মুন্সী মেহেরুল্লাহ : সুবহে সাদিকের মুয়াজ্জিন

৭ জুলাই, ১৯০৭ সালের এ দিনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৭ বছর বয়েসে ইন্তেকাল করেন তিনি। স্বল্প শিক্ষিত একজন মুন্সী বাঙালা অঞ্চলে কীভাবে খ্রিষ্টান মিশনারিদের মুকাবেলা করেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে, বয়ান-বক্তৃতা ও সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে কীভাবে আলোড়িত করেছিলেন বাঙালি মুসলমানের ঝিমিয়ে পড়া চেতনাকে, তারই বিস্তারিত বিবরণী উঠে এসেছে এই নিবন্ধে।

সময়টা ইংরেজ বেনিয়াদের দুর্দণ্ড প্রতাপের। নানামুখী শোষণ নির্যাতন আর নিপীড়নে জর্জরিত হচ্ছিলো উপমহাদেশের মানুষ। বিশেষত মুসলমানদের অবস্থা ছিলো খুবই শোচনীয়। শিক্ষা-দীক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে পিছিয়ে রেখে একটি অকর্মণ্য জাতিতে পরিণত করা হয়েছিলো। অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য ছিলো মুসলমানদের নিত্য সঙ্গী। বাঙালি মুসলমানদের হালাত তো আরো করুণ। একদিকে রুটি-রুজির অভাব, অপরদিকে মূর্খতা- এ দুইয়ের সমন্বয়ে বাঙালি মুসলমানরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও স্বকীয়তাবোধ থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছিলো। ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা ধারণার বাইরে ইসলাম সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানত না তারা। ধর্ম সম্পর্কে তাদের এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতাকে কাজে লাগায় ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী। উপমহাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয় খ্রিস্টান মিশনারিদেরকে। এরা দারিদ্র্যক্লিষ্ট মূর্খ মানুষদের দ্বারে দ্বারে খ্রিস্টান ধর্মের বানোয়াট মাহাত্ম্য আর ইসলামের গলদ ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়। সাথে গভর্নমেন্টের নানাবিধ সুবিধা ও অঢেল অর্থকড়ি। ফলে যতোটা না খ্রিস্টিয়বাদের মাহাত্ম্যে তারচেয়ে ঢের বেশি গর্ভনমেন্টের সুবিধাদি ও আর্থিক মোহে পড়ে এদেশের ভোখানাঙ্গা দারিদ্র্যপীড়িত অশিক্ষিত মানুষগুলোর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে।

উপমহাদেশীয় মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে বঞ্চনা অবহেলা আর নানাবিধ কূটকৌশলের এই দূর্যোগ প্রায় শতাব্দীকাল ধরে চলে আসছিলো। এরই ভেতর সংঘটিত হয়েছে বালাকোটের লড়াই, ১৮৫৭-এর সিপাহি বিপ্লব, তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা আন্দোলন, হাজি শরিয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনসহ মুসলমান তথা ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য নানা মুক্তিসংগ্রাম। তিতুমির ও হাজি শরিয়তুল্লাহর ইনতেকালে বাংলার গণমানুষকে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার জন্য একজন নাবিকের জরুর প্রয়োজন দেখা দেয় এ দেশে। ঠিক এই সময়টাতেই আলোর মশাল হাতে বাংলার জনপদে জনপদে হেদায়েতের আবে জমজম বিলাতে শুরু করেন মুন্সী মোহম্মদ মেহেরুল্লাহ।

১২৬৮ বঙ্গাব্দের ১০ই পৌষ সোমবার দিবাগত রাতে মুন্সী মেহেরুল্লাহর জন্ম। বর্তমান যশোর জেলার অন্তর্গত ‘ঘোপ’ নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টাব্দ তখন ১৮৬১ সাল। ঘোপ ছিলো মেহেরুল্লাহর নানাবাড়ি। পৈতৃক ভিটা একই জেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। জন্মের ছ’মাসের মাথায় মেহেরুল্লাহকে ছাতিয়ানতলা আনা হয়। তারপর এখানেই বেড়ে ওঠেন তিনি। পাঁচবছর বয়সে তাকে পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। অল্পদিনেই শিশু মেহেরুল্লাহ তৎসময়ের শিশুপাঠ্য বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ পড়ে পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। ছেলের মেধা ও মননের তীক্ষ্ণতা দেখে পিতা খুবই আনন্দিত হন। ধর্মে-কর্মে তাকে বড় বিদ্বান বানাবার স্বপ্ন বুনেন। সেই স্বপ্ন থেকেই মেহেরুল্লাহকে কোরআন শরিফ পড়তে দেয়া হয়। মেহেরুল্লাহ কুরআন শরিফ পড়া শেষ করে সমকালীন রীতি অনুযায়ী শেখ সাদি’র গুলিস্তাঁ-বোস্তাসহ উর্দুভাষাও কিছুটা আয়ত্ব করতে শুরু করেন। এরই ভেতর হঠাৎ পিতার ইনতেকাল হয়ে যায়। মুন্সী তখন সবে কৈশোরে পা রেখেছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতার মৃত্যুতে মা ও তিন বোনের সংসারের হাল মুন্সীকেই ধরতে হয়। এবং সেই সাথে অনিবার্যভাবে পড়ালেখারও ইস্তফা দিতে হয়। কৈশোরের থৈ থৈ উচ্ছলতায় মুন্সী যখন নাটাই সুতো দিয়ে মুক্ত আকাশে ঘুড়ি উড়াবার কথা, যখন মায়ের বকুনি খেয়ে পাঠশালায় যাবার বয়েস, তখন তাকে জীবিকার তাগিদে ইংরেজ সাহেবদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে।

সাহেবদের অফিসে কেরানির চাকরি পান কিশোর মেহেরুল্লাহ। সামান্য এই উপার্জন দিয়ে বড় কষ্টে তিনি পাঁচ জনের সংসারের ব্যয়ভার সামাল দিতেন। দিনমান খাটতে হতো অফিসে। স্বাধীনচেতা মেহেরুল্লাহর এসব সইতো না। তারপরও পরিবারের দৈন্যতার কথা চিন্তা করে বেশ খানিক দিন চাকরি করেন এখানে। তারপর আরেকটু যখন বড় হলেন, পরাধীনতাকে আর তিনি সইতে পারলেন না। সাহেবদের কেরানিগিরি ছেড়ে যশোর শহরের একটি দর্জিখানায় পোষাক সেলাইয়ের কাজ ভালোভাবে রপ্ত করে নেন। এবং স্বাধীনভাবে একটি সেলাইর দোকান খুলে দর্জির ব্যবসা শুরু করেন। কাজের মান, সততা ও সদ্ব্যবহারের কারণে অল্পদিনেই তিনি সমকালীন যশোরের নামকরা একজন দর্জিতে পরিণত হন। সরকারি কর্মকর্তা এমনকি ম্যাজিস্টেটের পোশাকও তার দোকানে তৈরি হতো। পোষাক সেলাইয়ের সুবাদে বেশ অনেক খ্রিস্টান মিশনারির সাথে মেহেরুল্লাহর সখ্যতা গড়ে ওঠে।

মুন্সী মেহেরুল্লাহ তখন টগবগে তরুণ। তার চিন্তার প্রখরতা, গভীরতা, স্বভাবজাত প্রতিভা এবং প্রত্যুতপন্নমতিত্ব দেখে খ্রিস্টান মিশনারিরা তাকে খ্রিস্ট ধর্মে কনভার্ট করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তার সাথে সখ্যতা গড়ার মূল উদ্দেশ্যই তাদের এটা। স্বল্প শিক্ষিত হলে কী হবে, মুন্সী মেহেরুল্লাহর জ্ঞান-পিপাসা ছিলো প্রচণ্ড। জীবিকার চাপ তার জ্ঞানান্বেষের আগ্রহকে এতোটুকুন ম্লান করতে পারেনি। মিশনারিরা মুন্সীর এই আগ্রহকেই পুঁজি করে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নানা বানোয়াট তথ্য দিয়ে রচিত তাদের বইপত্রগুলো মুন্সীকে পড়তে দেয়। খ্রিস্টান পাদ্রীদের বিভিন্ন সভায় তাকে নিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই মুন্সী মেহেরুল্লাহর ব্রেইন ওয়াশ করে তার মনে এই বিশ্বাস তারা পাকাপোক্ত করে দেয় যে, ইসলামের চেয়ে খ্রিস্টান ধর্ম বহু গুণে উত্তম এবং আধুনিক। সুতরাং মুসলমানিত্ব ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে নেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। মুন্সী মেহেরুল্লাহ মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে ফেলার, এর ভেতর ঘটনাক্রমে তার হাতে দু’টি বই আসে। একটার নাম ‘খ্রিস্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা’ আর অপরটা ‘ইনজিলে হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খবর আছে।’ প্রথমটার রচয়িতা হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ আর দ্বিতীয়টা লিখেছেন ঈশান ম-ল ওরফে এহসান উল্লাহ। মুন্সী মেহেরুল্লাহ বই দু’টো খুব মনোযোগিতার সাথে পাঠ করেন। পাঠ শেষে পেরেশান হয়ে ওঠেন তিনি। আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান ইসলাম সম্পর্কে শঠ মিশনারিরা এতো দিন তাকে কী গলদ ধারণাটাই না দিয়েছে। অনুতপ্ত মনে তওবা করেন মেহেরুল্লাহ এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন।

মিশনারিদের কাছ থেকে নিজের ধর্মের ব্যাপারে এমন ধোঁকা খাওয়ায় একটা জিদ চেপে বসে মেহেরুল্লাহর ভেতর। তার অজানা ও অজ্ঞতার কারণেই তারা এমন ধোঁকা দিতে পেরেছে। সুতরাং তাকে জানতে হবে এবং ইসলাম সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা করে তার মতো আরো আরো মানুষ, যারা মিশনারিদের ধোঁকায় পড়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, তাদের কাছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বজনীনতা সহজভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই প্রতিজ্ঞা থেকেই তিনি ইসলাম সম্পর্কে গভীর অধ্যাবসায়ে মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিন পরেই মেহেরুল্লাহ ‘খ্রিস্টীয় ধর্মের অসারতা’ নামে ক্ষুদ্র একটি পুস্তিকা রচনা করেন। প্রতিদিন বিকেলে যশোরের হাটে দাঁড়িয়ে নিজেই তা বিক্রি করতে শুরু করেন। বিক্রয়কালে বইটি সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে যে কথাগুলো বলতেন, তা এতোটা বাগ্মিতা সুলভ ছিলো যে, লোকজন শোনার জন্য বড় একটি জটলা বানিয়ে ফেলতো তার আশপাশে। ধীরে ধীরে সেই জটলা আরোও বড় হতে থাকে। মুন্সী মেহেরুল্লাহও শ্রোতাদের আগ্রহ দেখে খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা ও ইসলামের সার্বজনীনতা নিয়ে চমৎকার করে প্রতিদিন বিকেলে সেখানে কথা বলতে থাকেন। ফলে অল্প দিনেই তার বক্তৃতার সুনাম পুরো যশোরে ছড়িয়ে পড়ে। যশোরের নানা জায়গায়, যেখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের উৎপাত বেড়ে যেতো সেখানে গিয়ে তিনি মানুষদের জড়ো করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব সাবলীল ভাষায় বয়ান করতেন। মানুষ আগ্রহ নিয়ে তার বক্তব্য শুনতে আসতো। এভাবেই শুরু। ধীরে ধীরে তার বাগ্মিতার সুনাম পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টান মিশনারিদের অপপ্রচার সম্পর্কে বাঙালি সাধারণ মুসলমানদের সতর্ক করতে তিনি বাংলা-আসামের বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াতে লাগলেন।

পাশাপাশি লিখনির মাধ্যমেও তিনি তার মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যান। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য খ্রিস্টান পাদ্রীরা ইসলাম সম্পর্কে নানা অভিযোগ তুলে যে সমস্ত বই-পুস্তক প্রকাশ করতো, মুন্সী সেগুলোর দাঁতভাঙা এবং অখ-নীয় জবাব দিতেন পাল্টা বই রচনা করে। বিশেষত কুরআন শরিফের সত্যতা নিয়ে যখন এসব পাদ্রী প্রশ্ন ওঠায়, মুন্সী মেহেরুল্লাহ এককভাবে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে প্রশ্নটি খ-ন করেন। এ সমস্ত খ-ন প্রক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে প্রচ- যুক্তিবাদী ও অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী একজন মেহেরুল্লাহকে আবিষ্কার করা যায়। তার লেখা প্রায় দশটির মতো পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে ‘রদ্দে খ্রীষ্টিয়ান ও দলিলোল এছলাম’, ‘জোওয়াবোন্নাছারা’, ‘বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ-ভা-ার’ এবং ‘মেহেরুল এছলাম’ উল্লেখযোগ্য। মেহরুল এছলাম মূলত পুঁথিকাব্য। মুসলিম সমাজের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মুন্সি মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ এই পুঁথিগ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটির শুরুতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের শানে দীর্ঘ একটি নাত আছে। গ্রাম-বাংলার অনেক মানুষের গলায় আনন্দে-অবসরে আজও সুর ওঠে সেই নাতটির। যদিও সচেতন অনেকেও জানেন না নাতটির মূল রচয়িতা কে? নাতের এক জায়গা থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দিই–

গাওরে মছলেমগণ, নবীগুণ গাওরে।
পরাণ ভরিয়া সবে ছল্লে আলা গাওরে।

সত্যি কথা বলতে কি, মুন্সী মেহেরুল্লাহর পরবর্তী সময়ে তার অনেক পুঁথিকাব্য মীর মোশাররফ হোসেনের নাতের সাথে মিশে গেছে। আর বর্তমানে এসে তো তার প্রায় সবগুলো নাতই গোলাম মোস্তফা রচিত দরূদের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

হিন্দুদের বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা প্রথার উপরও মেহেরুল্লাহ কথা বলেছেন। তার ‘বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ-ভা-ার’ এ বিষয়েই লেখা একটি গীতিকাব্য। হিন্দু রেওয়াজে বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন না থাকায়, সেসব নারীদেরকে কতটা যাতনার ভেতর দিয়ে জীবন কাটাতে হয়, গ্রন্থটিতে মুন্সী মেহেরুল্লাহ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ থেকে দলিল দিয়ে সেকথাগুলোই যৌক্তিক ব্যাখ্যাসহ ব্যক্ত করেছেন বিধবার বিষাদমাখা করুণ জবানে। একটু উদ্ধৃতি–

সাধে কি সেজেছি আমি চাতকিনী
দহিছে হৃদয় মম প্রাণপতি বৈ লো!
অনন্ত বিরহানল
হৃদয়েতে অবিরল
জ্বলে যেন ইশালে কাহারে তা কৈ লো!
পড়েছি ভীষণ রণে
এ পোড়া যৌবন বনে
বিন্ধিছে কণ্টক মনে, আর কত সই লো!
চাতকিনী শূন্য ভরে
মেঘ বারি বিনে মরে
তবুও সে আশা করে, আমি তাও নই লো!
সদা মনে এই বলে
মনের সুখে আগুন জ্বেলে
কুল পুতে বকুল তলে, উড়ো পাখি হইলো!

কলকাতা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন ধর্মীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সুধাকর’-এও নিয়মিত লিখতেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ। সুধাকর শুধু একটা পত্রিকা ছিলো না, ছিলো একটা আন্দোলনের নাম। বঙ্গাব্দ ১২৯৬ সালের (১৮৮৯ ইসায়ি) আশ্বিন মাসে সুধাকর-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। শেখ আবদুর রহীম এবং মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদ পত্রিকাটি প্রকাশ করতেন। অর্থের অভাবে তা বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, কিন্তু প্রচ- এক সাড়া ফেলে দিয়েছিলো পুরো বাংলায়। এ পত্রিকার মাধ্যমেই বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, মহিমা, ঐতিহ্য এবং আলো ঝলমল অতীত সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করেছিলো। সুধাকর পত্রিকার সুবাদেই শেখ আবদুর রহীম এবং মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদের সাথে মুন্সী মেহেরুল্লাহর সখ্যতা গড়ে ওঠে। সুধাকর পত্রিকা যে উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হতো মেহেরুল্লাহর জীবনের ব্রতও ছিলো তাই। এজন্যে সুধাকর গোষ্ঠীর সাথে খুব সহজেই মিশে যান তিনি। এ গোষ্ঠীর সাথে একাত্ম হয়ে বাঙালি মুসলমানদের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে তোলা এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের অপতৎপরতাকে নস্যাৎ করার আন্দোলনকে তিনি আরো গতিময় করে তোলেন। তারও আগে স্থানীয়ভাবে কাজ করার জন্য যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইসলাম ধর্মোত্তেজিকা’ নামে একটি সংগঠন।

বিতর্ক বাহাস এবং তর্কযুদ্ধেও মুন্সী মেহেরুল্লাহর অসম্ভব দক্ষতা ছিলো। সিংহভাগ ক্ষেত্রে বাহাসটা হতো খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে। তখনকার দিনে খ্রিস্টান পাদ্রীরা ইসলামকে নানাভাবে খাটো করে, ইসলামের অকাট্য সব বিষয়াদির উপর আপত্তি তুলে বাহাস আহ্বান করতো। মুন্সী মেহেরুল্লাহ সেই সব বাহাসের মুকাবেলা করতেন। তার বাগ্মিতা এতোই প্রখর ছিলো যে, খ্রিস্টান পাদ্রীরা কোনোভাবেই তার সাথে তর্কযুদ্ধে পেরে উঠতো না। তার যুক্তির অকাট্যতা এবং উপস্থাপনের নিপুণতার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হতো। বিতর্ক-বাহাসে মেহেরুল্লাহর প্রথম অভিজ্ঞতা হয় ১২৯৮ বঙ্গাব্দে। ১২৯৮-এর ২১, ২২ ও ২৩ আশ্বিন বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমায় খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে তিন দিন ব্যাপী একটি বাহাসের আয়োজন করা হয়। কলকাতার সুধাকর কার্যালয় থেকে বাহাসে অংশগ্রহণের জন্য মুন্সী রেয়াজউদ্দীন একটি চিঠি লেখেন মুন্সী মেহেরুল্লাহকে। মেহেরুল্লাহ চিঠি পাওয়া মাত্র রওনা হয়ে যান বরিশালের উদ্দেশ্যে। নির্দিষ্ট তারিখে বাহাস অনুষ্ঠিত হয়। মেহেরুল্লাহর কাছে খ্রিস্টান পাদ্রীরা চরমভাবে পরাজয় বরণ করে। এর কিছুদিন পরে মেহেরুল্লাহ দাওয়াতি কাজে আসামের অন্তর্গত গোয়ালপাড়া জেলার গৌরিপুরে গমন করেন।

এই সময়টাতেই নদীয়ায় জমিরুদ্দীন নামের এক মুসলিম যুবক [জন্ম : ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ] সেখানকার মিশনারি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন এবং মিশনারিদের অর্থায়নে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। জমিরুদ্দীন থেকে তিনি হয়ে যান পাদ্রী জন জমিরুদ্দীন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত ‘খৃষ্টীয় বান্ধব’ নামক পত্রিকায় ‘আসল কোরান কোথায়’ শিরোনামে পবিত্র কোরআনের অবিকৃতির উপর আপত্তি তুলে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ১৯ ও ২৬ শে চৈত্র এবং ১৩০০ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ ও ২৭ জৈষ্ঠ মুন্সী মেহেরুল্লাহ এই প্রবন্ধের ঘোর প্রতিবাদ করে সুধাকর পত্রিকায় তার উত্থাপিত অভিযোগগুলোর জবাব অত্যন্ত যৌক্তিকতার সাথে দিয়ে পবিত্র কুরআনের চিরন্তনতা প্রমাণ করেন। জন জমিরুদ্দীন লেখাগুলো পড়ে এতোটাই প্রভাবিত হন যে, পুনরায় তিনি ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। তারপর সুধাকরের ঠিকানায় একটি চিঠি লেখেন মুন্সী রেয়াজউদ্দীনের কাছে। উত্তরে রেয়াজউদ্দীন তাকে লেখেন- ‘আপনার মতো লোকের মাস্টারি বা পণ্ডিতি শোভা পায় না। পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রাচার করণার্থে আপনি জীবনকে উৎসর্গ করুন। আপনি মুন্সী মেহেরুল্লাহর সাথে মিলিত হইয়া কার্য করুন। আমি তাহাকে আপনার বিষয়ে লিখিলাম, আপনি তাহাকে পত্র লিখিবেন।’

মুন্সী রেয়াজউদ্দীনের কথামতো জমিরুদ্দীন চিঠি লিখলেন মেহেরুল্লাহকে। মেহেরুল্লাহ চিঠি পাওয়া মাত্রই এর জবাব লিখতে বসে যান। দিনটা ছিলো ১৩০৪ সালের ১২ বৈশাখ। মেহেরুল্লাহ লেখেন–

মাননীয় সাহেব, আচ্ছালামু আলায়কুম। আজ আপনার স্বহস্তে লিখিত পত্র পাঠে যে কি আনন্দ সাগরে ভাসমান হইলাম তাহা লেখনী দ্বারা প্রকাশ করা অসম্ভব। সুধাকওে আপনার মুসলমান হইবার সংবাদ প্রকাশ হইয়াছে। ‘রদ্দে খৃষ্টানের’ জন্য যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহাতে আপনার নাম স্বাক্ষর দেখিয়াই আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল আজ তাহাই সত্য হইল। তজ্জন্য খোদাতালার শত সহ¯্র শোকর গোজারী করিতেছি। ্পনার ন্যায় শিক্ষিত ভ্রাতা যদি ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত হন, তবে সমাজ তাঁহাকে সাদরে গ্রহণ করিবেন। অন্যান্য বিষয় বিস্তৃত পত্রে লিখিতেছি। প্রচার কার্যে আপনি অতি শীঘ্রই প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিবেন।

এর কয়েকদিন পর জমিরুদ্দীনকে উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে তিনি যে চিঠিটি লিখেন তাতে তার জীবনের কয়েকটি দিক বড় সরলভাবে ফুটে ওঠে–

প্রিয় ব্রাত, আচ্ছালামু আলায়কুম পরে জানিবেন, আপনার ১৪ বৈশাখের পত্র পাইলাম। আমি আপনাকে এই পরামর্শ দেই, আপনি প্রথমত কিছুদিন ধর্ম সম্বন্ধে এক একটি প্রবন্ধ ও নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনী ‘সুধাকরে’ প্রকাশ করিতে থাকুন এবং ধর্মীয় ২/১ খানা পুস্তক প্রকাশ করুন। যদি ছোট ছোট পুস্তক ছাপার ব্যয় বহন করা আপনার ক্ষমতা না হয় তবে খোদাতালার ফজলে আমরা সে ভার গ্রহণ করিব। এইভাবে ক্রমে সমাজের নিকট পরিচিত হইলে আমরা দূর দারাজস্থ ধর্মসভা হইতে আপনাকে নিমন্ত্রণ করাইব। মধ্যে মধ্যে কতকটা সভাতে বক্তৃতা করিলে আপনি শীঘ্রই সাধারণ মুসলমানের ভক্তিভাজন হইতে পারিবেন। আজকাল বঙ্গদেশে বাঙ্গালা ভাষাভিজ্ঞ ইসলাম প্রচারকের এতই আবশ্যক যে, আপাতত ২০-২৫ জন ভাল প্রচারক হইলেও সে অভাব পূরণ হয় না। আমিও এক সময় পাদ্রী আনন্দ বাবুর প্রচাওে মুগ্ধ হইয়া যাইতাম। ক্রমে খৃষ্টধর্ম শাস্ত্র পাঠ করি এবং অন্তরে খৃষ্টধর্মই মুক্তির পথ কলিয়া বিশ্বাস করি। কিন্তু প্রকাশ্যে অবগাহিত (বাপ্তাইজ) হই নাই। সেই সময় আমি ‘ঈশান বাবু খৃষ্টানের মুসলমান হওন’ বৃত্তান্ত এবং হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ সাহেব লিখিত ‘খৃষ্টধর্মেরভ্রষ্টতা’ পুস্তকদ্বয় পাঠ করি। তাহাতেই খোদাতালার ফজলে আমার মনের ভাব গতি পরিবর্তন হয়। আমি সেই ১২৯৩ সালেই ‘খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা’ করি ও নিয়মিতভাবে হাটে-বাজারে প্রচার আরম্ভ করি। যদিও আমি ভাল বাঙ্গালা জানি না, তথাপি কমে কয়েকটি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করিয়াছি। তদ্বারা সমাজের কতদূর উপকার সাধিত হইয়াছে বলিতে পারি না তবে এইম মাত্র জানি যে, এখন আমি খোদাতালার ফজলে সমুদয় বঙ্গীয় মুসলমানের স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছি। আমি দরিদ্র লোকের সন্তান হইলেও আমাকে আর কোনো বিষয়ের অভাব অনুভব করিতে হয় না।

মুন্সী জমিরুদ্দীন লিখেছেন, ‘এই প্রকার লেখা দেখিয়া মুন্সী সাহেবের সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। ১৩০৪ সালে তিনি আমার কৃত ‘ইসলাম গ্রহণ’ প্রকাশ করিয়া আমার বিশেষ উপকার সাধন করেন। পরে ১৩০৪ সালের ১১ ফাল্গুন নদীয়া জেলার অন্তর্গত পান্টি নামক স্থানে মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত হয়। তাঁহার সহিত তালতলা হরিপুরের মৌলবী আবদুল আজীজ সাহেব ছিলেন। মুন্সী সাহেব আমকে লইয়া যাইবার জন্য সূফী আবদুল বারিকে কুমারখালি স্টেশনে পাঠাইয়াছিলেন। আহা! সেইদিন স্মরণ করিলে হৃদয়ে আনন্দ আর ধরে না। মুন্সী মোহাম্মদ আব্বাস আলী সাহেব ও হাজী মেহের আলী সাহেব ইহারা সকলই সেদিন মুন্সী সাহেবের সহচর ও অনুচর হইয়াছিলেন। ইহারা আমাকে এত সমাদর করিলেন যাহা বর্ণনাতীত।

‘১৩ ফাল্গুন পান্টিতে একটি বিরাট মুসলামন সভার অধিবেশন হয়। আমিও এই সভাতে মুন্সী সাহেবের সহিত বক্তৃতা করিয়াছিলাম। ১৩০৪ সালের ১২ চৈত্রের সুথাকরে মুন্সী সাহেব লিখিয়াছিলেন যে, ‘আমি নিজে অনেক সভাতে বক্তৃতা শুনিয়াছি কিন্তু শেখ জমিরুদ্দীনের বক্তৃতায় শ্রোতাগণকে যে প্রকার ধর্মভাবে ভিবোর হইতে দেখিয়াছি সেরূপ আর কখনও নয়নগোচর হয় নাই।

‘এই সময় অর্থাৎ ১৩০৪ সালের ফাল্গুন হইতে ১৩১৪ সালের জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ১০/১১ বৎসর কাল আমি মুন্সী সাহেবের অনুচর হইয়া নানা স্থানের ধর্মসভাতে বক্তৃতা করিয়াছি। ১৩০৪ সালের চৈত্র মাসে রানাঘাটের পাদ্রী মনহরা সাহেবের সাথে তর্ক উপলক্ষে যে বিরাট সভা হইয়াছিলো যাহার বিস্তৃত বিবরণ কবিবর মন্সী মোজাম্মেল হক সাহেব তৎকালে মিহির ও সুধাকওে লেখেন, ঐ সভাতে আমি তাঁহার সহিত উপস্থিত ছিলাম। ১৩০৫ সালের অগ্রহায়ন মাসে আমরা যশােহর জেলার কেশবপুর অঞ্চলে প্রচার করিয়া পরে নোয়াখালী গিয়াছিলাম। নোয়াখালীর টাউন হলে ও রাজকুমার স্কুলে মুন্সী সাহেব যে বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাহা শ্রবণ করিয়া তথাকার জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, মুনসেফ, উকিল, মোক্তার সকলেই মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছিলেন। পরে তিনি কুষ্টিয়া, কুমারখালী, রাজবাড়ি, পাবনা, চাটমোহর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নীলফামারী, দিনাজপুর, বগুড়া, করটিয়া, গোয়ালন্দ, কুচবিহার, ডায়মন্ড, হারবার, নদীয়া, খুলনা, চব্বিশ পরগণা, বরিশাল ইত্যাদি যেখানেই যখন বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন তথাকার হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই উপকৃত হইয়া শতমুখে তাঁহার প্রশংসা কীর্তন করিয়াছেন। তাঁহার বক্তৃতা করিবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তাঁহার ন্যায় অদ্ভুত ক্ষমতাবিশিষ্ট বক্তা হিন্দু সমাজেও আছে কি না সন্দেহ। তিনি যে কেবল বক্তৃতা করিতে পারিতেন, তাহা নহে, রচনা ও মুশাবিদা করিবার ও গ্রন্থাদি লিখিবারও অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।’

শেখ জমিরুদ্দীন আরোও লিখেছেন, ‘মুন্সী সাহেব শত সহস্র টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন, কিন্তু নিজের পরিবার বর্গেও জন্য কিছুই রাখিয়া যান নাই। অথচ তিনি অপব্যয়ও করেন নাই। তিনি পীড়িত অবস্থায় অর্থকষ্টে পতিত হইয়াছিলেন। মুন্সী সাহেব সামান্য পোষাক পরিতেন ও সামান্য আহার করিতেন। আড়ম্বরপূর্ণ খানা আদৌ পছন্দ করিতেন না। যে স্থানে নতুন যাইতেন, তথায় আমাদের দ্বারা বলাইতেন, কেবল আলু ভাতে ভাত চাই, গোশত আমরা খাই না। তিনি সহচর ও অনুচরদিগকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখিতেন। কখনও কাহারো মনে কষ্ট দিতেন না। তিনি সদা প্রফুল্ল ও কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। দুঃখীর আর্তনাদ কখনও সহ্য করিতেদ পারিতেন না। কেহ কখনো কোনো বিষয় তাঁহার নিকট প্রার্থী হইয়া বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া যায় নাই। যখন যেখানে যাইতেন ছোট হইতে চেষ্টা করিতেন। নামাজে ইমাম হইবার জন্য আদৌ পা বাড়াইতেন না। তাঁহার বসতভিটা আড়ম্বরপূর্ণ নহে, সামান্য কয়েকখানি পর্ণকুটির বলিলেও অত্যুক্তি হবে না।

‘বিলাসিতাকে তিনি বড়ই ঘৃণা করিতেন। তিনি শিক্ষক না হইয়া প্রায় ছাত্র হইতে চেষ্টা করিতেন। অহংকার, ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি ঘৃণিত কোনো রিপুর তিনি বশীভূত ছিলেন না। বৃদ্ধা জননীকে বড়ই ভক্তি করিতেন। কখনও তাঁহার অবাধ্য হইয়া কোনো কার্য করিতেন না। ইনজিলে লেখা আছে, কোনো মহান ব্যক্তি স্বদেশে গৃহীত হয় না। কিন্তু মুন্সী সাহেবের দেশের লোক তাঁহাকে অতিশয় সমাদর করিত। আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছি, কেহ তাঁহাকে ‘যশোরের চেরাগ’ কেহ বা ‘দীনের মশাল বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন। মুন্সী সাহেবের ওয়াজ শুনিয়া সহ¯্র সহ¯্র লোক শেরেক, বেদাৎ পরিত্যাগ করিয়া দীনদার হইয়াছে, সহ¯্র সহ¯্র বেনামাজি নামাজ ধরিয়াছে। মাদরাসা কারামতিয়া ও মাদরাসা তাঁহার অক্ষয় কীর্তি। অনেক সোদখোর মহাজন তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া সুদ পরিত্যাগ করিয়াছেন। অনেক বেপর্দা স্ত্রী তাঁহার নছিহত শুনিয়া পর্দানশিন হইয়াছে। তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া অনেক বেকার মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিয়াছে। অনেক ন্যাড়ার ফকির ও বিকৃতমনা মুসলমান তাঁহার নিকট তৌবা করিয়াছে। ইহা ব্যতীত তিনি যে কত শত শত সামাজিক সৎকার্য করিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না।’

১৩১৪ বাংলার ২৪ জ্যৈষ্ঠ মুতাবিক ৭ জুলাই ১৯০৭ ইসাব্দে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৭ বছর বয়েসে বাংলার বিস্ময়কর এই দাঈ ইনতেকাল করেন। ৪৭ বছরের ছোট্ট জীবনে তিনি যে কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, রীতিমতো বিস্ময় জাগানিয়া। একদিকে যেমন বয়ান-বক্তৃতার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের নির্জীব চেতনাকে সজীবতা দিয়েছেন, ধর্মান্তরের ফেতনা থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে বিতর্ক বাহাস ও তর্কযুদ্ধে খ্রিস্টান পাদ্রীদেরকে নাস্তানাবুদ করেছেন, অপরদিকে বাংলাভাষায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র সাহিত্য সৃষ্টিতেও রেখেছেন অমূল্য অবদান। বর্তমানের বিচারে তার রচনাবলির মান যেমনই হোক না কেন, তিনি যদি বাংলায় মুসলিম সাহিত্য সৃষ্টিতে কাজ না করতেন, তবে আজকের দিনে বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য ভা-ার আমরা এতোটা ঋদ্ধ পেতাম না। কেননা তিনি যে পথ তৈরি করে গিয়েছিলেন, সে পথে হেঁটেই আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান, কবি গোলাম মোস্তফা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদসহ বাংলার খ্যাতিমান সব মুসলিম কবি-সাহিত্যিক। ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও শেখ হবিবর রহমান তো ছিলেন সরাসরি মুন্সী মেহেরুল্লাহর চেতনায় প্রভাবিত। সিরাজীর শোকোচ্ছ্বাস কবিতাটি মেহেরুল্লাহর মৃত্যুশোকেরই কাতর নিনাদ। শোকোচ্ছ্বাসের ক’টি চরণ উদ্ধৃত করে ইতি টানছি–

একি অকস্মাৎ হ’ল বজ্রপাত কি আর লিখিবে কবি!
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকালো ছবি
কি আর লিখিব কি আর বলিব আঁধার যে হেরি ধরা
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
কেহ না ভাবিল কেহ না বুঝিল কেমনে ডুবিল বেলা
ভাবিনি এমন হইবে ঘটন সবাই করিনু হেলা।
শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা আঁধার আইল ছুটি
বুঝিবি এখন বঙ্গবাসীগণ কি রতন গেল উঠি’।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে সমাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন বিশ্বময় অন্ধকার।


হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24