দেশে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এ বিষয়ে শরীয়তের হুকুম জানতে চাচ্ছেন। আজকের নিবন্ধে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা একমাত্র তাওফীকদাতা।
শরঈ আলোচনা শুরু করার আগে মোবাইল ব্যাংকিং-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানা যাক।
মোবাইল ব্যাংকিং কী?
এককথায় বলতে গেলে মোবাইল ফোন অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের নামই হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। শাখা বা অফিসবিহীন এ ব্যাংকিং জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। প্রথমে ব্র্যাক ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংক এ কার্যক্রম শুরু করলেও এখন অনেক ব্যাংকই এ ধারায় প্রবেশ করছে। সন্দেহ নেই, মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
কি কি সেবা দিয়ে থাকে?
এখন পর্যন্ত যে সেবাসমূহ মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো দিচ্ছে তা নিম্নরূপ :
১. এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা প্রেরণ।
২. মোবাইল ফোন রিচার্জ।
৩. মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে জমা টাকা এজেন্ট থেকে উত্তোলন।
৪. মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে জমা টাকা ব্যাংকের এটিএম থেকে উত্তোলন।
৫. মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের টাকা ব্যাংক একাউন্টে এবং ব্যাংক একাউন্টের টাকা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে স্থানান্তর।
৬. নির্ধারিত দোকানপাট ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধ সুবিধা।
৭. দেশের বাইরে বসবাসরত আপনজন কর্তৃক প্রেরিত অর্থ (র্যামিটেন্স) গ্রহণ।
এছাড়া একাউন্টধারী কর্তৃক নিজ হিসাবের স্থিতি, মিনি স্টেটম্যান্ট দেখার সুবিধাও রয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়?
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তফসীলী ব্যাংকগুলো এ ব্যবসা করে থাকে। এজন্য তাদেরকে মোবাইল কোম্পানিগুলোর সাথেও চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়। মোবাইল অপারেটরদের দেশব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে শাখাবিহীন এ মিনি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ব্যাংকগুলো।
অনেকগুলো পক্ষের সংশ্লিষ্টতায় এ কারবার পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন,
ক) মূল কোম্পানি। যথা, বিকাশ, এমক্যাশ ইত্যাদি।
খ) মোবাইল কোম্পানিগুলো।
গ) ডিস্ট্রিবিউটর।
ঘ) এজেন্ট।
ঙ) গ্রাহক তথা একাউন্ট হোল্ডার। এছাড়াও রয়েছে,
চ) বিভিন্ন পণ্য বিক্রেতা ও সেবা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান যাদেরকে মার্চেন্ট বলা হয়।
ছ) প্রবাসী অর্থ তথা রেমিটেন্স গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে ভিন্ন চুক্তি।
মূলকাজ
মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্যাবলি ও তাদের প্রচারপত্র পড়ে দেখা হয়েছে। কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্টদের সাথে এবং উচ্চপদসস্থ মোবাইল ফোন কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে। সবকিছু দেখে ও শুনে যা স্পষ্ট হয়েছে তা হল, মূলত গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারী লোকদেরকে কিছুটা ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার মানসেই এ কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটেছে। এবং যত সেবাই মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে দেওয়া হোক এর মধ্যে সবগুলোর শীর্ষে রয়েছে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে টাকা প্রেরণ ও গ্রহণ। মোবাইল ব্যাংকিং-এর পরিভাষায় যাকে বলা হয় সেন্ড মানি ও ক্যাশ আউট। অর্থাৎ ব্যাংকের টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার (টিটি) এবং ডাক বিভাগের মানি অর্ডারের সহজ বিকল্প হচ্ছে বর্তমান সময়ের মোবাইল ব্যাংকিং।
শরঈ বিশ্লেষণ
এবার মোবাইল ব্যাংকিং-এর বর্তমান কার্যক্রমকে একে একে ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করা যাক।
একাউন্ট খোলা
মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধাগুলো নেওয়ার জন্য একজন ব্যক্তির একটি একাউন্ট থাকতে হয়, যে কোনো ব্যক্তি কোম্পানির এজেন্টদের কাছে গিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণের মাধ্যমে এ একাউন্ট খুলতে পারে। (যদিও টাকা প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য নিজস্ব একাউন্ট না থাকলেও চলে। সেক্ষেত্রে এজেন্টদের মাধ্যমে তা করা যায়।) আমরা বিকাশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং, এমক্যাশসহ কয়েকটি কোম্পানির একাউন্ট খোলার ফরম ও নিয়মাবলি পড়ে দেখেছি। সেগুলোতে মৌলিকভাবে শরীয়া পরিপন্থী কোনো শর্ত আছে বলে মনে হয়নি। তবে ভবিষ্যতে নিয়মাবলি পরিবর্তন করার একক অধিকার কোম্পানি বহন করবে এমন শর্ত শরীয়তের ‘আলইজারা’ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং উভয় পক্ষের সম্মতিতে এমনটি করাই শরীয়তের নিয়ম। বিকাশ এর একাউন্ট ফরমের অপর পৃষ্ঠায় ছাপানো শর্তাবলির ১১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘‘গ্রাহককে কোনো পূর্ব ঘোষণা অথবা বিজ্ঞাপনজারি ব্যতিরেকে যে কোনো সময়ে যে কোনোভাবে বর্তমান নিয়মাবলি সংশোধন, উন্নয়ন, পরিবর্তন করার ক্ষমতা বিকাশ সংরক্ষণ করে।’’ ভাবতে অবাক লাগে, এ ধরনের একচ্ছত্র ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে কি করে? একটি চুক্তি মানেই হল তাতে একাধিক পক্ষ জড়িত। সেখানে কোনো এক পক্ষের এত নিরঙ্কুশ অধিকার ভোগ করা কোনোক্রমেই ইনসাফপূর্ণ নয়। বিষয়টি এমনও হতে পারত যে, কোনো সময় নিয়মাবলি পরিবর্তন, সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে এবং গ্রাহকের মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানানো হবে।
তবে যেহেতু একজন একাউন্ট হোল্ডার যে কোনো সময় কোনো খরচ ছাড়াই তার একাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারে, তাই উপরোক্ত শর্তের কারণে একাউন্ট খোলা নাজায়েয হবে বলে মনে হয় না।
বিকাশ ফরমের ৭নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘গ্রাহক হিসাবে জমাকৃত তহবিল নিরাপত্তা জামানত বিবেচিত হবে। বিকাশ এর নিকট কৃত অঙ্গীকার এবং/অথবা দায়িত্ব অগ্রাহ্য অথবা যথাযথ পূরণ না করা হলে কোনো পূর্ব ঘোষণা প্রদান ব্যতিরেকে উক্ত তহবিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যবহারের অধিকার বিকাশ সংরক্ষণ করে।’’ এ ধারাটি দেখলে কারো হয়ত ফিকহে ইসলামীর ‘রাহান’ বলে সন্দেহ হতে পারে। বাস্তবে এটি ‘রাহান’ নয়। কারণ ‘রাহান’ হয় কোনো জিম্মা/পাওনার নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটি উল্টো। একাউন্ট হোল্ডারের টাকা বরং কোম্পানির কাছে জমা থাকে। কোম্পানি তার কাছে কিছু পাওনা থাকে না। এটি হয়ত প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফিকহে ইসলামীর ‘আযযফার বিল হক’-এর মাসআলার সাথে মিলতে পারে।
বিকাশ এর শর্তাবলির ১৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘বিকাশ একাউন্ট-এ জমাকৃত টাকার উপর কোনো প্রকার সুদ প্রদান করা বা না করার যাবতীয় অধিকার বিকাশ সংরক্ষণ করে।’’ বলা নিষ্প্রয়োজন যে, একজন মুসলমানের কোনোক্রমেই সুদ গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তাই ভবিষ্যতে কখনো মোবাইল একাউন্টধারীকে সুদ দেওয়া হলে কিছুতেই তা ব্যবহার করবে না-এমন সংকল্প ফরমে দস্তখত করার সময়েই মনে মনে রাখতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের এমক্যাশ-এর প্রচার পত্রে এজেন্টদের জন্য একটি অতিরিক্ত শর্ত দেখা গেল। তা হচ্ছে, এজেন্টকে ২৫০০০/- টাকা ইসলামী ব্যাংকে এফডিআর করে রাখতে হবে। যার উপর তাকে মুনাফা দেওয়া হবে। এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় শর্ত। যেখানে অন্যান্য কোম্পানি কোনো জামানত নিচ্ছে না, সেখানে এমক্যাশ কেন জামানত নিচ্ছে? আর ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়া পরিপালনে এত নিষ্ঠাবানও হয়ে উঠেনি যে, তারা মানুষকে হালাল মুনাফা প্রদানের গ্যারান্টি দিবে। মোটকথা মোবাইল একাউন্টে যেহেতু সামান্য টাকাই জমা রাখার সুযোগ আছে তাই এর উপর সুদ বা মুনাফা দেওয়ার বিষয়টি জড়িত করার কোনোই দরকার নেই। এ বিষয়ে সামনে আরো কিছু কথা আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
ক্যাশইন
মোবাইল একাউন্ট খোলার পর গ্রাহক নিজ একাউন্টে এজেন্টের মাধ্যমে টাকা জমা করতে পারেন, কোনো কোনো মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি তাদের ব্যাংকে গ্রাহকের একাউন্ট থাকলে সেখান থেকেও মোবাইল একাউন্টে স্থানান্তরের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ সুবিধাগুলো বিনামূল্যে বা ন্যূনতম (ফ্ল্যাট রেটে) মাশুলে (৫/১০ টাকা) হয়ে থাকে। অতএব এতে শরয়ী অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না।
সেন্ড মানি
একজন মোবাইল একাউন্টধারী তার হিসাব থেকে অন্য একাউন্টধারীর হিসাবে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পাঠাতে পারে। এটিকে বলা হচ্ছে সেন্ড মানি। ২/৫ টাকার ফ্ল্যাট রেটে এই সুবিধা দেওয়া হয়। এতেও শরয়ী সমস্যা নেই।
ক্যাশ আউট
মোবাইল ব্যাংকিং-এর বহুল ব্যবহৃত সুবিধা এটি। নিজ একাউন্ট থেকে অথবা এজেন্টের কাছে প্রেরিত টাকা উত্তোলনই মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে সবচাইতে বেশি হয়ে থাকে। আর দুঃখজনক সত্য হল এ সেবাটির জন্যেই মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি অনেক বেশি মাশুল নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের চার্জ হচ্ছে ১.৮৫% তথা প্রতি ১০০ টাকায় এক টাকা পঁচাশি পয়সা। আর হাজারে ১৮.৫০ টাকা।
সংশ্লিষ্ট এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটর, মোবাইল অপারেটরকে এ টাকা থেকে নির্ধারিত কমিশন প্রদানের পর অবশিষ্টাংশ কোম্পানি তথা ব্যাংক পেয়ে থাকে।
ফিকহে ইসলামীর দৃষ্টিতে এটি ‘আলইজারাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে টাকা জমা/উত্তোলনকারী হচ্ছে শ্রম/সেবা গ্রহীতা বা ‘মুসতাজির’। আর এজেন্ট হচ্ছে শ্রম/সেবাদাতা যাকে বলা হয় ‘আজীর’ (আলোচিত ক্ষেত্রে মূল ‘আজীরে’র প্রতিনিধি)। এক সময়ে ডাক বিভাগের মানি অর্ডারকেও তখনকার উলামায়ে কেরাম এভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। ‘আলইজারা’ এর মৌলিক শর্তগুলো পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টিকে জায়েয বলা যায় তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। যথা :
১. ক্যাশ আউটের বর্তমান চার্জ সার্বিক বিবেচনায় পরিমাণে বেশি। যেহেতু কোম্পানিকে কোনো পর্যায়েই নিজ থেকে কোনো টাকা দিতে হয় না; বরং বিভিন্ন পর্যায়ে ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্ট ও গ্রাহকের অনেক অনেক টাকা তাদের কাছে জমা থাকে তাই এ সার্ভিসটির চার্জ আরো কম হওয়া উচিত। জনবহুল বাংলাদেশে সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সামান্য চার্জ নিলেও তা একত্র হয়ে মোটা অংকের টাকায় পরিণত হবে। সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
২. বর্তমান নিয়মে টাকা যত বাড়বে চার্জও একই হারে বাড়বে। এটি সংশোধন করে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি সীমা নির্ধারণ করা দরকার। কারণ টাকার অংক বাড়লেও সার্ভিস তো সমানই হচ্ছে। বর্তমান নিয়মে কোনো প্রবাসী যদি আপনজনের মোবাইল একাউন্টে এক লক্ষ টাকা প্রেরণ করে তবে সে টাকা ক্যাশ আউট (উত্তোলন) করতে গিয়ে তাকে গুণতে হবে ১৮৫০/- টাকা। যা অবশ্যই জুলুম।
৩. অভিযোগ আছে যে, কোনো কোনো এজেন্ট ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হারের চেয়েও বেশি রাখে। হাজারে ১৮.৫০ টাকার জায়গায় ২০/- টাকা রাখার কথা তো ব্যাপকভাবেই শোনা যায়। কেউ কেউ নাকি তার চেয়েও বেশি নিয়ে থাকে। এটি কোনোক্রমেই জায়েয হবে না। মনে রাখতে হবে, এজেন্টগণ হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির নিযুক্ত শ্রম/সেবাদাতা প্রতিনিধি (উকীল)। কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত চার্জের বেশি নেওয়ার অধিকার তাদের নেই।
ব্যাংকের কাউন্টারে অফিসার কর্তৃক নির্ধারিত চার্জের অতিরিক্ত নেওয়া যেমন রিশওয়াত তথা উৎকোচের শামিল হবে এক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনি দাঁড়াবে। কোম্পানিগুলোকে এ দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন সাধারণ মানুষ তাদের কোনো এজেন্ট কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৪. কেউ কেউ পার্সোনাল একাউন্ট দ্বারাও ব্যবসা করে থাকে। আইন অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ। এমনটি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. আর এটিএম থেকে ক্যাশ আউটের হার বিকাশ রেখে থাকে হাজারে ২০ টাকা। অথচ এখানে এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটর কারো মধ্যস্থতা নেই।
শুধু এটিএম-এর সাথে মোবাইল ব্যাংকিং সফটওয়্যার এর লিংক স্থাপিত করলেই হল। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এটিএম থেকে নিজের জমা টাকা উঠাতে ২% চার্জ দেওয়া কতটুকু জুলুম তা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। হয়ত বিকাশ তার এজেন্ট/ডিস্ট্রিবিউটরদের সুবিধা দিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর মানসেই এ কৌশল নিয়েছে। কিন্তু গ্রাহকদের স্বার্থ কি উপেক্ষিতই থাকবে? এক্ষেত্রে কোনোক্রমেই ৫/১০ টাকার বেশি চার্জ হওয়া উচিত নয়। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের চার্জ এক্ষেত্রে বর্তমানে কম ও যুক্তিসঙ্গত।
মোবাইল রিচার্জ
মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের নিজ নিজ একাউন্টের মাধ্যমে মোবাইল ফোন রিচার্জের সুযোগও দিয়ে থাকে। এ জন্য বাড়তি কোনো ফী নেওয়া হয় না। তবে মোবাইল অপারেটরদের থেকে তারা কমিশন পেয়ে থাকে নিশ্চয়ই। শরীয়তের দৃষ্টিতে এতে সমস্যা নেই।
রেমিটেন্স গ্রহণ
আরেকটি সেবা দেওয়া হয় বিদেশ থেকে প্রেরিত টাকা মোবাইল একাউন্টে গ্রহণের। প্রেরণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা না দিতে হলেও উত্তোলনের ক্ষেত্রে ক্যাশ আউটের পুরো ফী-ই গ্রাহককে প্রদান করতে হয়। আগেই বলা হয়েছে যে, বর্তমানে তা হাজারে ১৮.৫০ টাকা ও লাখে ১৮৫০ টাকা। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের উপর এটি অন্যায় হস্তক্ষেপ। তবে কোনো গ্রাহক মোবাইল একাউন্টের মাধ্যমে রেমিটেন্স গ্রহণ করলে তা নাজায়েয হবে না।
পেমেন্ট
মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো বর্তমানে গ্রাহকদেরকে নিজ নিজ একাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে খরিদকৃত পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধেরও সুযোগ দিচ্ছে। এর জন্য গ্রাহক থেকে অতিরিক্ত চার্জ করা হয় না। পণ্য বিক্রয়কারী বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় ‘মার্চেন্ট।’ গ্রাহকের মোবাইল একাউন্ট এবং এজেন্ট/ডিস্ট্রিবিউটরের একাউন্টের মতো তাদেরও থাকে মার্চেন্ট একাউন্ট। কোম্পানি মার্চেন্ট থেকে কমিশন পেয়ে থাকে।
এটিকে তুলনা করা যায় ডেবিটকার্ড ও প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সাথে। মৌলিকভাবে এটি জায়েয। তবে একটি বিষয় লক্ষণ্যীয়। তা হচ্ছে, যদিও বাহ্যিকভাবে এসকল সেবার মাধ্যমে মানুষ ক্যাশ টাকা বহন করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে কিন্তু ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল একাউন্ট থেকে পেমেন্ট ইত্যাদি সুবিধা ব্যাংকগুলো আবিষ্কার করেছে তাদের লাভের জন্য। এসবের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো মার্চেন্ট তথা ব্যবসায়ীর লাভে ভাগ বসিয়ে থাকে। নিয়ে থাকে বিভিন্ন হারে কমিশন। যা সুস্পষ্ট মধ্যসত্ত্বভোগ। কারণ আধুনিক মার্চেন্টগণ এসব কমিশন ও চার্জের কথা মাথায় রেখেই তাদের পণ্য/সেবার মূল্য বাড়িয়ে ধরে থাকে। যার মাশুল গুণতে হয় সাধারণ ভোক্তাকে। ইসলাম এ ধরনের মধ্যসত্ত্বভোগকে নিরুৎসাহিত করে থাকে।
মোবাইল একাউন্টধারী একজন গ্রাহক বর্তমানে উপরোল্লেখিত সেবাগুলোই পেয়ে থাকে।
প্রসঙ্গ সুদ
শোনা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা জারি করা হতে পারে যেন গ্রাহক একাউন্টকে সেভিংস একাউন্ট হিসাবে ধরে একাউন্ট ব্যালেন্স এর উপর সুদপ্রদান করা হয়। এমনটি করা হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক নিন্দনীয় কাজ। এ কথা অনুধাবন করা দরকার যে, মানুষ টাকা জমা রাখা বা সুদ/মুনাফার জন্য মোবাইল একাউন্ট করে না। এখানে তার টাকা থাকে প্রয়োজনে আপনজনকে প্রেরণ বা দরকারি কাজে লাগানোর জন্য। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান গ্রাহক, এজেন্ট ও ডিস্ট্রিবিউটর মোবাইল ব্যাংকিং-এর সাথে জড়িত। তাদেরকে সুদের মতো একটি নিকৃষ্ট হারামের সাথে জুড়ে দেওয়া কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। (এমনটি করা হলে এমক্যাশ ওয়ালারা হয়ত তাদের একাউন্টকে মুদারাবা বলে দাবি করে মুনাফা দেওয়ার কথাও বলতে পারে!) কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ত ভাবছে গ্রাহককে সুদপ্রদান করা হলে তারা সেখানে ১০/১৫% হারে ভ্যাট বসাতে পারবে।
এ চিন্তা বাদ দিয়ে তাদেরকে ভাবা দরকার কিভাবে মোবাইল ব্যাংকিং-এর চার্জগুলো, বিশেষত ক্যাশ আউটের চার্জ কমানো যায়। সুদের উপর ভ্যাট বসিয়ে লাভবান না হয়ে তারা বরং নজরদারির জন্য ব্যাংকগুলো থেকে ন্যায়সঙ্গত ফী নিতে পারে। মনে রাখা দরকার যে, অসংখ্য অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত লোক প্রয়োজনের তাকিদে মোবাইল ব্যাংকিং এর গ্রাহক হয়েছে ও হচ্ছে। তাদের একাউন্টে ১০/২০ টাকা সুদ দেওয়া হলে তাদের তেমন কোনো লাভ হবে না কিন্তু ঐ টাকা হিসাব করে আলাদা করা এবং তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হবে। সুতরাং আমরা জোর দিয়েই বলতে চাই, যেন মোবাইল একাউন্টকে সেভিংস একাউন্ট ঘোষণা করা না হয়।
উপসংহার
মোটকথা হল, সার্বিক বিবেচনায় (আমাদের জানা তথ্যগুলো অনুযায়ী) বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম জায়েয। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগণকে উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া দরকার। অদ্য ২২/০৯/২০১৩ পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী উপরোক্ত আলোচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি কোনো নতুন নিয়ম করলে সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেম থেকে পুনরায় মাসআলা জেনে নিতে হবে।
যিলহজ্ব ১৪৩৪ – অক্টোবর ২০১৩
মাসিক আলকাউসার