উলামায়ে কেরামের অনুরোধে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর মুহাযারার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিগত ৬-১২-১৪৩২ হি. মোতাবেক ৩-১১-২০১১ ঈ., বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সম্পর্কে একটি মুহাযারা। বিভিন্ন মাদরাসার ফিকহ-ফতোয়া বিভাগে অধ্যয়নরত তালিবানে ইলম ও দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে মুহাযারাটি পেশ করেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার মুদীর, মারকাযের ফতোয়া বিভাগ ও আততাখাসসুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা’র রঈস মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব।
তাঁর নযরে ছানীর পর আলোচনাটি আলকাউসারে পত্রস্থ করা হচ্ছে। এ সংখ্যায় প্রথম কিস্তি ছাপা হল। মুসাজজিল থেকে আলোচনাটি পত্রস্থ করেছেন : মাওলানা আবদুল্লাহ মাসুম। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উপকৃত করুন। আমীন।
হামদ ও সালাতের পর,
মারকাযুদ দাওয়াহ কর্তৃপক্ষ ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে কিছু আলোচনা ও প্রশ্ন-উত্তর এর আয়োজন করেছেন। দীর্ঘদিন থেকেই আবেদন ও অনুরোধ করা হচ্ছিল, এ বিষয়ে বড় আকারে মুহাযারা ও প্রশিক্ষণ মজলিস করার। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে এতদিন তা হয়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে দাবিটা যখন ব্যাপক হল এবং এর প্রয়োজনীয়তাও বাড়ল তখন সিদ্ধান্ত হল, আপাতত স্বল্প পরিসরে শুরু করা হোক এবং মুহাযারা আকারে হোক। আল্লাহ তাআলা চাহে তো বড়ভাবে, তাদরীবী আকারে পরে আয়োজন করার চেষ্টা করা হবে। তাই ব্যাপক জানাজানি করা হয়নি এবং ব্যাপক প্রস্ত্ততি ছাড়াই আজকের মজলিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ঠিক হাকীকী মুহাযারা বলতে যা বুঝায় তা-ই।
কথা ছিল প্রথম দিকে তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার : ১. মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ২. শেয়ারবাজার ও ৩. মাল্টি পারপাস সোসাইটি ও এ জাতীয় সংস্থা।
একদিনের সামান্য সময়ে এ তিন বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই যে কোনো একটি বিষয়কেই বেছে নিতে হবে। অনেকে বলেছেন, এমএলএম দিয়ে শুরু করতে। তাই আমরা এ বিষয় দিয়েই আলোচনা শুরু করছি।
এমএলএম-এর ইতিহাস
এমএলএম-এর ইতিহাস অনেক বেশি দিনের নয়। অর্ধশতাব্দীর কিছু বেশি এর বয়স। ইনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৫ সাল থেকে এর যাত্রা শুরু। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমএলএম ভিত্তিক কোম্পানি চালু হয়েছে। এর অধিকাংশগুলোই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ হয়ে গেছে। আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন করে বন্ধ করা হয়েছে বহু এমএলএম কোম্পানিকে। কিন্তু এতে থেমে যায়নি এ কারবারের আগ্রহী ব্যক্তিরা।
ঠিক এখন আমাদের দেশে এমএলএম যেরূপে প্রচলিত শুরুতে এমন ছিল না। তবে এর পুরান পদ্ধতিটা ঐ নামে আমাদের দেশে না থাকলেও ঐ পদ্ধতিটা ভিন্নভাবে প্রচলিত ছিল। আপনাদের কারো কারো হয়ত মনে আছে, এ দেশে একসময় পোস্ট অফিসগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে-বেনামে অপরিচিত জায়গা থেকে মানি অর্ডারে টাকা আসার হিড়িক পড়েছিল। প্রাপককে লিখে দেওয়া হত দুটি ঠিকানা এবং ঐ ঠিকানাগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠানোর জন্য বলে দেওয়া হত। যার মাধ্যমে বড় লাভ পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হত। প্রতারণার এই ফাঁদ ব্যাপক হওয়ার পর কর্তৃক্ষের টনক নড়ে এবং ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়। যাই হোক, আমেরিকাতেও এর কাছাকাছি একটি কারবার পিরামিড স্কীম নামে শুরু হয়েছিল। এটিই এমএলএম-এর সনাতনি পদ্ধতি।
পিরামিড স্কীম-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
টাকা দিয়ে সদস্যপদ খরিদ করা। একজন লোক নির্ধারিত ফী দিয়ে সদস্য হবে। এরপর সে আরো সদস্য বানাবে। এভাবে নেট পদ্ধতিতে এগিয়ে যাবে এবং উপরওয়ালারা নীচেওয়ালাদের থেকে কমিশন পাবে। পিরামিড স্কীম কিছুদিন চলার পর স্বাভাবিক নিয়মেই তা বন্ধ হয়ে যায়। যখন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে তখন পিরামিড স্কীম আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমেরিকাতে আইন হয়েছে। আরো কিছু দেশেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এরপরও তারা থেমে থাকেনি। নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমএলএম-এর বর্তমান পদ্ধতিটি (পণ্য বা সেবার পদ্ধতি) শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এর বয়স মোটামুটি হয়ত দুই দশকের বেশি হবে না।
এদেশে যখন তারা আসে তখন মারকাযুদ দাওয়াহ প্রতিষ্ঠার সম্ভবত তৃতীয় বছর। বেকার ও স্বল্প আয়ের লোকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল এতে অংশগ্রহণ করার। রাতারাতি বড় লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল তারা। কিছু কিছু অবুঝ মাদরাসাছাত্র ও দ্বীনদার শ্রেণীর লোকও এ মিছিলে যোগ দিয়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে মারকাযুদ দাওয়াহসহ অন্যান্য দারুল ইফতাগুলোতে ব্যাপকভাবে মানুষ এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করে।
বিষয়টি ছিল তখন নতুন। এ পদ্ধতিতে পরিচালিত কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক পলিসি বুঝানোর জন্য বিভিন্ন সেমিনার ও লেকচারের আয়োজন করত। মানুষ তাতে ৫/-টাকা ফি দিয়ে অংশগ্রহণ করত। লেকচার ফি ৫/-টাকা। গুলশান এলাকায় তাদের বক্তৃতা হত। সেখানে এ কারবারের উপকারিতা এবং এতে অংশগ্রহণ করে কিভাবে অল্প দিনে অনেক টাকার মালিক হওয়া যায় তা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বুঝানো হত।
শুরুতে টংচেং ও জিজিয়ান এ দুটি কোম্পানি বেশ চলেছিল। টংচেং পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন বিক্রি করত। তারা যে মেশিন বিক্রি করত ঐ মানের মেশিন বাইরে অর্ধেক দামে পাওয়া যেত। তবে তাদের মেশিনটি ছিল ভিন্ন নাম ও ভিন্ন ব্র্যান্ডের। যা বাজারে নেই। এটি এমএলএম কোম্পানির একটি বিশেষ ব্যবসায়িক পলিসি। তারা এমন ব্র্যান্ডের পণ্য আনে, যা বাজারে থাকে না। ফলে সাধারণ মানুষ এই নামে আর দামের তুলনা করতে পারে না।
আমাকে প্রথম যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন শুনেই বলেছিলাম, ব্যবসার যে চক্করটা শুনলাম শরীয়তে এ ধরনের ব্যবসা বৈধ হওয়ার কথা নয়। তবে আমি সিদ্ধান্তও দিচ্ছি না। এটি এককভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো নয়। অন্যান্য দারুল ইফতার সাথে কথা বলে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এরপর ঢাকাস্থ বেফাকের মুফতী বোর্ডের নিকট এটি পেশ করা হল। তারা দীর্ঘদিন আলোচনা-পর্যালোচনার পর তাহকীক করে দলিলভিত্তিক সিদ্ধান্ত দিলেন যে, এটি বৈধ নয়। অতপর ফতোয়াটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের অন্যান্য জেলার বড় বড় মাদরাসাগুলোতে। এবং প্রায় সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর আসে।
ফতোয়া আসার কিছুদিনের মধ্যে কোম্পানি দুটি (টংচেং ও জিজিয়ান) বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারা বসে থাকেনি। আবার ভিন্ন নামে শুরু করার জন্য চেষ্টা আরম্ভ করে।
তখন ফতোয়ার প্রভাব এখনের চেয়ে ভালো ছিল। ফলে এমএলএম কারবারিগণ বাধ্য হয়ে মুফতীদের নিকট ও বিভিন্ন দারুল ইফতায় ছুটে এসেছিলেন।
তারা বিভিন্ন লোক মারফত খবর পাঠিয়েছিলেন, আলেমগণ রাজি হলে সোনাগাঁও হোটেলে তারা আলোচনার আয়োজন করবেন। তারা হয়ত ভেবেছিল, ৫ তারকা হোটেলের চাকচিক্য দেখে হুজুরররা ফতোয়া বাতিল করে ফেলবেন। আমি তখন বলেছি, দুনিয়াদাররা আলেমদেরকে কিনে ফেলতে চায়। আলেমদের দায়িত্ব তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং মুখের উপর তিরস্কার করা।
আমাকে যখন একথা শুনানো হয়েছিল তখন তাদের মুখের উপর বলেছিলাম, আমরা চাটাইয়ে বসে যে মাসআলা দিয়েছি সোনারগাঁও হোটেলেও মাসআলা তাই থাকবে। জায়গার চাকচিক্যে মাসআলার কোনো পরিবর্তন হবে না। আপনাদের কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের ফতোয়ার উপর কোনো কথা থাকলে আপনারা আমাদের অনাড়ম্বর দফতরে আসুন, আমরা কথা বলতে প্রস্ত্তত। সোনারগাঁও যেতে হবে কেন? এরপর তারা ঠিকই আমাদের চাটাইয়ের দফতরে এসেছিলেন এবং দুঃখও প্রকাশ করেছেন। ফতোয়া নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য ছিল না তবে তারা বিকল্প চেয়েছেন। আমরা তখন যা বলার বলেছি। এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ পরে আলোচনায় আসছি।
মোটকথা, ফতোয়া আসার কারণে কোম্পানি দুটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। অন্য নামে আরো কোম্পানি চালু করেছে। এই লাইনে আরো নতুন নতুন লোকের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই জিনিস। শুধু নামের পরিবর্তন। এবং আগের কোম্পানিগুলোতে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এ কোম্পানিগুলোতে যোগ দিয়েছেন। এটি এমএলএম কোম্পানির স্বভাবজাত ধর্ম। একটা বন্ধ হলে তারা ভিন্ন নামে আরেকটা চালু করে। আগের লোকেরাই নতুন নামে চালু করে।
আমাদের দেশেও এখন এমনি একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ চালু আছে। দেশের আনাচে কানাচে বহু বছর মেয়াদী গাছ বিক্রয়ের ব্যবসাসহ বহুমুখী প্রোডাক্ট নিয়ে তারা এখন অনেক বড় একটি গ্রুপ। তাদের কারবারের বৈধতা নিয়ে জাতীয় সংসদেও বারবার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আবার অজানা কারণে সেগুলো অগ্রসরও হয়নি।
আগেই বলে রাখি, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ বা ব্যক্তি চাই সে এমএলএম তরীকার হোক বা অন্য কোনো পন্থায় ব্যবসাকারী হোক তাদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক বা খারাপ সম্পর্ক কিছুই নেই। এবং শুধু মুসলমানদের হালাল-হারামের বিষয় জিজ্ঞাসাসমূহের সার্বিক উত্তরের ব্যাপারে আমাদের দায়বদ্ধতা না থাকলে আমরা তাদেরকে নিয়ে ভাবতামও না।
এটি এজন্য যে, এ বিষয়ে শরঈ সমাধান পাওয়ার আগেই দ্বীনদার কিছু মুসলমান এতে জড়িয়ে পড়েছে। গুজবে কান দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বাঙালিদের ক্ষতির (!) পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও শরঈ চিন্তা ছাড়াই একটা কিছুতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা স্পষ্ট হল। ‘নেহি মালুম মানযিল হ্যায়, কিদহর কিস সামেত জাতে হ্যাঁ।/মাচা হ্যায় কাফেলে মে শোর, হাম ভি গুল মাচাতে হ্যাঁয়।’
অর্থনীতি বিষয়ে জড়িত হওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা, চিন্তা-ভাবনা করা এটাকে আমরা অনেকে দরকারি মনে করি না। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি এসব তো ইসলাম নামক বৃক্ষেরই বিভিন্ন শাখা। এগুলোকে দ্বীন/ইসলাম থেকে ভিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এটা হল খৃস্টানদের বৈশিষ্ট্য। তারা মনে করে ধর্ম হল শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম। আর অন্যান্য বিষয়গুলো একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। খৃস্টানদের এই প্রভাবটা ধীরে ধীরে মুসলমানদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। (আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন।)
এখন আমরাও যদি কোনো মুয়ামালায় জড়িত হওয়ার পূর্বে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করি তাহলে তো আমরাও তাদের মতো হয়ে গেলাম, যারা ইবাদত ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ফরক করে। মোটকথা, এসব প্রেক্ষাপটেই মুফতী বোর্ড ঢাকার পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এমএলএম ব্যবসার ব্যাপারে ফতোয়া দেওয়া হয়। তো এই ছিল আমাদের তখনকার তিক্ত অভিজ্ঞতা যে, দ্বীনদার শ্রেণীর লোকেরা যাচাই-বাছাই না করেই এতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন যত দিন যাচ্ছে এ তিক্ত অভিজ্ঞতা ততই বাড়ছে। দ্বীনদার শ্রেণীর এই বিশাল গোষ্ঠিকে বাঁচানোর জন্যই আমরা ফতোয়া দিতে তৎপর হই।
এমএলএম পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
এমএলএম এখন বেশ প্রসিদ্ধ একটি কারবার। অনেকেই এখন তা মোটামুটি চিনে। এরপরও প্রসঙ্গের টানে সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা দরকারী মনে হচ্ছে। এর আগে একটি ঘটনা শোনাই।
এমএলএম বিষয়ে প্রথম ফতোয়া আসার পর দূর থেকে অনেকেই বলত, যারা ফতোয়া দিয়েছেন তারা কি গুলশানে গিয়ে লেকচার শুনেছেন। তারা বিষয়টি না জেনেই ফতোয়া দিয়েছেন। আমরা সেসব রাস্তাঘাটের মানুষের কথার জবাব দেইনি। একদিন টংচেং এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ সম্ভবত ওদের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ, আমাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। তাদের মাঝে পাগড়িওয়ালা এক মুরববীও ছিলেন। আলোচনার মাঝে তিনি বলে উঠলেন, আপনারা যে ফতোয়া দিয়েছেন, আপনি কি গুলশানে গিয়ে লেকচার শুনেছেন? আমি বললাম, কোন লেকচারের কথা বলছেন? লোকটি বললেন, এমএলএম-এর মার্কেটিং পদ্ধতি বুঝতে হলে কোর্স করতে হয়, লেকচার শুনতে হয়। কর্মকর্তাদের কেউ এ কথা বললে অন্যভাবে জবাব দিতাম। তাকে বললাম, মুফতীকে ফতোয়া দিতে হলে ৫/-টাকার কোর্স করতে হবে-এটা আপনি ভাবলেন কি করে? মুফতী বোর্ডের ফতোয়ায় শরঈ হুকুম বলার আগে কারবারটির একটি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মুফতী বোর্ড দিয়েছেন তাতে কী ভুল আছে বলুন। এমন কিছু কী বাদ থেকে গেছে যা থাকলে আজকের মাসআলার জবাব ভিন্ন হতে পারত? আমরা কি এমন কিছু লিখেছি, যা আপনারা বাস্তবে করেন না? বা আপনাদের স্বপক্ষে যেতে পারে এমন কোনো পয়েন্ট কি বাদ গেছে? তখন কর্মকর্তারা বললেন, না। আপনারা এই কারবারের যথাযথ বিশ্লেষণই করেছেন। কোনো কিছু ভুল বলেননি বা কিছু গোপনও করা হয়নি। তারা ঐ মুরববীকে চুপ থাকতে বললেন।
উক্ত ঘটনাটি এজন্য বললাম যে, অনেক হারাম কারবারীই আপনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে। প্রচলিত ভাষায় হাইকোর্ট ইত্যাদি দেখাতে পারে। কিন্তু ফতোয়ার কাজ যারা করবে তাদেরকে বিচলিত বা প্রভাবিত হলে চলবে না। যাহোক, এমএলএম-এর ব্যাখ্যা এই : Multi Level Marketing (M = Multi, L = Level, M = Marketing) Multi : বহু, নানা। যেমন : Multi Color (বহু বর্ণ), Multi National : (নানা দেশে সক্রিয়, বহুজাতিক), খবাবষ : স্তর, Marketing : ক্রয়বিক্রয়, বাজারে পণ্য ছাড়া।
এককথায় এর অর্থ দাঁড়ায়, বহুস্তরবিশিষ্ট বিপণন। এই অর্থ থেকেই অনেক কিছু বুঝে আসে। যেমন-
ক. বহু স্তরবিশিষ্ট বিপণন মানে প্রথম ক্রয়বিক্রয়ের পরই কারবার শেষ হয় না; বরং সামনে বহু স্তরে এটি চলমান থাকবে। (ব্যাখ্যা সামনে আসছে)।
খ. এখানে দুইটা জিনিস বা দুইটা পদবি একত্রে অর্জিত হয় ১. ক্রেতা ২. পরিবেশক। ওদের ফরমেই তা লেখা আছে। দুনিয়ার অন্যান্য কারবারে কেনা শেষ হওয়ার পর কেবল একটি পদবি অর্জিত হয়। তা হল ক্রেতা এবং জিনিসও একটিই অর্জিত হয় তা হল পণ্য বা নির্ধারিত সেবা। কিন্তু এখানে পদবী দুইটি, জিনিসও দুইটি। একটি হল পণ্য আর অপরটি হল ডিস্ট্রিবিউটরশীপ বা পরিবেশক হওয়ার যোগ্যতা। যেমন-ট্রি প্লান্টেশন। আপনি দশ হাজার টাকা দিয়ে ১২টি গাছ ক্রয় করলেন। এখানে আপনি একটি কিনলেন পণ্য। আরেকটি হল, উক্ত কোম্পানি থেকে কমিশন লাভের যোগ্যতা। আপনি আরো লোক যোগাড় করে দিতে পারলে কমিশন পাবেন। এতে বুঝা গেল, বিক্রয়টা এক স্তরে শেষ হয় না; বরং আপনার মাধ্যমে এবং আপনার পরবর্তী লোকদের মাধ্যমে তা বহু স্তরে বিস্তৃত হয়।
গ. আপনি কোম্পানিকে যে অর্থ দিয়ে তার সাথে জড়িত হলেন এর বিনিময়ে আপনি পাচ্ছেন দুইটি বিষয় : ১. পণ্য। তা হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে নগদে পেয়ে যাবেন। ২. এটি থাকবে বাকি। যার নাম পরিবেশক হয়ে কমিশন প্রাপ্তি। আপনি নিজে অন্য ক্রেতা জোগাড় করে দিলে এবং সে ক্রেতারা আরো লোকজন নিয়ে আসলে আপনি পাবেন নির্ধারিত হারে কমিশন।
এটিকে নেটওয়ার্ক সিস্টেমও বলা হয়ে থাকে। তাই এমএলএম কোম্পানিগুলোর কারবারকে নেটওয়ার্ক বিজনেস বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।
বিষয়টিকে সহজ করার জন্য একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন-ধরে নেওয়া যাক, গাছপালা লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি ৫ বছর পর লাভসহ মূল দেওয়ার শর্তে ৫০০০/-টাকার বিনিময়ে ‘ক’ নামক ব্যক্তিকে ক্রেতা-পরিবেশক বানাল। এরপর ক নামক লোকটি উক্ত শর্তে খ ও গ নামক আরো দুজনকে কোম্পানির ক্রেতা-পরিবেশক বানাল। অতপর খ ও গ প্রত্যেকে কোম্পানিতে ভেড়াল যথাক্রমে ঘ, ঙ এবং চ, ছ কে। এভাবে প্রত্যেক নতুন ব্যক্তি দুজন করে ক্রেতা কোম্পানিতে নিয়ে আসবে। উপরোক্ত উদাহরণে ক নামক ব্যক্তি যেমনিভাবে খ ও গ নামক ব্যক্তিকে জোগাড় করার জন্য কোম্পানি থেকে কমিশন পাবে তেমনি স্থলবর্তী প্রত্যেক ব্যক্তি তথা ঘ, ঙ, চ, ছ সহ আরো যতজন এ লাইন দুটিতে নীচের দিকে যোগ হবে তাদের প্রত্যেকের অন্তর্ভুক্তির জন্য কোম্পানি তাকে বোনাস টাকা প্রদান করবে। এভাবে আপ লেভেল বা উপরের স্তরের ক্রেতাগণ ডাউন লেভেল তথা নিম্নস্তরের পরিবেশকদের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে থাকবে এবং ঐ সব কোম্পানির ঘোষণা অনুযায়ী তারা বড় বড় পদবি অর্জন করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণসহ বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকবে।
আপনারা হয়ত অবগত আছেন যে, এ জাতীয় লোভনীয় অফারগুলোই এদেশের অনেক স্বল্প আয়ী বা বেকার লোকজনকে এমএলএম কোম্পানিগুলোর অফিসমুখী করে থাকে।
এতক্ষণ আলোচনা থেকে আমরা বুঝলাম যে, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোতে শুরু শুরুতে যে লোকেরা জড়িত হয় তারাই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। পক্ষান্তরে ডাউন লেভেল বা পরের দিকে আসা সদস্যগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে এবং একটি পর্যায়ে গিয়ে ঐ কোম্পানি বা তার নির্দিষ্ট প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভারতের গবেষকগণ হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, তাদের মতো পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশেও যদি ১জন ক্রেতা-পরিবেশক গড়ে ১০জন করে লোক কোম্পানিতে যোগ করায় এবং যদি পুরো দেশের ১০০ কোটি মানুষ এর সাথে যুক্ত হয় (যা অসম্ভব) তবুও কারবারটি দশম স্তরে গিয়ে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। বিষয়টি এভাবে বুঝা যেতে পারে। প্রথমজন ১০ জনকে, তারা প্রত্যেকে ১০ জন করে ১০০ জন, এরা সকলেই ১০ জন করে ১০০০। এভাবে দশম স্তরে গিয়ে হয়ে যাবে ১০০ কোটি। আর যদি প্রত্যেকের ২ জন করে হিসাব করা হয় তবে ২৭ তম স্তরে গিয়ে ১৩ কোটির ১টি দেশের সকল জনসংখ্যাও যদি তার পরিবেশক হয়ে যায় তবুও কারবারটি বন্ধ হয়ে যাবে।
এতক্ষণের বক্তব্য থেকে আমরা বুঝলাম যে, সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে এমএলএম ব্যবসার ধরন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ :
* সাধারণ ব্যবসায় বিক্রেতার কাজ থাকে পণ্য বিক্রয় করা। আর এমএলএম কোম্পানি সদস্য বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে।
* সাধারণ ব্যবসায় ক্রেতার মূল উদ্দেশ্য থাকে পণ্য। তাই পণ্যের গুণগত মান ও মূল্যের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য থাকে। অন্যদিকে এমএলএম এর ক্রেতাগণের কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে ডিস্ট্রিবিউশনশীপ বা পরিবেশক হওয়া। পরিবেশক হয়ে কমিশন ও বোনাস অর্জন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে। পণ্য তারা কেনে একপ্রকার বাধ্য হয়েই। তাই এর গুণগত মান ও মূল্যটি মুখ্য কোনো বিষয় নয় তাদের কাছে। এজন্যই যে গাছ কোম্পানির বক্তব্য অনুযায়ী এখনো চারা, যা তারা কখনো দেখেইনি এবং ভবিষ্যতেও কোম্পানি দেখাতে অনাগ্রহী সে গাছগুলোই তারা খরিদ করছে চড়া মূল্যে।
* খুব স্বাভাবিক কারণেই চাহিদা ও যোগানের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ায় এ কারবারের নীচের দিকের (ডাউন লেভেল) লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সাধারণ বেচা-কেনায় এমনটির চিন্তাও করা হয় না।
এ পর্যন্ত এমএলএম কারবারের সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরা হল। এখন আমরা এর শরঈ বিশ্লেষণ ও হুকুম নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ এবং এর পরেই থাকবে প্রশ্নোত্তর পর্ব।
সফর-১৪৩৩ – জানুয়ারি-২০১২
মাসিক আল কাউসার