সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ.। একটি নাম। একটি আদর্শ। একটি চেতনা। প্রতিভাবান হৃদয়ের দর্পণ। উম্মাহর জন্য নিবেদিত প্রাণ। ঈমান-জাগানিয়া বিপ্লব।
ইসলামি চেতনার আকাশে যার চিন্তাসূর্য আজও আলো বিলায়। যার সুচিন্তা ও চেতনায় আজও জাতি খুঁজে পায় শাশ্বত চেতনার গম্বুজ। যার কথামালা এখনও হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে প্রেরণার সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে। যার প্রতিভার বাতিঘর আজও জ্বলজ্বল করে প্রতিটা প্রতিভাবান হৃদয়ের চোখে।
জন্ম ও শৈশব
নাম আবুল হাসান আলী। (হিন্দুস্তানের অনেকে আদর করে ‘আলী মিয়াঁ’ বলেও ডাকতেন)। ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রায়বেরেলির পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট বস্তি ‘দায়েরা’তে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুল হাই আল-হাসানী। পিতা ছিলেন হিজরী চৌদ্দশতক তথা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলেমে দ্বীন। তার সময়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্য–এ দুয়ের মাঝে সভ্যতা ও চিন্তানৈতিকতার ভয়ংকর লড়াই চলছিল। তিনি ইসলামি সভ্যতা ও চিন্তার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক সব লড়াই চালিয়ে যান।
দাদার নাম ফখরুদ্দীন আল হাসানী। কয়েক শতাব্দী ধরে তার পূর্বপুরুষরা ভারতে বসবাস করে আসলেও মূলত তাদের বংশ গিয়ে মিলেছে আলী রা.-এর বংশের সাথে। সে হিসেবেই ‘আল-হাসানি’ লকব চলে আসছে। তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভারত আগমন করেন আমির সাইয়েদ কুতুবুদ্দিন আল মাদানি রহ.। হিজরী সপ্তম শতকের শুরুর দিকে যখন মোঘলদের ভেতরকার বিভেদ চলছিলো, তখন এই মহান দাঈ বাগদাদ ও গজনী হয়ে হিন্দুস্তানের মাটিতে পা রাখেন।
শৈশব
তার শৈশবটা এমন ছিল যে, এরদ্বারা সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের আশা করা যেতো না। এ নিয়ে আদুরে আম্মু প্রায়ই পেরেশানি পোহাতেন। তিনি নিজেই এ বৃত্তান্ত দিয়েছেন তার নিজের বিভিন্ন জীবনালেখ্যে।
মাত্র ন’বছরে যখন পা রাখেন শিশু আলী মিয়া নাদাবী, তখন তার পিতা ইন্তেকাল করেন। পুরো দায়িত্ব অর্পিত হয় বড় ভাইয়ের উপর। কিন্তু কোনকিছুই তার বড় হওয়ার পিছনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার পুরো শৈশবই বেড়ে উঠেছে ইলমি পরিবেশে। আদুরে আম্মুও ছিলেন জ্ঞান-তাপসী, বিদগ্ধ লেখিকা। আল্লাহপ্রেমী। বড়ো ভাইও ছিলেন ইসলামি ব্যক্তিত্ব। পিতার মৃত্যুর পর নাদাবী রহ.তার বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া শেখেন।
শিক্ষা ও শিক্ষকতা
রায়বেরেলিতেই কায়দা ও নাজেরা পড়েন। লৌখনো ও রায়বেরেলি–দুস্থান মিলিয়ে উর্দু-ফারসি শেখেন বড় ভাইয়ার তত্ত্বাবধানে।
আরবী ভাষা : তার আরবি ভাষার প্রথম শিক্ষক হলেন শায়খ খলিল ইবনে মুহাম্মাদ।যিনি ছিলেন সমকালের আরবি ভাষার সুখ্যাতিমান শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। যার পাঠদান ছিলো মন কেড়ে নেওয়ার মতো।উচ্চতর আরবি ভাষা শিখেন আরবজাহানের স্বীকৃত ভাষাবিদ শায়খ তকি উদ্দীন হেলালির কাছ থেকে।
তাফসীর : প্রাথমিক তাফসীরের দরস গ্রহণ করেন মাও. আব্দুল হাই ফারুকি রহ.-এর নিকট। এরপর উচ্চতর পাঠের জন্য লাহোর যান। সেখানে মাও. আহমদ আলি লহোরির নিকট ১৯৩০-৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফন্নে তাফসিরের উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
হাদিস : তিনি যখন দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার ছাত্র, তখন আল্লামা হায়দার হাসান টোংকি রহ.-এর কাছ থেকে হাদিসে নববি অধ্যায়ন করেন। এ ছাড়া হযরত মাদানি রহ.-এর কাছেও (১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ) বিশেষভাবে হাদিসের দরস লাভ করে ধন্য হন।
ইলমে দ্বীনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন যেমন প্রাজ্ঞ, তেমন ছিলেন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গতিধারা সম্পর্কে অবহিত। ইলমে নববিতে যেমন গভীরতা ছিল তার, সমসাময়িক সব বিষয়েও ছিল তেমন সচেতনতা। সে কারণেই তিনি ইসলামকে সময়ের ভাষায় অন্যান্য অনেক কিছুর শীর্ষে সমাসীন করে দেখাতে পারতেন।
তার বয়স যখন বিশ, তখন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামাতে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন।
লেখালেখি ও রচনা
আপন মাতৃভাষায় ছিল যেমন তার শুহরত, মুসলিম উম্মাহর প্রাণের ভাষা আরবিতেও ছিল তেমন সুখ্যাতি। যিনি অনারবি হয়েও আরব জাতিকে উপহার দিতে পেরেছিলেন–‘মা-যা খাছিরাল আলাম’-এর মত অমূল্য রত্ন। আরব যুবকরা আজও যা নিয়ে প্রশংসার মালা গাঁথে। শুধু তাই নয়, তিনি এমন আরো বহু কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছিলেন, যেসবের মাঝে আজও উম্মাহ খুঁজে পায় সঠিক পথের দিশা।
‘মা-যা খাছিরাল আলাম’-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় এভাবে দেওয়া যায়–মুসলিম উম্মাহর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনকালের সেতুবন্ধনে যেসব কিতাব রচনা করা হয়েছে, সবগুলোর মধ্যে এটি সবচে’ তথ্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী একটি কিতাব। এই জন্যই হয়তো-বা তৎকালীন মিশরের সর্বজনমান্য ইসলামি চিন্তাবিদ ড.ইউসুফ মূসা রহ. বলতে বাধ্য হয়েছিলেন–‘আমি এই বইটি হাতে পেয়ে একদিনেরও কম সময়ে তা পাঠ করেছি। এবং বইটির প্রতি গভীর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়েছি। এমনকি পড়া শেষ করে আমার নুসখার শেষ পৃষ্ঠায় লিখে রেখেছি–“ইসলামের মর্যাদা ও গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে, এমন প্রত্যেকের অপরিহার্য কর্তব্য হলো, এই বইটি পড়া।”’
কিতাবটি তিনি রচনা করেছেন ১৯৪৪ থেকে ৪৭-এর মধ্যবর্তী সময়ে।
তার প্রতিটি রচনাই ছিল গবেষণা-নির্ভর এবং প্রচুর তথ্য সমৃদ্ধ। এসবের সবক’টিই বিদগ্ধ পাঠক হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে। পাঠকের বিবেক-বিবেচনাকে করে তীক্ষ্ম। প্রজ্জ্বলিত করে তুলে পাঠকের চিন্তা-চেতনাকে।
মানবসভ্যতার উত্থান-পতনের ইতিহাস-বিষয়ে ছিল তার গভীর জানাশোনা। এ জন্য তিনি নতুন প্রজন্ম ও তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে বহু ভেবেছেন। শিক্ষানুরাগী আগামী জেনারেশনের জন্য এঁকে দিয়েছেন কিছু সুচিন্তিত মতামত। দ্বীনের পথে তাদের মনন বিকাশের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
বয়স যখন মাত্র তেরো,তখনই ‘যমীনদার’ নামক প্রত্রিকায় তার প্রথম উর্দৃ লেখা ছাপা হয়। এরপর বয়স যখন ষোল’র কোঠায়, তখন মিশরের অভিজাততম একটি পত্রিকায় তার দীর্ঘ একটি আরবি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটা শুধু প্রকাশ হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং সম্পাদক সাহেবের হৃদয়ে স্থানও করে নিয়েছিলো এ প্রবন্ধটি। যদ্দরুণ সম্পাদক একসময় তা স্বতন্ত্র পুস্তিকাকারেও ছাপেন। তার বয়স গড়িয়ে যখন ত্রিশে তখন প্রসিদ্ধ কিতাব ‘মা-যা খাছিরাল আলাম’ (মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কি ক্ষতি হলো-মাও.আবু তাহের মেসবাহ অনূদিত) রচনা করেন, যা তার বিশ্বময় শুহরতের অন্যতম মাধ্যম। কিতাবটি তার প্রথম দিককার রচনা। তার নিজের ভাষায়–‘…কিতাবটি আমার একেবারে প্রথম দিকের রচনা।’ লেখক এর মাধ্যমে মুসলমানদের গৌরবময় অতীতের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতি আশ্বস্ত করে তুলছিলেন নিরাশ হওয়া মুসলিম উম্মাহকে।
মিশরের প্রখ্যাত দাঈ সৈয়দ কুতুব শহিদ রহ. কিতাবটির ভূমিকায় খুব সুন্দর লিখেছেন–‘মুসলিম উম্মাহর আজ এমন যোগ্য মানুষের কত না প্রয়োজন, যিনি গৌরবময় অতীতের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনবেন এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের উজ্জ্বীবিত করে তুলবেন। …কিতাবটি সে প্রয়োজন পূরণেরই একটি সার্থক প্রচেষ্টা। এবিষয়ে আধুনিক ও প্রাচীন যা কিছু আমি পড়েছি তার মধ্যে নিঃসন্দেহে এটি অন্যতম সেরা গ্রন্থ।’
৩২ বছর বয়সে উর্দু ভাষায় লিখেন দ্বিতীয় কিতাব ‘সিরাতে সৈয়দ আহমদ শহিদ’। চমৎকার একটি কিতাব। এ ছাড়াও তার রচিত-প্রকাশিত গ্রন্থাদির সংখ্যা শয়ের কোঠা পেরিয়েছে। তন্মধ্যে আল-মুসলিমুনা ফিল হিন্দ, আস-সিরাতুন্নাবাবিয়্যাহ (সিরাত বিষয়ক আরবী কিতাব), নবীয়ে রহমত (উর্দু তরজমা),পা-জা সুরাগে যিন্দেগি (বক্তৃতা সংকলন) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আধ্যাত্মিকতা
আধ্যাত্মিক জগতেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। মাও.ইলিয়াস রহ.-এর সাথে তার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এ ছাড়াও তিনি মাদানি রহ.-এর হাতেও বায়াত গ্রহণ করেন এবং আবদুল কাদির রায়পুরি রহ. ও শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ.-এর খেলাফত লাভ করেন।
দাওয়াত ও সফর
তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত দাঈ ইলাল্লাহ। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সচেতনতাপূর্ণ ছিল তার দাওয়াতি মিশন। ইউরোপ-আমেরিকা, মধ্যাপ্রাচ্য পর্যন্ত যার শিকড় বিস্তৃত। দ্বীনের দাওয়াত ছিল তার অন্যতম মিশন। সেই দাওয়াতি মিশনে বিশ্বের অনেক দেশেই সফরের সুযোগ হয়েছে তার। ১৯৪৭ সালে আরব ভূমিতে হজের প্রথম সফর করেন এবং হিজাজ ভূমিতে নিজের দাওয়াত ও তাবলিগের ভিত্তিমূল রাখেন।
১৯৫১সালে মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম ভ্রমণ করেন। যা দিয়ে তিনি ‘মুযাককিরাতু সাইহিন ফিশ-শারক্বিল আওসাতি (মধ্যপ্রাচ্যের ডায়েরি লিখেন)। ১৯৫৬ সালে দামেস্ক ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে তিনি প্রতিষ্ঠানটির অতিথি-অধ্যাপক হন।
পদ ও পদবী
তিনি একাধারে ছিলেন জামিয়া ইসলামিয়া ও রাবেতা আলামে ইসলামির মজলিসে শুরার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। নদওয়াতুল উলামার মহাপরিচালক। সর্বভারতীয় মুসলিম পার্সোনাল’ ল-এর সভাপতি। অক্সফোর্ড ইউনিভির্সিটির ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান। এসব ছাড়াও ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
মৃত্যু
তার মৃৃত্যুটা ছিল সত্যিকার অর্থেই ঈর্ষণীয়। রমজান মাস। রহমত, মাগফিরাতের দিন পেরিয়ে নাজাতের দিন চলছে। ২২রমযান (৩১/১২/১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)।
দিনটা ছিল শুক্রবার। গোসল করে সাদা কাপড় পরে খুশবো মেখে জুমআর অপেক্ষা করছিলেন। সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত শুরু করলেন। ‘ফাবাশশির…এই আয়াতের তিলাওয়াত শেষ করতেই তিনি আমাদেরকে ইয়াতিম করে চলে যান মহান প্রভুর সান্নিধ্যে।
আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন।
উবায়দুল্লাহ তাসনিম
সূত্রঃ fateh24