নামাযের ওয়াক্ত – মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.

আল্লাহ তা‘আলা নামাযকে সময়ের সাথে খাস করে দিয়েছেন। প্রত্যেক নামাযের নির্ধারিত সময় রয়েছে। প্রত্যেক নামাযকে তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করা ফরয। গ্রহণযোগ্য কোনো ওযর ছাড়া এক নামায অন্য নামাযের সময়ে আদায় করলে কবীরা গুনাহ হবে। সবাই যেন নামাযের সঠিক সময় জেনে সময় মতো নামায আদায় করতে পারে সেজন্যই আমাদের এই প্রয়াস।

হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে‘রাজ থেকে এসে নামাযের প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং, নামাজের ওয়াক্ত এসব কিছু সাহাবাদের রা. যুহরের সময় জানালেন। ফজরের সময় যেহেতু সকলকে একত্র করা কঠিন ছিল, তাই এসব কিছু যুহর থেকে শুরু করলেন। এজন্য হাদীসের কিতাবেও নামাযের ওয়াক্তের বর্ণনা যুহর থেকে শুরু করা হয়েছে।

যুহরের ওয়াক্ত: দ্বিপ্রহর থেকে সূর্য যখন একটু পশ্চিম দিকে হেলে যায় তখন যুহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। এবং প্রতিটা জিনিসের আসল ছায়া ব্যতীত তার ছায়া দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত যুহরের ওয়াক্ত থাকে। জুম‘আ আর যুহরের নামাযের ওয়াক্ত এক ও অভিন্ন। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৩)

বি.দ্র.: ঠিক দুপুরে প্রত্যেক জিনিসের ছায়া যে পরিমাণ থাকে তাকে ঐ জিনিসের আসল ছায়া বলা হয়। কোনো ইমামের মতে আসল ছায়া ছাড়া প্রত্যেক জিনিসের ছায়া যখন একগুণ হয়ে যায় তখনই যুহরের সময় হয়ে যায়। আমাদের হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া এমন না। তাই একান্ত অপারগতা ছাড়া এই মতের উপর আমল করা যাবে না।

যুহর ও জুম‘আর নামাযের উত্তম সময়ঃ শীত কালে যত তাড়াতাড়ি যুহরের নামায পড়া যায় তত ভাল। গরমের দিন এক মিছিলের শেষ চতুর্থাংশে পড়া ভাল। তবে জুম‘আর নামায সব মৌসুমে আউয়াল ওয়াক্তে পড়া উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৯)

জুমআর নামাযের উত্তম সময়ঃ যখন যুহরের সময় হবে তখন সাথে সাথে আযান হবে এবং তখনই মসজিদে রওনা করা জরুরী হয়ে যাবে। তিনটি জিনিস এক সাথে হবে: ১. ওয়াক্ত হওয়া ২. আযান হওয়া ৩. মসজিদে রওনা হওয়া। তারপর ১৫/২০ মিনিট  বা সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা বয়ান হবে। বয়ান চলাকালীন যাদের উযূ প্রয়োজন তারা উযূ করে নিবে। বয়ান শেষে জুম‘আর দ্বিতীয় আযান হবে। আযান শেষ হলে খুতবা তারপর ফরয নামায হবে। সাধারণত শীতকালে দিন ছোট হওয়ার কারণে একটু আগে ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সর্বোচ্চ দুপুর সোয়া একটা থেকে দেড়টার মধ্যে পুরো নামায শেষ হয়ে যাবে। যেহেতু জুম‘আর আগে বয়ানের জন্য দীর্ঘ সময় পাওয়া যায় না তাই নামায শেষে পুনরায় দীনী বয়ান বা মাসআলা মাসায়েলের আলোচনা হতে পারে।

জুমআর নামায: জুম‘আর নামায মোট বার রাকা‘আত। কাবলাল জুম‘আ চার রাকা‘আত, ফরয দুই রাকা‘আত, বা‘দাল জুম‘আ চার রাকআত, ওয়াক্তিয়া সুন্নাত দুই রাকা‘আত। কোনো কোনো বড় গ্রামে এখনও আখেরী যুহর বা এহতিয়াতি যুহর পড়ে, এগুলি জায়েয নেই। বাংলাদেশের বড় গ্রামগুলো শহরের হুকুমে। সেখানে আখেরী যুহর পড়লে গুনাহ হবে। হ্যাঁ, এখনো যদি কোনো অজপাড়া থাকে যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায় না, রাস্তা ঘাট নেই, দোকান পাট নেই, কম সংখ্যক লোক ব্যবসা করে তাহলে তারা জুম‘আ ও ঈদ পড়বে না। সেখানে ভুলক্রমে জুম‘আ পড়ে ফেললে চার রাকা‘আত ইহতিয়াতি যুহর পড়ে নিবে।

আসরের নামাজের ওয়াক্ত: যুহরের নামাযের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আসারের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। এর মাঝখানে কোনো বিরতী নেই। সূর্য অস্থ যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আসরের ওয়াক্ত থাকে। তবে সূর্য ডুবার ১৫ মিনিট আগ পর্যন্ত উত্তম সময়। । (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৫)

আসরের মাকরূহ ওয়াক্ত: সূর্য অস্থ যাওয়ার ১৫ মি. আগ থেকে মাকরূহ সময় শুরু হয়ে যায়। এই সময় নামায পড়লে নামায আদায় হয়ে যাবে কিন্তু মাকরূহ হবে। ইচ্ছা করে এই সময়ে নামায পড়লে গুনাহ হবে। আর যদি এমন হয় যে, কেউ ঐ দিনের আসরের নামায আদায় করেনি ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে যাচ্ছে তাহলে তাকে ঐ সময়ই আসর পড়তে হবে। কিন্তু এটা মাকরূহে তাহরীমা হবে। তবে ফরজের যিম্মাদারি আদায় হয়ে যাবে। । (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩৫)

আসরের উত্তম সময়ঃ আসর সবসময় দেরি করে পড়া ভালো। কেননা আসরের পরে কোনো নফল পড়া যায় না। সুতরাং আসরের সময় হওয়ার প্রায় আধাঘণ্টা বা পোনে এক ঘণ্টা পরে আসর পড়বে। যাতে আসরের আগে বেশি করে নফল পড়া যায়। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৯)

মাগরিবের ওয়াক্ত: বেলা সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত এবং ইফতারের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। (ইফতার দেরি করে করা মাকরূহ) মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথে আযান ইকামাত দিয়ে নামায আদায় করা উত্তম। পশ্চিম আকাশ বেশ কিছু সময় লালিমা থাকে, এই লালিমা শেষ হওয়ার পর একটু সাদা ভাব হয়। সাদা ভাব শেষ হওয়ার পর আকাশ কালো হতে শুরু করে। আকাশ কালো হওয়ার আগ পর্যন্ত মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে। অর্থাৎ আকাশের অবস্থা যতক্ষণ লাল ও সাদা মিশ্রিত থাকে ততক্ষণ মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে। মাগরিবের সময় প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। আমাদের দেশের অনেকে মনে করে মাগরিবের সময় ১৫-২০ মি. থাকে। যার কারণে এই সময়ের ভিতর মাগরিব পড়তে না পারলে আর পড়ে না। মনে করে কাযা যখন হয়ে গেল তখন পরে এক সময় পড়ে নিব। অথচ সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে নামায পড়লেও আদায় হয়ে যাবে। কোনো ইমামের মতে লাল শেষ হয়ে সাদা শুরু হওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। আমাদের হানাফী মাযহাবে এ মতের উপর ফাতাওয়া নয়। তাই একান্ত ঠেকা ছাড়া ঐ সময়ে ইশা পড়বে না। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৫-২৬)

মাগরিবের উত্তম সময়ঃ মাগরিব নামায ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে পড়া উত্তম। কিন্তু রমযান মাসে একটু দেরি করে পড়তে বলা হয়েছে। যাতে আগে ইফতার করে নেয়া যায়। কারণ আগে ইফতার করতে পারলে নামায খুশু-খুযুর সাথে হবে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩১

ইশার নামাযের ওয়াক্ত: মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। ইশার ওয়াক্ত ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে। তথা সাহরীর ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে। (আল বাহরুর রায়েক ১/)

ইশার উত্তম সময়ঃ রাতের এক তৃতীয়াংশের শেষের দিকে ইশা পড়া উত্তম। অর্থাৎ ইশার সময় হওয়ার সোয়া এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে ইশা পড়া উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩০)

ইশার মাকরূহ সময়ঃ বিশেষ কোনো ওযর ছাড়া মধ্য রাতের পরে ইশা পড়া মাকরূহ। রুগীর সেবা ওযরের মধ্যে গণ্য হতে পারে কিন্তু ওয়ায মাহফিল ওযরের মধ্যে গণ্য হবে না। তাই ওয়ায মাহফিলেও যথা সময়ে ইশার নামায আদায় করা জরুরী। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩১)

ফজরের ওয়াক্ত: সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত ফজরের ওয়াক্ত থাকে। পূব আকাশের উত্তর-দক্ষিণে যখন সাদা একটা আলো ছড়ায় তখন ফজরের ওয়াক্ত হয়। সূর্যের কিনারা দেখা পর্যন্ত ফজরের ওয়াক্ত থাকে। ফজরের সময়ের মধ্যেও মাগরিবের মতো আকাশ সাদা ও লাল হয়। ফজরে প্রথমে আকাশ সাদা হয় তারপর লাল হয় আর মাগরিবে প্রথমে লাল হয় এরপর সাদা হয়। ফজরের সময়ও প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৩)

ফজরের উত্তম সময়ঃ ফজরের সময় আলো উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে যাওয়ার পরে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ফজর পড়তে বলেছেন। এ সময় ফজর পড়া উত্তম এবং বেশি সাওয়াব লাভের কারণ। কিন্তু রমযান মাসে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ার মধ্যে বেশি সাওয়াব। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৮-২৯)

ইশরাকঃ সূর্য উঠা শুরু হওয়া থেকে নিয়ে ১৫-২০মি. পর এই নামাযের সময় শুরু হয় এবং দ্বিপ্রহর পর্যন্ত এর সময় থাকে। সময় হওয়ার পর পর ইশরাক পড়া ভাল। এই নামায নফল। দুই চার রাকা‘আত যা পারা যায় পড়া। এই নামায যে পড়ে, সারা দিনের সমস্ত প্রয়োজনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। (আততারগীব ওয়াত তারহীব হা.নং ১০০৯)

চাশত: ইশরাক এবং চাশতের নামাযের সময় এক। তবে বেলা এগারটার দিকে চাশতের নামায পড়া ভাল। চাশতের নামায সর্বোচ্চ বার রাকা‘আত। এই নামাযও নফল। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২৪)

যাওয়ালঃ যখন যুহরের ওয়াক্ত শুরু হয় তখন সাথে সাথে যাওয়ালের ওয়াক্ত শুরু হয়। যাওয়ালের নামায ২-৪ রাকা‘আত। এই নামাযকে দিনের বেলার তাহাজ্জুদ বলা হয়। এর নেকীও তাহাজ্জুদ নামাযের মতো এবং হাদীসে এসেছে, এই সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসমানে সব দরজা খুলে দেন। (আততারগীব ওয়াত তারহীব হা.নং ৮৫৭,৮৫৯,৮৬২)

আউয়াবীনঃ মাগরিবের ফরযের পর এই নামায। মাগরিবের দুই রাকা‘আত সুন্নাত ছাড়া ছয় রাকা‘আত পড়তে পারলে উত্তম। তবে মাগরিবের দুই রাকা‘আত সুন্নাতসহ পড়লেও হবে। (গুনইয়াতুল মুতামালি পৃ.৪৩০)

তাহাজ্জুদ: এই নামায রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। উত্তম হলো শেষ রাতে পড়া। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন পূর্ণ সুস্থ ছিলেন তখন আট রাকা‘আত পড়তেন। যখন একটু বয়স বাড়লো তখন ছয় রাকা‘আত পড়তেন। যখন আরো বয়স বাড়লো, শরীর ভারী হয়ে গেল তখন চার রাকা‘আত পড়তেন। এই নামায ৪-৮ রাকা‘আত পড়তে হয়। এই নামায পড়ার জন্য ইশার নামায পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলে ভালো হয়। তবে বিশেষ কারণে কেউ যদি এই নামায উত্তম সময়ে পড়তে না পারে তাহলে সে যদি ইশার সুন্নাতের পর বিতিরের আগে দুই চার রাকা‘আত তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়ে নেয় তাহলে আশা করা যায় এতেও আল্লাহ তা‘আলা তাকে তাহাজ্জুদের নেকী দান করবেন। (গুনইয়াতুল মুতামালি পৃ. ৪৩২)

নামাযের মাকরূহ ওয়াক্ত: তিনটি সময় আছে যখন যেকোনো ধরণের নামায, জানাযার নামায ও সিজদায়ে তিলাওয়াত নিষেধ:

১. সূর্য উঠার সময়।

২. সূর্য যখন মাথার ঠিক উপরে থাকে তখন। (ক্যালেন্ডারে দ্বিপ্রহর বলে এই সময়কে বুঝানো হয়)

৩. সূর্য অস্থ যাওয়ার সময়। তবে ঐদিনের আসর না পড়ে থাকলে এই মাকরূহ ওয়াক্তে পড়া যাবে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩২-৩৩)

তিনটি সময় এমন আছে যখন নফল নামায পড়া মাকরূহ। তবে ঐ সময়ে কেউ উমরী কাযা পড়তে চাইলে পড়তে পারবে।

১. ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর ফজরের সুন্নাত ছাড়া অন্য কোনো সুন্নাত বা নফল পড়া যায় না। এমনিভাবে ফজরের ফরয নামায পড়ার পর থেকে নিয়ে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত কোনো নফল নামায পড়া যায় না।

২. সূর্য্য যখন উঠতে শুরু করে তখন থেকে ১৫ মি. পর্যন্ত নফল নামায পড়া যায় না।

৩. আসরের নামায পড়ার পর থেকে সূর্য অস্থ যাওয়া পর্যন্ত কোনো নফল পড়া যায় না। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩৭)