[মু‘জিযার পরিচয় প্রসঙ্গে এই ইলমী প্রবন্ধের জন্য আমরা জনাব মাওলানা আহমদ মায়মূন দামাত বারাকাতুহুমের শোকর আদায় করছি। সম্মানিত পাঠক যদি এটি বুঝে অধ্যয়ন করেন তাহলে এ বিষয়টিও তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে থাকবে- আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁকে আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যাঁর শরীয়তকে সর্বশেষ শরীয়ত এবং যাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবকে সর্বশেষ আসমানী কিতাব ঘোষণা করেছেন, কিয়ামত পযর্ন্তের জন্য তিনিই একমাত্র অনুসরণীয় অনুকরণীয় নবী, তাঁকে খাতামুন নাবিয়্যীন উপাধী দিয়ে আল্লাহ তাআলা এই ঘোষণা করেছেন যে, নবুওত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা তাঁর পর্যন্তই শেষ, তাঁর পরে নতুন কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না, তাঁর পূর্ববর্তী এক নবী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহর হুকুমে পৃথিবীতে আগমন করবেন। কিন্তু তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তের অনুসারী হিসেবেই আগমন করবেন। তো যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর কেউ নবুওত লাভ করবে না তাই মু‘জিযার পরিচয় জানার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এখন কোনো ব্যক্তি যদি নবুওতের দাবি করে তাহলে আমরা যেন এই পরিচয়ের আলোকে তা যাচাই করতে পারি। নাউযুবিল্লাহ। এমনটা কিছুতেই নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে যে নবুওতের দাবি করবে তা মিথ্যা ও অসার দাবি হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সে তো নবী নয় বরং মুতানাব্বি অর্থাৎ নবুওতের মিথ্যা দাবিদার। তাই যাচাইয়ের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। রেওয়ায়েতে এসেছে- ইমাম আবু হানিফা রাহ.-এর সময় এক লোক নবুওতের দাবি করে বসল এবং বলল, আমাকে অবকাশ দাও, আমি তোমাদেরকে মু‘জিযা দেখাব। তখন ইমাম আবু হানিফা রাহ. ফতোয়া দিলেন যে, যে কেউ তার থেকে মু‘জিযা তলব করবে সে কাফের হয়ে যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
আমি সর্বশেষ নবী আমার পরে কেউ নবুওত লাভ করবে না। -মানাকিবে আবী হানীফা, মুওয়াফফাক মক্কী (৫৬৮ হি.) খ- ১, পৃষ্ঠা ১৬১
মু‘জিযার পরিচয় জানার ফায়েদা এই যে, খাতামুন্নাবিয়্যীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের যে সকল মু‘জিযা কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যেন আমরা সেগুলোর ইলম হাসিল করতে পারি। যাতে আমাদের ঈমান আরো দৃঢ় হয় এবং বাস্তব জীবনে আমরা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের আরো বেশি গুরুত্ব দেই।
উল্লেখ্য, নবুওতের মিথ্যা দাবিদারদের মাঝে সবচে’ ভয়ানক মিথ্যুক হল মির্যা গোলাম আহমদ কাদীয়ানী। সে তার মিথ্যা দাবির পক্ষে মিথ্যা মু‘জিযা দাবি করারও প্রয়াস চালিয়েছিলো। অথচ তার লাঞ্ছনার উদাহরণের কোনো শেষ ছিল না। আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী মিথ্যা নবুওতের দাবিদার মুসাইলামাতুল কাযযাবের চেয়েও তাকে বেশি অপদস্থ করেছেন। আল্লাহ তাআলা সকল মিথ্যা দাবিদার ও দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে এই উম্মাহকে নিরাপদ রাখুন। আমীন। অনিবার্য কারণে প্রবন্ধটি কিছুটা সংক্ষেপ করতে হয়েছে। এ জন্য প্রবন্ধকারের খেদমতে আমরা মা‘যেরাত পেশ করছি। -আবদুল মালেক]
আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টির সেরা জাতি রূপে সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকে এমন বহুবিধ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিজীবকে প্রদান করা হয়নি। তাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন, যাতে তারা সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারে এবং সৃষ্টিকর্তার মর্জি মোতাবেক সুচারুরূপে জীবন পরিচালনা করতে পারে। তাদের দিকনির্দেশনার জন্য যুগে যুগে হেদায়েতের বার্তাসহ অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলগণের নবুওত ও রেসালাতের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানুষের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার জন্য আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নানা রকমের নিদর্শন প্রদান করেছেন। এ সব নিদর্শনকে পবিত্র কুরআনে আয়াত, বায়্যিনা, বুরহান, সুলতান ইত্যাদি শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।
* নিদর্শন বোঝাতে কুরআনে কারীমে ‘আয়াত’ শব্দের ব্যবহার এভাবে এসেছে-
وَ اَقْسَمُوْا بِاللهِ جَهْدَ اَیْمَانِهِمْ لَىِٕنْ جَآءَتْهُمْ اٰیَةٌ لَّیُؤْمِنُنَّ بِهَا قُلْ اِنَّمَا الْاٰیٰتُ عِنْدَ اللهِ وَ مَا یُشْعِرُكُمْ اَنَّهَاۤ اِذَا جَآءَتْ لَا یُؤْمِنُوْنَ.
আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের নিকট যদি কোনো নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান আনত। আপনি বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আর তাদের নিকট নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না, তা কীভাবে তোমাদের বোধগম্য করা যাবে। -সূরা আনআম (৬) : ১০৯
* নিদর্শন অর্থে ‘বায়্যিনা’ শব্দের ব্যবহার এভাবে হয়েছে-
قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ هٰذِهٖ نَاقَةُ اللهِ لَكُمْ اٰیَةً.
তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে। আল্লাহর এ উটনী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন।’ -সূরা আ‘রাফ (৭) : ৭৩
* নিদর্শন বোঝাতে ‘বুরহান’ শব্দের ব্যবহার কুরআনে কারীমে এসেছে এভাবে-
فَذٰنِكَ بُرْهَانٰنِ مِنْ رَّبِّكَ اِلٰی فِرْعَوْنَ وَ مَلَاۡىِٕهٖ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَوْمًا فٰسِقِیْنَ.
এ দু’টি (লাঠি সাপে পরিণত হওয়া এবং হাত বগলের নিচ থেকে শুভ্র হয়ে বের হওয়া) তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ (তথা নিদর্শন) ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য। নিশ্চয় তারা ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। -সূরা কাসাস (২৮) : ৩২
* নিদর্শন বোঝাতে কুরআনে কারীমে ‘সুলতান’ শব্দের ব্যবহার-
تُرِیْدُوْنَ اَنْ تَصُدُّوْنَا عَمَّا كَانَ یَعْبُدُ اٰبَآؤُنَا فَاْتُوْنَا بِسُلْطٰنٍ مُّبِیْنٍ.
আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদত করতো, তোমরা তাদের ইবাদত হতে আমাদেরকে বিরত রাখতে চাও, অতএব তোমরা আমাদের নিকট কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ (তথা নিদর্শন) উপস্থিত কর। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ১০
আয়াত, বায়্যিনা, বুরহান, সুলতান ইত্যাদি শব্দ নিদর্শনের অর্থ ছাড়া অন্য অর্থেও কুরআনে কারীমে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য সম্ভবত পরবর্তী উলামায়ে কেরাম নিদর্শন বা মু‘জিযা বোঝাতে ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং হাদীসবিশারদগণ এগুলোকে আলামাতুন নুবুওয়াহ বা দালাইলুন নুবুওয়াহ নামে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে ইলমুল আকাইদ শাস্ত্রীয়রূপ লাভ করার পর নবী-রাসূলগণের এসব নিদর্শনকে মু‘জিযা নামে অভিহিত করা শুরু হয়। কেননা, মু‘জিযা মানে এমন নিদর্শন, যা অন্য কোনো মানুষকে এরূপ বিষয় পেশ করতে অক্ষম সাব্যস্ত করে।
পূর্ববর্তী যুগের নবী-রাসূলগণের শরীয়ত যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা নয়, সম্ভবত এ কারণেই তাদের মু‘জিযাগুলো তাদের সময়কালের সাথে সম্পৃক্ত করে অস্থায়ী মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছে। যেমন হযরত মূসা আ.-এর লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, সালেহ আ.-এর উষ্ট্রী, হযরত ঈসা আ.-এর মু‘জিযা- মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগীকে হস্তস্পর্শে সুস্থ করে দেওয়া ইত্যাদি।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া মু‘জিযাগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জিযা হল কুরআনে কারীম। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিরন্তন মু‘জিযা। কেননা, তাঁর উপর অবতীর্ণ কুরআন এবং তাঁকে দেওয়া শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তাই তাঁকে এ চিরন্তন মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছে। এর অনুরূপ কোনো গ্রন্থ বা এর কোনো অংশবিশেষের অনুরূপ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনো রচনা পেশ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব হবে না।
কখনও মানুষ ভোজভাজি বা জাদুর সাহায্যে অনেক বিস্ময়কর কর্মকা- প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় তাই মু‘জিযাকে জাদু ও ভোজভাজি থেকে আলাদা করে চেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে দুষ্কর হতে পারে। এজন্য মু‘জিযা, জাদু, ভোজভাজি এবং অন্যান্য অলৌকিক বিষয়াদির সংজ্ঞা জেনে নেওয়া এবং সে আলোকে একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করতে পারার জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। নিম্নে এগুলোর সংজ্ঞা ও পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
মু‘জিযা কাকে বলে?
মুহাক্কিক আলেমগণ বিভিন্ন আঙ্গিকে মু‘জিযার সংজ্ঞা পেশ করেছেন। ভাষ্য ভিন্ন হলেও সংজ্ঞাগুলোর মূল বক্তব্য এক ও অভিন্ন। নিম্নে তিনটি সংজ্ঞা উদ্ধৃত করা হলো :
সংজ্ঞা-১. আল্লামা মীর সায়্যিদ শরীফ জুরজানী রাহ. (৭৪০ হি.-৮১৬ হি.) মু‘জিযার সংজ্ঞায় বলেন,
المعجزة أمر خارق للعادة داعية إلى الخير والسعادة مقرونة بدعوى النبوة، قصد به إظهار صدق من ادعى أنه رسول من الله.
মু‘জিযা এমন বিষয়, যা অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রমরূপে প্রকাশ পায় এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করে, যা নবুওতের দাবির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার দ্বারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যিনি দাবি করেন যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। -আততা‘রীফাত, পৃ. ২২৫
উপরিউক্ত সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, মু‘জিযার মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা শর্ত, তাহলে তা মু‘জিযা বলে গণ্য হবে। শর্তগুলো এই-
ক. অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়া।
খ. কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করা।
গ. নবুওতের দাবির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া।
ঘ. যিনি নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবি করেন, তার দাবির সত্যতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য থাকা।
মু‘জিযার শর্তগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি.) তার তাফসীর গ্রন্থ ‘আলজামে লিআহকামিল কুরআনে’র ভূমিকায়। (খ. ১, পৃ. ৭১-৭২) তালিবে ইলমগণ মুতালাআ করে নিতে পারেন।
সংজ্ঞা-২. আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (৮৪৯ হি.-৯১১ হি.) এভাবে মু‘জিযার সংজ্ঞা পেশ করেছেন-
أمر خارق للعادة، مقرون بالتحدي سالم عن المعارضة.
মু‘জিযা এমন বিষয়, যা অলৌকিক বা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বানযুক্ত এবং মোকাবিলার আশঙ্কামুক্ত। -আল ইতকান, খ. ৪, পৃ. ৩০৩
সংজ্ঞা-৩. আল মু‘জামুল ওয়াসীত অভিধানে মু‘জিযার সংজ্ঞা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
هي أمر خارق للعادة يظهره الله تعالى على يد النبي،تأييدا لنبوته،وما يعجز البشر أن يأتوا بمثله.
মু‘জিযা হল অলৌকিকভাবে প্রকাশিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়, যা আল্লাহ তাআলা কোনো নবীর মাধ্যমে প্রকাশ করেন, তাঁর নবুওতের প্রতি সমর্থন-দান বা তার নবুওতকে শক্তিশালী করার জন্য এবং যা মানুষকে তার অনুরূপ ব্যতিক্রমী বিষয় উপস্থাপন করতে অক্ষম করে দেয়।’ -আল মু‘জামুল ওয়াসীত عجز শব্দমূল
মু‘জিযা নামকরণের কারণঃ
ইমাম কুরতুবী (মৃত্যু ৬৭১ হি.) বলেন,
سميت (أي المعجزة) معجزة لأن البشر يعجزون عن الإتيان بمثلها.
মু‘জিযা-কে মু‘জিযা বলা হয়, কেননা, মানুষ এর অনুরূপ কিছু পেশ করতে অক্ষম হয়ে থাকে।’ -তাফসীরে কুরতুবী, মুকাদ্দিমা, পৃ. ৬৯
মু‘জিযার প্রকারভেদ
মু‘জিযা দু’প্রকার।
এক. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযা (معجزة حسية)
দুই. যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা (معجزة عقلية)।
বাহ্যিক ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা যে মু‘জিযা উপলব্ধি করা যায়, তাকে معجزة حسية বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযা বলে। যেমন, মূসা আ.-এর লাঠি সাপে রূপান্তরিত হওয়া, তাঁর শ্বেত-শুভ্র হাত ইত্যাদি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মু‘জিযাগুলো সাধারণত সাময়িক এবং অস্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে যে মু‘জিযা বাহ্যিক ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না; বরং যুক্তি ও জ্ঞান দ্বারা অনুধাবন করা যায়, তাকে معجزة عقلية বা যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা বলা হয়। যেমন মহাগ্রন্থ কুরআনে কারীম। যুক্তিগ্রাহ্য মু‘জিযা সাধারণত চিরন্তন ও স্থায়ী হয়।
আল্লামা সুয়ূতী (জন্ম ৮৪৯ হি.-মৃত্যু ৯১১ হি.) বলেন, ‘বনী ইসরাঈলের নবীগণের অধিকাংশ মু‘জিযা ছিল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। কেননা সে যুগের মানুষের মেধা ছিল দুর্বল এবং তাদের সূক্ষ্ম বিষয় উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান ছিল কম। আর এ উম্মতের সামনে প্রকাশিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ মু‘জিযা হল যুক্তিগ্রাহ্য। এর কারণ প্রথমত এই যে, এ উম্মতের মেধা ও বোধশক্তি পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের তুলনায় প্রবল ও ঋদ্ধ। দ্বিতীয়ত এই ইসলামী শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। তাই এ উম্মতের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য ও স্থায়ী মু‘জিযা প্রদান করা হয়েছে, যাতে জ্ঞানবান লোকেরা তা দেখতে পায়। -আলইতকান, খ. ৪, পৃ. ৩০৩
বনী ইসরাঈলের নবীগণ ছাড়াও তাঁদের আগের ও পরের অন্যান্য নবীগণের মু‘জিযাসমূহও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যই ছিল। হযরত মূসা আ.-এর লাঠি ও শুভ্র হাতের মু‘জিযা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ مَا تِلْكَ بِیَمِیْنِكَ یٰمُوْسٰی، قَالَ هِیَ عَصَایَ، اَتَوَكَّؤُا عَلَیْهَا وَ اَهُشُّ بِهَا عَلٰی غَنَمِیْ، وَ لِیَ فِیْهَا مَاٰرِبُ اُخْرٰی، قَالَ اَلْقِهَا یٰمُوْسٰی، فَاَلْقٰىهَا فَاِذَا هِیَ حَیَّةٌ تَسْعٰی، قَالَ خُذْهَا وَ لَا تَخَفْ، سَنُعِیْدُهَا سِیْرَتَهَا الْاُوْلٰی، وَ اضْمُمْ یَدَكَ اِلٰی جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَیْضَآءَ مِنْ غَیْرِ سُوْٓءٍ اٰیَةً اُخْرٰی، لِنُرِیَكَ مِنْ اٰیٰتِنَا الْكُبْرٰی.
হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কী? সে বলল, এটা আমার লাঠি। আমি এতে ভর দেই এবং এর দ্বারা আমি আমার মেষপালের জন্য বৃক্ষপত্র ঝরাই এবং এ লাঠি দ্বারা আমার আরও বিবিধ প্রয়োজন পূরণ হয়। আল্লাহ বললেন, হে মূসা! তুমি এটি নিক্ষেপ কর। অতপর সে লাঠিটি নিক্ষেপ করল, হঠাৎ দেখা গেল, তা একটি সাপ, দৌড়াচ্ছে। আল্লাহ বললেন, তুমি এটাকে ধর এবং ভয় পেয়ো না, আমি এটাকে অনতিবিলম্বে তার পূর্বরূপে ফিরিয়ে দিব। আর তোমার হাত তোমার বগলের সাথে সংযুক্ত কর, তা বের হয়ে আসবে ব্যাধিহীন উজ্জ্বলরূপে অপর এক নিদর্শনস্বরূপ। এটা এজন্য যে, আমি তোমাকে আমার মহানিদর্শনগুলোর কিছু দেখাব। -সূরা ত্ব-হা (২০) : ১৭-২৩
এমনিভাবে হযরত সালেহ আ.-এর উষ্ট্রী যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মু‘জিযা স্বরূপ ছামূদ গোত্রের জন্য প্রকাশ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اِلٰی ثَمُوْدَ اَخَاهُمْ صٰلِحًا، قَالَ یٰقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَیْرُهٗ، قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ، هٰذِهٖ نَاقَةُ اللهِ لَكُمْ اٰیَةً فَذَرُوْهَا تَاْكُلْ فِیْۤ اَرْضِ اللهِ وَ لَا تَمَسُّوْهَا بِسُوْٓءٍ فَیَاْخُذَكُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ.
‘আর ছামূদ জাতির নিকট তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে। আল্লাহর এ উষ্ট্রী তোমাদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ। একে তোমরা আল্লাহর জমিনে চরে খেতে দাও এবং একে কোনোরূপ মন্দের ছোঁয়া দিয়ো না, তাহলে যন্ত্রণাময় শাস্তি তোমাদেরকে পাকড়াও করবে।’ -সূরা আ‘রাফ (৭) : ৭৩
এরূপ মু‘জিযাগুলো সময়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে কুরআনে কারীম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিরন্তন মু‘জিযা, যা কিয়ামত পর্যন্ত আপন গুণে প্রদীপ্ত থাকবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক।’ -সূরা হিজর (১৫) : ৯
আর এ চিরন্তন মু‘জিযা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنَ الأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا أُعْطِيَ مَا مِثْلهُ آمَنَ عَلَيْهِ البَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِي أُوتِيتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللَّهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَ القِيَامَةِ.
‘নবীগণের মধ্যে প্রত্যেক নবীকে এমন নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে, যার প্রতি মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আর আমাকে যে নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে তা হল ওহী, আল্লাহ তাআলা আমার নিকট তা প্রেরণ করেছেন। আমি আশা করি যে, আমি হব তাদের মধ্যে সর্বাধিক অনুসারীর অধিকারী।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (জন্ম ৮৪৯ হি.- মৃত্যু ৯১১ হি.) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন :
পূর্ববর্তী যুগের নবীদের মু‘জিযাগুলো ছিল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, যেগুলো চর্মচোখে দেখা যেত। যেমন হযরত সালেহ আ.-এর উষ্ট্রী, হযরত মূসা আ.-এর লাঠি ইত্যাদি। পক্ষান্তরে কুরআনের মু‘জিযা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা দেখা যায়, সুতরাং কুরআনের মু‘জিযার কারণে যারা কুরআনের অনুসরণ করবে তাদের সংখ্যা হবে বেশি। কেননা চর্মচোখে পরিদৃষ্ট বিষয় দর্শকের বিলুপ্তির মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা পরিলক্ষিত বিষয় বিদ্যমান থাকে এবং পরবর্তীতে আশা সকল মানুষ কালপরম্পরায় তা প্রত্যক্ষ করে।
মু‘জিযা ও জাদুর মধ্যে পার্থক্যঃ
আল্লামা বদরে আলম মিরাঠী রাহ. (মৃত্যু ১৩৮৫ হি./১৯৬৫ ঈ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা এ জগৎকে সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে ভাল-মন্দের সংমিশ্রণে পয়দা করেছেন। একদিকে নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা পয়দা করেছেন তো অপরদিকে শয়তান সৃষ্টি করেছেন। এমনিভাবে একদিকে আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র জামাত পয়দা করেছেন। তার বিপরীতে দাজ্জালের দল সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং নবুওতের বিপরীতে কিছু সৃষ্টি করবেন না, তা কী করে হয়, তাই রাশিগণনা ও জাদু সৃষ্টি করে নবুওতের বিপরীত অবস্থান পূর্ণ করেছেন। ভাল ও মন্দের এসব পরস্পর বিপরীত শক্তির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না, কিন্তু বিভ্রান্তির এ জগতের অনেকেই (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। (যেমন হযরত মূসা ও ঈসা আ.-কে যেমন তাদের যুগের প্রতিপক্ষ কাফের সম্প্রদায় জাদুকর বলেছে, তেমনি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও মক্কার কাফেররা জাদুকর বলেছে। তাই সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়টিকে সহজে বোধগম্য করে তোলার জন্য মু‘জিযা ও জাদুর মধ্যে কী পার্থক্য তা উল্লেখ করা হচ্ছে।)
মু‘জিযা ও জাদু উভয়টির আপন আপন পরিচয়, প্রকাশকারী সত্তা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিবেচনায় একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন :
১. মু‘জিযার প্রকাশ হয় আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় যার হাতে মু‘জিযা প্রকাশ পায় এতে তার কোনো দখল থাকে না। পক্ষান্তরে জাদুুর প্রকাশ ঘটে শিরক সম্বলিত কালামের রিপুগত অভিনিবেশ এবং নানারকম মন্দ আত্মার সাহায্যে।
২. মু‘জিযা যাদের নিকট থেকে প্রকাশ পায় তারা হলেন, পরিচ্ছন্ন ও নিষ্কলুষ গুণাবলীর অধিকারী, আর জাদুকরেরা হয়ে থাকে দুরাত্মার অধিকারী।
৩. যাদের নিকট থেকে মু‘জিযা প্রকাশ পায় তাদের পরিণতি হল কামিয়াবী ও সফলতা, আর জাদুকরদের পরিণতি হল ব্যর্থতা ও ক্ষতিগ্রস্ততা।
৪. মু‘জিযা প্রকাশ করা মহান আল্লাহ তাআলার কাজ এবং আল্লাহ তাআলার নিদর্শন, আর জাদু হল জাদুকরের নিজের বানানো খেলা।
৫. মু‘জিযা নবী ও রাসূলের ইচ্ছাধীন নয় যে, তারা ইচ্ছা করলেই তা দেখাতে পারবেন, পক্ষান্তরে জাদু জাদুকরের ইচ্ছাধীন। যখনই সে চায় তা দেখাতে পারে। -তরজমানুস সুন্নাহ, খ. ৪, পৃ. ৬২-৬৩; আল্লামা যফর আহমদ উসমানী (মৃত্যু ১৩৯৪ হি.)কৃত আহকামুল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩৯-৪০; জাস্সাস কৃত আহকামুল কুরআন খ. ১, পৃ. ৪৯-এর বরাতে
৭. মু‘জিযা প্রকৃতিগত উপকরণের মধ্যস্থতা ব্যতীত সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাজ, আর জাদু অদৃশ্য প্রকৃতিগত উপকরণের সাহায্যে সংঘটিত হয়। অদৃশ্য উপকরণের কথা জানা থাকলে জাদু আর বিস্ময়কর থাকে না, আর জানা না থাকলে বিস্ময়কর মনে হয়।
৮. জাদুকর যদি নবুওতের দাবি করে তবে তার জাদু কাজ করে না, তাই তার নিকট থেকে বিস্ময়কর কিছু প্রকাশ পাবে না। সুতরাং নবুওতের দাবির সাথে জাদু কখনো চলে না। এটা এজন্য নয় যে, তা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব; বরং এর কারণ এই যে, জাদুকর যদি নবুওতের মিথ্যা দাবি করে তখন যাতে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার না হয়, এজন্য আল্লাহ তাআলা তার হাতে চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু প্রকাশ করেন না। -তাফসীরে কাবীর, খ. ৩, পৃ. ২৩২; আহকামুল কুরআন, যফর আহমদ উসমানী, খ. ১, পৃ. ৪০; মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী, খ. ১, পৃ. ২৬৭-২৬৮
আল্লামা রামাদান ইবনে মুহাম্মাদ আফান্দী রাহ. (মৃত্যু ৯৭৯ হি.) বলেন, মু‘জিযা ও জাদু একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং এতে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। যেমন :
এক. জাদুবিদ্যা অর্জনের জন্য কোনো জাদুকরের শিষ্যত্ব লাভ করতে হয় এবং তার নিকট থেকে জাদুর শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। জাদু প্রদর্শনে শিষ্য কখনও গুরুর চেয়ে অধিক দক্ষ হতে পারে। পক্ষান্তরে মু‘জিযা কারও শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বা কারও নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অর্জন করা যায় না। মু‘জিযার প্রকাশ ঘটানো সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার কর্ম, যা তিনি তাঁর মনোনীত নবী-রাসূলের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন।
দুই. জাদুর প্রকাশ কারও আবদার মোতাবেক হয় না; বরং জাদুকরের বিদ্যা অনুযায়ী হয়। সুতরাং যে কয়টি বিষয়ে তার জাদুবিদ্যা আছে, কেবল সেগুলোই সে প্রকাশ করতে সক্ষম। তার বিদ্যার বাইরে কোনো কিছু সে প্রদর্শন করতে পারে না। পক্ষান্তরে মু‘জিযার প্রকাশ আল্লাহর ইচ্ছায় আবদারকারীদের যে কোনো আবদার মোতাবেক হতে পারে। কেননা মু‘জিযা মানুষের সীমিত বিদ্যা বা শক্তির আওতাধীন নয়; বরং আল্লাহর শক্তির অধীন। তিনি আবদারকারীদের যে কোনো আবদার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। যেমন, পাথর থেকে উটনী বের করা, আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করা ইত্যাদি।
তিন. মু‘জিযার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ফলগুলো প্রকৃত ও বাস্তব। যেমন সামান্য খাবার দ্বারা অনেক মানুষের পেটভরে আহার করা, সামান্য পানি দ্বারা অনেক মানুষের অযু ও পানীয়ের প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া। কিন্তু জাদু তার বিপরীত। জাদুর মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ফলগুলো প্রকৃত ও বাস্তব নয়; বরং জাদু হল দৃষ্টি ও কল্পনার ভ্রম সৃষ্টি মাত্র, যার প্রকাশ নির্দিষ্ট সময় ও স্থান ব্যতীত সম্ভব হয় না। -আল-মাজমূআতুস সানিয়্যা আলা শারহিল আকাইদিন নাসাফিয়্যা, রামাদান আফান্দীর হাশিয়া ৫৪৫
উল্লেখ্য যে, জাদু দুই প্রকারঃ
এক. বিস্ময়কর বা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো কথা বা কর্মকাণ্ডের প্রকাশ, যা তন্ত্র-মন্ত্র, কুফরী-কালাম বা শয়তান ও জিনের সাহায্যে হয়ে থাকে। এরূপ জাদু শিরক বা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
দুই. এমন কিছু বিস্ময়কর কর্মকাণ্ডের প্রকাশ, যা কিছু অদৃশ্য উপায়-উপকরণের সাহায্যে অথবা বুদ্ধিগত কলাকৌশলের সাহায্যে হয়ে থাকে। এটা সমাজে জাদু নামে পরিচিত হলেও মূলত এর নাম ভোজভাজি, ভোজবিদ্যা, ইন্দ্রজালবিদ্যা, ভেল্কিবাজি, ম্যাজিক ইত্যাদি। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে শিরক বা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত না হলেও কাজ বা পেশা হিসেবে প্রশংসনীয় নয়। এটা অনর্থক ক্রিয়াকলাপের অন্তর্ভুক্ত, যা বর্জনীয়। এটাকে যদি প্রতারণার অবলম্বনরূপে গ্রহণ করা হয় তবে তা অবশ্যই কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত হবে।
জাদুর সংজ্ঞা-১ : মুফতী সায়্যিদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান রাহ. (মৃত্যু ১৩৯৫ হি.) তাঁর ‘আত তারীফাতুল ফিকহিয়্যা’ নামক গ্রন্থে বলেন,
السحر بالكسر ما يستعان في تحصيله بالتقرب إلى الشياطين مما لا يستقل به الإنسان، وإطلاقه على ما يفعله من الحيل حقيقة لغوية يعني ما يلعب بالعقول من الأمور العجيبة ولا يستظهر عليها بالشياطين.
‘ السحر শব্দটি س হরফে যের যোগে পঠিত হয়। سحر মানে জাদু। যা অর্জনের জন্য শয়তান তথা জিন্নাতের নৈকট্যের সাহায্য নেওয়া হয় এমন ক্ষেত্রে, যা মানুষ স্বতন্ত্রভাবে করতে পারে না। আর নানা রকমের বুদ্ধিগত কলাকৌশলকে জাদু বলা হয়, যা এ শব্দটির একটি স্বতন্ত্র আভিধানিক অর্থ। অর্থাৎ, বুদ্ধিগত কলাকৌশলের মাধ্যমে যেসব অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে শয়তান তথা জিন্নাতের সাহায্য নেওয়া হয় না। -আত তারীফাতুল ফিকহিয়্যা পৃ. ৩২০
জাদুর সংজ্ঞা-২ আলমুজামুল ওয়াসীত নামক অভিধানগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে :
السحر : كل أمر يخفى سببه ويتخيل على غير حقيقته،ويجري مجرى التمويه والخداع، وكل ما لطف مأخذه ودق.
‘জাদু বলা হয় এমন কোনো বিষয়কে, যার উপায়-উপকরণ বা কার্যকারণ গোপন থাকে এবং যা তার আপন বাস্তব অবস্থার বিপরীত অনুভূত হয় এবং যা মন্দকে শোভনরূপে প্রদর্শন ও প্রতারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আর যার উৎস সূক্ষ্ম ও দুর্বোধ্য হয় তাকেও سحر অর্থাৎ জাদু বলা হয়।
-আলমুজামুল ওয়াসীত, سحر শব্দমূল
মু‘জিযা ও জাদুর উল্লিখিত পার্থক্যসমূহ দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ দুটির একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। সুতরাং এতদুভয়ের মধ্যে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, মু‘জিযা এবং জাদু ছাড়াও আরও কিছু অলৌকিক কর্মকা- রয়েছে, যা মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পেতে পারে। মু‘জিযাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বুঝার জন্য অন্যান্য অলৌকিক বিষয়গুলোর পরিচয় লাভ করা এবং সেগুলোর সাথে মু‘জিযার পার্থক্য নির্ণয় করা আবশ্যক। এখানে অলৌকিক সেই বিষয়গুলোর প্রকারভেদ ও পরিচয় উল্লেখ করছি।
অলৌকিক বিষয়াদি ((خوارق-এর প্রকারভেদ
প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের সাহায্য ব্যতীত মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পাওয়া সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম অলৌকিক বিষয়াদি (خوارق العادت) ছয় প্রকার। যথা : মু‘জিযা, কারামাত, মাউনাত, ইরহাস, ইসতিদরাজ ও ইহানত। (معجزة، كرامة، معونة، إرهاص، استدراج، إهانة) এখানে এ ছয়টি বিষয়ের পৃথক পৃথক সংজ্ঞা উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে একটিকে অপরটি থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে চেনা সহজ হয়। মু‘জিযার কয়েকটি সংজ্ঞা এ লেখার শুরুতে প্রদান করা হয়েছে। এখানে উক্ত ছয়টি বিষয়ের পরিচয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে মু‘জিযার পূর্বোক্ত একটি সংজ্ঞা পুনঃউদ্ধৃত করা হচ্ছে।
১. মু‘জিযার সংজ্ঞাঃ
المعجزة : أمر خارق للعادة، داعية إلى الخير والسعادة، مقرونة بدعوى النبوة، قصد به إظهار صدق من ادعى أنه رسول من الله.
মু‘জিযা এমন বিষয়, যা অলৌকিক এবং সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রমরূপে প্রকাশ পায় এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রতি আহ্বান করে, যা নবুওতের দাবির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার দ্বারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যিনি দাবি করেন যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত।
২. কারামাতের সংজ্ঞাঃ
الكرامة : هي ظهور خارق للعادة غير مقارن لدعوى النبوة من قِبَلِ شخص مؤمن صالح ولي من أولياء الله تعالى.
কোনো মুমিন মুত্তাকী ও আল্লাহর ওলীর নিকট থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো কিছু প্রকাশ পাওয়াকে কারামাত বলে।
৩. মাউনতের সংজ্ঞাঃ
المعونة : أمر خارق للعادة غير مقارن لدعوى النبوة من قِبَلِ عامة المؤمنين تخليصا لهم من المحن والبلايا.
কোনো সাধারণ মুমিন ব্যক্তিকে কঠিন দুরাবস্থা ও বিপদ থেকে রক্ষার প্রয়োজনে আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কোনো বিষয় প্রকাশ পাওয়াকে মাউনত বলে।
৪. ইরহাসের সংজ্ঞাঃ
الإرهاص : أمر خارق للعادة يظهر من نبي من أنبياء الله تعالى قبل دعوى نبوته (وهو من قبيل الكرامات، فإن الأنبياء قبل النبوة لا يقصرون عن درجة الأولياء).
কোনো নবী নবুওতপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে তাঁর থেকে প্রকাশ পাওয়া অলৌকিক বা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়কে ইরহাস বলে। (এটা কারামাতের পর্যায়ভুক্ত। কেননা, কোনো নবী নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বে ওলীর চেয়ে কম মর্যাদার থাকেন না।)
৫. ইসতিদরাজের সংজ্ঞাঃ
الاستدراج : ظهور أمر خارق للعادة من قِبَلِ من لا يكون مؤمنا ولا صالحا، بل من قِبَلِ الكافر أو الفاسق المجاهر على وفق غرضه. سمي به لأنه يوصله بالتدريج إلى النار.
মুমিন বা মুত্তাকী নয়; বরং কাফের অথবা প্রকাশ্য ফাসেক কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে অলৌকিকভাবে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিস্ময়কর কিছু প্রকাশ পাওয়াকে ইসতিদরাজ বলে, যা তার দাবির অনুকূলে হয়।
এরূপ বিষয়কে এজন্য ইসতিদরাজ বলা হয় যে, এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
৬. ইহানতের সংজ্ঞাঃ
الإهانة : ما يظهر من الكافر أو الفاسق خارقا للعادة على خلاف غرضه.
কাফের অথবা ফাসেক ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীতে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিস্ময়কর যা কিছু প্রকাশ পায় তাকে ইহানত (লাঞ্ছনা) বলে।
মানুষের নিকট থেকে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এ ছয়টি বিষয় প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের সাহায্য ব্যতীত প্রকাশ পায়। জাদু এ ছয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কেননা, জাদুর কর্মকা- প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের সাহায্যেই প্রকাশ পায়। কেউ কেউ প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের সাহায্য গ্রহণ করা বা না করার প্রতি লক্ষ্য না করে জাদুকে অন্তর্ভুক্ত করে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী বিষয়াদি (خوارق العادات) সাত প্রকার বলে উল্লেখ করেছেন। শরহুল আকায়েদের ভাষ্যগ্রন্থ আন-নিবরাস প্রণেতা আল্লামা আবদুল আযীয আল ফারহারী (মৃত্যুসন অজ্ঞাত) বলেন,
أقسام الخوارق سبعة، أحدها : المعجزة من الأنبياء، ثانيها : الكرامة للأولياء، ثالثها : المعونة لعوام المؤمنين ممن ليس فاسقا ولا وليا، رابعها : الإرهاص للنبي قبل أن يبعث، كتسليم الأحجار على النبي صلى الله عليه وآله وسلم، وأدرجه بعضهم في الكرامة وبعضهم في المعجزة مجازا، خامسها : الاستدراج للكافر والفاسق المجاهر على وفق غرضه، سمي به لأنه يوصله بالتدريج إلى النار، سادسا : الإهانة للكافر والفاسق على خلاف غرضه كما ظهر عن مسيلمة الكذاب إذ تمضمض في ماء فصار ملحا، ومس عين الأعور فصار أعمى، سابعها : السحر لنفس شريرة تستعمل أعمالا مخصوصة بإعانة الشيطان، ومنهم من لا يعده خارقا لأن العادة جارية بظهوره عن كل من يزاول هذه الأعمال، والكهانة من السحر وهي الإخبار بما سمع من الجن.
খাওয়ারিক অর্থাৎ মানুষের নিকট থেকে প্রকাশ পাওয়া সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিষয়াদি সাত প্রকার: ১. মু‘জিযা, যা নবীগণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ২. কারামত, যা ওলীদের নিকট থেকে প্রকাশ পায়। ৩. মাউনত যা ফাসেক বা ওলী নয় এমন সাধারণ মুমিনের নিকট থেকে প্রকাশ পায়। ৪. ইরহাস যা নবুওতপ্রাপ্তির পূর্বে নবীর নিকট থেকে প্রকাশ পায়। যেমন পাথর কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করা। কেউ কেউ এটাকে কারামাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, আর কেউ মু‘জিযার মধ্যে, মাজায স্বরূপ। ৫. ইসতিদরাজ যা কাফেরের অথবা প্রকাশ্য পাপাচারী ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের অনুকূলে প্রকাশ পায়। এটাকে এজন্য ইসতিদরাজ বলা হয় যে, এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্রমে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। ৬. ইহানত যা কাফের বা পাপাচারী ব্যক্তির নিকট থেকে তার উদ্দেশ্যের বিপরীতে প্রকাশ পায়। যেমন মুসায়লামা কাযযাবের (যে মিথ্যা নবুওতের দাবি করেছিল) নিকট থেকে প্রকাশ পেয়েছিল যখন সে একবার পানিতে কুলি নিক্ষেপ করলো, কিন্তু পানির লবণাক্ততা দূরীভূত হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি লবণাক্ত হয়ে যায়। (এমনিভাবে সে একবার কূপের পানি বৃদ্ধি করার জন্য কূপের পানিতে কুলি নিক্ষেপ করে ফলে কূপের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে আরও শুকিয়ে যায়।) একবার এক ব্যক্তির কানা চোখ সুস্থ করার জন্য হাতের ছোঁয়া দেয়, ফলে তার উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ৭. জাদু যা শয়তানের সাহায্যে কিছু বিশেষ কর্মকা- সম্পাদন বা কিছু উপায়-উপকরণ অবলম্বনের মাধ্যমে মন্দ প্রকৃতির লোকের নিকট থেকে প্রকাশ পায় এটাকে কেউ কেউ খাওয়ারিক অর্থাৎ সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমী বিষয়াদির মধ্যে গণ্য করেননি। কারণ, যে কোনো ব্যক্তি উক্ত বিশেষ কর্মকা- সম্পাদন করে অথবা বিশেষ কিছু উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে তার দ্বারা এরূপ ব্যতিক্রম কিছু প্রকাশ করা সম্ভব। আর কাহানাত (রাশি গণনা বা ভাগ্য গণনা) জাদুর অন্তর্ভুক্ত। কাহানাত হল জিনদের সাহায্যে অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ বলা। -আন নিবরাস, পৃ. ২৭২
এছাড়া রয়েছে ভোজভাজির, মেসমোরিজম, নক্ষত্রবিদ্যা ইত্যাদি। এগুলো দ্বারাও অস্বাভাবিক কর্মকা- প্রকাশ করা, প্রদর্শন করা, অদৃশ্যের সংবাদ প্রদান বা মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের কথা বলা হয়। এসবই শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, বুদ্ধি ও কর্মকৌশল এবং প্রকৃতিগত উপায়-উপকরণের উপর নির্ভরশীল। এগুলোর কোনোটিই খাওয়ারিকের (সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম অলৌকিক বিষয়াদির) অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব কার্যকলাপ যে হারাম তা তো স্পষ্ট বিষয়।
যিলকদ ১৪৩৭ – আগস্ট ২০১৬
মাসিক আলকাউসার