হিজরতের পর মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত মদিনার মুসলিম-সমাজকে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন এবং পরিচ্ছন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর প্রতিষ্ঠিত করতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সক্ষম হলেন, তখন তিনি মদিনার অমুসলিম জনগোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক-উন্নয়ন ও সমঝোতা গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সুখী, সমৃদ্ধ ও বরকতময় জীবনের পথ প্রশস্তকরণ, মদিনাবাসী ও পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠির মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি ও একতার বন্ধন সুদৃঢ়করণ। এ লক্ষ্যে উদার-উন্মুক্ত মন-মানসিকতা নিয়ে তিনি এমন সব নিয়ম-নীতি ও কার্যক্রম অবলম্বন করলেন, ধর্মান্ধতা ও স্বার্থান্ধতা-ক্লিষ্ট সমসাময়িক সমাজে যা ছিলো একটি কল্পনাতীত ব্যাপার।
মদিনার মুসলিমগণের নিকটতম প্রতিবেশী ছিলো ইহুদিরা। হিজরতের সঙ্গে সঙ্গে মদিনায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কার্যক্রম—মুসলিমদের সুশৃঙ্খল সমাজগঠন, ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি-সামর্থ্যের বিকাশ—তারা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলো। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই মুসলিমদের সাথে শত্রুতা পোষণ করলেও প্রকাশ্য কলহ কিংবা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার হাবভাব তারা তখনো প্রকাশ করেনি। কাজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজন অনুভব করেন। সে মর্মে তাদের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদিতও হয়।এ চুক্তিতে তাদেরকে জান-মালের সাধারণ নিরাপত্তা এবং ধর্ম-কর্মের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করা
এই চুক্তি ৪৭টি ধারায় বিন্যস্ত ছিলো; এটি আধুনিক-রাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ও পূর্ণাঙ্গসংবিধানরূপে বিবেচিত।নিম্নে তার উল্লেখযোগ্য কিছু ধারা যুক্ত করা হলো—
১. বনু আউফের ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে মিলেমিশে একই উম্মতের মতো থাকবে, কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। এটা তাদের নিজেদের অধিকার হিসেবে যেমন গণ্য হবে, ঠিক তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে যারা সম্পর্কিত, তাদের এবং তাদের দাসদাসীদের বেলায়ও গণ্য হবে। বনু আউফ ছাড়া অন্যান্য ইহুদিদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।
২. মুসলিম এবং ইহুদি—উভয় সম্প্রদায়ের লোকই নিজ নিজ আয়-উপার্জনের জিম্মাদার থাকবে।
৩. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের সঙ্গে অন্য কোনো শক্তি যুদ্ধে লিপ্ত হলে চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
৪. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক উপকারের ভিত্তিতে কাজ করে যাবে, অন্যায়-অনাচার কিংবা পাপাচারের ভিত্তিতে নয়।
৫. মিত্রপক্ষের অন্যায়-অনাচারের জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
৬. কেউ কারো উপর জুলুম করলে মজলুমকে সাহায্য করতে হবে।
৭. চুক্তিবদ্ধ কোনো পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যত দিন যুদ্ধ চলতে থাকবে, ততদিন ইহুদিদেরকেও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ বহন করতে হবে।
৮. এ চুক্তিভুক্ত সকলের জন্যই মদিনায় কোনো প্রকার হাঙ্গামা সৃষ্টি করা কিংবা রক্তপাত ঘটানো হারাম হবে।
৯. চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো কোনো নতুন সমস্যা কিংবা ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে এর মীমাংসা করবেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
১০. কুরাইশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেওয়া চলবে না।
১১. ইয়াসরিবের উপর কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধএবং নিজ নিজ অঞ্চলে থেকে তা প্রতিহত করতে হবে।
১২. কোনো অন্যায়কারী কিংবা পাপীর জন্য এ চুক্তি সহায়ক হবে না।
এ চুক্তি সম্পাদনের ফলে মদিনা এবং তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ এক শান্তি-স্বস্তিময় সাম্রাজ্যের রূপ পরিগ্রহ করে—যার রাজধানী ছিলো মদিনা এবং সর্বময় নেতৃত্বে ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ সাম্রাজ্য পরিচালনার ভিত্তি ছিলো ইসলামি বিধি-বিধান এবং পরিচালনা-বিভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন মুসলিম। প্রকৃতপক্ষে এভাবে মদিনা ইসলামি হকুমতের রাজধানীতে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্র :আর-রাহিকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মোবারকপুরি; সিরাতে খাতামুলআম্বিয়া, মুফতিশফি।