী চলে যায়। কয়েক বছর তাদের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। এরপর আবু বকর কেইতা দুই হাজার জাহাজ নিয়ে নতুন ভূখণ্ডের সন্ধানে যান এবং আমাকে রাজত্বের দায়িত্ব দিয়েন যান।’ (১)

আল্লামা মাকরেজির বর্ণনামতে, মানসা মুসা হজ করেন ৬২৪ হিজরিতে (২)। তাঁর এই হজের সফরই ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। সফরের শুরুতেই তিনি পৌঁছেন মিসরে। সেখানে তখন আল-মালিকুন নাসির মুহাম্মদ বিন কালাউনের শাসন চলছিল। মানসা মুসার আগমনের সংবাদ শুনে সুলতান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সুলতান তাঁর নিজের কেল্লায় মানসা মুসাকে অবস্থান করার অনুরোধ করেন। প্রথম যেদিন মানসা মুসা সুলতানের দরবারে উপস্থিত হন তাঁকে বলা হয় দরবারের রীতি মেনে সুলতানের সামনে মাটি চুম্বন করতে। তখন মানসা মুসা বলেন, ‘আমি শুধু আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সামনেই মাথা নিচু করি।’ সুলতান এ কথায় প্রভাবিত হন। তিনি মানসা মুসাকে খুব সম্মানের সাথে রাখেন। তাঁকে অনেক উপহার দেন।

মানসা মুসার বিশাল কাফেলার আগমনে মিসরের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ে। একদিকে তাঁর স্বর্ণ বিতরণের কারণে সোনার দাম কমে যাচ্ছিল, আবার তাঁর কাফেলার কাছে জিনিসপত্র বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা খুব লাভবান হচ্ছিলেন। এ সময় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা বেশ মুনাফা লুটে নেয়। তারা এক দিনার মূল্যের কাপড় ৪৬ দিনারে বিক্রি করতে থাকে (৩)।

এরপর মানসা মুসা পৌঁছলেন মক্কায়। সেখানেও তিনি প্রচুর দান করেন। তবে মক্কার আবহাওয়া তাঁর কাফেলার সদস্যদের জন্য সহনীয় হয়নি। তাঁর কাফেলার এক তৃতীয়াংশ সদস্যই এই সফরে মারা যান (৪)।

মানসা মুসা ছিলেন প্রজাবান্ধব শাসক। সাম্রাজ্যের উন্নতিতে তিনি প্রচুর কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। হজের সফর থেকে ফেরার সময় তিনি আন্দালুসের কবি আবু ইসহাক ইবরাহিম সাহেলিকে সাথে নিয়ে আসেন। তিনি নিজের রাজ্যে প্রচুর মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ করেন। থিমবুকতু শহরেও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে তা মাদরাসায় রূপান্তরিত হয়। এবং তারও পরে এটি ইউনিভার্সিটি অব শাংকোর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বর্তমানে এর কার্যক্রম খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

আটলান্টিকের তীর থেকে তিম্বাকতু পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মাইল এলাকায় মানসা মুসা রাজত্ব করেছিলেন। সুদানের অমুসলিম গোত্রগুলোর সাথে বারবার তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। শত্রুপক্ষের সেনারা বন্দি হলে তাদের পাঠানো হতো স্বর্ণের খনিতে। শ্রমিক হিসেবে। ২৫ বছরের শাসন শেষে ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে মানসা মুসা মারা যান


১। শিহাবুদ্দিন উমরি, শিহাবুদ্দিন আহমাদ বিন ইয়াহইয়া (মৃত্যু ৭৪৯ হিজরী), মাসালিকুল আবসার ফি মামালিকিল আমসার, ৪/৫৬,৫৭ (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ২০১০ খ্রিস্টাব্দ)
২। মাকরেজি, তকিউদ্দিন আহমাদ বিন আলি (মৃত্যু ৮৪৫ হিজরী), আয যাহাবুল মাসবুক ফি যিকরি মান হাজ্জা মিনাল খুলাফাই ওয়াল মুলুক, পৃ- ১৪০ (মাকতাবাতুস সাকাফাতিদ দিনিয়্যাহ, ১৪২০ হিজরী)
৩। শিহাবুদ্দিন উমরি, শিহাবুদ্দিন আহমাদ বিন ইয়াহইয়া (মৃত্যু ৭৪৯ হিজরী), মাসালিকুল আবসার ফি মামালিকিল আমসার, ৪/৫৮ (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ২০১০ খ্রিস্টাব্দ)
৪। ইবনু হাজার আসকালানি, শিহাবুদ্দিন আহমাদ বিন আলি বিন মুহাম্মদ (মৃত্যু ৮৫২ হিজরী), আদ দুরারুল কামিনাহ, ৪/৩৮৩, (বৈরুত, দার এহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, ১৩৪৯ হিজরী)
৫। The Encyclopaedia Of Islam, part- ৬, page- 422 (E J Brill, 1991)


ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24