মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ – ১ম পর্ব

মুজিযা কি ও কেন?

শব্দ পরিচিতি
মুজিযা (معجزة) মূলঃ ع-ج-ز = عجز (আজয) , ضرب – يضرب – ضرباً – এর ওজনে। যথাঃ عجز – يعجز – عجزاً এর যেমন ব্যবহার রয়েছে, তেমনি বাব-ই ইফআলের ওজনে তার ব্যবহার হয়ে থাকে।

মুজিযা শব্দটি উক্ত মূল থেকে উদ্ভূত একটি কর্তৃপদ (إسم فاعل) জাতীয় শব্দ। আসল রূপ معجزة (মুজিযা) তার ة বর্ণটি মুবালাগা (مبالغة) আধিক্য জ্ঞাপক অর্থের জন্য সংযুক্ত হয়েছে। সেটা স্ত্রীবাচক (تاء تانيث) তা (ة) নয়। তবে কারো কারো মতে, معجزة শব্দটি উহ্য বিশেষ্য (موصوف) শব্দের বিশেষণ (صفت)। আসল রূপ – اية معجزة (আয়াতুন মুজিযাতুন), অলৌকিক নিদর্শন। (দ্র. ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড; আর-রাগিব ইসফাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, শিরো.)
সাধারণত কোন কাজ সম্পাদনে অক্ষম ও অসমর্থ হওয়ার অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি القدرة (শক্তি) এর বিপরীত। এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে একাধিক স্থানে পাওয়া যায়, যথা – “…. সে বললো – হায় ! আমি কি এই কাকের মতোও হতে অক্ষম হলাম, যাতে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি? এরপর সে অনুতপ্ত হলো।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫: ৩১)

এই অর্থে শব্দটির আরো ব্যবহার দেখুন আল-কুরআনের এ আয়াতসমূহে – ৬ : ১৩৪ ; ৮ : ৫৯ ; ৯ : ২-৩ ; ১০ : ৫৩ ; ১১ : ২০, ৩৩ ; ১২ : ৩১ ; ১৬ : ৪৬ ; ২২ : ৫১ ; ২৪ : ৫৭ ; ২৯ : ২২ ; ৩৪ : ৩৮ ; ৩৫ : ৪৪ ; ৩৯ : ৫১ ; ৪৬ : ৩২ ; ৭২ : ১২

এই অর্থের সূত্র ধরেই শব্দটি পবিত্র কুরআনে বার্ধক্য বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন- “তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সামনে আসলো আর তার মুখ চাপড়িয়ে বললো- আমি তো বৃদ্ধা, বন্ধ্যা।” (সূরাহ আয-যারিয়াত, ৫১ : ২৯) আরো দেখুন – সূরাহ হুদ, ১১ : ৭২ মোটকথা, মুজিযা শব্দের আভিধানিক অর্থ – “কোন কাজ সম্পাদনে অথবা কোন বিষয় প্রদর্শনে অক্ষম করা, অভিভূত করা।” (সুত্রঃ প্রাগুক্ত)

মুজিযার পারিভাষিক শব্দ
মুজিযার পারিভাষিক সংজ্ঞা বর্ণনায় বিশেষজ্ঞ আলিমগণের ভাষ্যসমূহে কিছু মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মতপার্থক্য একান্তই শব্দগত, সবগুলোর ভাবার্থ প্রায় এক ও অভিন্ন। মুজিযার কয়েকটি পারিভাষিক সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
আল্লামা ইবনে হাযার আসকালানী লিখেছেনঃ রাসুলগণ কর্তৃক সম্পাদিত সে সকল অলৌকিক বা অসাধারণ কার্যাবলীই মুজিযা, যার প্রতিযোগিতা করতে সমসাময়িক যুগের মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। (ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড)
শায়খ আবু হাফস উমার আন-নাসাফী লিখেছেনঃ মুজিযা হলো প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী কাজ, যা একজন নবুওয়াতের দাবীদার কর্তৃক প্রকাশ পায়। নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের চ্যালেঞ্জে তিনি তা সম্পাদন করেন এবং কাজটির প্রকৃতি এমন যে, অস্বীকারকারীদের পক্ষে সেরূপ কাজ সম্পাদন করা অসম্ভব। (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা)
বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ “আল-মুজামুল ওয়াসীত” এ মুজিযার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছেঃ মুজিযা এমন অসাধারণ কাজ, যা আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবী-রসূলগণের দ্বারা সংঘটিত করে থাকেন। উদ্দেশ্য নবীর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করা।

উপরে উল্লিখিত মুজিযার সংজ্ঞা তিনটির মর্ম প্রায় একই। তার সারসংক্ষেপ এই যে, মুজিযা বলা হয় –
(১) যা অসাধারণ, অস্বাভাবিক ও অলৌকিক,
(২) যা নবী-রাসুলগণের দ্বারা প্রকাশ পায়,
(৩) তবে তার সংঘটক স্বয়ং আল্লাহ তাআলা,
(৪) তা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ,
(৫) তার মধ্যে নবী-রাসুলগণের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি মুকাবিলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়, তবে তারা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম হয় না।

মুজিযার উল্লিখিত সংজ্ঞার আলোকে আল-ঈযী আল-মাওয়াকিফ গ্রন্থে লিখেছেন, যিনি আল্লাহ’র নবী তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করাই মুজিযার উদ্দেশ্য। তবে যে কোন অসাধারণ ঘটনাই মুজিযা নয়, বরং তা মুজিযারূপে স্বীকৃত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্যঃ
(১) তা আল্লাহ’র কাজ হতে হবে,
(২) প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে,
(৩) অনুরূপ কাজ সম্পাদন অন্যের পক্ষে অসম্ভব হতে হবে,
(৪) মুজিযা এমন ব্যক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হবে, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন যা তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ প্রকাশ পায়,
(৫) তার মাধ্যমে প্রকাশিত মুজিযাটি তার ঘোষণার সমর্থন জ্ঞাপক হতে হবে,
(৬) মুজিযা তার দাবীর পরিপন্থী হবে না,
(৭) মুজিযা দাবীর পরে সংঘটিত হতে হবে, পূর্বে নয়।

আল-ঈযীর মতে, মুজিযা এভাবে সংঘটিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান তার মাধ্যমে তা ঘটিয়ে থাকেন। ফলে মুজিযা দর্শকদের মধ্যে নবী-রাসুলের সত্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় সৃষ্টি করে। (আল-মাওয়াকিফ, মুজিযা অধ্যায়)

ইবন ইউসুফ সালিহী বলেন, মুজিযাকে মুজিযা বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে চারটি শর্তের আওতায় তাকে বিশ্লেষণ করতে হবে –
(১) যা স্বাভাবিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে সংঘটিত হবে, যেমন – চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া, অঙ্গুলীসমূহ থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়া, লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, প্রস্তরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হওয়া ইত্যাদি।
(২) যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত। আবার অনেকে বলেছেন, যা চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত নয়। কারণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ যে সকল ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশই চ্যালেঞ্জবিহীন। তাই যারা চ্যালেঞ্জের শর্ত আরোপ করেছেন, তাদের অভিমত সঠিক নয়। সমস্যাটির সমাধান এভাবে করা যেতে পারে যে, যখনই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের দাবী করেছেন, তখনই স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই তা সংঘটিত হয়েছে। যখনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করছেন- “আমি সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহ’র একজন রাসুল”, তখনই বুঝতে হবে স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করেই এই দাবীটি করা হচ্ছে। মুখ্যত চ্যালেঞ্জ এখানে পরোক্ষভাবেই জড়িত। (শায়খ কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম, মাসীরাত)
(৩) যা নবুওয়াত ও রিসালাত প্রাপ্তির পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। তাতে চ্যালেঞ্জ বা মুকাবিলার কোন উৎস থাকে না। এটি মুজিযা বলে অভিহিত নয় বরং কারামাত বলা যেতে পারে। যেমন – মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শৈশব অবস্থায় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বক্ষ বিদারণ, কৈশোরাবস্থায় তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেঘের ছায়াদান। শিশুকালে ঈসা আলাইহিস সালামের দোলনা থেকে কথা বলা। এটা নবী-রাসুলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের ভিত্তি।
(৪) যা দাবীদারের দাবীর স্বপক্ষে সংঘটিত হবে তা-ই মুজিযা, বিপক্ষে হলে মুজিযা নয়। যেমন – নবুওয়াতের দাবীদার দাবী করবেন যে, আমার নবুওয়াতের নিদর্শন হলো, আমার দাবীর স্বপক্ষে আমার হাত বা এই প্রাণী যার কথা বলবে। তার হাত বা প্রাণীটি যদি তার বিপক্ষে বলে এই লোকটি মিথ্যুক, সে নবী না। তা হলে তার হাত ও প্রাণীটি কথা বলা সত্ত্বেও তার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছে বলে তা মুজিযা নয়। যেমন – মুসায়লামা কাযযাব একটি কূপে পানি বৃদ্ধির জন্য থুথু নিক্ষেপ করেছিলো, ফলে কূপটি ধ্বসে গিয়ে তার পানি উধাও হয়ে গিয়েছিলো।

এই চারটি শর্ত বহির্ভূত বিষয়গুলো মুজিযা নয়। তবে দাজ্জাল তার দুই হাতে স্বাভাবিক নীতি বিরুদ্ধ নিদর্শনসহ আগমন করবে, তাকে মুজিযা বলা যাবে না। কারণ সে নবুওয়াতের দাবীদার হবে না, বরং সে দাবীদার হবে প্রভুত্বের। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৯খ.)

আল্লামা ইবন হাযার আসকালানীর মতেও নবী-রাসুলগণের দ্বারা সংঘটিত যে কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ডই মুজিযা নয়, বরং তিনি এ ক্ষেত্রে দুটো পরিভাষা স্থির করেছেন – মুজিযা, আর আলামাতুন নুবুওয়াত(নবুওয়াতের নিদর্শন বা চিহ্ন)। যে সকল অসাধারণ কাজের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণ বিরুদ্ধবাদীদেরকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন, কেবল তা-ই মুজিযা। যেমন তিনি বললেন, “যদি আমি এই কাজ করতে পারি, তবে আমি নবী, অন্যথা আমি মিথ্যাবাদী।” পক্ষান্তরে নবুওয়াতের আলামত ও নিদর্শনের মধ্যে কোন চ্যালেঞ্জ থাকে না, মুকাবিলার আহবান থাকে না।(ফাতহুল বারী, ৬ খণ্ড)

পবিত্র কুরআনে মুজিযা শব্দটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পারিভাষিক অর্থে নয়। মুজিযা অর্থ প্রকাশের জন্য পবিত্র কুরআনে “আয়াত” (اية) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, বহুবচনে “আয়াত” (ايات) এবং “আই” (اي)। এর অর্থ কোন বস্তু চিনার উপায় বা নিদর্শন। এই চিহ্ন বা নিদর্শন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথা, আল্লাহ’র অস্তিত্ব ও তার একত্ব প্রমাণের জন্য সমগ্র সৃষ্টি একটি প্রমাণ বা নিদর্শন। এই অর্থে “আয়াত” এর ব্যবহার এরুপঃ
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْ
“আর আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটো নিদর্শন ….” (সূরাহ বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ১২) আরো দেখুনঃ ৩০: ২২-২৫, ৪৬ ; ১০ : ৬ ; ২ : ৭৩, ১৮৭ ; ৩ : ১৯০

অনুরূপ, নবীগণের নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে শব্দটি অসাধারণ কাজ ও অলৌকিক বিষয় বুঝানোর অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে।
وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ
“যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল পেশ করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নিবে না ……..” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১৪৫)
আরো দেখুনঃ ২: ২১১, ২৪৮, ২৫৯; ৩ : ৪৯, ৫০ ; ৫ : ১১৪ ; ৬ : ২৫, ১২৪ ; ৭ : ৭৩, ১০৬, ১৩২, ১৪৬

অবশ্য আয়াত শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে উক্ত দুটো অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শব্দটি এটি ছাড়া অন্যান্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, উপদেশ ও শিক্ষণীয় অর্থে, যথা, আল-কুরআনে আছেঃ
إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ
“…. তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে ….. ” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ২৪৮)
আরো দেখুনঃ ৩: ১৩; ১০ : ৯২; ১১ : ১০৩

এবং কুরআনের আয়াত অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন – আল কুরআনে আছেঃ
وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا
“…. তোমরা আমার আয়াতের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করিও না …..” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২: ৪১)
আরো দেখুনঃ ২: ৯৯, ১০৬, ২২১, ২৫২ ; ৬: ৪, ১২৪ ; ১৬: ১০১ ; ৩৬: ৪৬ ; ৪৫: ৩১ ; ৬২: ২; ৮৩: ১৩

“আয়াতুন” শব্দটি “মুজিযা” শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। সুতরাং বলা যায়, পবিত্র কুরআনে “মুজিযা” শব্দ ব্যবহৃত না হয়ে বরং “আয়াতুন” শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় নবী-রাসুলগণের মুজিযা ও তাদের আলামতে নবুওয়াত উভয়বিধ বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত। “মুজিযা”‘র অর্থ বুঝাতে পবিত্র কুরআনে আরো একটি শব্দের ব্যবহার পরিদৃষ্ট হয়, তা হলো “বুরহান” (برهان) শব্দ। এর অর্থ অকাট্য এবং সুস্পষ্ট দলীল ও প্রমাণ। আল-মুজামুল ওয়াসীতে এর অর্থ বলা আছে, “সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী প্রমাণ।” যথাঃ পবিত্র কুরআনে মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন –
“যখন মুসা আগুনের কাছে পৌঁছালো, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষের দিক থেকে তাকে আহবান করে বলা হলো – হে মুসা, আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। আরো বলা হলো- তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো। এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো, তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরে তাকালো না। তাকে বলা হলো – হে মুসা, সামনে আসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ; আর তোমার হাত বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চেপে ধরো। এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরাউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য, তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮: ৩০-৩২)

সারকথা এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনকারীগণের হাতে কখনো কখনো মানবিক শক্তির অতীত কর্মকাণ্ড সাধিত হয়, যা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবনে মানবিক প্রজ্ঞা ও মনীষা অপারগ হয়ে যায়। যেমন – ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের উপর আগুন শীতল হয়ে যাওয়া, মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত জীবিত হওয়া, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক রাতে পবিত্র কাবাঘর থেকে আল-বায়তুল মুকাদ্দাস, এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা, এরপর আল্লাহ’র অদৃশ্য জগত পরিদর্শন করা ইত্যাদি। এ সমস্ত ঘটনার মর্মোদঘাটন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি একান্তই অপারগ। আল-কুরআনের ভাষায় এই সমস্ত ঘটনার নাম বুরহান (برهان), বায়্যিনাত (بينات)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আয়াত (ايات) অথবা আয়াতুম বায়্যিনাত (ايات بينات) রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এ সমস্ত হাদিসকে “দালাইলুন নুবুওয়াত” বলে অভিহিত করে থাকেন। আর আকাইদ বিশেষজ্ঞ (মুতাকাল্লিমুন) ও দার্শনিকদের পরিভাষায় একে মুজিযাত বলা হয়।

মুজিযার তাৎপর্য
নবুওয়াতের দাবীদার নিজ গোত্রের সন্তানদেরকে যে আমন্ত্রণ জানান আর এই জগতের বুকে যে পয়গাম ছড়িয়ে দেন, তার সত্যতার সমুজ্জ্বল প্রমাণ বা নিদর্শন যদিও স্বয়ং পয়গাম বা পয়গামবাহকের অস্তিত্ব, তথাপি সংশয়ী চিত্তের স্বস্তির প্রয়োজনে প্রমাণে পূর্ণতা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সত্যের আহবায়কের দ্বারা এমন কিছু কার্যাবলী প্রকাশ পায়, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বা ধ্যান-ধারণার ঊর্ধ্বে।

ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে আগুন শীতল হয়, মুসা আলাইহিস সালামের হাতের লাঠি পরিণত হলো অজগর সাপে, পিতাবিহীন সন্তানের অস্তিত্ব হলেন ঈসা আলাইহিস সালাম, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা এরপর সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পরিভ্রমণ করে আসেন স্বল্প সময়ে। মানববুদ্ধি যেহেতু এগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে অক্ষম, তাই এতে এক অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়া ধরা পড়ে। যে ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এটি প্রকাশ পায়, অদৃশ্যের জ্ঞানসহ অন্যান্য নিদর্শনাদি যার সহায়ক হয়, তাকে অদৃশ্য সাহায্যপ্রাপ্ত বলে ধরা হয়। কুরআন মাজিদ এ সকল ঘটনা নাম দিয়েছে “বায়্যিনাত”, “বারাহীন” এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে “আয়াত”। মুহাদ্দিসগণ সেগুলোকে “দালাইলুন নুবুওয়াত” আখ্যা দিয়েছেন। দার্শনিকগণের পরিভাষায় সেগুলোর নাম হলো “মুজিযা” বা অস্বাভাবিক কার্যাবলী। (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, সিরাতুন-নবী, ৩খ.)

মুজিযার স্বরূপ
আল্লাহ তাআলা কোন নিয়ম, উপকরণ, কার্যকরণ নীতি ছাড়াই যে কোন বস্তুকে অস্তিত্বে আনতে সক্ষম। মুজিযা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও তেমনই কোন নিয়মনীতির প্রয়োজন নেই। যখনই তিনি ইচ্ছে করেন, তখনই তিনি মুজিযা প্রদর্শন করেন। তবে এটি মানবিক শক্তির ঊর্ধ্বে। এটি শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোন শিক্ষাগার, পাঠাগার, পরীক্ষাগার বা পাঠ্যসুচি তৈরি করাও সম্ভব না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে লক্ষবার মাটিতে আঘাত করলেও আর ঝর্ণা প্রবাহিত হবে না, লক্ষবার মাটিতে নিক্ষেপ করলেও তা সাপে পরিণত হবে না, শুধু আল্লাহ’র ইচ্ছে হলেই তা সম্ভব হবে। আবার যে নবীর মাধ্যমে মুজিযা প্রদর্শিত হবে, তিনি নিজেও অনবহিত যে, কখন ও কিভাবে মুজিযা প্রদর্শিত হবে। কারণ মুজিযা প্রদর্শনের জন্য কোন সুনির্ধারিত নিয়মকানুন বা সময় নেই। দেখা গেছে, ফিরআউন ও তার নিজ জাতির সামনে মুসা আলাইহিস সালাম তার হাতের লাঠিটি মাটিতে ফেলে দিলেন। সাথে সাথে লাঠিটি বিরাট একটি অজগর সাপে পরিণত হলো আর ফোঁস ফাঁস, লম্ফঝম্ফ করতে লাগলো। মুসা আলাইহিস সালাম নিজেও ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন – “তিনি বললেন – তুমি একে ধরো, ভয় করো না, আমি একে এর পূর্বরূপে ফিরিয়ে দিবো।” (সূরাহ তা-হা, ২০ : ২১)
মুসা আলাইহিস সালাম যদি পূর্ব থেকেই জানতেন যে, লাঠি ছেড়ে দিলে সাপে পরিণত হবে, তাহলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হতেন না।

মুজিযার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এই জগতে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার খেলা চলছে। দেখা যায় যে, কেউ যদি কোন কিছু আবিস্কার-উদ্ভাবন করে, তখন অপর একজন তার প্রতিযোগিতায় তার চেয়ে উন্নততর আবিস্কারে মেটে উঠেছে। কিন্তু মুজিযার ক্ষেত্রে তেমনটি চিন্তা-ভাবনারও ঊর্ধ্বে। মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত সংগ্রাম করেও কেউ মুজিযার অনুরূপ কিছু প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না। উড়োজাহাজ আকাশে উড়ে চলে মেশিনের সাহায্যে, আরো উন্নততর মেশিনের সাহায্যে রকেট চলে। পক্ষান্তরে সুলায়মান আলাইহিস সালামের তখত- সিংহাসন আকাশে উড্ডীয়মান হয় মেশিন ছাড়াই, আল্লাহ’র ইচ্ছার দ্বারা। অনুরূপ মেশিন ছাড়া উড়া কি আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে? মানবিক শক্তি ও জগতের যাবতীয় শক্তি মুজিযার ক্ষেত্রে অচল, অকার্যকর। বস্তুত মুজিযা উপাত্ত-উপকরণ বহির্ভূত আল্লাহ’র গোপন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

মুজিযা কখন ও কিভাবে সংগঠিত হয়?
মুজিযা দুইভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে –
(১) তলবী (طلبي): মানুষের মুজিযা প্রদর্শনের দাবীর প্রেক্ষিতে। এর প্রকাশ এভাবে হয় যে, বিরুদ্ধবাদীরা নবী-রাসুলকে মিথ্যাবাদী মনে করে। তাই তার নিকট অতি প্রাকৃত কিছু ঘটানোর দাবী জানায়। তারা মনে করে যে, পয়গাম্বর তা কখনো প্রদর্শন করতে সক্ষম হবেন না। ফলে তাকে মানুষের সামনে লজ্জিত ও অপমানিত হতে হবে। তখন আল্লাহ তা উপযোগী মনে করলে তা পয়গাম্বরের হাতে অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রকাশ ঘটান। আর তখন তার ফলে দাঁড়ায় বিপরীতমুখী। পয়গাম্বরের লজ্জিত ও অপমানিত হওয়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সত্যতা ও যথার্থতা।
যেমন – ফেরাউন যাদুকরদের সমবেত করে মুসা আলাইহিস সালাম’কে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করতে এবং তাকে জনসম্মুখে লজ্জিত ও অপমানিত করতে চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ’র কুদরতে মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়ার মুজিযা সংগঠিত হলো। ফলে ঘটনাটি পরিণামে মুসা আলাইহিস সালামের লজ্জা ও অপমানের পরিবর্তে তার সফলতা ও তার মিশন বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা জনসম্মুখে সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। পরিণামে উপস্থিত যাদুকরগণ তার নবুওয়াতে বিশ্বাসী হয়ে ঈমানদার হয়ে গেলো। (দেখুনঃ সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১০৩-১২৬)

আরিফ রুমী তার মসনবীতে চমৎকার বলেছেনঃ অবিশ্বাসীরা মুজিযা তলবের মাধ্যমে সত্যকে নিস্প্রভ করে দিতে চায়, অথচ তাদের এই অপচেষ্টার ভিতর দিয়েই সত্যের বিজয় ও যথার্থতা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। তাদের ইচ্ছে ছিল মুজিযা তলব করে পয়গাম্বরকে লজ্জিত ও অপমানিত করা। কিন্তু তাদের এই পায়তারাই পয়গাম্বরের মর্যাদাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। (মসনবীর বরাতে সিরাতুন্নবী, ৪র্থ খণ্ড)

(২) গায়রে তলবী (غير طلبي): অর্থাৎ মানুষের পক্ষ থেকে মুজিযার দাবী করা ছাড়াই আল্লাহ নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যার (নবী-রাসুল) সত্যতা প্রমাণ করতে চান, তারই দ্বারা কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন, যাতে সেটি তার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রমাণ হিসেবে দর্শকদের মধ্যে প্রভাব ও প্রত্যয় সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যেমন – খাবারের মধ্যে বরকতের মুজিযা। এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে প্রদত্ত ঐতিহাসিক মুজিযা। খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ চরম আর্থিক সংকট এবং অনাহারের মধ্যে জীবন যাপন করছিলেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে কটিদেশ সোজা করতে পারছিলেন না, তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেটে পাথর বেঁধে খন্দক খননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সাহাবীদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই অবস্থা দেখে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন – ঘরে খাবার আছে কি? স্ত্রী বললেন – এক সা অর্থাৎ প্রায় সোয়া তিন কিলো গম আছে। এরপর জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু তার ঘরে পালিত একটি ছাগল জবাই করে স্ত্রীকে রুটি ও গোশত পাকানোর নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে অতি সন্তর্পণে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো দুই তিনজন সাহাবীসহ তার ঘরে রুটি ও গোশতের দাওয়াত গ্রহণের জন্য সবিনয় অনুরোধ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াত কবুল করলেন আর উচ্চস্বরে ডেকে বললেন – হে পরিখা খননকারী, জাবির তোমাদেরকে দাওয়াত করছে, তোমরা সকলে তার ঘরে চলে আসো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই আহবান শুনে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমাদ গুনতে লাগলেন। মাত্র এক সা গমের রুটি আর একটি ছাগলের গোশত দিয়ে সহস্রাধিক মেহমানকে কিভাবে পরিতুষ্ট করবেন, তিনি তা-ই ভাবছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু’র রন্ধনশালায় প্রবেশ করে উনুনের উপর চড়ানো গোশতের হাড়িতে এবং খমীর করা আটায় পবিত্র মুখের লালা মিশ্রণ করে বললেন – সমস্ত মেহমানের আহার গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুলার উপর থেকে হাঁড়ি নামিও না। আর এই খামীর থেকে অল্প অল্প করে আটা নিয়ে রুটি তৈরি করতে থাকো। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হলো। ফলে সহস্রাধিক মেহমানকে আহার করানোর পরও দেখা গেলো, যে পরিমাণ আটা খামীর করা হয়েছিলো, এখনো সেই পরিমাণই অবশিষ্ট রয়েছে এবং হাঁড়ি পূর্ববৎ গোশতে পরিপূর্ণই আছে। (বুখারী, ২য় খণ্ড)

মুজিযার প্রকারভেদ
নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর স্বপক্ষে যে প্রমাণ তথা মুজিযা প্রদান করেছেন, তা প্রথমত দুই প্রকারের – জাহেরী বা বস্তুভিত্তিক এবং বাতেনী বা আত্মিক। জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা, যেমন মৃতকে জীবিত করা, লাঠিকে সাপে পরিণত করা, আঙ্গুল থেকে পানির প্রবাহ জারী হওয়া, রুগ্নকে সুস্থ করা, চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করা, সমুদ্র বক্ষে চলার পথ তৈরি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আর বাতেনী ও আত্মিক(রূহানী) মুজিযা হচ্ছে – নবুওয়াতের দাবীদারের সত্যতা, নবীগণের নিস্পাপ ও পবিত্র হওয়া, তাদের প্রভাব শক্তি, সফলতা ও গায়বী সাহায্য ইত্যাদি। এর মধ্যে পবিত্র কুরআন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বাতেনী মুজিযা। বস্তুত নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে এই সমস্ত আত্মিক ও রূহানী নিদর্শন। আর জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাসমূহ শুধুই আবরণ এবং বাইরের প্রতি দৃষ্টি দানকারীদের জন্য। এ কারণে দেখা যায়, যারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গূঢ় মর্মজ্ঞানী, তার কখনো জাহেরি মুজিযা তলব করেন নাই। অনুরূপ নবী-রাসুলগণের যুগে যারা শিক্ষিত সমাজ হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও নবী-রাসুলগণের কাছে কোন জাহেরী মুজিযা দাবী করেন নাই।

উদাহারনস্বরূপ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের আহলে কিতাবগণ। তারা সন্দেহপ্রবণ মনে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বারবার উপস্থিত হয়েছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যতার প্রমাণ নিয়েছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষার বিষয়বস্তু কি ছিলো? তা ছিলো এই যে, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চরিত্র ও আখলাক পরীক্ষা করেছিলো। তারা অতীতের বনী ইস্রাইলী নবী-রাসুলের অবস্থাসমূহ ও ঘটনাবলী জিজ্ঞাসা করেছিলো এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা ও উলুমের ভাণ্ডার পর্যালোচনা করেছিলো। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী মুজিযা তলব করেনি। কারণ তারা জানতো যে, নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার আসল ও মৌলিক প্রমাণ হচ্ছে দাবীদারের আধ্যাত্মিক ও অভ্যন্তরীণ দিক এবং তার আখলাক ও চারিত্রিক অবস্থা। ঠিক একই কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তৎকালীন খৃষ্ট ধর্মবলম্বী রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত দিহইয়া কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত হলেন আর সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পত্র পেশ করলেন, তখন হিরাক্লিয়াস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্য কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ানকে রাজ দরবারে ডাকিয়ে এনে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। তার এই প্রশ্নগুলোর সমস্তটাই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও প্রভাব সম্পর্কে। সবশেষে হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন – তুমি (আবু সুফিয়ান) যা বলেছো তা যদি সত্য হয়, তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই আল্লাহ’র প্রেরিত নবী ও রাসুল। (বুখারী, ১০ম খণ্ড)

অনুরূপ নাজরানের খৃষ্টান বিদ্বানগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে কুরআনের আয়াতসমূহ শুনলো আর মুসলমানদের আত্মিক বিকাশের অবস্থা লক্ষ্য করলো। এরপর তারা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্বন্ধে ইসলামের সিদ্ধান্ত কি তা জানতে চাইলো। সবশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-কুরআনের হুকুম মুতাবিক তাদের সাথে মুবাহালা করতে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলেন। কিন্তু তারা এতে সম্মত হলো না। তারা পরস্পর বলতে লাগলো – প্রকৃতই যদি মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হোন, তাহলে আমরা সবংশে ধ্বংস হয়ে যাবো। পরিশেষে তারা বাৎসরিক খারাজ আরায় করার শর্তে সন্ধি স্থাপন করলো। লক্ষ্য করুন, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক শিক্ষা ও তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখলাক-চরিত্র ও আচার-অনুষ্ঠান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, কিন্তু দাবী প্রমাণের জন্য বাহ্যিক বস্তুভিত্তিক কোন মুজিযা তলব করে নাই। (যাদুল মাআদ, ৩য় খণ্ড)

স্বয়ং আরবের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের কথা পর্যালোচনা করে দেখুন। তাদের হাজারো ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা স্বীকার করেছেন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছেন। অথচ তারা কেবল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাতেনী ও আত্মিক মুজিযা অনুধাবন করেছেন, তাদের একজনও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযা দাবী করেন নাই। যথা – খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা, আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু, বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ সাহাবা-ই কিরাম। আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির কথা জানতে পারলেন, তখন নিজের ভাইকে বললেন – ঐ ব্যক্তির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে যাও, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাবী করেছেন যে, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসমান থেকে ওহী এসেছে, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থা পর্যবেক্ষণ করো। তার ভাই মক্কায় আসলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বললেন – আমি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সচ্চরিত্রের নির্দেশ দেন এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কালাম পেশ করেন যা কবিতা নয়। (মুসলিম, ২য় খণ্ড)

জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু আবিসিনিয়ায় নাজাশীর দরবারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পরিচয় সম্বন্ধে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন – হে সম্রাট, আমরা ছিলাম অজ্ঞ ও জাহিল সমাজ। আমরা মূর্তিপূজা করতাম, মৃত জীব ভক্ষণ করতাম, দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিলাম, প্রতিবেশীদের উপর অবিচার করতাম, পরস্পর হানাহানি ও মারামারি করতাম, দুর্বল লোককে সবল লোক নিশ্চিহ্ন করে দিতো। এমন অমানিশা ও দুর্যোগের সময় আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভূত হলেন, যার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভদ্র ও শিষ্ট আচরণ, সততা, ন্যায়ানুবর্তিতা সম্পর্কে আমরা পূর্বেই জ্ঞাত ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে এই শিক্ষা দিলেন যে, আমরা যেন মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করি, সত্য কথা বলি, রক্তপাত থেকে বিরত থাকি, ইয়াতিমের অধিকার হরণ না করি, প্রতিবেশীদের কষ্ট না দেই, সতী রমণীদের প্রতি যিনার মিথ্যা অপবাদ আরোপ না করি, নামায আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, সিয়াম পালন করি। আমরা এ সমস্ত কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, শিরক বর্জন করেছি, সকল প্রকার অপকর্ম পরিত্যাগ করেছি। (ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড; মুসনাদ আহমাদ ইবন হাম্বল, ১ম খণ্ড)

আলোচনার সারাংশ এই যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের আসল ও মৌলিক দলীল হচ্ছে, নবী-রাসুলগণের বাতেনী ও আধ্যাত্মিক মুজিযা ও নিদর্শনাবলী। তবে তাদের জাহেরী ও বস্তুভিত্তিক মুজিযাও ছিলো। তাই পবিত্র কুরআনে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহ অতীত নবী-রাসুলগণের জীবনেতিহাস বর্ণনার প্রেক্ষাপটে তাদের জাহেরী মুজিযার বিস্তৃত বর্ণনা পেশ করেছেন। তথা – মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, তার হাত শুভ্র আলোকোজ্জ্বল হওয়া, সালিহ আলাইহিস সালামের সময়ে পাথরের মধ্য থেকে উস্ট্রী বের হয়ে আসা, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে মৃত ব্যক্তির জীবিত হয়ে যাওয়া, অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থ হওয়া ইত্যাদি। নবীগণের জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার আরো একটি পর্যালোচনা এই যে, জাহেরী বস্তুভিত্তিক মুজিযা শুধু ঐ সমস্ত লোক তলব করে যাদের অন্তরচক্ষু অন্ধ আর যারা বিরুদ্ধতাবাদীতা, পক্ষপাতিত্ব ও কূপমণ্ডূকতাসুলভ মনোভাবের কারণে সত্যকে মেনে নিতে রাজি হয় না। বস্তুত গোঁড়া কাফিররাই জাহেরী মুজিযা তলব করে থাকে। এ কারণে দেখা যায়, পবিত্র কুরআনে মুজিযা তলব সংক্রান্ত দাবীগুলোকে সর্বদা কাফিরদের প্রতিই আরোপ করা হয়েছে, যেমন –
“এবং যারা কিছু জানে না তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন, কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে নিয়ে আসে না কেন? এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের অনুরূপ কথা বলতো; তাদের অন্তর একই রকম; আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১১৮)
“তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন? বলো, নিদর্শন নাযিল করতে আল্লাহ অবশ্যই সক্ষম, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৩৭)
“যারা কুফরি করেছে তারা বলে, তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল করা হয় না কেন? তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথপ্রদর্শক।” (সূরাহ আর-রদ, ১৩: ৭)
“তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে?” (সূরাহ তো-হা, ২০: ১৩৩)

উল্লিখিত আয়াতসমূহে লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক আয়াতেই মুজিযা তলব করার বিষয়টি কাফিরদের প্রতি আরোপ করা হয়েছে। পুণ্যবানগণ কখনো মুজিযা তলব করেননি। এটা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত মুজিযা বনী ইস্রাইলের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়নি, বরং ফিরাউন ও তার অনুসারীদের দাবীর প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছিলো। তাই যখন হাওয়ারীগণ ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে খাদ্যভর্তি আসমানী খাঞ্চার জন্য বললো – “…… হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দিবেন? ……” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২) তখন ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন -“…. যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে আল্লাহ’কে ভয় করো।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২) এতে বুঝা যায়, ঈমানদার বান্দার পক্ষে এ ধরনের ফরমাইশ করে আল্লাহ’কে পরীক্ষা করা কিংবা তার কাছে অলৌকিক বিষয় দাবী করা একান্তই অনুচিত। এমনিভাবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযাসমূহ আবু বকর, উমর ও উসমান (রাঃ) তলব করেননি, বরং আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা প্রমুখ কাফিররাই তলব করেছিলো। অন্যান্য নবী-রাসুলগণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কাফিররা জাহেরি মুজিযা তলব করতো তাদের শত্রুতা, হিংসা, দ্বেষ এবং অন্তরের হঠকারিতা ও গোঁয়ার্তুমির বশবর্তী হয়ে – সত্যানুসন্ধানী হয়ে নয়। এ কারণে তারা একের পর এক জাহেরী মুজিযা তলব করেই যাচ্ছিলো। পক্ষান্তরে যখনই তাদের দাবী অনুসারে কোন মুজিযা বাস্তবায়িত হতো তখন তারাই তাকে যাদু বলে আখ্যায়িত করে বসতো। বস্তুত এরূপ গোঁয়ার্তুমি ও কূপমণ্ডূকতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো জাহেরী মুজিযা দেখে উপকৃত হতে পারে না বরং তারা নিজেদের অন্তরের কপটতার দরুন জাহেরী মুজিযাকে যাদু ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে এবং নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। মুসা আলাইহিস সালাম ফিরাউন ও তার অনুসারীদেরকে অনেক মুজিযা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিটি মুজিযার ক্ষেত্রেই মুসা আলাইহিস সালাম’কে ফিরাউনের মুখে একই জবাব শুনতে হয়েছিলো – “তুমি মহাযাদুকর”, অথবা – “এটা তো প্রকাশ্য যাদু”, অথবা – “এই মুসা ও তার ভাই উভয়ে জাদুকর।”
দেখুনঃ ৫ : ১১০; ৬ : ৭ ; ১০ : ৭৬ ; ১১ : ৭ ; ২৭ : ১৩ ; ৩৪ : ৪৩ ; ৩৭ : ১৫ ; ২০ : ৬৩ ; ৭ : ১১২।

আরো আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে মিসরের সমস্ত যাদুকর সিজদায় পড়ে গিয়েছিলো আর তাদের প্রত্যেকে ঈমান এনে চির সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়েছিলো। কিন্তু ফিরআউনের মুখে ছিল পূর্বের সেই একই কথা, অভিন্ন বুলি –
” …… সে তো তোমাদের (যাদুকর) প্রধান, সে তোমাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছে …..” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৭১)

শেষনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ঠিক একই অবস্থা ঘটেছিলো। কাফির কুরাইশ সম্প্রদায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুজিযা তলব করেছিলো আর মুজিযার বিকাশ দেখার পরই তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদুকর বা কাহিনীকার বলে আখ্যায়িত করেছিলো।
দেখুনঃ ৭৪: ২৪ ; ৫২ : ২৯, ৩০ ; ৫৪ : ১-২ ; ৬৯ : ৪০, ৪৮

উপরে উল্লিখিত আলোচনার দ্বারা একটি সংশয়ের অবসানও হয়ে গেলো যে, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে লক্ষ্য করা যায় যে, মক্কায় কাফিররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট বরাবর মুজিযা তলব করেছে, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সেই দাবী অনুসারে মুজিযা দেখাননি কেন?

বস্তুত তাদেরকে অনেক জাহেরী মুজিযা দেখানো হয়েছিলো, কিন্তু জাহেরী মুজিযা দিয়ে কাফিরদের মন কখনো শান্ত হয় না এবং এতে তারা কখনো হিদায়াত লাভ করতে পারে না। কারণ এই সমস্ত মুজিযা তলবের পিছনে তাদের অন্তরের কপটতা, হিংসা, দ্বেষ ও গোঁয়ার্তুমি কার্যকর থাকে। এই অবস্থায় তাদের প্রার্থিত মুজিযা সংঘটনে তাদের বিশেষ কোন ফায়দা হতো না, বরং এটা তাদের অন্তরের শঠতাকে আরো বৃদ্ধি করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন –
“আর যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটি তাদের কলুষের সাথে আরো কলুষ যুক্ত করে …..” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ : ১২৫)
আরো দেখুনঃ ২: ১০ ; ৭১ : ২৪, ২৮ ; ১৭ : ৮২ ; ৫ : ৬৪, ৬৮।

তাই পবিত্র কুরআনে জাহেরী মুজিযা তলবের কারণে কাফিরদেরকে ভৎসনা করা হয়েছে আর বাতেনী মুজিযার প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে।
ইরশাদ হচ্ছেঃ “তারা বলে, সে তার প্রতিপালকের কাছ থেকে আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনে না কেন? তাদের কাছে কি আসেনি সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে?” (সূরা তো-হা, ২০ : ১৩৩)
“তারা বলে, তার প্রতিপালকের কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শন প্রেরিত হয় না কেন? বলুন, নিদর্শন আল্লাহ’র এখতিয়ারে, আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। এটি কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার কাছে কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।” (সূরা আল-আনকাবুত, ২৯ : ৫০-৫১)

এ কারণেই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কাফিরদের জাহেরী মুজিযা তলবের প্রতিউত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে কেবল এতোটুকু বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – আমি তো কেবল একজন মানুষ ও পয়গাম্বর।
ইরশাদ হয়েছেঃ “এবং তারা বলে, আমরা কখনো আপনার প্রতি ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আপনি আমাদের জন্য ভূমি থেকে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করবেন; অথবা আপনার খেজুরের বা আঙ্গুরের এক বাগান হবে, যার ফাঁকে-ফাঁকে আপনি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করবেন নদী-নালা; অথবা আপনি যেমন বলে থাকেন, সে অনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখন্ড করে আমাদের উপর ফেলবেন, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাগণকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবেন; অথবা আপনার একটি স্বর্ণ নির্মিত ঘর হবে অথবা আপনি আকাশে আরোহণ করবেন, কিন্তু আপনার আকাশ আরোহণে আমরা কখনো ঈমান আনবো না, যতক্ষণ আপনি আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল না করবেন, যা আমরা পাঠ করবো, বলুন – পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক, আমি তো হচ্ছি কেবল একজন মানুষ, একজন রাসুল।” (সূরা বানি ঈসরাঈল, ১৭ : ৯০-৯৩)


সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)